ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ, ড. এ.কে.এম. রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা
এক. সরকারের গণতান্ত্রিক কিংবা অগণতান্ত্রিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে শাসন বিভাগের মাধ্যমে। শাসন বিভাগের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে থেকে পুলিশ বাহিনী জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া সহ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই বলা হয়, একটি দেশের পুলিশের আচার-আচরণ দেখে সরকারের চরিত্র বোঝা যায়। গত ২৬মে ঢাকা আগারগাঁও মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রীদের আন্দোলনের ছবি তুলতে গিয়ে ফটো সাংবাদিকরা পুলিশের হাতে নির্মম প্রহারের শিকার হন। একইভাবে গত ২৯ মে ঢাকা সিএমএম আদালত চত্বরে পুলিশ কর্তৃক একজন তরুণীর লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় প্রতিবাদ করলে সেখানেও দুজন সাংবাদিক পুলিশের হাতে প্রহৃত হন। পুলিশের হাতে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও অনুরূপ নির্যাতনের বহু ঘটনা রয়েছে। তবে বর্তমান সরকারের আমলে এই নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
দুই. সকলের জানা রয়েছে, বৃটিশ সরকার ১৮৬১ সালে পুলিশ আইন তৈরি করে তাদের শাসনকার্য পরিচালনার স্বার্থে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশ দু’দুবার স্বাধীনতা লাভ করলেও পুলিশ এখনও জনগণের বন্ধু হতে পারেনি। তবে বৃটিশ আমলে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অধীনে পুলিশকে কাজ করতে হতো। ফলে কিছুটা হলেও জবাবদিহিতার মধ্যে থেকে তাদেরকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্বার্থে গোটা পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হয়। ফলে থানায় একজন জুনিয়র অফিসারের অন্যায় আচরণ দেখলে মানুষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে দায়ী করে। আমরা জানি, যাবতীয় অপরাধ ও বিশৃঙ্খলার সিংহভাগ ঘটে স্থানীয় পর্যায়ে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রকৃত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা না থাকায় পুলিশ বাহিনী স্থানীয় সরকারকে কোনো গুরুত্ব প্রদান করে না। যদিও ইংল্যান্ডসহ উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে পুলিশ বাহিনীকে স্থানীয় সরকারের অধীনে শুরু থেকেই ন্যস্ত করা আছে। সিডিএলজি দীর্ঘদিন আগে থেকে বলে আসছে বাংলাদেশে দু’প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করে স্থানীয় সরকারের জন্য পৃথক পুলিশ বাহিনী গঠন করা অত্যাবশ্যক।
তিন. পূর্বে আমাদের দেশটি পুরোপুরি গ্রামকেন্দ্রিক ছিল। বৃটিশরা গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে চৌকিদার নিয়োগ করে। তৎকালীন বৃটিশ সরকার গ্রাম চৌকিদারী আইন পাশ করে স্থানীয় শাসনকে আইনের কাঠামো প্রদান করে। পরবর্তীকালে ইউনিয়ন কমিটি, ইউনিয়ন বোর্ড, ইউনিয়ন কাউন্সিল ইত্যাদির হাত ধরে বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ নামে গ্রামীণ ইউনিটটি পরিচিতি লাভ করেছে। স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর মাধ্যমে গ্রাম পুলিশের ক্ষমতা ও কার্যাবলী নির্দিষ্ট করা হয়। উক্ত আইনে ২১ প্রকার অপরাধের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা গ্রাম পুলিশদের হাতে দেয়া হয়। তার মধ্যে ১৮নং ক্রমিকে বলা হয়েছে, গ্রাম পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ও ওয়ারেন্ট বা গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়াই কতিপয় অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করতে পারবে। তবে ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম পুলিশদের নিয়ন্ত্রণের একক কর্তৃপক্ষ না হওয়ায় কার্যত তারা থানা পুলিশের এজেন্ট হয়ে কাজ করতে বাধ্য থাকে। ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত নামে বিচার ও শালিসী বোর্ড রয়েছে। সেখানে ক্ষমতার পৃথকীকরণ তত্ত্বের প্রয়োগ না থাকায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিচারিক কাজ করে থাকেন। তার ফলে বিচারে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ থাকে এবং মাঝে মধ্যে সংশ্লিষ্টদের আইন নিজ হাতে তুলে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। তারপরেও সেখানকার শালিসী বোর্ড এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে একই ব্যক্তি গ্রাম আদালতে ভুল স্বীকার করে, অথচ উচ্চ আদালতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে। সেজন্য বিদ্যমান আদালতের সাক্ষী-সাবুদ ব্যবস্থাকে অনেকে আর্টিফিশিয়্যাল বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। কেউ কেউ মনে করেন ছাগল হারিয়ে কোর্টের কাছে বিচার চাওয়া মানে গরু হারানোর ব্যবস্থা করা। সেজন্য ইউনিয়নে ‘ইউনিয়ন আদালত’ গঠন করা এখন সময়ের দাবী।
চার. বর্তমান সরকার পৌর এলাকায় ‘পৌর পুলিশ’ নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। তবে যেসব পৌরসভা পৌর পুলিশদের বেতন-ভাতা প্রদান করতে সক্ষম হবে সেখানেই প্রথমে পৌর পুলিশ নিয়োগ দেয়া হবে। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো, কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থা বহাল রেখে সরকারের কোন উদ্যোগই কাজে আসবে না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিদ্যমান ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন আর ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোতে জনগণের একেকটি অংশ বসবাস করে। এই চারটি ইউনিটের মধ্যে ইউনিয়ন হলো গ্রামীণ এবং পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন/ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হলো নগরীয় স্থানীয় ইউনিট। প্রথমে উক্ত দুই প্রকারের স্থানীয় সরকারকে ভিত্তিমূল ধরে স্থানীয় সরকারের উচ্চতম ও মধ্যবর্তী ইউনিটগুলো নির্দিষ্ট করে তাদের কাজ নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে সর্বপ্রথম ইউনিয়নে ‘ইউনিয়ন সরকার’ ও নগরে ‘নগর সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। ইউনিয়ন সরকারের অধীনে ‘ইউনিয়ন পুলিশ’ (গ্রাম পুলিশ) এবং নগর সরকারের অধীনে ‘নগর পুলিশ’ দায়িত্ব পালন করবে। এখানে সংক্ষেপে নগর পুলিশের কার্যক্রম তুলে ধরা যেতে পারে। নগর প্রশাসন, নগর সংসদ ও নগর আদালত মিলে ‘নগর সরকার’ গঠিত হবে। নগর প্রশাসনের প্রধান হবেন ‘মেয়র’। কাউন্সিলররা নগর সংসদের সদস্য হবেন। আর পৃথকভাবে মনোনীত কিংবা নির্বাচিত ব্যক্তিরা ‘নগর আদালতে বিচারিক দায়িত্ব পালন করবেন। নগর পুলিশরা মেয়রের অধীনে থেকে দায়িত্ব পালন করবেন। নগর পুলিশ নগরকেন্দ্রিক যাবতীয় অপরাধের তদন্ত করবেন এবং অপরাধীকে বিচারের জন্য নগর আদালতে সোপর্দ করবে। নগর পুলিশ জাতীয় পর্যায়ে সংঘটিত কিংবা বড় ধরনের অপরাধ দমনে কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশকে সহযোগিতা দিবে। নগর পুলিশ নগরে বসবাসরত নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানসহ আবাসিক হোটেলগুলোর বোর্ডারদেরও নিরাপত্তা প্রদান করবে।
পাঁচ. বলা বাহুল্য, এই বাহিনী ফুটপাত, খাল, সরকারি জায়গা, পার্ক ইত্যাদি সহ নাগরিকদের স্বার্থে ব্যবহৃত সরকারি জায়গাগুলো অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত রাখবে। নগর সংসদে উন্নয়ন, প্রশাসন, শিক্ষা, যানজট, রাস্তাঘাট উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, আইন-শৃঙ্খলা, সবুজায়ন, বৃক্ষায়ন সহ যাবতীয় বিষয় আলোচনা করা হবে। আর সংসদে পাশকৃত প্রস্তাবাবলী নগর প্রশাসন বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ নগর সরকারে ক্ষমতার পৃথকীকরণ তত্ত্বের পুরোপুরি প্রয়োগ ঘটবে। এই ব্যবস্থা গৃহীত হলে নগরে অপরাধ দমনে পুলিশ ব্যর্থ হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়ী না করে মানুষ মেয়রকে প্রথমে দায়ী করবে। সেইসঙ্গে কমিউনিটি পুলিশিং এর শ্লোগান ‘আমি পুলিশ, আমিই জনগণ’ শুধু কথার কথা হয়ে থাকবে না, নিজেদের চর্চার মধ্য দিয়ে প্রতিটি মানুষ সেটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।
লেখকবৃন্দ: প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, চেয়ারম্যান, জানিপপ; প্রফেসর ড. এ.কে.এম. রিয়াজুল হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা; এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি।