আ. জ. ম কামাল:
কিছু কিছু মানুষ সমাজ সংস্কৃতি, জাতি তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চলমান বিশ্বের সৃজন ধারায় কিছু অবদান রেখে যান যা আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃতির মতই øিগ্ধতায় অনুভবে অনুরণন তোলে। ত্যাগ আর সেবার সারল্যতায় সংস্কারের বেড়াজাল ভেঙ্গে ফুলের মত নির্মল শিশুদের থেকে শুরু করে দিন মান খেটে খাওয়া ফুটিয়ে তোলেন রঙ আর তুলির আলতো পরশে ক্যানভাসের পাতায়,ফুটিয়ে তোলে মানবতার আকুতিকে সংগ্রাম আর সহনশীল ভালবাসায় উদ্দীপ্ত চেতনার মধ্য দিয়ে। তেমনি একজন মানুষ একজন শিল্পী এস এম সুলতান।
আমার সাথে এ মহান শিল্পীর পরিচয় করিয়ে দেন গণসঙ্গীত শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর। একুশে বই মেলায় গিয়েছিলাম আমার দুই বন্ধু তোফাজ্জেল হোসেন হিরু ও ফজলুর রহমান। আলমগীর ভাই বলেন সালাম কর। আমি তাই করলাম। কালো রংয়ের সালোয়ার, পাঞ্জাবী, ওড়না পড়া মেয়েদের মত মাথায় বড় চুল। আমার মধ্যে জানার ভীষণ আগ্রহ। ফকির ভাই বলেন, আমার পীর। পৃথিবীর বড় মাপের চিত্রশিল্পী। একা একা থাকেন। মাঝে মাঝে তার কাছে যেও। ভোলা মনের মানুষ। কিছু পরে মহিউদ্দিন ফারুকী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, খ. ম. হাসান, শামীম শিকদার, কামরুল হাসানসহ আরো গুণীজন এলেন। আমরা সবাই তাদের কথা শুনছিলাম। এক ফাঁকে সালাম দিয়ে শিল্পীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম।
তারপর থেকে রোজ একুশে বই মেলায় যেতাম সুলতান সাহেবের সাথে কথা বলতে, জানতে। মাঝে মাঝে তার বাসায় যেতাম। এস এম সুলতান সবার সাথে আপনি বলে কথা বলতেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক একবার বলেছিলেন,‘লাল মিয়া মানে এশিয়া’। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, ‘এস এম সুলতানকে যে চিনবে সে এশিয়াকে চিনবে।’ চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান জ্বীদ্দশায় তার প্রতিভার স্বীকৃতি যে পাননি তা নয়। ১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ম্যান অব দ্যা ইয়ার অর্থাৎ বছরের শ্রেষ্ঠ মানব ঘোষণা করে। এ ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট এবং এশিয়া উইক পত্রিকা কর্তৃক ম্যান অব এশিয়া সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৮১ সালে তাকে আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্ট ঘোষণার মাধ্যমে সম্মানিত করে।
এস এম সুলতানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামে। বাবা রাজমিস্ত্রী মেছের আলী। বাবা তার নাম রাখেন লাল মিয়া।
৫ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে লাল মিয়া ৫ম শ্রেণিতে পড়েন। সে সময় ড. শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় আসেন স্কুল পরিদর্শনে। লাল মিয়া তার একটি পোট্রেট এঁকে তাকে দেন, সবাই মুগ্ধ। পড়ার ফাঁকে বাবাকে সাহায্য করতেন তিনি। ১৯৩৮ সালে অজানার উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন লাল মিয়া। বাড়ি তাকে ধরে রাখতে পারেনি। সোজা চলে এলেন কোলকাতায়। কোলকাতার ভবানীপুর রুবী স্টুডিওর মালিক ছিলেন তার স্কুলের শিক। কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্যের বাড়ি সেখান থেকে একদিন হাজির হন নড়াইল জমিদারদের কোলকাতার কাশিমপুরের বাড়িতে। জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় লাল মিয়াকে খুব ভালোবাসতেন, øেহ করতেন। তাকে জানালেন তিনি আর বাড়ি ফিরে যাবেন না। তিনি বলেন, জমিদার বাড়ির অরুণ রায়ের মতন শিল্পী হবেন। আর্ট কলেজে ভর্তি হতে মেট্রিক পাশ লাগে। লাল মিয়ার আগ্রহ দেখে অরুণ বাবু ব্যবস্থা করেন। ভর্তি পরীায় লাল মিয়া প্রথম হন। হৈচৈ পড়ে গেল কলেজে। কিন্তু কি হবে। মেট্রিক পাশ ছাড়া ভর্তি হওয়া যাবে না।
জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় এবং অরুণ রায় শহীদ সোহরাওযার্দীর কাছে গিযে ঘটনা বলেন। বিখ্যাত চিত্র সমালোচক শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর্ট কলেজের কার্যকরি কমিটির প্রভাবশালী সদস্য। তার অনুরোধে লাল মিয়াকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে। লাল মিয়ার প্রতিভায় তার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে। তার দামী গাড়িতে করে মাছিমদিয়ার রাজমিস্ত্রীর ছেলে লাল মিয়া প্রতিদিন আর্ট কলেজে যাতায়াত করে।
সময় ১৯৩৮ সাল। জযনুল আবেদিন সে বছর আর্ট কলেজে শিক হিসাবে যোগদান করে। লাল মিয়া ও কামরুল হাসান সহপাঠী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী লাল মিয়ার নাম রাখেন এস এম সুলতান। এ নামেই সে পৃথিবী জোড়া পরিচিতি লাভ করে। সুলতান প্রতিবছর প্রথম হন। কারো কাছে না বলে বেড়িয়ে পড়েন পথে। প্রথমে আগ্রা। পকেটে মাত্র চার আনা। তাজমহলে আসতেই চার আনা শেষ। দারুণ ুধা নিয়ে ছবি আঁকেন। তিনজন আমেরিকান সৈনিককে ছবি এঁকে দিতে হবে। তারা তাকে ১৫০টাকা দেন। সোজা গিয়ে ওঠেন বিসমিল্লাহ হোটেলে। এসময় ড. বি এম জহুরীর সাথে তার পরিচয় হয়। জহুরী তাকে চাকুরী করার অনুরোধ করেন। কাজ ছবি আঁকা। সুলতান রাজী হন এবং তার সাথে চলে যান।
চার মাস পর চলে আসেন দিল্লী। সেখানে এক শিল্পীর বাড়ি এক মাস থাকেন। তাদের সাথে আজমীর শরীফ আসেন। আজমীরে এক মাস থাকার পর তিনি চলে আসেন লাক্ষ্মৌতে। সেখান থেকে হিমালয়ের
প্রতি হিল স্টেশনে পায়ে হেটে ঘুরে বেড়ান, দেখেন দেরাদুন কাগন জালি। লক্ষ্মৌ ছেড়ে আসেন সিমলা। সেখানে অনেক ছবি আঁকেন। সিমলায় বসে এক কানাডিয়ান মহিলার সাথে তার পরিচয় হয়। তার সহযোগিতায় সিমলা সেন্টার পিটার্স স্কুলে তার ছবির প্রদর্শনী হয়। উদ্বোধন করেন কাপুরতলার মহারাজ। প্রদর্শনীতে চার শত টাকার ছবি বিক্রি হয়। সেখান থেকে চলে আসেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। পরিচিত হন সেখানকার নবাব ফরিদ খানের সাথে। ফরিদ খান তার ভালো বন্ধু হয়েছিলেন। পরে চলে আসেন কাশ্মীরে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় করাচি এসে পরিচয় হয় কবি জসীম উদ্দীনের সাথে। এসময় শাকের আলী , শেখ আহমেদসহ আরো নামিদামি শিল্পীদের সাথে পরিচিত হন। এবং আর্ট কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এস এম সুলতান করাচিতে প্রদর্শনী করেন। যা উদ্বোধন করেন ফিরোজ খান নুন। এরপর করাচী ুসিবধ হলে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। টিকেট এক টাকা। প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিল।
১৯৫০ সালে পাকিস্তান চিত্রশিল্পীদের মধ্য থেকে তাকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য মনোনিত করা হয়। তিনি ২০টি ছবি নিয়ে ১ জানুয়ারি আমেরিকা যান। আমেরিকা যাওয়ার আগে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কোথায় কোথায় যাবেন। তিনি জানান, শিশুদের স্কুল দেখতে যাবেন। আমেরিকার ওয়াশিংটন, বোস্টন,শিলানা, মিসিগান শহরে তার একক প্রদর্শনী হয়। আমেরিকা থেকে আসেন লন্ডনে। সেখানে তার একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়। ভিক্টোরিয়া ডুস্বি ডালি,পন, ব্র্যাক,ক্রীব’র মত বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে তার ছবি সমমর্যাদায় প্রদর্শীত হয়।
এস এম সুলতানের আগে এশিয়া মহাদেশের এমন দুর্লভ সম্মান কোন চিত্রশিল্পী পান নি। লন্ডনের লিসার গ্যালারীর প্রদর্শনী শেষে ছবিগুলো গ্যালারীকে দান করে যান। ১৯৫৩ সালে তিনি দেশে ফেরেন। সরকার তাকে আর্ট কলেজের উপাধ্য পদের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। জয়নুল আবেদিন তখন অধ্য। তিনি রাজী হলেন না। বিশ্বজয়ের মুকুট মাথায় নিয়ে তিনি চলে আসেন নড়াইল। ১৯৫৮ সালে সরকারি ভাবে বিশ শতাংশ জমিসহ একটি পুরাতন বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে তিনি ১৯৫৯ সালে ‘দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্বরূপে স্বতন্ত্র এ মানুষটির হৃদয় জুড়ে ছিল প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। চিত্রা নদীর তীরে তিনি গড়ে তুললেন এক তপোবন। বিভিন্ন জাতের বিচিত্র বৃরাজিতে পরিপূর্ণ এ তপোবনে প্রবেশ করলে মন ভরে যাবে। এরপর গড়ে তোলেন চিড়িয়াখানা। এখানে বানর, হনুমান, ঘোড়া, খরগোশ, গিনিপিগ, বনবিড়াল, দেশি-বিদেশি কুকুর, জাতি সাপ ও নানান জাতের নানান রঙের পাখি রয়েছে। এ মহান শিল্পীর মৃত্যুর পর তার চিড়িযাখানার জীব-জন্তু সব ঢাকা চিড়িয়াখানায় নিযে যাওয়া হয়। লাল মিয়া সুন্দর সুরে বাঁশি বাজাতেন। গভীর রাতে জমিদার বাড়ির পুকুর ঘাটে বসে বাঁশি বাজাতেন। এলাকার লোকেরা বলেছে তার বাঁশির সুরের তালে তালে সাপ ফণা তুলতো।
১৯৫৯ সালে রফিকুন নবী ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। তিনি বলেন, অধ্য জয়নুল আবেদিন, কামরুর হাসান, শফি উদ্দিন আহমেদ চারুকলার চত্বরে জলসভায় বসা। তারা সবাই এক মহিলা অতিথির সাথে গল্প করছেন। মহিলা অতিথি আমাদের কাসের দিকে পিঠ করে বসা। মাথায় ঢেউ খেলানো কোকড়ানো চুল। পড়নে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। ঠিক এগারটার দিকে স্যারদের সাথে অতিথি আমাদের কাসে আসে। আমরা সবাই চমকে উঠলাম। অতিথি মহিলা নন; সে একজন জ্বলজ্যান্ত পুরুষ মানুষ। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। হাতে বাঁশের বাঁশি। অধ্য সার পরিচয় করিয়ে দিলেনÑ নাম এস এম সুলতান। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও এস এম সুলতানের বন্ধু ছিলেন। এস এম সুলতানের যক্ষ্মা হয়েছিল ৮০ সালের দিকে। ব্যাংককের সুমিতভেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়; ভালো হয়ে দেশে এলেন।
এস এম সুলতান সর্ববৃহৎ ক্যানভাসে ছবি এঁকেছেন। যার আয়তন ২০ বর্গফুট। নড়াইলের লাল মিয়া চির কুমার ছিলেন। আমি তাকে যত কাছ তেকে দেখেছি। তার কাছে থাকার সৌভাগ্য হয় আমার। আজ মনে হয়, আর বাঁশি বাজবেনা, ইঞ্জিনের নৌকা চলবেনা, কেউ জানতে চাইবে না, ডাক্তার আসবেনা,সাংবাদিক জানবে না, সবাইকে আড়ালে রেখে, জাতিকে ফাঁকি দিয়ে নড়াইলের চিত্রা নদীর পারের মাছিমদিয়া গ্রামের এস এম সুলতান (লাল মিয়া) ১০ অক্টোবর চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ধন্য নড়াইলের মাটি, ধন্য চিত্রা নদী, ধন্য মাছিমদিয়া গ্রাম।
আ.জ.ম কামাল,
প্রশিক, নাটক বিভাগ
জেলা শিল্পকলা একাডেমী, মাদারীপুর।
কিছু কিছু মানুষ সমাজ সংস্কৃতি, জাতি তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চলমান বিশ্বের সৃজন ধারায় কিছু অবদান রেখে যান যা আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃতির মতই øিগ্ধতায় অনুভবে অনুরণন তোলে। ত্যাগ আর সেবার সারল্যতায় সংস্কারের বেড়াজাল ভেঙ্গে ফুলের মত নির্মল শিশুদের থেকে শুরু করে দিন মান খেটে খাওয়া ফুটিয়ে তোলেন রঙ আর তুলির আলতো পরশে ক্যানভাসের পাতায়,ফুটিয়ে তোলে মানবতার আকুতিকে সংগ্রাম আর সহনশীল ভালবাসায় উদ্দীপ্ত চেতনার মধ্য দিয়ে। তেমনি একজন মানুষ একজন শিল্পী এস এম সুলতান।
আমার সাথে এ মহান শিল্পীর পরিচয় করিয়ে দেন গণসঙ্গীত শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর। একুশে বই মেলায় গিয়েছিলাম আমার দুই বন্ধু তোফাজ্জেল হোসেন হিরু ও ফজলুর রহমান। আলমগীর ভাই বলেন সালাম কর। আমি তাই করলাম। কালো রংয়ের সালোয়ার, পাঞ্জাবী, ওড়না পড়া মেয়েদের মত মাথায় বড় চুল। আমার মধ্যে জানার ভীষণ আগ্রহ। ফকির ভাই বলেন, আমার পীর। পৃথিবীর বড় মাপের চিত্রশিল্পী। একা একা থাকেন। মাঝে মাঝে তার কাছে যেও। ভোলা মনের মানুষ। কিছু পরে মহিউদ্দিন ফারুকী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, খ. ম. হাসান, শামীম শিকদার, কামরুল হাসানসহ আরো গুণীজন এলেন। আমরা সবাই তাদের কথা শুনছিলাম। এক ফাঁকে সালাম দিয়ে শিল্পীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম।
তারপর থেকে রোজ একুশে বই মেলায় যেতাম সুলতান সাহেবের সাথে কথা বলতে, জানতে। মাঝে মাঝে তার বাসায় যেতাম। এস এম সুলতান সবার সাথে আপনি বলে কথা বলতেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক একবার বলেছিলেন,‘লাল মিয়া মানে এশিয়া’। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, ‘এস এম সুলতানকে যে চিনবে সে এশিয়াকে চিনবে।’ চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান জ্বীদ্দশায় তার প্রতিভার স্বীকৃতি যে পাননি তা নয়। ১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ম্যান অব দ্যা ইয়ার অর্থাৎ বছরের শ্রেষ্ঠ মানব ঘোষণা করে। এ ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট এবং এশিয়া উইক পত্রিকা কর্তৃক ম্যান অব এশিয়া সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৮১ সালে তাকে আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্ট ঘোষণার মাধ্যমে সম্মানিত করে।
এস এম সুলতানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামে। বাবা রাজমিস্ত্রী মেছের আলী। বাবা তার নাম রাখেন লাল মিয়া।
৫ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে লাল মিয়া ৫ম শ্রেণিতে পড়েন। সে সময় ড. শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় আসেন স্কুল পরিদর্শনে। লাল মিয়া তার একটি পোট্রেট এঁকে তাকে দেন, সবাই মুগ্ধ। পড়ার ফাঁকে বাবাকে সাহায্য করতেন তিনি। ১৯৩৮ সালে অজানার উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন লাল মিয়া। বাড়ি তাকে ধরে রাখতে পারেনি। সোজা চলে এলেন কোলকাতায়। কোলকাতার ভবানীপুর রুবী স্টুডিওর মালিক ছিলেন তার স্কুলের শিক। কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্যের বাড়ি সেখান থেকে একদিন হাজির হন নড়াইল জমিদারদের কোলকাতার কাশিমপুরের বাড়িতে। জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় লাল মিয়াকে খুব ভালোবাসতেন, øেহ করতেন। তাকে জানালেন তিনি আর বাড়ি ফিরে যাবেন না। তিনি বলেন, জমিদার বাড়ির অরুণ রায়ের মতন শিল্পী হবেন। আর্ট কলেজে ভর্তি হতে মেট্রিক পাশ লাগে। লাল মিয়ার আগ্রহ দেখে অরুণ বাবু ব্যবস্থা করেন। ভর্তি পরীায় লাল মিয়া প্রথম হন। হৈচৈ পড়ে গেল কলেজে। কিন্তু কি হবে। মেট্রিক পাশ ছাড়া ভর্তি হওয়া যাবে না।
জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় এবং অরুণ রায় শহীদ সোহরাওযার্দীর কাছে গিযে ঘটনা বলেন। বিখ্যাত চিত্র সমালোচক শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর্ট কলেজের কার্যকরি কমিটির প্রভাবশালী সদস্য। তার অনুরোধে লাল মিয়াকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে। লাল মিয়ার প্রতিভায় তার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে। তার দামী গাড়িতে করে মাছিমদিয়ার রাজমিস্ত্রীর ছেলে লাল মিয়া প্রতিদিন আর্ট কলেজে যাতায়াত করে।
সময় ১৯৩৮ সাল। জযনুল আবেদিন সে বছর আর্ট কলেজে শিক হিসাবে যোগদান করে। লাল মিয়া ও কামরুল হাসান সহপাঠী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী লাল মিয়ার নাম রাখেন এস এম সুলতান। এ নামেই সে পৃথিবী জোড়া পরিচিতি লাভ করে। সুলতান প্রতিবছর প্রথম হন। কারো কাছে না বলে বেড়িয়ে পড়েন পথে। প্রথমে আগ্রা। পকেটে মাত্র চার আনা। তাজমহলে আসতেই চার আনা শেষ। দারুণ ুধা নিয়ে ছবি আঁকেন। তিনজন আমেরিকান সৈনিককে ছবি এঁকে দিতে হবে। তারা তাকে ১৫০টাকা দেন। সোজা গিয়ে ওঠেন বিসমিল্লাহ হোটেলে। এসময় ড. বি এম জহুরীর সাথে তার পরিচয় হয়। জহুরী তাকে চাকুরী করার অনুরোধ করেন। কাজ ছবি আঁকা। সুলতান রাজী হন এবং তার সাথে চলে যান।
চার মাস পর চলে আসেন দিল্লী। সেখানে এক শিল্পীর বাড়ি এক মাস থাকেন। তাদের সাথে আজমীর শরীফ আসেন। আজমীরে এক মাস থাকার পর তিনি চলে আসেন লাক্ষ্মৌতে। সেখান থেকে হিমালয়ের
প্রতি হিল স্টেশনে পায়ে হেটে ঘুরে বেড়ান, দেখেন দেরাদুন কাগন জালি। লক্ষ্মৌ ছেড়ে আসেন সিমলা। সেখানে অনেক ছবি আঁকেন। সিমলায় বসে এক কানাডিয়ান মহিলার সাথে তার পরিচয় হয়। তার সহযোগিতায় সিমলা সেন্টার পিটার্স স্কুলে তার ছবির প্রদর্শনী হয়। উদ্বোধন করেন কাপুরতলার মহারাজ। প্রদর্শনীতে চার শত টাকার ছবি বিক্রি হয়। সেখান থেকে চলে আসেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। পরিচিত হন সেখানকার নবাব ফরিদ খানের সাথে। ফরিদ খান তার ভালো বন্ধু হয়েছিলেন। পরে চলে আসেন কাশ্মীরে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় করাচি এসে পরিচয় হয় কবি জসীম উদ্দীনের সাথে। এসময় শাকের আলী , শেখ আহমেদসহ আরো নামিদামি শিল্পীদের সাথে পরিচিত হন। এবং আর্ট কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এস এম সুলতান করাচিতে প্রদর্শনী করেন। যা উদ্বোধন করেন ফিরোজ খান নুন। এরপর করাচী ুসিবধ হলে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। টিকেট এক টাকা। প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিল।
১৯৫০ সালে পাকিস্তান চিত্রশিল্পীদের মধ্য থেকে তাকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য মনোনিত করা হয়। তিনি ২০টি ছবি নিয়ে ১ জানুয়ারি আমেরিকা যান। আমেরিকা যাওয়ার আগে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কোথায় কোথায় যাবেন। তিনি জানান, শিশুদের স্কুল দেখতে যাবেন। আমেরিকার ওয়াশিংটন, বোস্টন,শিলানা, মিসিগান শহরে তার একক প্রদর্শনী হয়। আমেরিকা থেকে আসেন লন্ডনে। সেখানে তার একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়। ভিক্টোরিয়া ডুস্বি ডালি,পন, ব্র্যাক,ক্রীব’র মত বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে তার ছবি সমমর্যাদায় প্রদর্শীত হয়।
এস এম সুলতানের আগে এশিয়া মহাদেশের এমন দুর্লভ সম্মান কোন চিত্রশিল্পী পান নি। লন্ডনের লিসার গ্যালারীর প্রদর্শনী শেষে ছবিগুলো গ্যালারীকে দান করে যান। ১৯৫৩ সালে তিনি দেশে ফেরেন। সরকার তাকে আর্ট কলেজের উপাধ্য পদের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। জয়নুল আবেদিন তখন অধ্য। তিনি রাজী হলেন না। বিশ্বজয়ের মুকুট মাথায় নিয়ে তিনি চলে আসেন নড়াইল। ১৯৫৮ সালে সরকারি ভাবে বিশ শতাংশ জমিসহ একটি পুরাতন বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে তিনি ১৯৫৯ সালে ‘দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্বরূপে স্বতন্ত্র এ মানুষটির হৃদয় জুড়ে ছিল প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। চিত্রা নদীর তীরে তিনি গড়ে তুললেন এক তপোবন। বিভিন্ন জাতের বিচিত্র বৃরাজিতে পরিপূর্ণ এ তপোবনে প্রবেশ করলে মন ভরে যাবে। এরপর গড়ে তোলেন চিড়িয়াখানা। এখানে বানর, হনুমান, ঘোড়া, খরগোশ, গিনিপিগ, বনবিড়াল, দেশি-বিদেশি কুকুর, জাতি সাপ ও নানান জাতের নানান রঙের পাখি রয়েছে। এ মহান শিল্পীর মৃত্যুর পর তার চিড়িযাখানার জীব-জন্তু সব ঢাকা চিড়িয়াখানায় নিযে যাওয়া হয়। লাল মিয়া সুন্দর সুরে বাঁশি বাজাতেন। গভীর রাতে জমিদার বাড়ির পুকুর ঘাটে বসে বাঁশি বাজাতেন। এলাকার লোকেরা বলেছে তার বাঁশির সুরের তালে তালে সাপ ফণা তুলতো।
১৯৫৯ সালে রফিকুন নবী ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। তিনি বলেন, অধ্য জয়নুল আবেদিন, কামরুর হাসান, শফি উদ্দিন আহমেদ চারুকলার চত্বরে জলসভায় বসা। তারা সবাই এক মহিলা অতিথির সাথে গল্প করছেন। মহিলা অতিথি আমাদের কাসের দিকে পিঠ করে বসা। মাথায় ঢেউ খেলানো কোকড়ানো চুল। পড়নে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। ঠিক এগারটার দিকে স্যারদের সাথে অতিথি আমাদের কাসে আসে। আমরা সবাই চমকে উঠলাম। অতিথি মহিলা নন; সে একজন জ্বলজ্যান্ত পুরুষ মানুষ। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। হাতে বাঁশের বাঁশি। অধ্য সার পরিচয় করিয়ে দিলেনÑ নাম এস এম সুলতান। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও এস এম সুলতানের বন্ধু ছিলেন। এস এম সুলতানের যক্ষ্মা হয়েছিল ৮০ সালের দিকে। ব্যাংককের সুমিতভেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়; ভালো হয়ে দেশে এলেন।
এস এম সুলতান সর্ববৃহৎ ক্যানভাসে ছবি এঁকেছেন। যার আয়তন ২০ বর্গফুট। নড়াইলের লাল মিয়া চির কুমার ছিলেন। আমি তাকে যত কাছ তেকে দেখেছি। তার কাছে থাকার সৌভাগ্য হয় আমার। আজ মনে হয়, আর বাঁশি বাজবেনা, ইঞ্জিনের নৌকা চলবেনা, কেউ জানতে চাইবে না, ডাক্তার আসবেনা,সাংবাদিক জানবে না, সবাইকে আড়ালে রেখে, জাতিকে ফাঁকি দিয়ে নড়াইলের চিত্রা নদীর পারের মাছিমদিয়া গ্রামের এস এম সুলতান (লাল মিয়া) ১০ অক্টোবর চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ধন্য নড়াইলের মাটি, ধন্য চিত্রা নদী, ধন্য মাছিমদিয়া গ্রাম।
আ.জ.ম কামাল,
প্রশিক, নাটক বিভাগ
জেলা শিল্পকলা একাডেমী, মাদারীপুর।