সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
দিনদিন বেড়েই চলছে সীমান্ত হত্যা। ফলে শিথিল হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। বহুবার দু'দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর কোন হত্যাকান্ড নয়; আর কোন গুলি নয়। এ সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশ সম্মান করলেও ভারত বারবার অপমান করেছে। এ কেমন বন্ধুত্বের নমুনা। অথচ ভারত জোর গলায় বলছে, বাংলাদেশ তার অকৃত্রিম বন্ধু। কিন্তু সীমান্ত হত্যার কারণে যে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। তা উত্তোরণের পথ কোথায়?
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত একযুগে বিএসএফের হাতে ১০০৬ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। আর গত এক বছরে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ২১ জন। ভারতের পুলিশের হাতে নিহত হয়েছেন ১ জন। ভারতীয় নাগরিকদের হাতে নিহত হয়েছেন ১০ জন। সীমান্তের ওপারে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির হাতে নিহত হয়েছেন ৩ জন। সব মিলিয়ে গত এক বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ), ভারতীয় পুলিশ, ভারতীয় নাগরিকের হাতে ৩৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশি একজন সন্ত্রাসীর হাতেও ভারতীয় একজন নাগরিক নিহত হওয়ার কোন নজির নেই। এছাড়া মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে দীর্ঘ হয়েছে লাশের মিছিল। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ৩বছরে সীমান্ত এলাকায় ২০০৯ সালে ৯৮ জন, ২০১০ সালে ৭৪ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া বিএসএফের হাতে অপহৃত হয়েছেন ৯০ বাংলাদেশি। তাই মনে হয় আমাদের বন্ধুত্ব এখন একতরফা হয়ে যাচ্ছে। ভারত আমাদের বুকে টেনে পিঠে ছুড়ি বসিয়ে দিচ্ছে।
গত ২৩ মে দিনাজপুরের ফুলবাড়ি সীমান্তের আমড়া বিওপির সোনাপাড়া, রসুলপুর সীমান্তের ছোট সইচান্দা গ্রামের মো. নাদের আলী বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারালেন। এঘটনা আজ নতুন নয়। প্রতি সপ্তাহেই সীমান্তে নিহত হচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক। কিশোরী ফেলানীকে হত্যা করে কাঁটাতারের বেড়ায় লাশ ঝুলিয়ে রাখা, দিনাজপুরের বিরামপুরের সাইফুল ইসলামকে হত্যা কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুবক হাবিবুর রহমানকে দিগম্বর করে হাত-পা বেধে নির্দয়ভাবে নির্যাতনের পর গোপনাঙ্গে পেট্রল ঢেলে উল্লাসের দৃশ্য ভিডিও চিত্রে দেখে আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। সেদিন ভারত বলেছিল-এমন ঘটনা আর ঘটবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং নির্দেশ দিয়েছিলেন-যাতে এধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার। হাবিবুর রহমানের অত্যাচারের সাথে জড়িত ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিস্কার করা হয়েছে। কিন্তু অত্যাচারতো বন্ধ হয়নি। সে ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ২৬ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে বাংলাদেশি আব্দুল লতিফ লেবুর লাশ ফেরত দিয়েছিল ভারত। আর যখন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সাথে ‘কারপাস’ চালুর ব্যাপারে আলাপ করছেন, তখন যশোরের ধান্যখোলা সীমান্তেরাশেদুজ্জামান নামে এক বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। সাংবাদিকরা এব্যাপারে জানতে চাইলে বিরক্তিমিশ্রিত সুরে প্রণব মুখার্জি বলেন,‘এতে দুই দেশের সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে আমি মনে করি।’
তবে কি এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া? ভারতের সাথে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে আমাদের অকাতরে প্রাণ দিতে হবে? বাংলাদেশের প্রতি ভারেতের তথাকথিত এই অকৃত্রিম বন্ধুত্ব কি দিনদিন বাড়তেই থাকবে? ভারত আমাদের গুলি করে মারবে আর সান্ত্বনা দেবে। এভাবে গরু মেরে জুতা দানের সংস্কৃতি আর কতকাল চলবে? তাহলে কী আমরা ব্যর্থ। সরকার কেন এর প্রতিবাদ করতে পারছে না। অথচ বাংলাদেশ সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন- সীমান্তে যা কিছু ঘটছে, তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। এসব অতীতে ঘটেছে ,এখনো ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে সরকার মনে করে না।
সীমান্ত হত্যাকান্ড নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বিগ্ন। মানবাধিকার সংস্থার চাপে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে ‘দোষ’ স্বীকার করেন। কিন্তু নির্যাতন বন্ধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। ভারতের মানবাধিকার সংগঠন ‘মাসুমের’ সেক্রেটারি জেনারেল কিরিটি রায় বলেছেন,‘বিএসএফ একের পর এক নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। এটা শুধু মানবাধিকারের লঙ্ঘনই নয়; বরং ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। এ কারণে তারা যা ইচ্ছা, তা করে পার পেয়ে যাচ্ছে।’
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিয়ে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এ নিয়ে একাধিক বার বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু নির্যাতনের হার না কমায় প্রতিনিয়ত আমাদের উদ্বেগ আরো বেড়ে যাচ্ছে। ওদিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান ইউ কে বানশাল গত ৭ ফেব্র“য়ারি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন,‘ সীমান্তে গুলি চালানো বন্ধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়।’ বিভিন্ন কারণ দর্শিয়ে তিনি বললেন,‘সীমান্তে গুলি চলবে।’ ঠিক সে মুহূর্তে বাংলাদেশ-ভারত কর্তৃপক্ষ ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি, ফেনী নদীর ওপর সড়ক নির্মাণসহ ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার ও বাংলাদেশ-ভারত সরাসরি রেলপথ নির্মাণে সিদ্ধান্তের কাছকাছি পৌঁছেছেন।
সীমান্তে হত্যার ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে, ভারত থেকে বাংলাদেশে নির্বিঘেœ ফেনসিডিল আনার ক্ষেত্রে কোন বাধা আসলেই তখন হত্যার শিকার হন কিছু নিরীহ বাংলাদেশি। আসলে ফেনসিডিল চোরাচালান নিরাপদ করতেই বিএসএফ বেছে নেয় বর্বর হত্যাকান্ডের পথ। শোনা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বোতল ফেনসিডিল প্রবেশ করতে বিএসএফকে দিতে হয় পাঁচ টাকা। যেটা বিএসএফের জন্য একটি লাভজনক ব্যবসা। কারণ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গড়ে উঠেছে ১ হাজার ২ শ’র মতো ফেনসিডিল কারখানা। যখন বাংলাদেশের র্যাব ও বিডিআর ফেনসিডিল ঠেকাতে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছে তখন প্রতিদিন লাখ লাখ ফেনসিডিল বাংলাদেশে আসা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশে ফেনসিডিল পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে বিএসএফ প্রতিশোধ নিতে মেতে উঠেছে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে। আর এ কর্মকান্ডের মদদ দিচ্ছেন বিএসএফ প্রধান।
এর প্রতিকার কী? সীমান্তে লাশের মিছিল আর কত দীর্ঘ হবে? কবে জেগে উঠবে জাতি ভারতীয আগ্রাসনের বিরুদ্ধে? এ মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড চিরতরে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।