সোমবার, ১০ জুন, ২০১৩

বাবার কাছে খোলা চিঠি

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
পরম শ্রদ্ধাভাজন পিতা,   
পৃথিবীর সবটুকু অনুভূতি দিয়ে আজ উপলব্ধি করছি তোমায়। তোমার মাঝেই আমার অস্তিত্ব। আর আমার মাঝে সুপ্ত তোমার আগামী দিনের স্বপ্ন। তুমি আমার স্বপ্নদ্রষ্টা। আর আমি তোমার স্বপ্নবিলাসী রাত। এখনো কী রাত জেগে জেগে ঝাপসা চোখে আগামীর স্বপ্ন দেখো? হাজার রঙের ছবি আঁকো মনে মনে। এখনো হয়তো বসে বসে ভাবো, ফেলে আসা অতীত। বার্ধক্যের মাঝে আজ খুঁজে ফেরো শৈশব ও যৌবনের সার্থকতা।
বাবা, আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে তুমিই ছিলে প্রধান। তুমি পরিবারের বড় সন্তান। সকলের মিয়া ভাই। তোমাকে নিয়ে হয়তো তোমার বাবারও অনেক স্বপ্ন ছিলো। আজ তুমি পেশাগত জীবনে একজন শিক্ষক। সমাজে আলো ছড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলে। অথচ তেলের অভাবে তোমার প্রদীপই ছিল নিভূ নিভূ। যৌবনে তুমি তোমার বাবাকে (আমার দাদা) হারিয়েছ। ছয় বোনকে পাত্রস্থ করাসহ তিনভাইকে মানুষ করার গুরুভার ছিলো তোমার ঘাড়ে। তুমি সফল হয়েছো। নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েও তুমি তোমার আস্থায় অবিচল ছিলে। আদর্শ আর নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হওনি কখনো।
বাবা, আমার মনে আছে- কাকারা বিবাহ করার পরপর আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে যায়। সেদিন তুমি অঝোরে কেঁদেছিলে। আমি তখন থেকে বুঝতে শিখেছি- বিচ্ছেদ মানুষকে কতটা কষ্ট দেয়। আলাদা হবার মত বা নতুন সংসার গড়ার মত তেমন কোন উপাদান তোমার হাতে ছিলো না। তবুও আলাদা সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থার মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে আমাদের মানুষ করেছো। আসলে মানুষের মত মানুষ হতে পেরেছি কিনা সে মাপকাঠি তোমার হাতে। ছয় ভাই-এক বোনের বিশাল সংসারের দায়িত্ব তোমার মত ছাপোষা শিক্ষকের ঘাড়ে।
বাবা, ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি- মায়ের অনেক আব্দার তুমি রক্ষা করতে পারোনি। তখন অনেক তিক্ত কথাও শুনতে হয়েছে তোমাকে। তিক্ততা রিক্ততা টানাপড়েন আর হতাশার গ্লানি নিয়েই কেটে গেছে তোমাদের সুদীর্ঘ দাম্পত্য জীবন। অনেক কষ্টে টেনে-টুনে আজো হাল ধরে আছো সংসারের। সন্তানের চাওয়াগুলো তুমি হাসিমুখে মেনে নিয়েছ। সাধ্যমত চেষ্টা করেছো সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে। তোমার মধ্যে আমি হতাশা দেখেছি তবে তোমাকে অধৈর্য হতে দেখেনি।
বাবা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করতে পারিনি। প্রকাশের কোন সুযোগ বা উপলক্ষও পাইনি। বাবা এখন তুমি আমাদের আনন্দে আনন্দিত হও। আমাদের ব্যথায় ব্যথিত হও। আমাদের আনন্দ-বেদনার সমান অংশীদার তুমি। তুমি বলতে,‘তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ আমি জানিনা, কখনো কিছু করতে পারবো কিনা। তবে যেদিন এমএ শ্রেণির ফলাফল পেয়ে তোমাকে ফোন করেছিলাম, সেদিন তুমি মহাখুশি হয়েছিলে। তোমার ছেলে ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছে- তুমি তা মহল্লার সবাইকে গর্বের সাথে জানিয়েছিলে। এ যেন তোমার বিশাল পাওয়া। বাবা তুমি উপজেলা শহর থেকে চার কেজি মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরেছিলে। আনন্দে সেদিন তোমার চোখের কোণে চিকচিক করছিল আনন্দ অশ্রু।
বাবা, বিশ্বাস করো, আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে তোমার সব ক্লান্তি মুছে দিতে চাই। তুমি শুধু সে অবধি বেঁচে থাক। সৃষ্টিকর্তার কাছে তা-ই প্রার্থনা করি। সৃষ্টিকর্তা যেন আমাকে একটু সুযোগ দেন। আমার জীবনে জন্মদাতা তুমি, আভিভাবক তুমি, এমনকি বন্ধুও তুমি। ঘৃণা যত করেছো তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছো আমায়। যখন কিছু না পারার ব্যর্থতার কারণে আমাকে বকতে; তখন বড্ড রাগ হতো তোমার ওপর। কিন্তু আজ বুঝতে পারি, সন্তানের সফলতায় প্রত্যেক বাবাই গর্বিত হয়। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও।
বাবা, তুমি দীর্ঘজীবী হও। তোমার সুস্থ্যতা সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনায়Ñ
ইতি, তোমার আশির্বাদ প্রত্যাশী।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কালকিনি, মাদারীপুর।
০৯.০৬.২০১৩