বুধবার, ৬ মার্চ, ২০১৩

স্বপ্ন ও দ্রোহের নাটক’:



নাট্যকার: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
নির্দেশনায়: আ জ ম কামাল

পরিবেশনায়: কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ
ব্যবস্থাপনায়: জেলা শিল্পকলা একাডেমী, মাদারীপুর
আয়োজনে: বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী

চরিত্র:
১.    বৈচাপাগল
২.    খান সাহেব
৩.    দাদি
৪.    আসিফ
৫.    ফ্যাচাং আলী
৬.    দারোগা
৭.    পুলিশ-১
৮.    পুলিশ-২
৯.    মেজর
১০.    পাক সৈন্য-১
১১.    পাক সৈন্য-২
১২.     বৈচাপাগলের বাবা
১৩.     বৈচাপাগলের মা
১৪.     বৈচাপাগরের বোন
১৫.     মুক্তিযোদ্ধা-১
১৬.    মুক্তিযোদ্ধা-২
১৭.     কতিপয় প্রতিবেশি
১৮.     কতিপয় বালক-বালিকা


প্রথম দৃশ্য:

‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানের সাথে সাথে মঞ্চে আলো জ্বলে উঠবে। দু’ জন কৃষক জমিতে যায়। একজন বাজার করে বাড়ি ফেরে। তিন-চারটি ছেলে-মেয়ে কানামাছি খেলবে। চোখ বাধা মেয়েটিকে রেখে অন্যরা পালাবে। এসময় খান সাহেবের নাতি আসিফ বহু বছর পর গ্রামের মাটিতে পা রাখে। কাধে ও হাতে একটি করে ব্যাগ। হাতের ব্যাগটা রাখে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বিস্ময়ে হা- হয়ে থাকবে। দাদু বাড়িটা খোঁজে। মেয়েটা আসিফকে ধরে ফেলে। চোখ খুলে অবাক হয়Ñ
মেয়ে: এই মিয়া আপনে ক্যাডা? কইত্তোন আইছেন?
আসিফ: আমি খান সাহেবের নাতি। ঢাকা থেকে আসছি।
মেয়ে: (লজ্জা পেয়ে) ও আপনে...।
আসিফ: আমি আসিফ। বহু বছর পর এসেছি। আচ্ছা, আমার দাদু বাড়িটাতো এদিকেই তাই না?
মেয়ে: হ, একটু আগায়া যাইতে অইবো। লন, আমি আপনারে লইয়া যাই। (দু’জন চলে যায়।)
আসিফ এসে দাদা-দাদিকে ডাকতে থাকেÑ
আসিফ: দাদা, দাদা তুমি কোথায়?
(খান সাহেব বেরিয়ে আসেন)
খান সাহেব: (চশমাটা চোখে দিয়ে) আরে আসিফ দাদু ভাই যে। আমি স্বপন দেখতাছি নাতো। (হাতে চিমটি কেটে) না, সত্যিই তো আমার নাতি আইছে। বহু বছর পর আইলা। আমাগো মনে অয় ভুইল্যাই গ্যাছো?
আসিফ: না দাদা, তা নয়। তাছাড়া তোমাদের ভুলবো কেন? আমার শেকড়তো এখানেই। শেকড়ে টান পড়লো- তাই চলে এলাম। আচ্ছা দাদীকে দেখছি না। দাদী কোথায়?
খান সাহেব: কৈ গো, কৈ গ্যালা? আরে দেইক্যা যাও কেডা আইছে।
(তড়িগড়ি করে দাদী আসে।)
দাদি: (আঁচল দিয়ে হাত- মুখ মুছতে মুছতে) আরে দাদু ভাইযে, কী সৌভাগ্য আমার। থালা-বাসন ধুইতে গিয়া হাত থেইক্যা যহন পইরা গ্যাছে, তহনই মনে মনে কইছিলাম ঘরে মেহমান আইব। তা দাদু ভাই, তোমার আইতে কোন কষ্ট অয় নাই তো।
আসিফ: না কোন কষ্ট হয় নি। তা এখন বলো, তোমরা কেমন আছ?
খান সাহেব: আমরা ভালো আছি।
দাদি: তা আসিফ, তোমার বাবা- মা ক্যামন আছে?
আসিফ: আব্বু- আম্মু ভালো আছে। ও ভালো কথা, আব্বু বলছিল...। আচ্ছা দাদু, আমাদের বাড়িতে একটা পাগল আছে না। কি যেন নাম?
খান সাহেব: (শুকনো মুখে) বৈচাপাগল। সারা রাইত খালি চিল্লায় আর দিনের বেলা ঘুমায়। ব্যাটা বদের হাড্ডি।
আসিফ: হ্যা, বৈচাপাগল। তা ওনার কি খবর?
খান সাহেব: আহা, বাদ দাও তো ওর কতা। শোন দাদু ভাই, ভুলেও ঐ পাগলের কাছে যাইবা না। যাও তুমি ভিতরে যাও। আগে জিরায়া লও, তারপর কতা। আমি এই ফাকে একটু বাজার থেইক্যা আহি। (এদিক-ওদিক তাকিয়ে) কইরে ফ্যাচাং, কই গেলি? (ফ্যাচাং দৌঁড়ে আসে)
ফ্যাচাং: (হন্তদন্ত হয়ে) খানসাব ডাকছেন?
খান সাহেব: ল, বাজারে যাই। দেহস না আমার শরীক আইছে। ভালো-মন্দ বাজার করতে অইবো তো। (সবাই হেসে ওঠে। খান সাহেব ও ফ্যাচাং আলী চলে যায়)
দাদি: চলো ভাই, ভেতরে চলো। তোমার দাদা বাজার থিক্যা তোমার লাইগ্যা ভাল-মন্দ কিছু নিয়া আসুক।
আসিফ: চলো। ( চলে যায়।)
(বাজারের ব্যাগ হাতে ফ্যাচাং পিছন পিছন হাটে।)
খান সাহেব: বুঝলি ফ্যাচাং।
ফ্যাচাং: না কইলে বুঝমু ক্যামনে?
খান সাহেব: তাইতো কই। হোন, বৈচাপাগলের ব্যাপারে আসিফরে কিচ্ছু কওন দরকার নাই। বুঝলি। কারণ হুনছি ও নাকি সাংবাদিকতা করে।
ফ্যাচাং: ওরে বাবা, খানসাব সাংঘাতিক আবার কি!
খান সাহেব: আরে সাংঘাতিক না, সাংবাদিক। বিয়ানে যেই পত্রিকা আহে না। ওগুলাতে অরা ল্যাহে। কারো বিরুদ্ধে ল্যাকলে হ্যার বারোটা বাইজ্যা যায়। হোন, পাগলের ব্যাপারে তোরে কিছু জিগাইলে কবি- তুই কিছু জানছ না।
ফ্যাচাং: খানসাব, হঠাৎ কইরা আপনে পাগল সম্পর্কে সজাগ অইলেন ক্যান?
খান সাহেব: দ্যাশে ওইযে কি বিচার-ফিচার শুরু অইছে। হুজুরগো আটকাইতাছে।
ফ্যাচাং: হুজুরগো না, রাজাকারগো।
খান সাহেব: আরে একটা অইলেই অইলো। আমার ক্যান জানি সন্দেহ অইতাছে। আর ও আইসাই যে পাগলের কতা জিগাইল। যদি কেউচ্যা খোড়তে গিয়া যদি সাপ বাইর করে।
ফ্যাচাং: ক্যান হুজুর, পাগলের ঘরে কি সাপ আছে?
খান সাহেব: আরে গাধা, এতো বছর ধইরা আমার লগে আছস, এহনো চালাক অইলি না। বলদই রইয়া গেলি। ক্যান মনে নাই, গন্ডগোলের সময় আকাম-কুকাম কী কম করছোস?
ফ্যাচাং: উঁ, আমি কি আকাম করছি। তহনও কামলা আছিলাম এহনও কামরাই রইয়া গেলাম। চালাক অইলে কি আর আপনের কামলা খাটতাম? তাইলে তো কবেই এমপি-মিনিস্টার অইয়া যাইতাম। আর তহন যা করছি সব তো আপনের কতায়।
খান সাহেব: রসিকতা বাদদে। চুপ কর। বাতাসেরও কান আছে। হাটের কাছে আইয়া পড়ছি। (প্রস্থান)

দ্বিতীয় দৃশ্য:

(বৈচা শিকল ছিড়ে বেরিয়ে আসে। বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করতে করতে মঞ্চের এক কোনে গিয়ে ওৎ পেতে থাকে। এমন সময় খান সাহেব ও ফ্যাচাং আলী আসে। সুযোগ পেয়ে খান সাহেবকে ঝাপটে ধরে চিৎকার করে। ফ্যাচাং আলী দৌঁড়ে পালায়।)
বৈচাপাগল: আইজ খাইছি তোরে। তুই রাজাকার। তুই দ্যাশের শত্র“। তুই আমার সব কাইরা নিয়া আমারে পাগল বানাইয়া রাখছোস। তোরে আমি খুন করুম। তোর বাইচ্যা থাকনের কোন অধিকার নাই। তুই পাকিস্তানি খান কুত্তাগো পাও-চাডা গোলাম। ইয়াহিয়া খার দোসর। তুই আমার সব কাইরা নিছোস। তোরে আমি আইজ...।
(ফ্যাচাং দুইজন প্রতিবেশি ও আসিফকে সাথে নিয়ে এসে খান সাহেবকে উদ্ধার করে। বৈচাপাগলকে আরো মোটা ও শক্ত শিকল দিয়ে বেধে রাখে। খান সাহেব হাপাতে হাপাতে সকলের উদ্দেশ্যে বলে)
খান সাহেব: কি করুম কন? চল্লিশ বছর ধইরা পাগলডারে লইয়া আছি মহা ঝামেলায়। মানবতার খাতিরে নিজের বাড়িতে জায়গা দিছি। মনে অইতাছে খাল কাইট্টা কুমির আনছি। কেডা কইছিলো অরে যুদ্ধে যাইতে।
প্রতিবেশি: কি করবেন খানসাব? পাগল মানুষ। কহন কি কয় নিজেও জানে না। পাঞ্জাবি-টুপি দ্যাকলেই চিক্কর দেয়।
খান সাহেব: নিয়া যাও অরে। শক্ত আর মোটা ছেকল দিয়া বাইন্ধা রাহো।
(প্রতিবেশিরা বৈচাকে নিয়ে চলে যায়। আসিফ দাদুকে জিজ্ঞাসা করে)
আসিফ: আচ্ছা দাদু, বৈচাপাগল আসলে কে?
খান সাহেব: বৈচাপাগল আসলে জাতে হিন্দু। নাম আছিল বৈচিন্ত্য মন্ডল। বাপের নাম শুকলাল মন্ডল। বৈচা নামে ডাকে সবাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সব হারায়া মাথা খারাপ হইয়া গ্যাছে। তাই তারে শিকল দিয়া বাঁইন্ধা একটা ঘরে আটকাইয়া রাখতে হয়। যাতে পাগলামি কইরা মাইনষের ক্ষতি করতে না পারে। তোমার দাদি তিনবেলা খাবার দিয়া আসে। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। এত এত ভালো মানুষ মরে কিন্তু পাগলটা মরেও না।
আসিফ: ও তাই। চিকিৎসা করলে ভালো হতো কি না।
খান সাহেব: হ, কেডা কইছে তোমারে? অর পিছে বেহুদা পয়সা ঢালবো কেডা? তোমারা তো বাড়ি থাহো না। আইছ বহু বছর পর। দুইদিন পর আবার চইল্যা যাবা। বাদ দাও এইসব। তুমি ঘরে যাও। আমি হাত-মুখটা ধুইয়া আসি।
আসিফ: ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি এসো।
(দু’জন চলে যায়)

তৃতীয় দৃশ্য:

গভীর রাত। নিঝুম নিস্তব্ধতা। কোথাও কেউ জেগে নেই। বৈচাপাগল রাত্রির নিরবতা ভেঙ্গে মাঝ রাতে হঠাৎ গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠে-‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে...।’ গান থামিয়ে বলেÑ
বৈচাপাগল: ছাইড়া দে, আমারে ছাইড়া দে। সাহস থাকলে একবার ছাইড়া দিয়া দ্যাক। তোর আল্লার দোহাই, আমার ভগবানের দিব্যি। একবার ছাইড়া দে। আমি আমার বাপ-মা আর বৈনরে ফিরায়া আনতে চাই। খান কুত্তার বাচ্চার রক্ত দিয়া গোসল করতে চাই... ...। দ্যাশটারে স্বাধীন করার লাইগ্যা যুদ্ধে গেছিলাম। নয় মাস যুদ্ধ কইরা কি পাইলাম? বুড়া বাপ-মা, আদরের ছোট বোন, সহায় সম্পত্তি সব হারাইলাম। দ্যাশ আমারে কি দিছে? কিছুই দেয় নাই। খানসাব আমার সব কাইরা নিছে। ক্যান ৭১ সালে আমি যুদ্ধে গেছিলাম। ক্যান এই হাতে অস্ত্র নিছিলাম... ...।
(গোলাগুলির শব্দ। মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদারের মধ্যে যুদ্ধের দৃশ্য। ফ্ল্যাশব্যাক)
দ্যাশ স্বাধীন অইলো। আমি বাড়ি ফিইরা আইলাম। খানসাব আমারে ডাইকা কয়- বৈচারে তুই আইছোস ভালোই অইছে। তোর বৈনেরে পাকবাহিনী তুইল্যা নিয়া গ্যাছে। দুঃখ-কষ্ট আর ভয়ে তোর বাপ-মা সব বেইচ্যা ইন্ডিয়া চইল্যা গ্যাছে। খান সাব বুকে টাইন্যা নিয়া কয়- সব গ্যাছে তো কি অইছে? আমিতো আছি। হ আছে, খানসাবতো আছে। খালি আমার কিছু নাই। কতদিন বুক ভাসায়া কানছি। ভগবানরে ডাকছি। চোউখের পানি হুগায়া চর পড়ছে। এহোন আর কান্দিনা। ভগবানরে ডাইক্যা হয়রান অইছি। এহোন আর ডাকিনা। ঐ কুত্তার বাচ্চায় কয়Ñ আমার বাপে যাওয়ার আগে নাকি সব বেইচ্যা দিয়া গ্যাছে। আমারে করুণা করোছ। আরে তুইতো একটা রাজাকার। একটা দেশদ্রোহী রাজাকার একজন মুক্তিযোদ্ধারে কী করুণা করবো ক? হা.. হা.. হা..। অস্ত্র জমা দিছি। ট্রেনিং জমা দেই নাই। একবার ছাইড়া দে। তোর রক্ত দিয়া গোসল করুম।
(প্রবেশ করে আসিফ। পায়ের আওয়াজে বৈচাপাগল থামে। তাকায় আসিফের দিকে। শরীরের ঝাঁকিতে শিকলের ঝনঝন আওয়াজ শোনা যায়। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ায় সে। পাগল এগিয়ে আসতে চাইলে শিকলে টান পড়ে। বৈচাপাগল প্রশ্ন করে।)
বৈচাপাগল: ক্যাডা, ক্যাডা তুই?
আসিফ: আমি.. ।
বৈচাপাগল: আমি ক্যাডা, নাম নাই।
আসিফ: আমি আসিফ।
বৈচাপাগল: আসলে তুই ক্যাডা?
আসিফ: আমি খান সাহেবের নাতি।
বৈচাপাগল: ও তুই বেঈমান রাজাকারের নাতি।
বৈচাপাগল: এতো রাইতে এইহানে ক্যান আইছোস?
আসিফ: জানতে এসেছি, আপনার এ অবস্থা কেন?
বৈচাপাগল: তুমি হালারপুত কই থাহো? দ্যাশের খবর কিছু রাহোনা। আন্ধারে আইছোস ক্যান? খানসাব পাডাইছে তোরে?
আসিফ: না, আমিই এসেছি। (বলতে বলতে মোবাইলের লাইট অন করে।)
বৈচাপাগল: ক্যান আইছোস?
আসিফ: আপনার সাথে কথা বলতে।
বৈচাপাগল: আমার লগে তোর কি কতা?
আসিফ: মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী শুনবো।
বৈচাপাগল: না, না। রাইতের বেলা কওন যাইবো না। ওই দ্যাক পাকবাহিনী আইতাছে। রক্তের ঢেউ আইতাছে। রক্তের জোয়ারে ভাইসা যাবি। চইল্যা যা। ভাটির সময় আইবি। আমারে একলা থাকতে দে। (বৈচাপাগল চুপ করে। কোন কথা নেই। আসিফ বের হয়ে যায়। আলো নিভে যাবে।)

চতুর্থ দৃশ্য:

সকাল বেলা উঠান ঝাড়– দিচ্ছে দাদি। চুপিসারে দাদির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় আসিফ।
আসিফ: দাদি ও দাদি।
দাদি: (ঝাড়– রেখে হাত মুছতে মুছতে) কি দাদাভাই?
আসিফ: দাদা কোথায়?
দাদি: তোমার দাদাতো বাজারে গ্যাছে। তুমি নাস্তা করবা না দাদু।
আসিফ: করবো, তার আগে গোসলটা সেরে আসি।
দাদি: তাইলে যাও, গোসলখানায় পানি দেওয়া আছে।
আসিফ: না, গোসলখানায় যাবনা। আমি নদীতে গোসল করব।
দাদি: দ্যাহো দেহি, এইয়া কয় কী? ইদীতে গোসল করলে ঠান্ডা লাইগ্যা যাইবো। জ্বর-জারি অইবো তো।
আসিফ: না, আমার কিচছু হবে না। ইস্ নদীর এরকম নির্মল ঠান্ডা পানি কতদিন ছুঁই না। লঞ্চে আসতে আসতে মনে হয়েছিল নদীতে ঝাপ দেই।
দাদী: ও খোদা এয়া কয় কী?
আসিফ: আমার কি ইচ্ছে হয় জান দাদী?
দাদী: কি ইচ্ছে হয়?
আসিফ: ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়ত মানুষ নয়Ñ হয়তোবা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়;
হয়তোবা হাঁস হবোÑ কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারাদিন কেটে যাবে কল্মীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেড়া পাল-এ
ডিঙা বায়, রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।’
-কী দাদু কিছু বুঝলে?
দাদি: (সম্বিৎ ফিরে পেয়ে) কি কও না কও কিছুই বুঝিনা। কি কাক-শালিক অইবা। কই শেখছো এইসব।
আসিফ: বই পড়ে।
দাদী: তোমরা শিক্ষিত পোলাপান। কলেজে পড়, পত্রিকায় কাম কর। আমি অতশত বুঝি না। তয়, তুমি একবার ক্যান? তুমি বারবার আইবা। এই সব কিছুতো তোমারি। আমরা বুড়া-বুড়ি আর বাচুম কয়দিন?
আসিফ: এগুলো আমার কথা নয় দাদী।
দাদী: কার কতা?
আসিফ: কবি জীবনানন্দ দাশের কথা।
দাদী: হেইডা আবার কেডা?
আসিফ: আমাদের রূপসী বাংলার কবি।
দাদী: জীবনানন্দ কেডা আমি চিনি না। ঐসব হিন্দু মানুষ আমার চিইন্যা কাম নাই। (লজ্জিত মুখে) আমি খালি চিনি তোমার দাদারে। বাদ দাও এইসব। ঠিক আছে তুমি গোসল করতে যাও। তয়, তাড়াতাড়ি আইসো। আমি রান্নাঘরে গ্যালাম।
(দাদী চলে যায়। আসিফ হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়।)

পঞ্চম দৃশ্য:

(আসিফ বৈচার ঘরে উঁকি দেয়। দরজা খোলা। বৈচাপাগল বসে বসে মাটি খুড়ছে।)
বৈচাপাগল: এই মাটির তলে তোরে জ্যান্ত কবর দিমু।
আসিফ: কি করছেন আপনি?
বৈচাপাগল: ক্যাডা তুই? (মাথা তুলে তাকায়)
আসিফ: ঐ যে, রাত্রে আসছিলাম।
বৈচাপাগল: ও গল্প শুনতে চাস? যুদ্ধের গল্প।
আসিফ: হ্যা যুদ্ধের গল্প। আপনার জীবনের গল্প।
বৈচাপাগল: যুদ্ধের কাহিনী শুইনা তুই কি করবি? আর আমার কাহিনীর কতা কস? আমি একটা জিন্দা লাশ। আমার কাহিনী কী শুনবি? কঅ। পারবি আমার বাপ-মা, আদরের বৈনডারে ফিরায়া দিতে? পারবি আমার জমি-জমা ফিরায়া দিতে? পারবি না।
আসিফ: তা হয়তো পারবো না।
বৈচাপাগল: তয় ক্যান শুনতে চাস? ক্যান কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে চাস?
আসিফ: আমিতো যুদ্ধ দেখিনি, তাই শুনতে ইচ্ছে হয়।
বৈচাপাগল: ক্যান, তোর দাদায় কয় না। একাত্তরে সে কি করছে। কয়ডা ঘর-বাড়ি পোড়াইছে। কয়ডা হিন্দু পরিবাররে ঘর ছাড়া করছে। কয়ডা যুবতি মাইয়া, পরের বউ লইয়া তামাশা করছে। কয় না, কয় না তোর কাছে।
আসিফ: কী বলছেন আপনি। কোন প্রমাণ আছে আপনার কাছে।
বৈচাপাগল: চুপ! একদম চুপ! কোন কতা কবি না। তুই কি বিশ্বাস করবি। তোর গায়ে তো বেঈমানের রক্ত।  নরপিশাচের রক্ত। তোর আল্লা সাক্ষী, আমার ভগবান সাক্ষী।
আসিফ: সবাই আপনাকে পাগল বললেও আপনাকে তো পাগল মনে হয় না।
বৈচাপাগল: হা.. হা.. হা..। আমি পাগল? আমি পাগল না। আমারে পাগল বানাইছে তোর দাদা। উচিৎ কতা কইলেই সবাই পাগল কয়। আমি পাগল সাইজা মাটি কামড়াইয়া পইড়া আছি। পাগলের ভান ধরছি। যাতে স্বাধীন দেশে বাপ-দাদার মাটিতে শুইয়া একটু নিঃশ্বাস নিতে পারি।
আসিফ: কী বলছেন আপনি?
বৈচাপাগল: হ, ঠিকই কইতাছি। ৭১ সালে দ্যাশে যুদ্ধ শুরু অইয়া গ্যালো। পঁচিশ মার্চ কাল রাইতে পাকবাহিনী ঝাপায়া পড়লো বাঙালির ওপর। আমরাও অস্ত্র তুইলা নিলাম হাতে। বুড়া বাপ-মা আর বৈনডারে রাইখ্যা যুদ্ধে গেলাম... ...।
(ফ্ল্যাশব্যাক: বৈচার বাড়িতে পাকবাহিনীর মেজর, পাকসেনা, খান সাহেব, ফ্যাচাং আলীসহ কয়েকজন। বাবা-মার সামনে বৈচার বোনকে নির্যাতনের দৃশ্য। অট্টহাসি..।)
না.. না..। নয় মাস যুদ্ধ অইল। ১৬ই ডিসেম্বর দ্যাশ স্বাধীন অইল। চাইর দিন পর বাড়ি আইলাম। অইয়া দেহি আমার সব শ্যাষ। বাপ-মা, বৈন কেউ নাই। শূন্য ঘর। তোর দাদার কাছে হোনলাম- বাপ-মা ভারত চইল্যা গ্যাছে। বৈনডারে পাকবাহিনী তুইল্যা নিয়া গ্যাছে। বৈনের খোঁজে বাইর হইলাম। কোতাও পাইলাম না। এমনকি লাশটাও না। কয়েকদিন পর বাড়ি আইলাম। ঠিক তহন মাথায় আকাশ ভাইঙা পড়লো। সারা দুনিয়া আন্ধার অইয়া আইল। (বৈচা থামে। বাকরুদ্ধ হয়ে আসে কন্ঠ। দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্র“। দু’হাতের তালু দিয়ে মুছে নেয়। চোখে মুখে ক্ষোভের বিচ্ছুরণ।)
আসিফ: কেন, কি হয়েছিল সেদিন?
বৈচাপাগল: তোর দাদায় কইল- বৈচা, তোর তো আর কিছু রইল না। তুই আর ফিইরা আইবি না ভাইবা তোর বাজানতো যাওয়ার সময় সব বেইচা দিয়া গ্যাছে। ইন্ডিয়া যাইতেও তো টাকা-কড়ি লাগবো। তাই.. ..। এহন তুই কোতাও না গেলে আমি তোরে ঠাঁই দিতে পারি? আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। স্বর্ণের দোকান, জমি-জমা, ভিটাবাড়ি সব গ্যালো। এহোন আমি কি করুম। দলিল দেইখ্যা বুঝলাম, জোর কইরা বাজানরে দিয়া টিপসই দেওয়াইছে। চোউখের জলে কিছু লেহা ঝাপসা অইয়া গ্যাছে। আর বাজানের রক্তের ফোটা দেখছি আমি দলিলে। আর কিছু মনে নাই। অজ্ঞান অইয়া পড়লাম। জ্ঞান ফেরার পর আবোল-তাবোল কইতে লাগলাম। কোমড়ে শিকল পড়লো। জায়গা পাইলাম এই ঘরে। বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন লইয়া চল্লিশ বছর ধইরা এইহানে পইড়া আছি।
(এমন সময় বাড়ির সদর দরজায় দাদার কাশির আওয়াজ। আসিফ বেরিয়ে যায়।)
বৈচার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই দাদার সাথে দেখা।
খান সাহেব: নাস্তা করছো দাদু ভাই?
আসিফ: না, এখনো করিনি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একসাথে নাস্তা করবো।
খান সাহেব: তাইলে আহো আমার লগে।
আসিফ: তুমি গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। আমি ঝটপট গোসলটা করে আসি।
খান সাহেব: আইচ্ছা জলদি আইস। বাজার থিকা তোমার লাইগ্যা দেশি সবরি কলা আনছি।
আসিফ: ঠিক আছে দাদু। তুমি ভিতরে যাও। আমি তাড়াতাড়িই আসবো।
দু’জন দু’দিকে চলে যায়।

ষষ্ঠ দৃশ্য:

ফ্যাচাং বাজারের ব্যাগটা রেখে তালপাখা দিয়ে নিজের গায়ে বাতাস দিচ্ছে। গামছা দিয়ে মুখ-মন্ডল মোছে। মাটিতে বসে পড়ে। এমন সময় খান সাহেব আসে।
খান সাহেব: এ ফ্যাচাং আসিফরে দ্যাকলাম পাগলের ঘরের দিক থেকে আইতে।
ফ্যাচাং: মনে অয় উকিঝুকি দিয়া দেখতাছিল পাগল কী করে?
খান সাহেব: আমারতো কেমন জানি সুবিধার মনে অইতাছে না।
ফ্যাচাং: খান সাব বেহুদা চিন্তা কইরেন না।
(আসিফ এসে পাশে দাঁড়ায়।)
আসিফ: আচ্ছা দাদু, একটা কথা বলব।
খান সাহেব: একটা কেন দশটা কও।
আসিফ: দাদু, ঐ যে পাগলের মুখে যুদ্ধের গান, তুই রাজাকার, পাঞ্জাবি-টুপি সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।
খান সাহেব: কিসের রহস্য?
ফ্যাচাং: কই আমিতো কোন গন্ধ পাইনা। খান সাব আপনি পান?
আসিফ: বৈচাপাগলের যুদ্ধে যাওয়ার কাহিনী, পাগলামীর কারণ সব আমি জেনে গেছি। তোমার ওপর বৈচার এতো ক্ষোভ কেন তাও আমি জানি?
খান সাহেব: কৈ, আমি তো এই ব্যাপারে কিছুই জানি না। ওতো পাগল তাই.. ..।
আসিফ: দাদু, বিশাল এ বাড়িটা কার?
খান সাহেব: ক্যান
আসিফ: তোমার না বৈচাপাগলের?
খান সাহেব: আরে ও তো একটা পাগল।
আসিফ: আজ বৈচাপাগলের এ অবস্থা কেন?
খান সাহেব: ওর কথা বাদ দাও।
আসিফ: আচ্ছা দাদু, বৈচা কি সত্যিই পাগল?
খান সাহেব: পাগল তো পাগলই। এর সত্যি-মিথ্যা আবার কি?
ফ্যাচাং: খান সাব ঠিকই কইছেন।
আসিফ: না, তার কথা শুনেতো তাকে পাগল মনে হয় না।
খান সাহেব: আরে ধ্যাৎ, বাদ দাও তো ওই সব। পাগলে কি না কয়।
ফ্যাচাং: ছাগলে কি না খায়?
আসিফ: দাদু, একটা সত্যি কথা বলবে?
খান সাহেব: কি কতা? তোমার কাছে মিথ্যা কতা কমু ক্যান?
আসিফ: তার বাবা কি সত্যিই তোমার কাছে সব বিক্রি করে গেছে?
খান সাহেব: কও কি তুমি ? বিগত চল্লিশ বছরে কেউ এমন প্রশ্ন করে নাই আমারে। তোমার কি সন্দেহ হয়? এ ফ্যাচাং আমি নাতি এয়া কি কয়?
আসিফ: হতেও পারে।
খান সাহেব: কেন এমন সন্দেহ?
আসিফ: তুমি তো স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলে।
খান সাহেব: তুমি কি আমারে রাজাকার কইতাছ?
আসিফ: হ্যা, শুধু আমি বলছি না। তোমার আচার আচরণ বলছে। তোমার চোখ বলছে তুমি অপরাধী।
খান সাহেব: সাংবাদিকগো এই একটা সমস্যা, মানুষরে বিশ্বাস করতে চায় না। সব কিছুতেই খালি সন্দেহ।
ফ্যাচাং: খান সাব এই জন্যইতো কইছিলাম সাংঘাতিক।
আসিফ: আপনি চুপ করেন। আমাদের সন্দেহ অমূলক নয়। আমরা জানতে পেরেছি- চন্দ্রনগর গ্রামে আমার দাদা স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলো।
(খান সাহেবের মুখে কোন কথা নেই। দ্রুত উঠে পড়ে।)
ফ্যাচাং: খান সাব এয়া কয় কি? এয়া দিহি ঘরের শত্র“ বিভীষণ।
খান সাহেব: আমি দোকানে গেলাম। তোমার এতো কিছু জাইন্যা কাজ নাই। বেড়াইতে আইছ কয়দিন বেড়াও। তারপর চইল্যা যাও।
আসিফ: যাব, তবে যাবার আগে এর রহস্য আমি উদঘাটন করবই। বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। তুমি যদি সত্যিকারের অপরাধি হও। তাহলে তুমিও বাঁচতে পারবে না।
খান সাহেব: আইছ্যা সময় অইলেই দ্যাহা যাইব।
(খান সাহেবের পেছন পেছন ফ্যাচাংয়ের প্রস্থানের পর দাদী গরম দুধ নিয়ে আসে।)
দাদী: দাদুভাই দুধটুকু খাইয়া নাও।
আসিফ: দাও। (ঢক ঢক করে দুধটুকু খায়)
দাদী: (গ্লাস নিতে নিতে) তোমার দাদু কই?
আসিফ: চলে গেছে।
দাদী: কোই গ্যালো?
আসিফ: মনে হয় বাজারে।
দাদী: এহনই চইল্যা গ্যালো। তোমারে একটু সময়ও দিলো না।
আসিফ: না থাক। ব্যবসায়ি মানুষ। দোকানে বসলে কর্মচারীদের সুবিধা হয়। (প্রসঙ্গ পাল্টে) আচ্ছা দাদী, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা তোমার মনে আছে না ?
দাদী: আছে না মানে। সব মনে আছে। তোমার বাপজান তহন ছোট। চৌদ্দ-পনের বছর বয়স। অরে নিয়া ভেতরের ঘরে লুকায়া থাকতাম। তোমার দাদার লগে পাক আর্মির ভালো সম্পর্ক আছিল। তাই আমাগো কিছু কইত না। মাঝে মাঝে পাকবাহিনীর লগে এদিক-সেদিক যাইতো।
আসিফ: যুদ্ধের সময় বৈচাপাগলের পরিবারের কি হয়েছিল?
দাদী: একদিন মাঝ রাইতে ওই বাড়িতে পাকবাহিনী হামলা করে। বৈচার বৈনরে ধইরা নিয়া যায়। বৈচার বাপ-মারে সকাল হওয়ার আগে দেশ ছাড়তে কইয়া যায়। রাগে ক্ষোভে দুঃখে তারা গ্রাম ছাইড়া চইল্যা গ্যালো। আশ-পাশের পুরুষ-মহিলারা ভয়ে পলায়া আছিল। হুনছি পাকবাহিনীর লগে মুখোশ পড়া কেউ একজন আছিল। কেউ চিনবার পারে নাই।
আসিফ: সেই মুখোশ পড়া লোকটা কে তাকি আর জানতে পেরেছ?
দাদী: আইজও জানতে পারি নাই। তা এতো বছর পর তুমি এগুলা নিয়া বাড়াবাড়ি করতাছো ক্যান?
আসিফ: আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। এ দেশ নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। তাই দেশের শত্র“দের ঘৃণা করি।
দাদী: তুমি কি কইতে চাও তোমার দাদা দ্যাশের শত্র“?
আসিফ: অবশ্যই। সেই রাতের মুখোশ পড়া লোকটিই আমার দাদাভাই। আমি তাকে ক্ষমা করতে পারবো না।
দাদী: তা অইতেও পারে। আমার মনে অয়, তোমার বাবাও একই কারণে বাড়ি আহে না। লোকটা না হয় না বুইজ্যা ভুল করছে। মুসলমান বইল্যা পাকিস্তানিগো সাহায্য করছে।
আসিফ: ভুল ধারণা তোমার। কোন কিছু না জেনে করলে তা ভুল, আর জেনে করলে তা অপরাধ। সে তো জেনে শুনেই করেছে। তবে কি জানো দাদী, আগে তো দেশ। তারপর ধর্ম। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।
দাদী: তোমার দাদাই একলা বিরোধিতা কওে নাই। আরো তো মানুষ আছিল।
আসিফ: সবাইকেই আমি ঘৃণা করি। আমি আর এক মুহূর্তও এ বাড়িতে থাকবো না। আজই আমি ঢাকা চলে যাব। আর কোনদিন আসবো না।
বলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে যায় আসিফ। দাদী অশ্র“সজল চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে চলে যায়।

শেষ দৃশ্য:

গভীর রাত। বৈচাপাগলের কোন সাড়াশব্দ নেই। নিঝুম নিস্তব্ধতা ভাঙ্গে ভাড়ি বুটের আওয়াজ। খান সাহেবের দরোজায় বার কয়েক কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে-
খান সাহেব: এত রাইতে দরজা ধাক্কায় কেডা ?
দারোগা: আমরা থানা থেকে এসেছি।
খান সাহেব: দারোগা সাব, এত রাইতে আমার বাড়ি।
দারোগা: খান সাহেব দরজা খুলে বাহিরে আসুন। জরুরী দরকার আছে।
(খান সাহেব বেরিয়ে আসেন। বাইরে দারোগার সাথে দু’জন সিপাহি দাঁড়ানো।)
খান সাহেব: দারোগা সাব আমার নাতি রাগ অইয়া চইল্যা গ্যাছে। অর কি কোন বিপদ অইছে?
(পুলিশের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে আসিফ ও বৈচাপাগল। খান সাহেব হতবাক। মসজিদে মসজিদে তখন ধ্বনিত হচ্ছে ফজরের আজান।)
দারোগা: আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে।
খান সাহেব: ক্যান, থানায় যাইতে অইবো ক্যান? কোন অঘটন ঘটছে না কি ?
দারোগা: হ্যা, অঘটন ঘটেছে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। সেই অঘটনের নায়ক আপনি।
খান সাহেব: কী কন, চল্লিশ বছর আগে.. ..। নায়ক আমি.. ..।
দারোগা: হ্যা, আপনার বিরুদ্ধে থানায় একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।
খান সাহেব: ফালতু কতা। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে কেডা ? কার এত বড় সাহস।
দারোগা: সময় নষ্ট করছেন কেন? থানায় গেলেই সব জানতে পারবেন।
খান সাহেব: ঠিক আছে খাড়ান। আমি জামাডা গায় দিয়া আহি।
(খান সাহেব ভেতর থেকে জামা গায় দিয়ে বেরিয়ে আসে। পেছনে তার স্ত্রী। খানসাব একবার নাতির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে একটু দাঁড়ায়। দু’গন্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোটা লবণাক্ত জল। দাদি পাথরের মূর্তির মত নির্বাক।)
খান সাহেব: শ্যাস পর্যন্ত তুমি আমারে।
আসিফ: সরি দাদু। সারাদেশেই আজ যুদ্ধাপরাধীদের ধরা হচ্ছে। যুদ্ধের পরপরই কে বা কারা তোমার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ ও হত্যাসহ মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ করে রেখেছে। আজ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। আমাদের স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। আমার কষ্টটা এখানেই যে, আমি তোমার গর্বিত বংশধর হতে পারিনি। আমার দাদা মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে হলো একজন যুদ্ধাপরাধী।
দারোগা: চলেন। সময় নষ্ট করবেন না।
(পুলিশ খান সাহেবকে নিয়ে চলে যায়। আসিফ চলে যেতে উদ্যত হয়।)
দাদী: খাড়াও আসিফ। তুমি আমারে আমার ছেলের ধারে লইয়া যাও। আমি আর এই নরকে থাকতে চাইনা। এই পাপের ফসল ভোগ করতে চাই না। বৈচারে তোর সহায় সম্পত্তি তুই বুইজ্যা লঅ।
(বৈচাপাগল ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। দাদী ও আসিফ দুপাশ থেকে বৈচার দুই কাধে হাত রাখে।সবাই ফ্রিজ।)

(সমাপ্ত)