সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’- বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানের এ কথাগুলো আজ মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো। হাজার রছরের পুরনো আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগকেও হার মানিয়েছে রামুর সহিংসতা। রামুর ঘটনার জন্য আমরা কাকে দায়ি করবো? নিশ্চয়ই উগ্রতা আর ধর্মান্ধতাকে। আর ব্যর্থতা প্রশাসনের। দায়ভার অবশ্যই সরকারের। এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকের কারণে নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্কজনক অধ্যায়। তবে অবাক হতে হয় যখন রাজনৈতিকভাবে এ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। যা অনভিপ্রেত। রামুর সহিংসতা নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দল এখন দাবা খেলায় মেতে উঠেছে। দাবার গুটি বানানো হচ্ছে নির্যাতিত সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে।
বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাদের উজ্জ্বল ঐতিহ্যের অংশ। পৌষ-পার্বণে কিংবা ঈদ উৎসবে বুকে বুক মিলানোর ইতিহাস আমাদের পুরনো। অথচ অতি উৎসাহি কিছু ধর্মান্ধ মানুষের জন্য সে সম্প্রীতি ভেঙ্গে চুড়মাড় হয়ে গেল। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত আটটার দিকে কক্সবাজারের রামু উপজেলার মেরুংলোয়া বড়–য়া পাড়ার উত্তম কুমার বড়–য়ার ফেসবুকে কে বা কারা পবিত্র কুরআন শরিফ অবমাননার একটি ছবি যুক্ত (ট্যাগ) করে। ছবিটি অন্যান্যরাও শেয়ার করে। ফলে রাত দশটার দিকে কয়েক হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে রামুর চৌমুহনী চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
শুধু প্রতিবাদেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। সমাবেশ শেষে সংঘবদ্ধ লোকজন সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শত বছরের পুরনো ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে। পুড়িয়ে দেয় চল্লিশটির মতো বসতবাড়ি এবং ভাঙচুর করেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। একই কারণে ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়ায় দু’টি বৌদ্ধবিহার ও একটি হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
হযরত মুহম্মদ(স:) কে নিয়ে নির্মিত ব্যঙ্গ চলচ্চিত্র ‘ইনোসেন্স অফ মুসলিমস’ ও ফ্রান্সের পত্রিকায় প্রকাশিত ব্যঙ্গ কার্টুনের কারণে এমনিতেই মুসলিম বিশ্ব ছিল উত্তপ্ত। ফলে জ্বলন্ত আগুনে তেল ঢেলে দেওয়ার মতোই রামুর এ ঘটনা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ভাঙন ধরাতেই এমন কর্মকান্ড করা হয়েছে বলে বিজ্ঞজনের ধারণা। তবে এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরো ধৈর্যশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিৎ ছিল কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ কোন এক যুবকের অপরাধের জন্য শতাধিক মানুষের জান ও মালের ক্ষতি সাধন করার ব্যাপারে ইসলামি শরীয়াও হয়ত সমর্থন করবে না। যেহেতু বিষয়টি জানার সাথে সাথে যুবক তার ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া সে নিজেতো আর ছবি পোস্ট করেনি। কে বা কারা ট্যাগ (যুক্ত) করেছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে এটা বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। যা তৃতীয় পক্ষের দ্বারা সংঘটিত হওয়াটা অমূলক নয়। ঐ যুবক যদি স্বেচ্ছায় করে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এতবড় সহিংস ঘটনার পিছনে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ছিল এটা নিশ্চিত। কারণ একটি অপরাধ হাজারো অপরাধের জন্ম দেয়। কোরআন অবমাননার বিষয়টি মোটেই ছোট কোন অপরাধ নয়। কিন্তু যে ঘটনা ঘটলো তাকেও ছোট করে দেখার উপায় নেই। তাই আমরা বাধ্য হয়েই দু’টি ঘটনাকে অনাকাঙ্খিত ঘটনা বলছি। তবে এভাবে অনাকাঙ্খিত ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটলে সংঘাতময় পরিস্থিতি কোনভাবেই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ফলে বিশ্বজুড়ে অশান্তির পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা শান্তির পক্ষে-আমরা সম্প্রীতির পক্ষে।
অনাকাঙ্খিত ঘটনা পরিদর্শণে গেলেন সরকারের দুই মন্ত্রী। তাদের বক্তব্যে উচ্চারিত হয় ভিন্ন সুর। সেখানে না আছে শান্তির বাণী না আছে সম্প্রীতির জয়গান। প্রথমেই তাদের দৃষ্টি মৌলবাদী ও বিরোধীদলের ওপর। বিরোধী দলও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তারাও অভিযোগ আনেন ক্ষমতাসীন দলের ওপর। ফলে ঘটনা মোড় নিতে থাকে ভিন্ন খাতে। যেটা সাধারণ নিরীহ মানুষের কাছে কাম্য নয়। দায়িত্বশীল দু’টি দল বা ব্যক্তির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সহিংসতা দীর্ঘজীবি হোক- এটা কারোই কাম্য নয়। এতে হয়ত প্রকৃত দোষিরা ছাড়া পেয়ে যাবে। আর দুর্ভোগ পোহাবে নিরীহ শান্তিপ্রিয় কিছু মানুষ। গ্রামীণ প্রবাদের মতো-‘পাটা-পুতায় ঘঁষাঘঁষি মরিচের শ্যাষ’ হওয়ার মতো অবস্থা ছাড়া আর কি হতে পারে। তবে ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবি- এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার হোক। যাতে এমন কলঙ্কজনক অধ্যায়ের পুণরাবৃত্তি না ঘটে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর ঘটনাস্থল পরিদর্শণ শেষে এক সমাবেশে বলেছেন,‘সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে মন্দিরে হামলা করেছে।’ কিন্তু জামায়াতের সেক্রেটারি জি এম রহি মোল্লা বলেছেন,‘ফেসবুকে ছবি প্রকাশ হওয়ার পর রামুতে যেসব মিছিল-মিটিং হয়েছে, সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামীলীগের নেতারাই।’ বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বঙ্কিম বড়–য়া দাবি করেন,‘ পুলিশ শুরু থেকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। রাত তিনটার পর সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মাঠে না নামলে অবশিষ্ট মন্দিরগুলোও রক্ষা করা সম্ভব হতো না।’ রামু উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার বলেন,‘ জামাত-শিবির মৌলবাদী চক্র এঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারেন’। তাই যদি হবে তবে আপনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কী ভূমিকা রেখেছিলেন। এ প্রশ্ন এখন সকলের মনে।
তাছাড়া পুলিশ যদি সময়মতো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারে এমনকি চেষ্টাও যদি না করে তাহলে সরকারের এত টাকা ব্যয় করে পুলিশ পোষার দরকার কী? আর যারা এখন পরস্পর বিরোধী কথা বলেন; ঘটনা ঘটার আগে তারা কি কোন আলামত পাননি। তাহলে আপনারা বসে বসে কি করছিলেন? তামাশা দেখছিলেন। চোখের সামনে কীভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতিগত সভ্যতা।
আসলে আমরা কেউ নির্দোষ নই। ‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপাতেই আমরা ওস্তাদ। ধ্বংসলীলা দেখে আমরা মর্মাহত হইনা। আমাদের মানবতা আজ পাথরের নিচে চাপা পড়ে গেছে। ধর্মান্ধতা আর গোড়ামী আমাদের মনুষ্যত্বকে গলা টিপে হত্যা করেছে। এর কি কোন প্রতিকার নেই। সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত দোষিদের বিচারের আওতায় আনা কি সম্ভব নয়। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির নোংড়া খেলা কি কখনোই শেষ হবার নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আসুন আমরা অসহায় নির্যাতিত মানুষের পাশে দাড়াই। খোলা আকাশের নিচে যে শতাধিক মানুষ অন্নহীন-বস্ত্রহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে-তাদের মাথার ওপরে একটু ছায়ার ব্যবস্থা করে দেই। আমার কী তাও পারবো না? আসলে মানুষ না ধর্ম; আমরা কোন দিকে যাবো? সবশেষে বাউল শাহ আব্দুল করিমের সুরে বলতে হয়-‘করি যে ভাবনা, সেদিন আর পাব না। ছিল বাসনা সুখি হইতাম। দিন হতে দিন, আসে যে কঠিন। করিম দীনহীন কোনপথে যাইতাম। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। আমরা আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’- বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানের এ কথাগুলো আজ মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো। হাজার রছরের পুরনো আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগকেও হার মানিয়েছে রামুর সহিংসতা। রামুর ঘটনার জন্য আমরা কাকে দায়ি করবো? নিশ্চয়ই উগ্রতা আর ধর্মান্ধতাকে। আর ব্যর্থতা প্রশাসনের। দায়ভার অবশ্যই সরকারের। এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকের কারণে নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্কজনক অধ্যায়। তবে অবাক হতে হয় যখন রাজনৈতিকভাবে এ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। যা অনভিপ্রেত। রামুর সহিংসতা নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দল এখন দাবা খেলায় মেতে উঠেছে। দাবার গুটি বানানো হচ্ছে নির্যাতিত সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে।
বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাদের উজ্জ্বল ঐতিহ্যের অংশ। পৌষ-পার্বণে কিংবা ঈদ উৎসবে বুকে বুক মিলানোর ইতিহাস আমাদের পুরনো। অথচ অতি উৎসাহি কিছু ধর্মান্ধ মানুষের জন্য সে সম্প্রীতি ভেঙ্গে চুড়মাড় হয়ে গেল। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত আটটার দিকে কক্সবাজারের রামু উপজেলার মেরুংলোয়া বড়–য়া পাড়ার উত্তম কুমার বড়–য়ার ফেসবুকে কে বা কারা পবিত্র কুরআন শরিফ অবমাননার একটি ছবি যুক্ত (ট্যাগ) করে। ছবিটি অন্যান্যরাও শেয়ার করে। ফলে রাত দশটার দিকে কয়েক হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে রামুর চৌমুহনী চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
শুধু প্রতিবাদেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। সমাবেশ শেষে সংঘবদ্ধ লোকজন সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শত বছরের পুরনো ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে। পুড়িয়ে দেয় চল্লিশটির মতো বসতবাড়ি এবং ভাঙচুর করেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। একই কারণে ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়ায় দু’টি বৌদ্ধবিহার ও একটি হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
হযরত মুহম্মদ(স:) কে নিয়ে নির্মিত ব্যঙ্গ চলচ্চিত্র ‘ইনোসেন্স অফ মুসলিমস’ ও ফ্রান্সের পত্রিকায় প্রকাশিত ব্যঙ্গ কার্টুনের কারণে এমনিতেই মুসলিম বিশ্ব ছিল উত্তপ্ত। ফলে জ্বলন্ত আগুনে তেল ঢেলে দেওয়ার মতোই রামুর এ ঘটনা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ভাঙন ধরাতেই এমন কর্মকান্ড করা হয়েছে বলে বিজ্ঞজনের ধারণা। তবে এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরো ধৈর্যশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিৎ ছিল কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ কোন এক যুবকের অপরাধের জন্য শতাধিক মানুষের জান ও মালের ক্ষতি সাধন করার ব্যাপারে ইসলামি শরীয়াও হয়ত সমর্থন করবে না। যেহেতু বিষয়টি জানার সাথে সাথে যুবক তার ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া সে নিজেতো আর ছবি পোস্ট করেনি। কে বা কারা ট্যাগ (যুক্ত) করেছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে এটা বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। যা তৃতীয় পক্ষের দ্বারা সংঘটিত হওয়াটা অমূলক নয়। ঐ যুবক যদি স্বেচ্ছায় করে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এতবড় সহিংস ঘটনার পিছনে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ছিল এটা নিশ্চিত। কারণ একটি অপরাধ হাজারো অপরাধের জন্ম দেয়। কোরআন অবমাননার বিষয়টি মোটেই ছোট কোন অপরাধ নয়। কিন্তু যে ঘটনা ঘটলো তাকেও ছোট করে দেখার উপায় নেই। তাই আমরা বাধ্য হয়েই দু’টি ঘটনাকে অনাকাঙ্খিত ঘটনা বলছি। তবে এভাবে অনাকাঙ্খিত ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটলে সংঘাতময় পরিস্থিতি কোনভাবেই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ফলে বিশ্বজুড়ে অশান্তির পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা শান্তির পক্ষে-আমরা সম্প্রীতির পক্ষে।
অনাকাঙ্খিত ঘটনা পরিদর্শণে গেলেন সরকারের দুই মন্ত্রী। তাদের বক্তব্যে উচ্চারিত হয় ভিন্ন সুর। সেখানে না আছে শান্তির বাণী না আছে সম্প্রীতির জয়গান। প্রথমেই তাদের দৃষ্টি মৌলবাদী ও বিরোধীদলের ওপর। বিরোধী দলও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তারাও অভিযোগ আনেন ক্ষমতাসীন দলের ওপর। ফলে ঘটনা মোড় নিতে থাকে ভিন্ন খাতে। যেটা সাধারণ নিরীহ মানুষের কাছে কাম্য নয়। দায়িত্বশীল দু’টি দল বা ব্যক্তির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সহিংসতা দীর্ঘজীবি হোক- এটা কারোই কাম্য নয়। এতে হয়ত প্রকৃত দোষিরা ছাড়া পেয়ে যাবে। আর দুর্ভোগ পোহাবে নিরীহ শান্তিপ্রিয় কিছু মানুষ। গ্রামীণ প্রবাদের মতো-‘পাটা-পুতায় ঘঁষাঘঁষি মরিচের শ্যাষ’ হওয়ার মতো অবস্থা ছাড়া আর কি হতে পারে। তবে ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবি- এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার হোক। যাতে এমন কলঙ্কজনক অধ্যায়ের পুণরাবৃত্তি না ঘটে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর ঘটনাস্থল পরিদর্শণ শেষে এক সমাবেশে বলেছেন,‘সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে মন্দিরে হামলা করেছে।’ কিন্তু জামায়াতের সেক্রেটারি জি এম রহি মোল্লা বলেছেন,‘ফেসবুকে ছবি প্রকাশ হওয়ার পর রামুতে যেসব মিছিল-মিটিং হয়েছে, সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামীলীগের নেতারাই।’ বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বঙ্কিম বড়–য়া দাবি করেন,‘ পুলিশ শুরু থেকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। রাত তিনটার পর সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মাঠে না নামলে অবশিষ্ট মন্দিরগুলোও রক্ষা করা সম্ভব হতো না।’ রামু উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার বলেন,‘ জামাত-শিবির মৌলবাদী চক্র এঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারেন’। তাই যদি হবে তবে আপনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কী ভূমিকা রেখেছিলেন। এ প্রশ্ন এখন সকলের মনে।
তাছাড়া পুলিশ যদি সময়মতো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারে এমনকি চেষ্টাও যদি না করে তাহলে সরকারের এত টাকা ব্যয় করে পুলিশ পোষার দরকার কী? আর যারা এখন পরস্পর বিরোধী কথা বলেন; ঘটনা ঘটার আগে তারা কি কোন আলামত পাননি। তাহলে আপনারা বসে বসে কি করছিলেন? তামাশা দেখছিলেন। চোখের সামনে কীভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতিগত সভ্যতা।
আসলে আমরা কেউ নির্দোষ নই। ‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপাতেই আমরা ওস্তাদ। ধ্বংসলীলা দেখে আমরা মর্মাহত হইনা। আমাদের মানবতা আজ পাথরের নিচে চাপা পড়ে গেছে। ধর্মান্ধতা আর গোড়ামী আমাদের মনুষ্যত্বকে গলা টিপে হত্যা করেছে। এর কি কোন প্রতিকার নেই। সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত দোষিদের বিচারের আওতায় আনা কি সম্ভব নয়। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির নোংড়া খেলা কি কখনোই শেষ হবার নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আসুন আমরা অসহায় নির্যাতিত মানুষের পাশে দাড়াই। খোলা আকাশের নিচে যে শতাধিক মানুষ অন্নহীন-বস্ত্রহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে-তাদের মাথার ওপরে একটু ছায়ার ব্যবস্থা করে দেই। আমার কী তাও পারবো না? আসলে মানুষ না ধর্ম; আমরা কোন দিকে যাবো? সবশেষে বাউল শাহ আব্দুল করিমের সুরে বলতে হয়-‘করি যে ভাবনা, সেদিন আর পাব না। ছিল বাসনা সুখি হইতাম। দিন হতে দিন, আসে যে কঠিন। করিম দীনহীন কোনপথে যাইতাম। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। আমরা আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী