:: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ::
“কে বলে তোমায় বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু এ-গায়ে,/ হয়তো তোমারে স্তন্য দিয়াছে সীতাসম সতী মায়ে।’ (-বারাঙ্গনা: কাজী নজরুল ইসলাম।) বিদ্রোহী কবির মৃত্যুদিবসে মাদারীপুরের পতিতাপল্লী উচ্ছেদকল্পে পরিচালিত অমানবিক নিষ্ঠুর অভিযানের সংবাদচিত্র দেখে নজরুলের কবিতার এ দু’টি চরণ মনে এলো। মাদারীপুরের বারাঙ্গনারা বিদেশ থেকে আসেনি, আকাশ থেকেও মাটিতে পড়েনি। উনারা আমাদেরেই মা-বোন। আমাদের বাপ-ভাইরাই উনাদের গ্রাহক। উচ্ছেদ-অভিযান সম্পন্ন করার পর কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি প্রদান না করে অভিযান পরিচালনার পূর্বেই কি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা যেতো না? সরকারের কাছে আবেদন, উনাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হোক। যারা আমাদের মা-বোনদের রক্তাত করেছে, মাদারীপুরের বারাঙ্গনাদের সহায়-সম্পদ লুট করেছে- তাদের শাস্তি দেয়া হোক। মিথ্যে তো নয়। এই সত্য যে, এ আমার পাপ এ তোমার পাপ।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম কবি নির্মলেন্দু গুণ। এমন অগণিত মন্তব্যে ভরে আছে বিভিন্ন মাধ্যম। কেউ কেউ আবার মাদারীপুরের দামাল যুবকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেছেন। দু’শ বছরের কলঙ্ককে উচ্ছেদ করতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। সবই ঠিক ছিল। তবে আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক যৌনকর্মীকে উচ্ছেদ করাটা কোন বাহাদুরি নয়। বরং মানবতার চরম পরাজয়। নারীরা সমাজ থেকে পতিত হয়ে গেলে তারা পতিতা হয়ে যায় ঠিক; কিন্তু পতিত যুবককে বা পুরুষকে কোন অভিধায় সিক্ত করা যায়? পুরুষ শাসিত সমাজে এর কোন সদুত্তর নেই। থাকবেও না।
প্রসঙ্গত বলতে হয়, সম্ভবত প্রায় দু’শ বছর আগে মাদারীপুর বন্দরে ব্যবসায়িদের অবসর কাটাতে বিনোদনের স্বার্থে স্থানীয় প্রভাবশালী জমিদারদের উদ্যোগে পুরানবাজারে নাচ-গানের আয়োজন করা হতো। নাচ-গানের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে নামকরা বাইজিদের আনা হতো। প্রতিরাতে নতুন নতুন মুখ দিয়ে জলসার ঔজ্জ্বল্য বাড়ানো হতো। বাইজিদের কেউ কেউ ধীরে ধীরে স্থায়িভাবে থাকতে শুরু করে এখানে। প্রথম দিকে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলেও আস্তে আস্তে জমি বা বাড়ি কিনে নেয় তারা। সারারাতের নাচ-গানের আড়ালে চলতে থাকে দেহব্যবসা। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে নারী। বাড়তে থাকে পুরুষের আনাগোনা। তখন দূর-দূরান্ত থেকে আগত ব্যবসায়িদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীরাও যুক্ত হতে থাকে। জলসা ঘর রূপান্তরিত হতে থাকে যৌনপল্লিতে। বিগত দু’শ বছরে বহুবার এদের উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন হয়েছে। বিভিন্ন কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
শেষবার গত ২৭ আগস্ট সকাল ১১ টায় দু’শ বছরের সেই যৌনপল্লিতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা হয়। এঘটনার পর জীবন বাঁচাতে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে পাঁচ শতাধিক যৌনকর্মী। ঘটনার সময় নির্বিকার থাকলেও মঙ্গলবার রাতে পুলিশ বাদি হয়ে অজ্ঞাত ২ সহ¯্রাধিক ব্যক্তির নামে সদর থানায় মামলা করেছে। দু’দিনে ঘটনার সাথে জড়িত ১৬ জনকে গ্রেফতার করার দাবিও করেছে পুলিশ। একই রাতে আটটার সময় আন্দোলন পরিচালনাকারী সংগঠন ইসলাহে কওম পরিষদ পুরান বাজারের উত্তরণ ক্লাবে জরুরী সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যৌনপল্লিতে হামলার সাথে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ইসলাহে কওম পরিষদ, মাদারীপুর বণিক সমিতি, সাধারণ ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, গত ১৯ মাস ধরে ইসলাহে কওম পরিষদ মাদারীপুরের যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে উচ্ছেদের আন্দোলন করে আসছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, ইসলাহে কওম পরিষদ যৌনপল্লির নেত্রীদের সাথে একাধিক বৈঠকও করেছেন। এমনকি নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সাথেও কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু যৌনকর্মীরা তাদের অবস্থানে অনড় থাকায় ইসলাহে কওম পরিষদের নেতৃবৃন্দ কঠোর আন্দোলন ও আল্টিমেটাম দেয়। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক মো. নূর-উর-রহমান যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য শহরের গণ্যমান্য বিশজন ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। ২৭ আগস্ট বেলা ১১টায় ওই কমিটির সদস্য মাদারীপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র নুরুল আলম বাবু চৌধুরী, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান খান, বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান মিলন ভূঁইয়া, কাউন্সিলর মো. আক্তার হাওলাদার ও মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার কণাসহ কয়েকজন যৌনকর্মীদের সাথে পুর্নবাসনের ব্যপারে পরামর্শ করতে গেলে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে যৌনকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে হামলা চালিয়ে তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এ খবর দ্রুত পুরান বাজার এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে স্থানীয় লোকজন সঙ্গে নিয়ে যৌনপল্লিতে হামলা চালায়। হামলার সময় ইসলাহে কওম পরিষদের কোন নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিল না বলে সংবাদ সম্মেলনে তারা দাবি করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইসলাহে কওম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আলী আহমেদ চৌধুরী, ইসলাহে কওম পরিষদের নেতা আলহাজ্ব বোরহান উদ্দিন খান, বণিক সমিতির সহ-সভাপতি সায়ীদ খান, সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান মিলন ভূইয়া, পৌর কাউন্সিলর মো. আক্তার হাওলাদার, আওয়ামীলীগ নেতা ইরশাদ হোসন উজ্জ্বল, যুবলীগ নেতা জাহিদুল ইসলামসহ শতাধিক ব্যবসায়ী।
তবে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে অজ্ঞাত ২ সহ¯্রাধিক ব্যক্তিকে আসামী করে একটি মামলা করেছে। গত দু’দিনে নূরে আলম, শহিদুল ইসলাম, সীমান্ত, সুজন, মিরাজ, ফারুক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, আজিজুল হক ও শাহাদাৎ কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেছেন, গ্রেফতারকৃতদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া পরবর্তীতে কোন ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্যে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
যৌনপল্লির নেত্রীবৃন্দ দাবি করেছেন, তারা দু’শ বছর ধরে মাদারীপুর যৌনপল্লিতে বসবাস করে আসছে। এখানকার অধিকাংশ সম্পত্তি তাদের। আর এ সম্পত্তি জবরদখলের জন্যই একটি স্বার্থান্বেষী মহল পায়তারা করে আসছে। গত ১৯ মাস ধরে স্থানীয় ইসলাহে কওম পরিষদ নামের একটি সংগঠন তাদের উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন শুরু করে। এবং যে কোন সময় তাদের উপর হামলা হতে পারে এ আশঙ্কায় পাঁচ শতাধিক যৌনকর্মীর জান-মালের নিরাপত্তা চেয়ে উচ্চতর আদালতে একটি রীট পিটিশন করে। আদালত গত ২২ জুলাই থেকে একবছরের জন্য তাদের নির্বিঘেœ জীবন যাপনের জন্য একটি রুল নিশি জারি করেন। যার অনুলিপি সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইজিপি, মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও মাদারীপুর সদর থানার ওসিকে দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও আকস্মিকভাবে গত ২৭ আগস্ট হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও মারপিট করে যৌনকর্মীদের বের করে দেওয়া হয়েছে। আইনত যা মারাত্মক অপরাধ। আদালতের নির্দেশকে অবমাননা করা হয়েছে। যৌনকর্মী হলেও তারা মানুষ। এবং এ দেশের নাগরিক। এদেশে তাদেরও অধিকার রয়েছে।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার খোন্দকার ফরিদুল ইসলাম বলেছেন, হাইকোর্টের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে তাই হবে। যৌনপল্লিতে হামলা, লুটপাট, উচ্ছেদ ও ভাঙচুরের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু কথা হচ্ছে- যৌনকর্মীরাতো তাদের পল্লিতে নেই। জীবন বাঁচাতে তারা পল্লি ছেড়ে চলে গেছে। উচ্চতর আদালতের নির্দেশ মতে তারা আর একবছরও থাকতে পারলো না। তার আগেই তাদের জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হলো। আন্দোলনকারীরা যৌনকর্মীদের চুলের মুঠি ধরে টেনে হেচড়ে বাইরে নিয়ে আসে। এরপর রাস্তায় ফেলে মারধর করে টাকা-পয়সা, অলঙ্কার ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ইজিবাইকে তুলে দেয়। অনেকেই আবার সবকিছু ফেলে জীবন বাঁচাতে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।
আজ আমরা আমাদের পাপ ঢাকতে উচ্ছেদ করেছি তাদের। অন্ধকারের অতল গহ্বরে ছুড়ে দিয়েছি তাদের। এখন তারা সমাজের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। সমাজ আরো বেশি কলুষিত হবে। যুব সমাজ তথা পুরুষ আরো বেশি বিপথগামী হবে। পক্ষান্তরে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের লালসা চরিতার্থ হবে। মূলত যৌনপল্লির জমি দখলের রাস্তা উন্মোচিত হলো আজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে পতিতাবৃত্তি বন্ধের পক্ষে। তবে সেটা হতে পারতো সহমর্মিতা, ভালোবাসা ও মানবিক উপায়ে। জোর করে একটি মেয়েকে পতিতা বানানো যায়। কিন্তু জোর করে তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা যায় না। যে পুরুষ রাতের অন্ধকারে পতিতার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়। দিনের আলোতে সে তার স্বীকৃতি দিতে চায় না বা পারে না। যারা তাদের উচ্ছেদ করেছে তারা তাদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করলো না কেন?
কবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আমিও বলতে চাই- সরকারের উচিৎ যৌনকর্মীদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ধর্মকে পুঁজি করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে ব্যবহার করে যারা যৌনকর্মীদের রক্তাক্ত করেছে, বারাঙ্গনাদের সহায়-সম্পদ লুট করেছে- তাদের শাস্তি দেয়া হোক। কারণ, ‘এ আমার পাপ এ তোমার পাপ।’
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
০১৭২৫৪৩০৭৬৩
২৮.০৮.২০১৩