শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

শীতে কাঁপুক মানবতা


সালাহ উদ্দিন মাহমুদ


ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় সম্ভারের অন্যতম উপাদান শীতকাল। পৌষ-মাঘ দুইমাস শীতকাল হিসেবে প্রচলিত হলেও শীতের প্রকোপ থেকে যায় প্রায় চারমাস। শীতের আগমনী বার্তা শোনার সাথে সাথেই জনমনে শুরু হয় কাঁপুনি। সে কাঁপুনি যখন তীব্রতা পায় তখন হয়ে ওঠে দুর্গতি।

শীত নিয়ে মজার মজার ছড়া-কবিতা, গল্প থাকলেও এর দুঃখের সারথি কম নয়। শৈত্যপ্রবাহ যখন মানবপ্রবাহকে স্থীতিমিত করে দেয় তখন আর শীতকে নিয়ে গীত গাওয়ার বাসনা জাগে না। বরং কাঁপা কাঁপা শরীরে কম্পমান কান্নার সুর ভেসে ওঠে।চোখের সামনে ভেসে ওঠে কৃষকের উলঙ্গ শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়া শিশির। কুয়াশাচ্ছন্ন নদীর বুকে দিকভ্রান্ত নাবিকের পাণ্ডুর মুখখানি ভেসে ওঠে চোখের তারায়। কিংবা হেডলাইটের আলোয় যখন কাটে না কুয়াশা; কুয়াশার শক্ত দেয়াল ভেদ করেও দেখতে পায় না অগ্রগামী কিছু। তখন কিইবা করার থাকে। কুয়াশা আর শীতের হাতে সব শপে দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যায় আনন্দ ভ্রমণ।

উচ্চবিত্তরা শীতকে উপভোগ করে। আর নিম্নবিত্তরা শীতকে সহ্য করে। অথচ তোমার পরনের চাদরটা খুলে কাউকে দিতে পেরেছো কি না এ প্রশ্ন কখনোই নিজেকে আমরা করি না। শীতের পথশিশু বা বস্তির অসহায় বৃদ্ধ জানে শীত কাকে বলে। ভ্রাম্যমাণ দেহপসারিনীর শরীরেও উত্তাপ নেই। কম্পমান শরীরে জবুথবু হয়ে তারা বসে থাকে গলির মোড়ে কিংবা পথের ধারে।

আমার কথাগুলোই আসলে রুক্ষ্ম। শীতের সন্ধ্যায় শীতকে জড়িয়ে ভালোবাসতে পারি না। কিংবা সকালে শীতের অলস কম্বলে নিজেকে জড়াতে পারি না। স্নানঘরে কুসুম কুসুম গরম জলের পরিবর্তে তীক্ষ্ম আর তীব্র হাড় কাঁপানো জল ঢেলেই পবিত্র হই। তাতে কোনো আক্ষেপ নেই।

আমি কবিতায় যতোই বলি-
সোনা বউ, বড্ড বেশি শীত পড়েছে,
এবার একটু আয় না কাছে
আর কতকাল দূরে থেকে কষ্ট দিবি,
একলা শুয়ে হাড়কাঁপানো রাত কাটাবি? (তোর জন্য শীতকাব্য)
স্বপ্নের সোনাবউ স্বপ্নই থেকে যায়। কম্বল কেনার সম্বলও যার কাছে নেই তার আবার শীতের রাতে সোনাবউ খোঁজার তাগিদ কীসের?

তবু শীত আসে শীত চলে যায়- কেবল কেঁপে যায় মানবতা। আমরা না হয় মধ্যবিত্ত। শীতের সাথে লড়াই করে হরহামেশা দিব্যি সুখে বেঁচে আছি। শরীর আমার শীতে কাঁপে না। তবে  যারা নিম্নবিত্ত, উদ্বাস্তু, পথশিশু, ফুটপাতের রাজা তাদের জন্য হৃদয় কাঁপে।

আসুন ওদের সেই কাঁপাকাঁপি বন্ধ করতে আমরা এগিয়ে যাই। এই শীতে আমাদের মানবতা কেঁপে উঠুক। শীতার্তের পাশে দাঁড়াবার সৌভাগ্য রচনা করি নিজের হাতেই। কেন নয়- আমরা কি মানুষ নই? আমাদের যেমন মিষ্টি মধুর শীত আছে, ওদের না হয় হাড় কাঁপানো কষ্ট আছে।

মিথিলা এখনো কানামাছি খেলে


সালাহ উদ্দিন মাহমুদ


মিথিলাকে যখন প্রথম পছন্দ হয়, তখন ওর কানামাছি খেলার বয়স। চঞ্চল, উচ্ছ্বল, বাকপটু সর্বোপরি মন হরণ করার যাবতীয় গুণাবলী ওর মধ্যে বিদ্যমান। একটি বালিকাকে কখনোই ‘ভালোবাসি’ বলা যায় না বলে বলতে পারি অনেক পছন্দ করি। ভবিষ্যতে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার ব্যগ্র বাসনা লালন করি।

সেই কানামাছি খেলবার বয়সেই মিথিলা আমার থিয়েটারে যুক্ত হয়। মিথিলা ছোটবেলা থেকেই নৃত্যকলায় পারদর্শী। বিশ্বাস ছিলো- অভিনয়টা ভালোই করবে। মঞ্চে বালিকা বয়সে জীবনের প্রথম আমার স্ত্রীর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলো। তারপর আমার প্রেমিকা চরিত্রেও সাবলিল অভিনয় দেখেছি ওর। কিন্তু কখনোই আমার বোন চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হয়নি। ওর অভিনয় দর্শককে যতটা মুগ্ধ করেছে তার চেয়ে বেশি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে আমার জীবনে।

বালিকা থেকে যখন কিশোরী হলো- আমার প্রতি ওর টানটাও অনুভব করতে লাগলাম। আমি বলি না সংকোচে। মিথিলা বলে না ভয়ে। যদি ফিরিয়ে দেই। আমি ভাবি যদি বাসায় বলে দেয়। তাহলে বড্ড কেলেংকারি হয়ে যাবে যে।

সব দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে কিশোরীর হৃদয়ে সেদিন পুলক লেগেছিলো। লাজুক মুখখানি রক্তিম হয়ে উঠেছিলো। কম্পমান কণ্ঠে একটাই জিজ্ঞাসা- ‘এ কি সত্যি? নাকি ক্ষণিকের আবেগ।’ মিথিলার কিশোরী হৃদয় থেকে পাওয়া শুচি শুভ্র ভালোবাসা আর কোনো বাঁধাকে পরোয়া করেনি।

মাঝখানে বিচ্ছিন্ন সময় গেছে দেড়বছর। হয়ত মিথিলা আমার কথা ভাবতে ভাবতে বিকেলে কানামাছি খেলে কাটিয়ে দিয়েছে এই সময়গুলো। কখনো সকালে কিংবা রাতে ফোন এসেছে। আমি দুর্ব্যবহার করেছি। ভুল বোঝাবোঝি ওকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলো। এমনকি কঠিন ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবনের মায়াই ত্যাগ করতে বসেছিলো। তবে সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়া গেলেও মাধ্যমিক পরীক্ষায় আশানুরূপ সফলতা আসেনি।

এতেও মিথিলার কষ্ট ছিলো না। কষ্টটা দানা বেঁধেছিলো আমার জন্য। আমি কবে ফিরে যাবো মিথিলার বুকে। মিথিলার গুমড়ে ওঠা কান্না আমাকে প্রতিনিয়ত অপরাধী করে দিচ্ছিল। মিথিলা ভুলে যাচ্ছিলো তার কানামাছির কথা। আমার অপেক্ষায় ওর কানামাছি অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলো, যেন আর ফিরে পাওয়ার নয়। এতটুকু এক জীবনে এত দুঃখ মিথিলা সইবে কী করে? আমিই তো পারি ফিরিয়ে দিতে- ওর সুখ, হাসি, উচ্ছ্বলতা আর শেষ বিকেলের কানামাছি খেলা। অবশেষে তাই করলাম। ফিরিয়ে দিলাম সব।

বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে ষোড়শী, ষোড়শী থেকে অষ্টাদশী। এরই মধ্যে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। মিথিলা তখনো ভুলতে পারেনি তার কানামাছি। বাড়িতে খেলারসঙ্গী নিশি, শান্তা, তমা, ইশিতা, অহনা, শ্রাবণী সবাই যেন ধীরে ধীরে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় নতুন ঠিকানায়। ক্রমশই কমতে থাকে মিথিলার কানামাছির সঙ্গী। আবার নতুন সঙ্গী খুঁজে নেয়।

একদিকে ভালোবাসা, একদিকে কানামাছি। দু’টোকেই ভালোবাসে সে। প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসা। আমার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বিকেলে বলে ওঠে- ‘ওরা খেলছে, আমি খেলতে যাই?’ আমি হাসি। মিথিলাকে ফেরানো যাবে না। যেতে না দিলে গোমড়া মুখে বসে থাকবে। সন্ধ্যাটাই মাটি হবে ওর। পড়তেও বসবে না। তাই আর আটকাই না। কখনো ফোনে না পেলে ছোট্ট ক্ষুদেবার্তায় জানায়- ‘আমি খেলতে গেলাম। এসে ফোন দেবো।’

পরিবারের সবার ছোট বলে অতি আদরের মিথিলা। অভাব কাকে বলে বুঝতে দেয়নি বাবা, মা, ভাই, বোন কেউই। প্রায় সব আব্দারই রক্ষা করেছে তারা। শুধু আমাকে ভালোবাসতেই তাদের যত আপত্তি। ভাবা যায়, ‘এইটুকুন একটা মেয়ে প্রেম করতে পারে? এসব ঐ বজ্জাত ছেলেটার কাজ। ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মিথিলার মাথাটা নষ্ট করে দিয়েছে।’

এমন হাস্যোজ্জ্বল মিথিলা কেমন যেন মিইয়ে যেতে লাগলো। বকুনি, গালমন্দ, মারধর কম যায়নি মিথিলার ওপর দিয়ে। তবুও নাছোড়বান্দা মিথিলা। বয়সে নবীন হলেও ভালোবাসায় সে প্রবীণকে হার মানায়। এককথার কিংবা একরোখা টাইপের মানুষ। এই ভালোবাসার শেষ ও দেখেই ছাড়বে। জয় করবে সবার হৃদয়। আমাকে বলতো, ‘তুমি ভেবো না। সময় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি প্রতিষ্ঠিত হলেই সবাই মেনে নেবে।’

মাঝে মাঝে প্রচণ্ড মার খেতো। খবর পেতাম ওর প্রতিবেশিদের কাছে। এত মার খেয়েও আমাকে ফোন দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে যেত। ফোন দিয়েই বলতো, ‘জানো আজ অনেক মেরেছে ভাইয়া। কিন্তু ব্যথা লাগেনি। যতই মারে, আমার কেবল হাসি পায়। জানো পিঠটা না অনেক ফুলে গেছে। বলো, আমি ছোট মানুষ না। ছোট মানুষকে কেউ এতো মারে।’ আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারতাম না। কিন্তু মিথিলা সাবলিল ভাবে বলেই যাচ্ছে। যদি আমি বলি, ‘এত কষ্ট পাও, তবে আমাকে ভুলে যেতে পারো না?’ মিথিলা এবার কাঁদে, ‘ একথা বললে তুমিই আমাকে মেরে ফেল।’ বাধভাঙা কান্নার তোড়ে ভেসে যায় ফোন। ওর ধার করা ফোনটা চেয়ে নিয়ে যায় ফোনের মালিক। আমি অসহায় প্রেমিকের মতো দেয়ালে মাথাকুটি। কিন্তু তখন জানতে পারিনি মিথিলা তার প্রিয় কানামাছি খেলেছে কিনা প্রতিনিয়ত।

ভালো বাসতে বাসতে কখন যে কেটে গেছে সাতটি বছর। মিথিলা এখন কলেজে পড়ে। নিদারুন যন্ত্রণা সয়ে সয়েও জিইয়ে রেখেছিলো ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাই এখন মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। আর কোনো বাঁধা নেই। মিথিলার মনে-প্রাণে কেবলই জয়োল্লাস। মিথিলা তার কথা রেখেছে। স্বপ্ন পূরণ করেছে। ভালোবাসার মধুর পরিণতিতে নিয়ে গেছে।

পরে জেনেছি- শৈশবের লালন করা প্রিয় বৈকালিক খেলা বিগত সাত বছরেও ছাড়তে পারেনি মিথিলা। কিন্তু সে কখনোই আমার সাথে কানামছি খেলেনি। চোখের আড়ালে গেলেও মনের আড়াল করেনি। মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি। আমি কেন ওর একটি ইচ্ছেকে গলাটিপে হত্যা করবো।

দীর্ঘ সাত বছরের রোমান্টিক অধ্যায়ের ইতি টানতে চলেছি আমরা। আজ মিথিলা- আমার শুভবিবাহ। সারাদিনে বিবাহসংক্রান্ত ঝামেলা শেষে মিথিলা ও আমি আমার শয়নকক্ষে। সহজ ভাষায় বলা যায় বাসর ঘরে। বিকেলের নরম আলোয় বাহিরে শিশুদের চেচামেচি শোনা যায়। ওরা কানামাছি খেলছে। মিথিলা আমার দিকে তাকায়। মিথিলা বলে, ‘আমি খেলতে যাবো?’ ‘কেউ কিছু বলে কিনা।’ বলে এদিক-ওদিক তাকাই। ইশারায় বললাম, ‘যাও’।

মিথিলা কানামাছির দলের কাছে যেতেই সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। বউ এসছে, বউ এসেছে। ভেতর থেকে মা উঁকি দিলেন। ‘একি বউমা বাইরে কেন?’ মিথিলা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কানামাছি খেলছিলো ওরা।’ অবাক জিজ্ঞাসা মায়ের, ‘তাতে তোমার কী? যাও যাও ভিতরে যাও।’

মিথিলা কিছু না বলে সোজা চলে এলো রুমে। ঝাপিয়ে পড়লো আমার বুকের ওপর। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। আমি উঠে দাঁড়াই। বলি, ‘চলো আমরা দু’জন কানামাছি খেলবো।’ বলেই মিথিলার চোখ বেঁধে দিলাম। মিথিলা অন্ধকারে তার এতবছরের জমানো ভালোবাসা হাতরে বেড়ায়। আমি বলতে থাকি- ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ…।’

মধ্যবাড্ডা, ঢাকা।