মঙ্গলবার, ১৫ মে, ২০১২

বর্ষা আসে বিরহ নিয়ে

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
আমার জীবনে বর্ষা আসে বিরহ নিয়ে। তাই আমার কাছে মনে হয় বর্ষা মানে ক্ষণে ক্ষণে বিরহের গান। বলা নেই - কওয়া নেই অমনি শুরু হয়ে গেল অশ্র“র বর্ষণ। কখনো কখনো মনে হয় চোখ ভরা অভিমান নিয়ে ধেয়ে আসা কিশোরীর পায়ের নূপুরের রিনি ঝিনি আওয়াজ।
এখনো বর্ষা আমাকে কাঁদায়। তাই আমার কাছে বর্ষা মানে গর্জে ওঠা নদী। দু’কুল ছাপিয়ে তলিয়ে দেওয়া গ্রামের পর গ্রাম। সুখ-দু:খে একাকার হয়ে ভেসে বেড়ানো পাল তোলা নৌকা। বিরহী সুর জেগে ওঠা মাঝির ভাটিয়ালি গান। কলা গাছের ভেলায় ভেসে যাওয়া ক্ষুদ্র জীবন। ব্যাঙের একটানা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকে দূর থেকে ভেসে আসা রাগ-রাগিণী। পানকৌড়ির ডুবসাঁতারের খেলার মতো প্রিয়তমার লুকোচুরি।
তবুও অসহায় আমি নি:সঙ্গ হয়ে আজ চার দেয়ালের বন্দী জীবন থেকে বের হয়ে বারবার ফিরে যেতে চাই বর্ষাস্নাত গাঁয়ের বুকে। যান্ত্রিক সভ্যতার নাগপাশ ছিড়ে দু’হাতের আজলা ভরে কুড়িয়ে নিতে চাই প্রকৃতির নির্মল বাতাস। ইচ্ছে হয় কাদা জলে হোচট খেতে, ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে। সাঁঝ পোহানো কোন রাতে জোছনা বিলাসের আয়োজন করতে। গভীর রাতে বিলের জলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে সুখের বাঁশরী বাজাতে।
সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি বৃষ্টির তোড়ে থরথর কওে কাঁপে জানালার শার্শি। ঝড়ো হাওয়ার রাতে বিরহের গান গেয়ে যায় বাতাস। এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় শরীর। কী এক স্বপ্নীল শিহরণ জেগে ওঠে মনে। মনে পড়ে এক বর্ষারাতে হাতে হাত রেখে বলেছিল সোনাবউ- ‘ আজ জোছনার আলোয় বৃষ্টির জলে ভিজবো দু’জন’।
এখনো আগের মতোই বর্ষা আসে ; আবার চলেও যায়। শুধু আমার সোনাবউ অন্য কোথাও। বৃষ্টির শব্দে তার কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে। দু'চোখের তারায় ভেসে ওঠে বৃষ্টিভেজা একটি গ্রাম। মাঝখানে আমি আর সোনাবউ।
দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াই খোলা আকাশের নিচে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা তার চোখের অশ্র“ হয়ে জমা হয় আমার অসহায় হাতের তারায়.....।

কিশোর কবি সুকান্ত স্মরণে

মারজিয়া নিশি :
“বন্ধু, আজকে বিদায়! দেখেছ উঠল যে হাওয়া ঝড়ো, ঠিকানা রইল, এবার মুক্ত স্বদেশেই দেখা করো ॥”-এ আহ্বান জানিয়ে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য ১৯২৬ সালরে ১৬ই আগষ্ট কোলকাতার ৪২ মহীম হালদার স্ট্রিটের মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম নবারুন ভট্টাচার্য্য। মাতার নাম সুনীতি দেবী। কবির পুর্ব পুরুষরা এদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বসবাস করতেন। কবির জন্মের পূর্বেই তাঁর পূর্ব পূরুষরা এ দেশ থেকে ভারতে চলে যান। দীর্ঘদিন ধরে কবির পৈতৃক ভিটায় কোন প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তার জন্ম ও মৃর্ত্যুবার্ষিকী পালিত হতো। গত বছর থেকে সুকান্ত স্মৃতি সংসদ, উদীচী ও সুকান্ত সেবা সংঘের পক্ষ থেকে ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে কবির মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হচ্ছে।
কবির পূর্ব পুরুষরা এদেশ থেকে চলে যাবার পর তার পৈত্রিক ভিটা ভূমিদস্যুরা দখল করে নেয়। দীর্ঘদিন দখল থাকার পর ২০০৫ সালে কবির পৈত্রিক ভিটাটি দখলমুক্ত করা হয়। কবির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তার পৈত্রিক ভিটায় সরকারিভাবে একটি অডিটোরিয়াম এবং একটি লাইব্রেরী গড়ে তোলা হয়।
বাংলা বিশ দশকের সূচনাতে ঔপনিবেশিক বৃিটশ শাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ শুরু হয়। এই গণজাগরণের উত্তাপ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে থেকে কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন সুকান্ত ভট্টাচার্য্য। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, রুশ বিপ্লব সুকান্তের চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। ঘুম নেই, ছাড়পত্র, পূর্বাভাস কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।


বন্ধু কী খবর বল

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে অগণিত বন্ধু আমার। তাদের ছবি দেখি। অনলাইনে কথাও হয়। হাই- হ্যালো ! কেমন আছ? কি করছ...? ইত্যাদি। কেবল জানার জন্যই জানা। অন্তর থেকে কোন টান অনুভূত হয়না। অনেকটা যন্ত্রমানবের মতো। সভ্যতার উৎকর্ষতার সাথে সাথে আজকাল আমিও হয়ে উঠেছি যান্ত্রিক।
বন্ধুদের প্রসঙ্গ এলে কাজী নজরুল ইসলামের একটা চিঠির কয়েকটি কথা মনে পড়ে-‘ বন্ধু আমি পেয়েছি- যার সংখ্যা আমি নিজেই করতে পারব না। এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু। ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়েছে, প্রিয় হয়ে ওঠেনি কেউ।’
যান্ত্রিক বন্ধুদের কথা বলছিলাম। যার সংখ্যা অগণিত। বন্ধু হয়েছে ঠিকই ; কিন্তু প্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি কেউ। ফেসবুকের ফাইন্ড ফ্রেন্ড্সে গিয়ে আজও হারিয়ে যাওয়া পুরনো দিনের বন্ধুদের খুঁজি। কোন কোন নিস্তব্ধ রাতে যাদেরকে প্রিয়ার মতো জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলাম। মনের অব্যক্ত কথাগুলো বলতে বলতে রাত ভোর করে দিয়েছি।
যান্ত্রিক বন্ধুদের সব কথা বলা হয় না। সব ব্যথার অংশীদারও করা হয় না। তাই সত্যিকারের বন্ধুদের আজও খুঁজি শেষ বিকেলের কোন চায়ের আড্ডায়। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্য অস্ত যাবার দৃশ্য দেখতে দেখতে। খুঁজি ব্যস্ততম জনপদে।
আজ থেকে আট বছর আগের কথা। ঢাকার শাহজাহান পুরে থাকতে ভালোবেসে ফেলি খন্দকার মাহমুদুল হক মিলনকে। দু’জনার মনের অনেক কথা ভাগাভাগি করেছি আমরা। জীবনের ব্যর্থতা-হতাশার গল্প বলে কাটিয়ে দিয়েছি রাত। একসাথে অনেক ঘুরেছি। শাহজাহান পুর থেকে হাটতে হাটতে চলে গেছি টি এস সি। শহীদ দিবসে গিয়েছি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। কত স্মৃতি আজ মনে পড়ে। কিন্তু সেই প্রিয় মানুষটি আজ কোথায় জানি না। তার বাড়ি ছিল রাজশাহী। তখন আমার ফোন ছিলনা। তবুও তার একটা নম্বর আমার ডায়রিতে লিখে রেখেছিলাম। কিন্তু সে নম্বরও এখন বন্ধ। তার বাসার ঠিকানাও ছিল। চিঠি দিয়েছি- তার কোন উত্তর পাইনি। আজো মনে পড়ে তাকে। এখন ফোনে- ফেইস বুকে কিংবা কর্মস্থলে এতো বন্ধু আমার। অথচ আজো তার শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে। 
সুমনের একটা গানের কথা ঘুরে-ফিরে মনে আসে-`হঠাৎ রাস্তায় আপিস অঞ্চলে, হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে - বন্ধু কী খবর বল? কতদিন দেখা হয়না।’ এমন একটা মুহূর্তের জন্য আমি আজও প্রতীক্ষায় থাকি। গলির মোড়ে কিংবা পার্কে হঠাৎ কেউ পিঠ চাপড়ে চমকে দিক। তাকিয়ে দেখবো শৈশবের কোন বন্ধু সহাস্যবদনে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য। কেবল ঘুরে-ফিরে দু:সময়ের বন্ধুদের কথাই মনে পড়ে। কারণ দু:সময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। তাই অসংখ্য বন্ধুর ভিড়ে আজও মনে পড়ে পুরনো দিনের সেই চেনা মুখগুলো। যে মুখ থেকে একদিন উচ্চারিত হবেÑ বন্ধু কী খবর বল...?