বুধবার, ১৩ জুন, ২০১২

মহাত্মা গুরুনাথ স্মরণে বসন্ত উৎসব

সালাহ উদ্দিন মাহমুদঃ
সত্যধর্মের প্রচারক কবিরতœ মহাত্মা গুরুনাথ সেন গুপ্ত স্মরণে সত্যধর্ম মহামন্ডল বাংলাদেশের উদ্যোগে মাদারীপুরের কালকিনি অঞ্চলের নিভৃত পল্লী ঝুরগাঁও গ্রামে তিনদিনব্যাপী বসন্ত উৎসব পালিত হয়। প্রতিবছর ২৮ জানুয়ারি সকাল থেকে ৩০ জানুয়ারি গভীর রাত পর্যন্ত ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে  একেক বছর একেক স্থানে এ উৎসব পালিত হয়।
সন্ধ্যা নাগাদ উৎসবস্থলে পৌঁছে আমি হতবাক। সহস্র লোকের আনাগোনা। ভক্তরা মন্ডপের সামনে তাবুতে বসে আরাধনা করছেন। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। এরই ফাঁকে কথা হয় কয়েকজন ভক্তের সাথে। তারা সত্য ধর্মাবলম্বী। যুগ যুগ সাধনা করে মহাত্মা গুরুনাথ সত্য ধর্মকে আবিস্কার করেছিলেন। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রতিবছর এ দিনে পালিত হয় এ উৎসব। আয়োজন করেন সত্যধর্ম মহামন্ডল বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটি। একেক বছর একেক স্থানে পালিত হয়। এ বছর স্থান নির্ধারণ করা হয় কালকিনি। এ উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-‘সৃষ্টিস্থীতিলয় কর্তা সর্ব শক্তিমান মঙ্গলময় জগদীশ্বরের উপাসনা।’
উৎসবের তিনদিন স্রষ্টার গুণকীর্তণ, মহাত্মা গুরুনাথ রচিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও আলোচনা, সকল দেহত্যাগী আত্মার জন্য প্রার্থনা করা। সবশেষে সমাপনী রাতে কবিরতœ মহাত্মা গুরুনাথের পাদপদ্মে অর্চনার মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তী ঘোষণা করা হয়। উৎসবে বিভিন্ন জেলা থেকে মহাত্মা গুরুনাথের অগণিত ভক্ত অংশগ্রহণ করেন।
এ বছর সত্যধর্ম মহামন্ডল বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রমেশ চন্দ্র বিশ্বাসের সভাপতিত্বে উৎসবকে অলংকৃত করতে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সত্যধর্ম মহামন্ডল বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক হারান চন্দ্র দাস, হবিগঞ্জ জেলার সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মলয় চৌধুরী, নেপালে কর্মরত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ নীহার রঞ্জন বিশ্বাস ও গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তন্ময় কুমার সরকার।
উৎসবে মোট ৮টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন তিন ঘন্টা সময় নিয়ে তিনটি করে অধিবেশন হয়। পরিবেশিত হয় ধর্মীয় সংগীত। সংগীতের মূর্ছনায় কলুষিত অন্তর পরিশুদ্ধ হয়। সত্যধর্মের জয় কামনা করে বিদায় নিতে হয় আগত ভক্তদের। তখন সৃষ্টি হয় একটি ভ্রাতৃত্বময় পরিবেশের। যে দৃশ্য আজীবন প্রত্যাশা করেন সবাই।

নারীর প্রতি কেন এত সহিংসতা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদঃ
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ কথা আমরা কখনোই অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু কাজের বেলায় তার উল্টো। আমরা মুখে এ কথা বললেও তা অন্তরে লালন করি না। এ আমাদের মত পুরুষের দীনতা। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা এ জন্য বহুলাংশে দায়ি। আমরা কেবল নারীকে আমাদের ভোগের সামগ্রী হিসাবে পেতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করি।
আমাদের সমাজের নারী কারো মা কারো সন্তান কারো বোন কারো স্ত্রী। কিন্তু সে আমরাই আমাদেও লোলুপ দৃষ্টির কারণে তাদের আলাদা করে দেখি। পরিবর্তিত হয়ে যায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষমাত্রই এখন নারীর কাছে আজরাইল। আমাদের সমাজ এখন নারীর কাছে অনেকটা অভিশাপের মতন।
কবি বলেছেন-‘নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি প্রাণ,/ যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।’ অথচ আমরা যখন বিরহে কাতর হই; তখন নারীর বুকে মাথা রেখে একটু উষ্ণতা খুঁজি। কামাতুর হয়ে নারীকে ভোগ করি। শেষে নিক্ষেপ করি আস্তাকুড়ে। মিলনে ব্যর্থ হলে ঝলসে দেই নারীর শরীর। উন্মত্ততায় খুন করতেও দ্বিধাবোধ করি না। প্রেমের ফাঁদে ফেলে লালসা মিটিয়ে ছাব্বিশ টুকরো করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেই নারীর শরীর।
তাইতো মেয়ে যত বড় হয় পরিবারের দুঃশ্চিন্তা ততই বাড়ে। ফলে তার স্বাভাবিক বিকাশ তখন বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই নারীর প্রতি সহিংসতার নানাবিধ সংবাদ চোখে পড়ে। কারো চোখে জল, কারো মুখে বীভৎস হাসি।
ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, হত্যা ও নারী নির্যাতন এখন সমাজের জন্য বিভীষিকা হয়ে দেখা দিয়েছে। এর থেকে মুক্তি পেতে আমাদের কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নৈতিক শিক্ষা ও মানবিক আচরণগত ধারণাই এর সমাধান হতে পারে। 

কালকিনির গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষিত হয়নি

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ফাসিয়াতলা বাজারের হাটের দিন । সরগরম প্রায় দোকানপাট। সন্ধ্যার ঠিক আগে হঠ্যাৎ দু'জন অপরিচিত মানুষ ঢোল পিটিয়ে ঘোষনা করলো মুক্তিবাহিনী আসছে মিটিং করবে আপনারা কেউ বাজার ছেড়ে যাবেন না। মিনিট ১৫ না পেরোতেই হাটটি ঘেরাও করে রাজাকার, আল-বদর বাহিনী। ১০ মিনিট পরই নদীতে গানবোটে চড়ে আসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। ততক্ষণে রাজাকাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিকামী মানুষের ওপর।  একদিকে হানাদারদের গুলি অপরদিকে স্থানীয় রাজাকার, আল-বদরদের নির্মম হানায় হত্যা করা হয় অন্তত দেড় শত মুক্তিকামী মানুষকে। অনেককে ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতে।  লুটপাট শেষে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় হাটের দোকানপাট। যাওয়ার সময় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ১৮ জনকে। এরমধ্যে ১০ জন আজও ফিরে আসেনি। এরপর কেটে গেছে ৪০ টি বছর। তবে শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে নেওয়া হয়নি কোন পদক্ষেপ। ফলে নতুন প্রজন্ম মহান এই স্মৃতিকে ভুলে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার পর ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে উপজেলা গেট সংলগ্ন সুরভী সিনেমা হলের পাশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন। কিন্তু তারপর কেটে গেছে তিনুটি বছর। তবুও কাজ শুরু হয়নি স্মৃতিসৌধের। ঠিক তেমনিভাবে অবজ্ঞা-অবহেলায় পড়ে আছে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়। অর্থাভাবে সংস্কার বা পুণঃনির্মাণ কোনটাই সম্ভব হচ্ছেনা।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এসকান্দার আলী বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে চল্লিশ বছর আগে। অথচ দেশের জন্য যারা জীবন দিল, পঙ্গু হল, সর্বস্ব হারালো তাদের স্মৃতি সংরক্ষণের কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তিন বছর আগে স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও কাজ শুরু হয়নি। ফাসিয়াতলার গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়টিও অর্থাভাবে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। এরকম হলে আগামী প্রজন্ম স্বাধীনতার ইতিহাস ভুলে যাবে।

অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা আকন মোশাররফ হোসেনের উদ্যোগে বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের খাসেরহাট বন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের খাসের হাট বন্দরে মুক্তিযোদ্ধা মিউজিয়াম স্থাপিত হয়। ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ ও মিউজিয়ামের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। মিউজিয়ামের সংস্কার কাজ চললেও স্মৃতিসৌধের কাজ শুরু হয়নি। অর্থাভাবে ঢিমেতালে চলছে মিউজিয়ামের কাজ। কাজ শেষ না হওয়ায় দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এখানে সংরক্ষিত আছে শহীদ বীর বিক্রম নুরুল ইসলাম শিকদারসহ ২৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার ছবি, মুজিব নগর সরকারের গার্ড অব অনারের ছবি, নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল ও ছবি, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত হেলমেট ও বিভিন্ন জিনিসপত্র।
মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা আকন মোশাররফ হোসেন জানান, দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছি। শহীদ বীর বিক্রম নুরুল ইসলাম এ এলাকার সন্তান। তার জন্য কিছু করতে পারিনি। কেবল একটি স্মৃতিসৌধ ও মিউজিয়াম করার উদ্যোগ নিয়েছি। মিউজিয়ামের সংস্কার কাজ এখনো শেষ হয়নি। এখনো স্মৃতিসৌধের কাজ শুরু করতে পারিনি। অর্থাভাবে করতে পারছিনা। মন্ত্রী মহোদয় আশ্বাস দিয়েছিলেন। সরকারী বা বেসরকারী সাহায্য পেলেই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের বিনিময়ে শত্র“মুক্ত হয়েছে এদেশ। স্বাধীনতার জন্য বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়েছে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। ইজ্জত হারিয়েছে মা-বোন। পঙ্গু হয়েছে অগণিত মানুষ। অথচ স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ফাসিয়াতলা গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষিত হয়নি। এমনকি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে গড়ে ওঠেনি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়টিও সংস্কারের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবীর মুখে উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের খাসের হাট বন্দরে মুক্তিযোদ্ধা মিউজিয়াম স্থাপিত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রস্তাবিত স্মৃতিসৌধের কাজ এখনো শুরু হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি এখন আপামর জনসাধারণের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আর কালক্ষেপণ না করে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে কার্যকরি পদক্ষেপের দাবি জানাচ্ছে কালকিনিবাসী।