বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

প্রসঙ্গ : রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান

(বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫১ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে)
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলমানদের জন্য কী করেছেন ? এমন প্রশ্ন বহুকাল ধরেই বাঙলা সাহিত্যের মুসলমান পাঠক ও রবীন্দ্র সংগীতের মুসলমান শ্রোতাদের মুখে শোনা যাচ্ছে। এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর আছে কি না আমার জানা নেই। অভিযোগগুলো এ রকম : রবীন্দ্র সাহিত্য তথা উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, নাটক কিংবা গানে কোথাও কোন মুসলমান চরিত্রকে বড় করে দেখান হয়নি। কেন দেখান হয়নি? এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। সাহিত্যিক আনোয়ারুল কাদীর বলেছিলেন : আকাশের সূর্য মুসলমানদের জন্য বিশেষ কি করেছে?
এ প্রসঙ্গে কাজী আব্দুল ওদুদ তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান-সমাজ’ প্রবন্ধে বলেছেন,‘‘ কবি আকাশের সুর্যের মতোই একজন সহজ মানব বন্ধু। অবশ্য যেহেতু কবি একজন মানুষ, এক বিশেষ পরিবেষ্টনের সৃষ্টি, সেজন্যে অত্যন্ত কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আলোকের উৎস সূর্যেও ধরা পড়ে কারো দাগ। যে গোলাপ সৌষ্ঠব আর গন্ধে অতুলনীয় তার স্পর্শ লোভাতুর লাভ করে হাতে কাঁটার আঘাত। কিন্তু কালোদাগ সত্ত্বেও সূর্য সূর্যই। কাঁটা সত্ত্বেও গোলাপ গোলাপই। এক বিশেষ পরিবেষ্টনে জন্ম সত্ত্বেও কবি চিরন্তন মানব-তাঁর পরিবেষ্টনের সমস্ত সীমারেখা অবলীলাক্রমের অতিক্রম করে তাঁতে উৎসারিত হয় মানুষের চিরন্তন সুখ, চিরন্তন দু:খ, চিরন্তন প্রেম, চিরন্তন অভয়। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ কবি, এবং যেহেতু মুসলমান মানুষ, সে জন্যে মুসলমান তাঁর আজকার বিশেষ ঐতিহাসিক বিবর্তণের প্রভাবে বুঝুক আর নাই বুঝুক, রবীন্দ্রনাথ বাস্তবিকই তার পরম বন্ধু ব্যতীত আর কিছু নন।”
একথা সত্য যে, এমন প্রশ্নের উদ্ভব হওয়া মুলত অবান্তর নয়। কিন্তু রবীন্দ্রানুরাগীরা এমন প্রশ্ন শুনেই চটে যান। কেই কেউ আবার বলেন : রবীন্দ্রনাথ হিন্দুও না, মুসলমানও না- তিনি একজন মানুষ। রবীন্দ্রনাথ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি তার প্রকৃতিগত বিরূপভাব না থাকলেও এমনকি অল্প-বিস্তর অনুরাগ ছিল। তবুও তিনি সে সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে প্রায় মৌন ছিলেন। তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে মুসলমান প্রসঙ্গ খুব বেশি এড়িয়ে গেছেন। তবে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় যখন বাংলাদেশ ফাটো ফাটো, টান টান উত্তেজনা তখন রবীন্দ্রনাথ তার ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে ভারতবর্ষের ইতিহাসে পালাবদলের প্রশ্নে মুসলমান বিজয়ের কথা উল্লেখ করেছেন।
মূলত হিন্দু-মুসলমানের সংঘাত নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে চিন্তাও করেছেন। তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে উবয়ের সমস্যা সমাদানের কারণগুলো ঘেঁটে দেখেছেন এবং দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর মতে সমস্যা সমাধানে মনের পরিবর্তন, সত্যের সাধনা ও মনুষ্যত্বের বিকাশের প্রয়োজন। সমালোচকরা বলেছেন, শিল্পী ছবি আঁকেন তাঁর বিশেষ পরিচিত জনের মুখ অবলম্বন করে। তাঁর প্রতিদিনের দেখা মুখগুলোও তুলিতে ধরা পড়ে না। অথচ ক্ষণিকের দেখা এক-আধ পরিচিত মুখ তাঁর মনে গেঁথে থাকে দীর্ঘদিন ও দীর্ঘরাত। শিল্পীর এমন পক্ষপাতের আসল রহস্য আমাদের বোধগম্য নয়।
সে কথা না হয় বাদই দিলাম। রবীন্দ্রনাথতো কেবল একজন শিল্পী নন, একজন জীবন সমালোচকও বটে। সে হিসাবে তাঁর দেশবাসী মুসলমান সম্পর্কে তাঁর মৌনভাব কি অদ্ভুত নয়? এমন প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, মুসলমান সম্পর্কে তিনি যে কম আলোচনা করেছেন তা নয়, তিনি যে আলোচনা করেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমান ধর্মের প্রতি অথবা অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর ‘সতী’ নাটিকায়। ভারতের মুসলমানদের দোষ ও গুণ দুই-ই-তাঁর আলোচ্য বিষয় ছিল।
‘রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের নিয়ে কোন গান রচনা করেছেন কি না?’ - এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেমন হবে ঠিক বলা যাচ্ছে না। আর শ্রোতাদের নিবৃত্তও করা যাবে কি না আমাদের জানা নেই। বাস্তবিক অর্থে এ ধরণের প্রশ্ন অবান্তর না হলেও অট্টহাসির জন্ম দেয়। এমন প্রশ্ন থেকে সৃষ্টি হয় এক শ্রেণির দু:খী মুসলমানের। সাহিত্য থাকুক সাহিত্যের মতোই। হিন্দু কি মুসলমান- কে কার জন্য কি করেছে? এমন প্রসঙ্গ টেনে মনের মাঝে দীনতা সৃষ্টির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের , রবীন্দ্রনাথ সত্য ও সুন্দরের। মানুষ সত্য ও সুন্দরের পূজারী, সুতরাং রবীন্দ্রনাথ মানুষের।

কালকিনি প্রবাহ

- আকন মোশাররফ হোসেন :
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কালকিনি উপজেলার আদিবাসী কারা, কোথা থেকে তাদের আগমন ঘটেছিল আর কোথায় চলে গেছেন তা- বলা কঠিন। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, কালকিনি উপজেলার মুসলমান বনেদী পরিবারগুলো বহিরাগত। সৈয়দ, খন্দকার, চৌধুরী, হাওলাদার, ভূইয়া, তালুকদার এদের অন্তর্ভূক্ত। অন্যদিকে ব্রাক্ষ্মণ সম্প্রদায়ের বসবাস এখানে অনেক আগে থেকে তাছাড়া কায়স্থ, সাহা, মালো ইত্যাদি হিন্দু সম্প্রদায় তখনও ছিল এখনও আছে। তবে নিু বর্ণের হিন্দু নম সম্প্রদায়ের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি ছিল। বাঁশগাড়ী, আলীনগর, কাজী বাকাই, মাইজপাড়া, ঘোষেরহাট, নবগ্রাম, শশিকর এলাকার জলাভূমিতে ও বিল অঞ্চলের এরা প্রধান অধিবাসী। হিন্দু জমিদার ও উচ্চ বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের অত্যাচার ও শোষণের কারণে এরা নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছিল। ভৌগোলিক  দৃষ্টিতে দেখা যায় নদী প্রবাহিত এলাকা আলীনগর, এনায়েতনগর, বাঁশগাড়ী, শিকারমঙ্গল, চর দৌলত খান, সাহেবরামপুর, কয়ারিয়া ও রমজানপুর ইউনিয়নের নদীর তীর বা চরাঞ্চলের মুসলমানদের আবাসন। যদিও নদীর ভাঙ্গা-গড়ার খেলা কৌতুহলের বিষয়। এ এলাকার নম শুদ্র সম্প্রদায়ের নারীরা এবং গরীব মুসলমান নারীদের অনেককে পুরুষের মতো ধুমপান করতে দেখা গিয়েছে আদীকাল থেকেই।
প্রাচীন অনেক নিদর্শন কালকিনি থানাতে রয়েছে। এই উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের আমড়াতলা ও খাতিয়াল গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে আড়াই হাজার একর জমিতে সেনাপতির দিঘি রয়েছে। শীত মৌসুমে নানা প্রকার হাজার হাজার অতিথি পাখি ঐ দিঘিতে শীত অবকাশ যাপন করে। জনশ্র“তিতে জানা যায়, মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সুবাদার ইসলাম খার নেতৃত্বে বিশাল একদল সৈন্য ঢাকা যাওয়ার পথে এখানে কিছুদিন অতিবাহিত করেন। পানীয় জলের অভাব মেটাতে সেনাবাহিনী দ্বারা এই দিঘি খনন করা হয়। এ কারণেই এই দিঘির নামকরণ করা হয় সেনাপতির দিঘি।
কালকিনি উপজেলায় ইসলাম ধর্মের আগমন ও বিকাশের পূর্বে হিন্দু ধর্ম ছিল প্রধান। এখানকার প্রাচীন জনগোষ্ঠী ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। দশম শতাব্দীতে এ এলাকায় কিছু কিছু বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর বসবাসের প্রাচীন ইতিহাস পাওয়া যায়। ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার লক্ষে এ এলাকায় পীর-দরবেশ- আউলিয়ার আগমন ঘটেছে। সেই সুবাদে এই এলাকার একটি মৌজার নাম আউলিয়ার চর।
হযরত পীরজাদা শাহ সুফি এনায়েতপুরী (র) সাহেবের বর্জার (ইঞ্জিনবিহীন বড় নৌকা) নোঙর করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন যেকারনে এই মৌজার নাম এনায়েতনগর হয়েছে। এবং সেই থেকে এই মৌজা ও ইউনিয়নের নাম এনায়েতনগর।
(চলবে)