শীত কালের একটি উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ খেজুর রস বা গুড়। গ্রামাঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষ মাত্র ২-৩ মাস খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বারো মাসের সাংসারিক খরচ জোগাতে পারেন। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে কিংবা গুড় তৈরি করে এ আয় করা সম্ভব। খন্ডকালীন এ পেশায় যারা নিয়োজিত হন গ্রামবাংলায় তাদের বলা হয় ‘শিউলি বা গাছি’। খেজুর রস বা খেজুর গুড় পরিবারে এনে দিতে পারে সচ্ছলতা। বিস্তারিত জানাচ্ছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।
যা যা প্রয়োজন: রস সংগ্রহ করতে প্রথমত নিজের বা অন্যের খেজুর গাছ নির্বাচন করতে হবে। রসের উপোযোগি গাছ ঝোরতে (পরিস্কার) হবে। এরপর বাঁশের তৈরি ঠুই বা ঠুলি (ঝুড়ি) দরকার। খলা তৈরি করতে দুইটি ছেনদা ও একটি কোপাদা। আবার দা ধারালো রাখতে বালু আর বালিকাচা (সুপারি কাঠ)। কোমড়ে বাঁধতে একটি পাটের চট বা বস্তা। ৫-৬ হাত লম্বা কাছি (রশি)। যা শিউলিকে গাছের সাথে বেঁধে রাখতে সাহায্য করে। ৩ হাত লম্বা একটি বাঁশ, যেটা গাছের ডাল-পালা পরিস্কার করার সময় আড়াআড়ি বেঁধে দাঁড়াতে প্রয়োজন হয়। সবশেষে রস পড়ার উপযোগি খলা তেরি করে বাঁশের নলি(নল) ও দুইটা খিল দিয়ে হাড়ি দিতে হবে।
খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ: বাঙলা কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে গাছের একদিকের কাঁটা ফেলে দিয়ে কিছুদিন বিশ্রামের পর অগ্রহায়নের মাঝামাঝি খলা তৈরি করে রস সংগ্রহ করতে হবে। সংগ্রহ চলবে চৈত্র মাস পর্যন্ত। তবে যে গাছে খেজুর হয়না তাকে বলে ‘চুমুইর্যা’ গাছ। এ গাছের রস সংগ্রহ শুরু করতে হবে অগ্রহায়নের শেষের দিকে। আর সংগ্রহ শেষ হবে মাঘ মাসের শেষের দিকে। যে গাছে খেজুর ধরে তাকে বলে ‘খাজুইর্যা’ গাছ। এ গাছের রস পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংগ্রহ করা যাবে। সপ্তাহের চারদিন বিকেলে গাছ কাটতে হবে। রাতের জমানো রস সকাল বেলা সংগ্রহ করতে হবে। গাছকে অবশ্যই সপ্তাহে ৩ দিন বিশ্রাম দিতে হবে।
যেভাবে তৈরি হয় গুড়: শিউলিরা ইচ্ছা করলে রস দিয়ে গুড় তৈরি করতে পারেন। রস দিয়ে গুড় তৈরি করতে হলে সকালে রস সংগ্রহের পর বাড়ির আঙিনায় স্থায়ী বা অস্থায়ী চতুর্ভূজ আকৃতির বিশেষ চুলার ওপর সিলভারের তাফালে (চতুর্ভূজ আকৃতির পাত্র) আগুনে জাল দিয়ে চিট (আঠাল) হলে ছোট ছোট মাটির গর্তের ওপর কাপড় রেখে কিংবা পরিস্কার প্লেট বা থালায় ফেলে তার ওপর ঢেলে গুড় তৈরি করতে হবে। শক্ত হলে গুড় তুলে নিতে হবে। আকারে ছোট গুড়কে ‘পাটালি’ আর বড় গুড়কে ‘মধুখন্ড’ বলা হয়।
বিক্রি ও আয়: বাজারে এক হাড়ি রস ১০০-১৩০টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন। রস ক্রেতারা সকাল বেলা আপনার বাড়ি এসে নিয়ে যাবেন বা স্থানীয় বাজার থেকেও কিনে নিতে পারবেন। আপনার অধীনে ৩৫-৪০টি গাছ থাকলে আপনি প্রতিদিন ৪০০-৫০০টাকার রস বিক্রি করতে পারবেন। আর বর্তমানে বাজারে খেজুর গুড় বিক্রি করতে পারেন প্রতি কেজি ৮০-১৩০ টাকা দরে। যারা গুড় তৈরি করবেন তারা অন্য শিউলি বা গাছির কাছ থেকে অতিরিক্ত রস কিনে নিতে পারবেন। গুড় বিক্রেতারা স্থানীয় ব্যবসায়ি বা পাইকারের কাছে গুড় বিক্রি করতে পারেন। তবে পাইকারি বিক্রি করলে লাভ একটু কম হবে। তবে হাটে বসে খুচরা বিক্রি করলেই লাভবান হবেন বেশি।
শিউলি বা গাছির কথা: শিউলি বা গাছি আবুল কালাম জানান,‘মোর ৩০টা গাছ মুই কাটি। ভালোই আয় অয়। আরেক জনের গাছ কাটা লাগে না। আরেক জনেরটা কাটলে তারে তিনভাগের একভাগ দেওয়া লাগে। তিন বছর অইলো পোলা দুইডা বিদাশ আছে। অগো টাকা মোর লাগেনা। মোরা খাইয়া-লইয়া ভালোই আছি।’
অথবা: আবুল কালামের সংসার চলে খেজুর রস বিক্রি করে
শীত কালের একটি উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ খেজুর রস বা গুড়। গ্রামাঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষ মাত্র ২-৩ মাস খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বারো মাসের সাংসারিক খরচ জোগাতে পারেন। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে কিংবা গুড় তৈরি করে এ আয় করা সম্ভব। খন্ডকালীন এ পেশায় যারা নিয়োজিত হন গ্রামবাংলায় তাদের বলা হয় ‘শিউলি বা গাছি’। তাই ২০ বছর যাবৎ খেজুর রস সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন আবুল কালাম। দুই ছেলেকে তিন বছর আগে দুবাই পাঠিয়েছেন। কাজ-কর্ম বোঝার পর থেকেই খেজুর গাছ কাটাকে নিজের পেশা হিসাবে নেন তিনি। এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার উত্তর রাজদী কাঠেরপুল গ্রামের শিউলি বা গাছি আবুল কালামের কথা জানাচ্ছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।
‘তেমন কিছু করি না। মাঝে মাঝে মানুষের বাড়ি কামলা খাটি। আর শীতকাল আইলে খাজুর গাছ কাটি। রস বেইচ্যা যা আয় অয় তাতেই হারা বছর পার অইয়া যায়।’ কথাগুলো বললেন আবুল কালাম। তিনি ২০ বছর যাবৎ এ পেশায় যুক্ত রয়েছেন। তার একমাত্র আয়ের উৎস খেজুর রস।
বাঙলা কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে গাছের একদিকের কাটা ফেলে দিয়ে কিছুদিন বিশ্রামের পর অগ্রহায়নের মাঝামাঝি খলা তৈরি করেন। যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে পৌষ মাসের শুরু থেকেই পুরোদমে রস সংগ্রহ করতে থাকেন। এ সংগ্রহ চলে চৈত্র মাস পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে গাছের ধরণ অনুযায়ি দুইটি সময় উল্লেখযোগ্য। আর তা হলো- যে গাছে খেজুর হয় না তাকে বলে ‘চুমুইর্যা’ গাছ। এ গাছের রস সংগ্রহ শুরু করেন অগ্রহায়নের শেষের দিকে। আর সংগ্রহ শেষ হয় মাঘ মাসের শেষের দিকে। যে গাছে খেজুর ধরে তাকে বলে ‘খাজুইর্যা’ গাছ। এ গাছের রস পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংগ্রহ করেন। সপ্তাহে চারদিন বিকেলে গাছ কাটেন। সারারাতের জমানো রস সকাল বেলা সংগ্রহ করে বিক্রি করেন ।
বর্তমান বাজারে এক হাড়ি রস ১০০-১৩০টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেন। রস ক্রেতারা সকাল বেলা তার বাড়ি এসে নিয়ে যায় বা স্থানীয় বাজার থেকেও কিনে নেয়। তার নিজেরই ৩০টি খেজুর গাছ আছে। সপ্তাহে তিন দিন গাছ কাটেন না। বাকি চার দিনে তার দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকার রস বিক্রি হয়। ২-৩ মাস রস বিক্রি করে টাকাটা জমিয়ে রাখেন। শীতকালের ২-৩ মাসের আয়ে তার সারা বছর চলে যায়। এছাড়া মাঝে মাঝে কামলা খাটেন। তার জমানো টাকা ও নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু ধার করে দুই ছেলেকে ৩ বছর আগে দুবাই পাঠিয়েছেন। তবুও ছাড়েননি এ পেশা। খেজুর গাছ কাটা তার নেশায় পরিণত হয়েছে।
আবুল কালাম জানান,‘মোর ৩০টা গাছ মুই কাটি। ভালোই আয় অয়। আরেক জনের গাছ কাটা লাগে না। আরেক জনেরটা কাটলে তারে তিনভাগের একভাগ দেওয়া লাগে। তিন বছর অইলো পোলা দুইডা বিদাশ আছে। অগো টাকা মোর লাগেনা। মোরা খাইয়া-লইয়া ভালোই আছি।’
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, কালকিনি
১৭.০১.২০১৩
০১৭২৫৪৩০৭৬৩