শুক্রবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৩

এইচআইভি/এইডস: প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি

‘১ ডিসেম্বর- বিশ্ব এইডস দিবস’
এইচআইভি/এইডস: প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
এক সময় মানুষ জানতো না এইচআইভি/এইডস কী? শুরু হলো প্রচার-প্রচারণা। আন্তর্জাতিক, সরকারি, বেসরকারি, এনজিও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এগিয়ে এসে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে সোচ্চার হলেন। ফলে কিছু সংখ্যক শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল এইডস এর ধারণা। কিছু সংখ্যক মানুষকে শেখানো হলো কিভাবে এইডস প্রতিরোধ করতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে চলল কাজ। প্রকল্প শেষ; সচেতনতার কাজও শেষ। সচেতনতা আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়নি। কারণ আমরা প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে শতভাগ সফলতা অর্জন করতে পারিনি। বাংলাদেশে এইডস সনাক্ত হওয়ার বিশ বছর পরও ৬৮হাজার গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে তার ধারণা পৌঁছে দিতে পারিনি। যে কারণে এখনো মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা, অসচেতনতা ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়।
এইচআইভি/এইডস একটি মরণব্যাধি। এটা মানব জাতির মধ্যেই সংক্রমিত হয়। যথাযথ কোন প্রতিকার ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। পুরোপুরি নির্মূল করেতে না পারলেও অবদমিত করার কিছুটা উপায়ও তারা এ পর্যন্ত আবিস্কার করেছেন। তবে আশা করি একদিন তারা এর নির্মূলের গবেষণায় সফল হবেন। বিজ্ঞরা গবেষণা করছেন আর অজ্ঞরা একে অবজ্ঞা করছেন। তাই এখনো এইচআইভি/এইডসকে অনেকে অভিশাপ হিসাবেও গণ্য করেন। তারা মনে করেন শুধু মানুষের নৈতিক অধ:পতনই এর জন্য দায়ি। ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার জন্য প্রত্যেক ধর্মের পক্ষ থেকে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এ রোগের গোড়ার ইতিহাস সমকামীতাকে দায়ি করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের তথ্য মতে, ১৯৮১ সালের জুন মাসে লস এ্যাঞ্জেলস শহরে পাঁচ জন সমকামীর মধ্যে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। যে কারণে গবেষকরা ১৯৮২ সালে প্রথম একে এইডস হিসাবে নামকরণ করেন। ১৯৮৩ সালে ড. লুক মন্টাগনিয়ের এর নাম দেন লিম্ফোঅ্যাডেনোপ্যাথি অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস। ১৯৮৪ সালে ড. রবার্ট গ্যালো নিশ্চিত করেন যে, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংসকারী ভাইরাসই এইডস রোগের কারণ। ১৯৮৫ সালে হলিউডের অভিনেতা রক হাডসন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন বিশ্বব্যাপি হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনমি এইডস এর জীবাণুর নাম রাখেন এইচআইভি। ১৯৮৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘লন্ডন ঘোষণা’ অনুসারে ১ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব এইডস দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়।
বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস ১৯৮৯ সালে প্রথম সনাক্ত করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ২০৮৮ জন এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৪১ জন। বাংলাদেশে এইডস এখনো মহামারি আকারে দেখা না দিলেও অসতর্ককা, অসচেতনতা ও উদাসীনতার ফলে অচিরেই এ মরণব্যাধি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কারণ এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সব রকমের নমুনা বা ঝুঁকি বাংলাদেশে বিদ্যমান। তাছাড়া ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে এইডস বিস্তারের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠি যেমন পতিতালয়ের যৌনকর্মী, ভাসমান যৌনকর্মী, মাদকসেবী, হিজড়া, প্রবাসী, যুবক-যুবতীর নৈতিক অবক্ষয়, কারখানা ও পরিবহণ শ্রমিক সংখ্যায় অনেক। এছাড়া যৌন মিলনে কনডম ব্যবহারে অনিহা, সঠিক নিয়মে ব্যবহার না করা ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা এইডস বিস্তারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সঙ্গত কারণে আমাদের নারী শিশু ও যুবক-যুবতীরা আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। তাই এখনই আমাদের একটি মজবুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
যেহেতু আমাদের হাতে এইডস রোগ প্রতিকারের কোন উপায় নেই। গবেষকরা মাত্র মানবদেহে এইচআইভি জীবাণু নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ঔষধ আবিস্কার করেছেন। যা কেবল মৃত্যুটাকে বিলম্বিত করতে পারে। আক্রান্তকে কেবল চিকিৎসা হিসাবে এন্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি দেওয়া হয়। ঔষধ হিসাবে রয়েছে জাইডোভুডিন, নেভিরাপিন, ডাইডেনোসিন, লেমিভুডিন ইত্যাদি। কিন্তু এ থেরাপির আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যায়। এতে অগ্নাশয়ে প্রদাহ, হাত-পা শুকিযে যাওয়া, পরিপাকতন্ত্রে জটিলতা, বৃক্কে পাথর হওয়া, অরুচি, মুখে বিস্বাদ, স্বপ্ন, ঘুমের অভাব ও যকৃতে প্রদাহ ইত্যাদি হতে পারে। তবুও উন্নত দেশগুলোতে এ থেরাপির কারণে মৃত্যুর হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্রাজিলে মৃত্যুর হার শতকরা আশি ভাগ কমে এসেছে। একজন আক্রান্ত এ থেরাপি গ্রহণের ফলে গড়ে প্রায় ৬-৭ বছর বেশি বাঁচতে পারে। তবে মৃত্যু অবধারিত।
তাই প্রতিকারের চেয়ে আগে আমাদের শরীরে এইচআইভি আছে কি না? তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া জরুরী। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে এইচআইভির উপস্থিতি সনাক্ত করা যায়। মূলত এইচআইভি পরীক্ষার জন্য শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষার জন্য যে পরিমাণ এন্টিবডির প্রয়োজন সে পরিমাণ এন্টিবডি শরীর তৈরি করতে পারেনা। ফলে  এসময় পরীক্ষায় এইচআইভির উপস্থিতি ধরা পড়ে না। এ সময়কালকে দি উইনডো পিরিয়ড বলা হয় যা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস হতে পারে। এছাড়া যদি শরীরে জীবাণু পাওয়া যায় তখন তাকে এইডস রোগী বলা যায় না। তখন তাকে এইচআইভি পজেটিভ বা এইচআইভি বাহক বলা হয়। ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশের পর থেকে সাধারণত ৮-১০ বছর পর আক্রান্ত হয়। যদিও তখন আক্রান্তকে সুস্থ্য সবল দেখায়। এমন অবস্থাতেও তার থেকে অন্যজন আক্রান্ত হতে পারে। তাই প্রথমে এ্যালাইজা টেস্ট করতে হয়। তাতে যদি জীবাণু ধরা না পড়ে তবে তিনি নিশ্চিন্তথাকতে পারেন। আর যদি ধরা পড়ে তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাথে সাথে ওয়েস্টার্ন ব্লট টেস্ট করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে কেউ আক্রান্ত হলে সাধারণত তিন বছরের মধ্যে মারা যায়।
কেবল সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষণের মাধ্যমে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এইডস সনাক্ত করতে পারেন। বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনামূলে গোপনীয়তা রক্ষা করে এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়। ঢাকার শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজী বিভাগ, মহাখালীর মাইক্রোবায়োলজী ল্যাবরেটরী জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনিষ্টিটিউট, ক্যান্টনমেন্ট আর্মড ফোর্সেস প্যাথলজী ল্যাবরেটরী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, খুলনা মেডিকেল কলেজ ও সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্যাথলজী বিভাগ ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ল্যাবরেটরীতে এইচআইভি পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। অন্তত বৈবাহিক বন্ধনের পূর্বে উভয়ের রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া উচিৎ।
এ মরণব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়া আরো কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু দিবস ভিত্তিক সচেতনতা নয়। প্রত্যেকটি টিভি চ্যানেল ও বেতার কেন্দ্রের সৌজন্যে এইডস সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন ও নাটক প্রচার করতে হবে। পত্রিকাগুলোকে বিজ্ঞাপন ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রত্যেক ধর্মের প্রতিটি উপাসনালয়ে এইডস সংক্রান্ত আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামে অন্তত মাসে একবার হলেও এইডস বিষয়ক ভিডিও প্রদর্শন, সিনেমা স্লাইড প্রদর্শন, মঞ্চ বা পথনাটক, জারি বা গণ সংগীত পরিবেশনসহ পোস্টার, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিলবোর্ড, হাট-বাজার বা পরিবহণে লিফলেট ও বুকলেটস বিতরণ করতে হবে। তাহলে হয়তো সচেতনতা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।
মোট কথা এইডস বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের প্রতিমুহূর্তে কাজ করতে হবে। আর যারা এইডস আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ঘৃণা না করে ভালোবাসতে হবে। তাদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যদিও কিছু স্পর্শকাতর বিষয় এর সাথে জড়িত। তাই যে কারণে এইচআইভি ছড়ায় সে কারণগুলো সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যেহেতু এ রোগ সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এখনো স্বচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে। মানুষ এইডস সম্পর্কে নানা রকম ভুল ধারণা পোষণ করে থাকেন। ফলে এইডস রোগীরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ঘৃণার বস্তু হয়ে যান। তাদের প্রতি করা হয় অমানবিক আচরণ। এইডস রোগিরা যেন সমাজের অন্য রোগিদের মত সেবা পেতে পারে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এইডস কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। সবচেয়ে বড় কথা আমরা যে কেউ যে কোন সময়ে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারি। তাই রোগিকে ঘৃণা না করে রোগকে ঘৃণা করতে হবে। সংক্রমিতের প্রতি সহনশীলতা এবং মানবিক আচরণ করতে হবে। আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রতিকার না খুঁজে। আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা করি।
 
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

দেশপ্রেম কি কেবল দিবসভিত্তিক হয়ে যাবে

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’- এ ঘোষণা ইসলাম ধর্মের হলেও সকল ধর্মের মানুষই এ ঘোষণার সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কে দেশদ্রোহী হতে চায়? কেউ না। যারা দেশদ্রোহী; তারা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে তৎপর। তারা মানুষের কল্যাণে নয়, নিজের কল্যাণে সব করে। তারা ঘৃণ্য ও অপাঙক্তেয়। দেশদ্রোহীতার পরিণতি সকলেরই জানা। দেশপ্রেমকে ধর্মাচার বললেও অত্যুক্তি হবে না। সকল ধর্মেই দেশপ্রেমের কথা বলা হয়েছে। তাই দেশের প্রত্যেক নাগরিকের অন্তরে দেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। কারণ, যে দেশের মাটি বায়ু জল বাতাসে প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠি আমি। সে দেশতো আমার মা। আর মাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। যে করে সে অকৃতজ্ঞ ও মহাপাপী। তাই আমরা সবাই দেশপ্রেমিক হতে চাই। মনে-প্রাণে দেশকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই ১৯৭১ সালে জীবনের বিনিময়ে দেশকে রক্ষা করেছিলাম। আমরা জাতির গর্বিত সন্তান।
কিন্তু আজকাল আমরা দেশপ্রেমের নামে প্রহসনে মেতে উঠেছি। ইদানীং দেশপ্রেম হয়ে গেছে স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার। হয়ে গেছে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অংশ। শুধু রাজনীতিবীদরাই দেশপ্রেমের স্লোগান দেবেন। বাকিরা তাকিয়ে উপভোগ করবেন। সর্বোপরি দেশপ্রেম এখন দিবসভিত্তিক। প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ ও ২১ ফেব্র“য়ারি এলে নানাবিধ কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে তা পালন করি। পরদিন সকালেই দেশের বারোটা বাজানোর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠি। দেশকে ভালোবাসার নামে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ফ্যাশনে রুপান্তরিত করি।
‘দেশ আমার, মাটি আমার’- স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করি আকাশ। বিভিন্ন রঙের বাহারি পোস্টারে, ফেস্টুনে, ব্যানারে ও দেয়াল লিখনে তখন দেশের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে ব্যক্তির প্রচার। ‘ দেশদরদী, গরীবের বন্ধু অমুক নেতার পক্ষ থেকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা’ প্রভৃতি প্রচার-প্রচারণায় ছেয়ে যায় অলি-গলি, হাট-বাজার, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও রাজপথ। এ আমাদের দেশপ্রেমের নমুনা। অথচ আমাদের আশপাশের হতদরিদ্র মানুষগুলো দু’বেলা দু’মুঠো না খেতে পেয়ে বেছে নেয় ভিক্ষাবৃত্তির মত জঘন্য কাজ। কবির ভাষায়-‘ঘাতক শিল্পের দেশ তাকে আমি কখনোই স্বদেশ বলি না।’ ক্ষুধার তাড়নায় নারী বেছে নেয় বেশ্যাবৃত্তির মত জঘন্য পেশা। তাইতো কবি বলেছেন,‘বেশ্যালয়কে কখনো আমি স্বদেশ বলি না।’ তাতে কি আমাদের দেশ সারা বিশ্বের কাছে লজ্জিত হয় না? ব্যক্তির প্রচারে অর্থ ব্যয় না  করে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালে কী দেশপ্রেম প্রকাশিত হয় না। কয়দিন থাকে ঐ ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার? একদিন, একসপ্তাহ, একমাস বা একবছর। অথচ ডিসেম্বর মাসের এ কনকনে শীতের রাতে কোন বস্ত্রহীন মানুষকে একটি শীতবস্ত্র দিলে সেটার স্থায়ীত্ব বহুদিন। দেশের মানুষকে ভালোবাসা কী দেশপ্রেম নয়?
আসলে প্রকৃত দেশপ্রেম কী? আমরা অনেকেই জানিনা বা বুঝতে চাই না। শুধু মুখেই বলি দেশ ও দশের কল্যাণে আমি নিয়োজিত। অথচ দেশ ও দশের কল্যাণ সাধনের চেয়ে আমরা নিজেদের কল্যাণেই নিয়োজিত থাকি। তাইতো দেশপ্রেমিকের সংজ্ঞাও আমরা পাল্টে ফেলেছি। দেশ ও দশের কল্যাণে ব্যর্থ হয়েও আমরা ‘দেশপ্রেমিক’ উপাধি পেতে পারি। বেয়াদবি মাফ করবেন, ‘আসল কথা হইতেছে- আমরা যে যত বেশি দেশ ও দশের বারোটা বাজাইতে পারিব। সে তত বড় দেশপ্রেমিক হিসাবে উপাধি লাভ করিয়া থাকিবেন।’
আমি দেশপ্রেমিক। তা ঘোষণা দেওয়ারতো কিছু নাই। সেদিন গাড়ীর জন্য এক বাস স্টপেজে অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় প্যান্ট-শার্ট পড়া এক ভদ্রলোকের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। রিংটোনে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর। আমি চমকে উঠলাম! এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক ফোন রিসিভ করলেন। রিং থেমে গেল। জাতীয় সংগীতের সম্মান বা ব্যবহারের বিধিমালাও আমাদের জানা নেই। আমি যতটুকু জানি, তাতে জাতীয় সংগীতের সময় দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। যত্রতত্র জাতীয় সংগীত বেজে উঠলে আমরা কী করতে পারি? এতো ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’র মতো।
কিছুদিন আগের ঘটনা। গত শারদীয় দূর্গা পূজায় ‘আনন্দধারা নাট্যগোষ্ঠী’র আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের একটি গ্রামে। পূজার অনুষ্ঠান চলছে। সবশেষে নাটক মঞ্চস্থ হবে। নাটকের আগে পরিবেশিত হবে জাতীয় সংগীত। শিল্পীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন শুরু করলেন। কেউ দাঁড়ালো না। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে একাই দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার দেখাদেখি সাংবাদিক বন্ধু মিজানুর রহমানও দাঁড়ালেন। পরে আমাদের দেখাদেখি পূজামন্ডপ প্রাঙ্গনে যে যেখানে বসা ছিলেন; তারা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। জাতীয় সংগীত সহযোগে দেশকে সম্মান জানানো হলো। জনগণ কি বুঝেছে জানি না। তবে আমার মনে হয়, যেহেতু আমরা অনুষ্ঠানের অতিথি। অতিথিরা দাঁড়িয়েছে তাই সবাই দাঁড়িয়েছে।
আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বসে পরীক্ষা পাসের জন্য পৃষ্ঠা ভরে ‘দেশপ্রেম’ রচনা লিখেছি। কিন্তু তার সারমর্ম কিছুই অনুধাবন করিনি। দেশপ্রেমকে কেবল রচনার জন্যই উপযুক্ত মনে করেছি। আমরা বলি-‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।’ কিন্তু আজ সেটা উল্টে গেছে। বলতে হবে- দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়। তাই যদি না হবে তবে আমাদের দেশ আজ এত দুর্ভাগা কেন? দেশের অর্থ কেন বিদেশে পাচার হয়? কেন ‘নিবিড় পাটচাষের বদলে অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে নিবিড় কোটিপতির চাষ।’ দেশি পণ্য না কিনে আমরা বিদেশি পণ্য কিনে ধন্য হই। দেশি পণ্য ব্যবহার করলে না কি প্রেসটিজ নষ্ট হয়। এছাড়াও দেশি সংস্কৃতির চেয়ে পরগাছা সংস্কৃতি লালন করি। আমার মনে হয় না- এবার শতকরা বিশজন মানুষ বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান টেলিভিশনে দেখেছে। তার কারণ, আমার আকাশ দখল করে রেখেছে স্টার জলসা, জি বাংলা, স্টার প্লাস আর জি টিভিরা। ‘টাপুর টুপুর’, ‘সাতপাকে বাধা’ আর ‘মা’ (ঝিলিক) আমাদের নারী সমাজের মগজ এমনভাবে ধোলাই করেছে যে, তারা ঐ সিরিয়াল দেখে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবেন। ভুলেও চ্যানেল পাল্টে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান দেখবেন না। ছি! আমরা কতটাই অকৃতজ্ঞ। অথচ ভারত সরকার তাদের টেলিভিশনে আমাদের কোন চ্যানেল প্রচারে অনুমতি দেন নি। কবি যথার্থই বলেছেন-‘ আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো টিভি পর্দায় যখন পাশ্চাত্যের/ হাঙর-সংস্কৃতি এসে গিলে খাচ্ছে পদ্মার রূপালী ইলিশ।’
বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও মাতৃভাষা দিবস এলেই ফুল দেই। লাল-সবুজের রঙে নিজেকে সাজাই। একদিন পড়ে সে পোশাক তুলে রাখি আগামী বছরের জন্য। পত্র-পত্রিকাগুলো সাময়িকী ছাপে। পনের দিন দেশাত্মবোধ জাতীয় কলাম ও প্রতিবেদন ছাপে। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই। টেলিভিশনগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক, সিনেমা ও টকশো প্রভৃতি প্রচার করে। এরপর পাল্টে যায় সবার চেহারা। কেন? দেশপ্রেম কী কেবল দিবসভিত্তিক? দেশাত্মবোধকে কেন আমরা সঙ্কীর্ণ গন্ডির মধ্যে নিয়ে এসেছি। দেশাত্মবোধক নাটক, সিনেমা কী সারা বছর প্রচারিত হতে পারে না।
আসুন শুধু মুখেই নয় অন্তরেও ভালোবাসতে শিখি। রাজনীতির স্বার্থে নয়, ব্যক্তি স্বার্থে নয়, ক্ষমতার লোভে নয়। ঈমানী দায়িত্ব মনে করেই দেশকে ভালোবাসি। নিজের কল্যাণে নয়, দেশের কল্যাণে এগিয়ে আসি। দেশের প্রতিটি নাগরিককে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে আহ্বান জানাই। ‘দেশ আমার, মাটি আমার’- স্লোগানকে অন্তরে ধারণ করে দেশের অভ্যন্তরের যাবতীয় ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে ঐক্যবদ্ধ হই। দলের স্বার্থে দলাদলি না করে দেশের স্বার্থে সবাই এক হয়ে কাজ করি। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়-‘যখন আমাদের শত্র“রা সংঘবদ্ধ, বন্ধুরা ঐক্যভ্রষ্টÑ/ তখন এই কবিতাটির ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।’

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

চল্লিশ বছর পরও উপেক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
৮ ডিসেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে কমান্ডার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা লালপোল সংলগ্ন ও থানার অভ্যন্তরে পাক হানাদার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে কালকিনিকে হানাদার মুক্ত করেন। এ দিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ বিজয়ের আনন্দে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রকাশ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। কালকিনি মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা মাদারীপুর সদর মুক্ত করার জন্য রওয়ানা হন। ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হয় মাদারীপুর সদর। কিন্তু স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও এ দিনটি কালকিনিবাসীর কাছে উপেক্ষিত বা অজ্ঞাত। মুক্ত দিবস উপলক্ষে নেই কোন কর্মসূচি।
শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও কালকিনিতে নির্মিত হয়নি স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ। প্রবীণ থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্মও জানে না কালকিনি মুক্ত হয় কত তারিখে। লজ্জার বিষয়, অনেক মুক্তিযোদ্ধাও দিনটির কথা বেমালুম ভুলে বসে আছেন। তার কারণ, কালকিনি মুক্ত দিবস উপলক্ষে চল্লিশ বছরে একবারও কোন কর্মসূচি পালিত হয়নি। এমনকি এনায়েত নগর ইউনিয়নের ফাসিয়াতলার গণহত্যা দিবসও ভুলে গেছে সবাই। ভুলে গেছে শহীদ বীর বিক্রম এম নুরুল ইসলাম ও শহীদ নুরুল আলম পান্নাসহ অনেক শহীদের নাম। তার কারণ, স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও নির্মিত হয়নি স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বা অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক।
বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার এনায়েত নগর ইউনিয়নের ফাসিয়াতলা বন্দর সাপ্তাহিক হাটের দিন বলে সরগরম। নিয়মিত নিয়মে চলছে বেচা-কেনা। হঠাৎ সন্ধ্যার ঠিক আগে দু’জন অপরিচিত লোক ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করল,‘মুক্তিবাহিনী আইছে। তারা আপনাগো লইয়া মিটিং করব। আপনারা বাজার ছাইড়া যাইবেন না।’ ঘোষণার ১৫ মিনিট যেতে না যেতেই রাজাকার ও আল বদর বাহিনী বাজার ঘেরাও করে ফেলে। এর ১০ মিনিট পর নদীতে গানবোটে চরে আসে পাক বাহিনী। রাজাকার ও পাক হানাদার বাহিনী সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র হাটুরে মানুষের ওপর। হানাদারদের অতর্কিত হামলায় শহীদ হয় প্রায় দেড়শতাধিক মুক্তিকামী মানুষ। অনেককে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। লুটপাট শেষে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বাজারের দোকানপাট। যাওয়ার সময় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ১৮ জনকে। এর মধ্যে ১০জন আজো ফিরে আসেনি।
১৯৭১ এর মে মাসে বর্তমান পৌর এলাকার দক্ষিণ রাজদী গ্রামের নুরুল আলম পান্না যোগ দেন ৩০৩ নম্বর রাইফেলে। মেজর মনজুর নেতৃত্বে ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে কালকিনি অঞ্চলে নুরু কবিরাজের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধকালীন তাঁর কাজ ছিল পাক বাহিনীর গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একাত্তরের ১০ অক্টোবর উপজেলার ফাসিয়াতলা বাজারে যান। সেখানে রাজাকারদের সহায়তায় পাক বাহিনী তাকে আটক করে মাদারীপুর এ.আর হাওলাদার জুট মিলের মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। হত্যার পর নিশ্চিহ্ণ করে দেওয়া হয় মৃতদেহ। এরপর কেটে গেছে চল্লিশ বছর। অথচ নিখোঁজ শহীদ নুরে আলম পান্নার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নেই। আজ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর তাঁর আত্মীয়-স্বজনের কাছে খোঁজ নিয়ে শুনতে হয় তাঁর নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি। বহুবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন শহীদের ভাই জহিরুল আলম সিদ্দিকী ডালিম।
১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে পাক বাহিনীর যাতায়াতে বিঘœ ঘটানোর জন্য গোপালপুর ব্রীজে মাইন বিস্ফোরণ শেষে ফেরার পথে রাজাকার ও পাক বাহিনীর নির্মম বুলেটে শাহাদাত বরণ করেন উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের পরিপত্তর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা এম নুরুল ইসলাম। তাঁর লাশ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিজের ভিটায় দাফন করার সৌভাগ্য হয়নি স্বজনের। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর বীর বিক্রম উপাধীতে ভূষিত করেন। অথচ তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণেও আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি স্মৃতিস্তম্ভ। কিংবা কোন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বা স্থাপনার নামকরণও হয়নি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আজ ভুলতে বসেছে কালকিনিবাসী। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের কোন পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০৮ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন ‘মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ উপলক্ষে উপজেলা গেট সংলগ্ন সুরভী সিনেমা হলের পাশে স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও তার কাজ শুরু হয়নি। ঠিক তেমনি অযতœ অবহেলায় পড়ে আছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসার পরও উপেক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। দানবীর, শিক্ষাণুরাগী স্থানীয় সাংসদ সৈয়দ আবুল হোসেনও পরপর চার বার নির্বাচিত হয়েও কর্ণপাত করেননি স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে। অথচ নিজের নামে, বাবার নামে অনেক কিছু করলেও এলাকার মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদদের নামে কিছুই করেন নি।
কিন্তু ২০১০ সালে উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের খাসের হাট বন্দরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর স্থাপিত হয়। ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কিন্তু অর্থাভাবে ঢিমেতালে চলছে তার কাজ। কাজ শেষ না হওয়ায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ কালকিনির মুক্তিযোদ্ধারা। যার ফলে গত ২৫ মার্চ কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত ‘স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তি’ অনুষ্ঠানে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। পরে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সৈয়দ আবুল হোসেন তাদের শান্ত করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আকন মোশাররফ হোসেন ক্ষোভের সাথে বলেন, দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীন দেশের স্রষ্টারাই আজ ধুুকে ধুকে মরে। এমনকি তাদের স্মৃতিটুকুও সংরক্ষণ করা হয়নি। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এসকান্দার আলী বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে চল্লিশ বছর আগে। এখনো ফাসিয়াতলা গণহত্যা, স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয় সবই কালের ধুলায় বিলীন হতে চলেছে।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে শত্র“মুক্ত হয়েছে আমাদের স্বদেশ। আজ স্বাধীন দেশের মাটিতে পালিত হয় না কালকিনি মুক্ত দিবস। গড়ে ওঠে না স্মৃতিস্তম্ভ। সংরক্ষিত হয় না গণহত্যার স্মৃতি। এ লজ্জা রাখবো কোথায়? এ দীনতা কাদের? তবে কী জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ। হয়তো একদিন মরতে মরতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা শূন্য হয়ে যাবে। সেদিন কী আমরা তাদের স্মরণ করবো? আগামী প্রজন্ম কী মনে রাখবে তাদের কথা। কীভাবেই বা রাখবে? আমরা যদি তাদের স্মৃৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করি তবে সেই ব্যর্থতা কেবল আমাদের।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী