বুধবার, ৯ জুন, ২০২১

বুদ্ধদেব বসুর শিল্প-ভাবনা ও বাস্তবঘনিষ্ঠতা ।। সালাহ উদ্দিন মাহমুদ


বাংলা কবি ও কবিতার আলোচনায় বুদ্ধদেব বসুর নাম অবধারিত। বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টির যে প্রয়াস তিরিশের কবিদের মধ্যে দেখা যায়, বুদ্ধদেব বসু সেই ধারার অন্যতম কাণ্ডারি। আধুনিক বাংলা কবিতা বিশ্লেষণের অন্যতম নায়কও বুদ্ধদেব বসু। সমালোচনাও যে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে, বুদ্ধদেব বসু তা যুক্তিনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন। তার প্রবন্ধ পড়ার সময় পাঠক একটি বোধ পাবেন। সেই বোধ পাঠককে বাস্তবঘনিষ্ঠ করে তুলবে। তবে তার রচনার সংহতি পরিমিতি এবং বস্তুনিষ্ঠতা প্রবল। চিন্তা ও আবেগের ক্রিয়াকলাপ অন্য সমালোচকের লেখায় অনুভব করা যায় না।

 
বলতে দ্বিধা নেই যে, আধুনিক কবিদের অনেকেই জনপ্রিয়তার আড়ালেই থেকে যেতেন। যদি না বুদ্ধদেব বসু একা তাদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে না নিতেন। বিশেষকরে জীবনানন্দকে প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস চেষ্টা করে গেছেন তিনি। বুদ্ধদেব বসু বারবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন, নতুন এই কবিকে। তেমনই আরও অনেক কবিকে তিনি তুলে ধরেছেন তার লেখায়। সেসবের সমষ্টিই তার বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কালের পুতুল’।

কালের পুতুল ১৯৪৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এতে প্রথম চৌধুরী, দীনেশরঞ্জন দাশ, জীবনানন্দ দাশ, সমর সেন, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অমিয় চক্রবর্তী, নিশিকান্ত, অন্নদাশঙ্কর রায়, ফাল্গুনী রায়, সুকুমার সরকার, নজরুল ইসলাম, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত প্রমুখের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। বইটির বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণের ভূমিকা লিখেছেন কবি ও কথাশিল্পী জাকির তালুকদার। বইটিতে বুদ্ধদেব বসুর লেখা বিভিন্ন সময়ের ২৫টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে।

তার বইয়ের প্রথম প্রবন্ধ ‘লেখার ইস্কুলে’ তিনি বলেছেন, ‘মম’র মতে সাহিত্যিকের পক্ষে হাসপাতালের মতো চমৎকার ইস্কুল আর হয় না, প্রত্যেক নবীন ঔপন্যাসিককে যদি হাসপাতালে বছরখানেক কাজ করানো যায়, তাহলে তাঁদের পক্ষে ভালো বই লেখা অনেকটা সুসাধ্য হতে পারে।’ (পৃষ্ঠা ২৩) তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর প্রধান লেখকেরা অনেকেই অজস্র লিখেছেন; আর সেটাই তো স্বাভাবিক, কেননা সাধারণ নিয়ম হিসেবে বলা যায় যে রচনা পরিমাণে বেশি না-হলে সমসাময়িক সাহিত্যে ও সমাজে তাঁর প্রভাব ব্যাপক কিংবা গভীর হতে পারে না।’ (পৃষ্ঠা ২৪) তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সাহিত্যের শ্রেণীবিভাগে অভ্যস্ত; বিশেষ-কোনও শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত না-হলেই সে বইকে আমরা মনে মনে ‘বাজে’ আখ্যা দিয়ে থাকি। সেইসঙ্গে জনপ্রিয়তাকে সন্দেহের চোখে দেখাও আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে, যদিও এটাও দেখি যে প্রত্যেক শ্রদ্ধেয় লেখকেরই কালক্রমে পাঠকসংখ্যা বেড়ে চলে।’ (পৃষ্ঠা ২৫)

প্রথম চৌধুরীর জয়ন্তী-উৎসব উপলক্ষে লিখেছেন ‘প্রথম চৌধুরী ও বাংলা গদ্য’। তার মতে, ‘চলিতভাষার প্রতিষ্ঠা প্রমথ চৌধুরীর মহৎ কীর্তি হলেও একামাত্র, এমনকি প্রধান কীর্তিও নয়। তাঁর সম্বন্ধে সবচেয়ে বড়ো কথা এই যে গদ্যে তিনি অনিন্দ্য শিল্পী। ভালো স্টাইলের অধিকারী না-হয়েও ভালো গল্পলেখক বা ঔপন্যাসিক হওয়া যায়—যদিও প্রাবন্ধিক হয়তো হওয়া যায় না, যদি-না আমরা প্রবন্ধ বলতে শুধু তথ্যবহ রচনা বুঝি।’ (পৃষ্ঠা ৩৫) ‘প্রথম চৌধুরী’ শিরোনামে অপর প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘শরৎচন্দ্রের আর প্রথম চৌধুরীর অভ্যুত্থান প্রায় একই সময়ে; সহযাত্রী তাঁরা, কিন্তু এক যাত্রায় পৃথক ফলের এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ যদি থাকে সেটি খুঁজে পাওয়া যাবে প্রাথমিক জীবনচরিতেই। প্রমথনাথ রায়চৌধুরী ও চিত্তরঞ্জন দাশ, এই দুই নবীন ব্যারিস্টার একই দিনে প্রথম হাইকোর্টে পদার্পণ করলেন; চিত্তরঞ্জন সোজা উঠে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে, আর প্রমথনাথ হোঁচট খেয়ে সেই যে ফিরলেন; জীবনে আর ওমুখো হলেন না।’ (পৃষ্ঠা ৩৯)

‘‘কল্লোল’ ও দীনেশরঞ্জন দাশ’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘‘কল্লোল’-সম্পাদনা ছাড়া আর কোনও কাজ তিনি করতেন না, তাতেই দিয়েছিলেন তাঁর সময়, সম্বল ও উদ্যম, এবং ‘কল্লোলে’র আয়ু ঠিক তখনই ফুরিয়ে এলো, যখন সদ্য-আগত দিশি সিনেমার আকর্ষণ তাঁর সময় ও মনোযোগ অনেকাংশে অধিকার করে নিলে।’ (পৃষ্ঠা ৪২) আমরা জানি, কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রকৃতির কবি হিসেবে প্রধান। কারণ তার কবিতার প্রধান বিষয়ই ছিল প্রকৃতি। যত কবিতা ও গান তিনি লিখেছেন তার বেশিরভাগই ঋতু বা প্রকৃতি সংক্রান্ত। তার উপলব্ধিও প্রকৃতির মধ্যদিয়ে। একথা বুদ্ধদেব বসু অকপটে স্বীকার করেছেন। তবুও তিনি ‘জীবনানন্দ দাশ : ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে একজনকে এই বিশেষ অর্থে প্রকৃতির কবি বলা যায় : তিনি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর নব প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পড়ে এই কথাই আমার মনে হল। অবশ্য এই বইয়ের কবিতাগুলো আমার পক্ষে নতুন নয়।’ (পৃষ্ঠা ৪৭)

তিনি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘জীবনানন্দ দাশকে আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান কবি বলে মনে করি।’ এছাড়াও তিনি ‘জীবনানন্দ দাশ : বনলতা সেন’ ও ‘জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে’ শিরোনামে দুটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। বলতে গেলে জীবনানন্দকে তিনিই কেবল মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘বাংলা কাব্যের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আসনটি ঠিক কোথায় সে-বিষয়ে এখনই মনস্থির করা সম্ভব নয়, তাঁর কোনও প্রয়োজনও নেই এই মুহূর্তে; এই কাজের দায়িত্ব আমরা তুলে দিতে পারি আমাদের ঈর্ষাভাজন সেইসব নাবালকদের হাতে, যারা আজ প্রথমবার জীবনানন্দ’র স্বাদুতাময় আলো-অন্ধকারে অবগাহন করছে।’ (জীবনানন্দ দাশ-এর স্মরণে: পৃষ্ঠা ৭৪)

‘সমর সেন : কয়েকটি কবিতা’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘সমর সেনের কবিতায় এই বিদ্রোহের ভাব ও ভঙ্গি সুস্পষ্ট। প্রথমে রীতির কথা বলি। তাঁর কবিতা গদ্যে রচিত, এবং কেবলই গদ্যে। আমার ধারণা ছিল গদ্যরচনায় ভালো দখল থাকলে তবেই গদ্যকবিতায় স্বাচ্ছন্দ্য আসে, কিন্তু সমর সেনের মধ্যে এর ব্যতিক্রম দেখলুম। তিনি গদ্যে ছাড়া লেখনেনি, এবং কখনও লিখবেন এমন আশাও আমার নেই।’ (পৃষ্ঠা ৭৬)

সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়েও তিনি তিনটি প্রবন্ধ রচনা করেছেন এ গ্রন্থে। ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : অর্কেস্ট্রা’ ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : ক্রন্দসী’ ও ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা’ শিরোনামে এ তিনটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে বইটিতে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি এরকম—‘স্বতঃস্ফূর্ত গূীতিকবি হিসেবে দেখতে গেলে তাঁর প্রতি সুবিচার হবে না। গীতিকবিতার সহজ স্ফূর্তি নেই তাঁর রচনায়।’ (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : অর্কেস্ট্রা, পৃষ্ঠা ৮২) অন্যত্র বলেছেন, ‘সুধীন্দ্রনাথের কবিতা ও আমার উপভোগের মধ্যে কোথায় যেন একটা ব্যবধান দেখতে পেয়েছি। তাঁর কবিত্বশক্তিকে স্বীকার ও সম্মান না করা অসম্ভব; কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার মেজাজের মিল নেই।’ (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : ক্রন্দসী, পৃষ্ঠা ৮৪) পরের প্রবন্ধেই তিনি আবার বলেছেন, ‘‘কালের পুতুলের’ কোনও কোনও আলোচনা যে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হয়নি এ-কথা সবচেয়ে বেশি জানি আমি, আর সে-দুঃখ সবেচেয়ে বেশি আমার। কিন্তু প্রতিকারের সময় আর নেই। বিষ্ণু দে আর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্বন্ধে রচনা দুটি অর্ধ-মনস্ক হয়েছে, বইয়ের প্রুফ দেখতে দেখতে এ-চিন্তা আমার মনকে বার বার পীড়া দিয়েছে।’ (সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা, পৃষ্ঠা ৮৮)

‘বিষ্ণু দে : ‘চোরাবালি’’ লেখাটি একটি চিঠির মতো। মনে হয় বুদ্ধদেব বসু কবিকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লিখেছেন। শুরুতেই বলা হয়েছে, বিষ্ণু দের সঙ্গে এবং তার লেখার সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর পরিচয় দশ বছরের। এক পর্যায়ে তিনি বলছেন, ‘আপনার কবি প্রতিভায় আমি আস্থাবান; এ-দেশে কবিতা যাঁরা ভালোবাসেন, লেখেন ও লিখতে চেষ্টা করেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই আপনার রচনা খুব মনোযোগপূর্বক পড়া উচিত সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই; আর সেইজন্য যেখানেই আমার মনে হয়েছে আপনি যে স্বেচ্ছায় আপনার কবিতার আবেদন খর্ব করেছেন, সেখানেই আমার মন প্রতিবাদ করেছে।’ (পৃষ্ঠা ৯৬)

সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখযোগ্য : প্রথমত, তিনি বোধ হয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন না। এমনকি, প্রকৃতিবিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না; কোনও অস্পষ্ট মধুর সৌরভ তাঁর রচনায় নেই, যা সমর সেনেরও প্রথম কবিতাগুলোতে লক্ষণীয় ছিল। দ্বিতীয়ত, কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে কাব্যরচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে বলে মনে করি।’ (পৃষ্ঠা ৯৭)

জীবনানন্দ দাশ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মতো অমিয় চক্রবর্তীকে নিয়ে তিনটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে কালের পুতুলে। তিনি মনে করেন, ‘অমিয় চক্রবর্তীর মন পুরোপুরি আধুনিক ছাঁচে ঢালাই করা। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বহির্মুখী।’ তিনি আবার বলেছেন, ‘অমিয় চক্রবর্তীর আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে বাঙালি কবিদের মধ্যে তিনি প্রকৃতই সর্বদেশীয়। নতুন বিচিত্র ভূগোলের অভাবিত রস পরিবেশন করেছেন তিনি।’ তৃতীয় প্রবন্ধে অমিয় চক্রবর্তী সম্পর্কে লেখকের অভিমত এমন—‘সমকালীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আধ্যাত্মিক কবি অমিয় চক্রবর্তী।’

নিশিকান্ত সম্পর্কে লেখক বলেছেন, ‘প্রথমেই বলে রাখি যে নিশিকান্ত’র কবিতার আমি অনুরক্ত। তাঁর ‘পণ্ডিচেরির ঈশান কোণের প্রান্তর’ (‘কবিতা’য় প্রকাশিত) বাংলা গদ্যকবিতার মধ্যে একটি প্রধান রচনা বলে আমি মনে করি।’ (পৃষ্ঠা ১২৫) প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু তার লেখায় অন্নদাশঙ্কর রায় সম্পর্কে বলেছেন, ‘শ্রীযুক্ত অন্নদাশঙ্কর রায় ভবিষ্যতের কিংবা অদৃষ্টের ওপর ভরসা রাখেননি, তিনি প্রাক-চল্লিশেই নিজের কাব্যসংগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আধুনিক কবিদের মধ্যে এ ধরনের উদ্যম তাঁরই প্রথম।’ (পৃষ্ঠা ১২৯)

শেষের দিকে তিনি দু’জন তরুণ মৃত কবিকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। তারা হলেন—ফাল্গুনী রায় ও সুকুমার সরকার। ফাল্গুনী রায়কে নিয়ে লেখা নাতিদীর্ঘ এ প্রবন্ধ মাত্র বারোটি কবিতা পড়ে তিনি লিখেছেন। তার ভাষায়, ‘এই বারোটির যে-কোনও একটি কবিতা পড়লেই বোঝা যাবে যে ফাল্গুনী যথার্থ বাকপ্রেমিক। তাতে প্রমাণ হয় যে তিনি জাত-কবি।’ (পৃষ্ঠা ১৩৬) হাঁড়ির একটি ভাত টিপলেই যেমন সব ভাতের অবস্থা বোঝা যায়; তেমনই তিনি মাত্র কয়েকটি কবিতা পড়েই ফাল্গুনীকে ‘জাত কবি’ আখ্যা  দিলেন। অপরদিকে সুকুমার সরকার মাত্র পাঁচ-ছয় বছর কবিতা লিখেছিলেন। তাতেই শুধু সাময়িকপত্রেই তাঁর শতাধিক কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। হয়তো অপ্রকাশিত লেখা ছিল তারও বেশি।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য—‘বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরে সবেচেয়ে বড়ো কবিত্বশক্তি নজরুল ইসলামের। তিনি যখন সাহিত্যক্ষেত্রে এলেন তখন সত্যেন্দ্র দত্ত তাঁর খ্যাতির চূড়ায় অধিষ্ঠিত, সে সময় তাঁর প্রভাব বোধহয় রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।’ (পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৪)  এছাড়া যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সম্পর্কে বলেছেন, ‘যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত বাংলা কাব্যের সেই যুগের প্রতিভূ, যখন রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল থেকে মুক্ত হবার ইচ্ছেটা জেগে উঠেছে, কিন্তু অন্য পথ ঠিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ (পৃষ্ঠা ১৪৭)

বইটির নামপ্রবন্ধে লেখক বলেন, ‘যাকে আমরা মতামত বলি সে-জিনিসটা অত্যন্ত অস্থির। তার উপর নির্ভর করতে ভয় হয়।’ (পৃষ্ঠা ১৪৯) অন্যত্র বলেন, ‘সমালোচনাকেই সাহিত্য করে তুলতে পারলে মস্ত একটা সুবিধে এই যে পরবর্তীযুগে মতামতগুলো সর্বাংশে গ্রাহ্য যদি না-ও হয়, সাহিত্যরসের প্রলোভনেই পাঠক সেখানে আকির্ষিত হবে, তার মধ্যে সত্য প্রচ্ছন্ন থেকে মনকে নাড়া দেবে সুন্দর, তাই কোনও কালেই তা ব্যর্থ হবে না।’ (পৃষ্ঠা ১৫১) বুদ্ধদেব বসু ‘কালের পুতুল’ বইয়ে তার সমকালীন কয়েকজন বাঙালি কবির রচনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনায় তার উৎসাহ, অনুরাগ, শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন কবিতার সঙ্গে আছেন। তাই নিজেকে সার্থক বলে মনে করেন। তার এই সার্থকতাবোধ আসে মূলত মূল্যবোধ থেকে। বুদ্ধদেব বসুর সেই মূল্যবোধ আমাদেরও শিখিয়েছে সমালোচনা করার ধরন। বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে তার সমালোচনায়। উপকৃত হয়েছেন কবি-লেখক ও বোদ্ধারা।   

সবশেষে বলতে হয়, বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য আলোচনায় বিশেষ কিছু ব্যাপার লক্ষণীয়। মাইকেলের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার যে বিস্তার ঘটেছে; ক্রমেই সেই আধুনিকতায় এসেছে নবতর পরিবর্তন। এতদিন ধরে নীতিবাদী সাহিত্যচর্চার ভেতরে থেকে বাংলা কবিতায় রোমান্টিকতার যে প্রাবল্য প্রবহমান ছিল। তিরিশের দশকে এসে ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাবে বাংলা কবিতাও ভাবপ্রকরণে বদলে যেতে থাকে। বদলে যাওয়া কবিতার স্বরূপ সুচিহ্নিত করার প্রয়াসে বুদ্ধদেব বসু ভেবেছেন। এমনকি সেই কাব্যভাবনা প্রবন্ধ আকারে লিখে প্রচারের ব্যবস্থাও করেছেন। সেসব পড়ে মনে হবে যেন পাঠকেরই প্রতিক্রিয়া।

বই: কালের পুতুল
লেখক: বুদ্ধদেব বসু
প্রকাশক: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ১৮০ টাকা
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১০

লেখক হওয়ার স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় ।। সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

লেখক হওয়ার গল্প বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, আমি চাপা স্বভাবের মানুষ। সব কথা বলতে পারি না, তাই লিখে প্রকাশ করি। ভালো লাগা থেকে শুরু হলেও এখন তা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। আর ভালোবাসার প্রতি একটি দায়িত্ববোধ এসে যায়। মূলত আমি আশাবাদী ও স্বপ্নবিলাসী। তবে আমার কোন উচ্চাশা নেই। আমার আশাবাদ ও স্বপ্নবিলাসই আমাকে লেখক হতে উৎসাহ জুগিয়েছে। লেখালেখির মাঠে আমি কচ্ছপগতির একজন প্রতিযোগী। অনেকের চেয়ে অনেক পেছনে। তা বলে আমি থেমে নেই। লিখছি এবং লিখব। এটাই আমার দৃঢ় প্রত্যয়।

তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় একটি গল্প লিখেছিলাম। লিখে লুকিয়ে রাখলাম। তবুও তা পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের হাতে পৌঁছে গেল। স্কুল থেকে ফিরে দেখি সবাই আমাকে দেখে মুচকি হাসছেন। মা জানালেন আসল ঘটনা। আমি বেশ লজ্জা পেলাম। কারো চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। তবে ব্যাপারটিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিলেন আমার মরহুম নানাজান মাওলানা আফছার উদ্দিন আহমেদ। বলতে গেলে, আমার লেখালেখির পেছনে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ছিল তার। ছোটবেলায় নানার কাছে থাকতাম। নানা রাত জেগে জেগে অনেক বই পড়তেন। তার দেখাদেখি পাঠ্যবই বাদ দিয়ে আমিও পড়তে শুরু করি।

কবি-লেখকদের জীবনী আমাকে বেশি আকৃষ্ট করত। তখন থেকেই নিজেও লিখতে চেষ্টা করি। সে সময়ের লেখাগুলো এখন আমার কাছে নেই। থাকলে হয়তো নিজেই লজ্জা পেতাম। এখনো খুব ভালো লিখি কি না জানি না। তবে প্রতি সপ্তাহে দু’একটা লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, অনলাইনে বা ওয়েবম্যাগে ছাপা হয়। যা-ই হোক, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় পাঠ্যবইয়ের একটি কবিতাকে (শিরোনাম স্মরণ নেই) নকল করে একটি কবিতা লিখেছিলাম। আমার মরহুম মামা মাওলানা মেছবাহ উদ্দিন ফয়েজী সেটি দেখে বললেন, ‘অন্যেরটা নকল করে কেন? নিজে লেখার চেষ্টা করো।’ সে সময় তার কথায়ও উৎসাহ পেয়েছিলাম।

তখন থেকেই ছাপার অক্ষরে আমার লেখা দেখার সাধ জাগতে শুরু করে। পত্রিকার পাতা থেকে ঠিকানা নিয়ে অনেক পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছি। কিন্তু ছাপা হয়নি। মাঝে মাঝে মন খারাপ হতো। এই মন খারাপের বয়সে হৃদয় মাঝে হঠাৎ প্রেম উঁকি দেয়। বালিকার প্রেমে পড়ে ডজন ডজন প্রেমের কবিতা লিখতাম। বন্ধুরাও কবিতা ধার নিত। কাউকে কাউকে আবার প্রেমপত্র লিখে দিতাম। বিনিময়ে তারা বনরুটি আর সবরি কলা খাওয়াতেন। মূলত কবি বলেই ভেতরে একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব চলে আসে। এই ভাব থেকেই লেখক হওয়ার বাসনা আরও তীব্র হয়।
তবে এর বাইরেও একটা কারণ ছিল, অভাব। দাদার মৃত্যু ও নদী ভাঙন আমাদের অভাবের মুখে ফেলে দেয়। বাবার অক্লান্ত পরিশ্রমে টেনেটুনে সংসার চলছে। তাই কখনোই কোনো আবদার বাবা পূরণ করতে পারেননি। এই অভাবের কারণেই নানাবাড়ি থাকতে হয়েছে আমাকে। এককথায় বলতে গেলে, ভাব আর অভাবের সংমিশ্রণে হৃদয়ের ভেতরে ধীরে ধীরে কবিসত্তা জেগে উঠেছে।

এখনো ভাব আছে, অভাবও আছে। মাঝে মাঝে নিজেকে শূন্য মনে হয়। কখনোই মানুষের জীবনে পূর্ণতা আসে না। কিছু না কিছুর অভাব থেকে যায়। হয়তো লেখকের অন্তরে এই অভাব বোধ থাকতে হয়। তো যা বলছিলাম, এসএসসি পরীক্ষার আগমুহূর্তে লেখার ভাবটা তীব্র হয়ে ওঠে। আমার মেজভাই নুরুদ্দিন আহমেদ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। রাতে ঘুমুতে গেলে তিনি বকতে থাকেন, ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল অইবি? লেখাপড়া নাই। সারাদিন খালি কবিতা আর কবিতা’। আমি চুপ। কথার জবাব দিলেন বড়ভাই মোছলেহ উদ্দিন, ‘ল্যাখুক না। সমস্যা কি ল্যাখলে? রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তো একদিনেই বিখ্যাত হয় নাই।’ আমি মনে মনে আন্দোলিত হই। উৎসাহ পাই। যা হোক, অন্তত একজন আমার পাশে আছেন। এসএসসির কেন্দ্রীয় পরীক্ষার রাতেও কবিতা লিখেছি। অনেক টেনশন হলে কবিতা লিখতে ইচ্ছে হতো।

এইচএসসি পড়ার সময় একটা টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে যাই। সবাই ধরে নিয়েছিলেন, আমাকে দ্বারা লেখাপড়া হবে না। অবস্থাটাও তেমন। ভর্তি হয়ে ক্লাসে যাই না। ঢাকা থেকে চলে যাই গ্রামের বাড়ি। উপন্যাস লিখতে শুরু করি। দু’তিনটা লিখেও ফেলি। কিভাবে ছাপানো যায়? চিন্তাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। উপায় খুঁজে পাই না। বাংলাবাজারের অনেক প্রকাশনীর সাথে যোগাযোগ করি। তাতে টাকার প্রয়োজন। ফিরে আসি। তবুও থেমে নেই। লিখে যাই প্রতিনিয়ত। আমার কবিতার খাতার কিছু পাঠক তৈরি হয়। তারা পড়ে উৎসাহ দেন। ভালো লাগে। পোশাক-আশাক, চলা-ফেরায় পরিবর্তন আসে। চটের ব্যাগ কিনি। পাঞ্জাবি-পাজামা পরি। সবাই ‘কবি’ বলে ডাকে। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অপূর্ণতা থেকেই যায়। একটা লেখাও প্রকাশ হলো না।

একটা সময় সে আশাও পূর্ণ হয়। আমার লেখা প্রথম প্রকাশ হয় জেলা শহর থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায়। ছাপার হরফে আমার কবিতা দেখে সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম, তা আজ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সম্মান শ্রেণিতে পড়তে এসে লেখালেখির তাড়নায় যুক্ত হয়ে যাই মফস্বল সাংবাদিকতায়। ছোট কাকা মো. খবির উদ্দিনের সহায়তায় দৈনিক দেশবাংলায় কালকিনি উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ শুরু করি। কালকিনি প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। বিশেষ করে শহীদ ভাই, খায়রুল ভাই, জাকির ভাই ও মিন্টু ভাইসহ অনেকেই নিউজ ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন। সংবাদের পাশাপাশি লেখালেখির একটা প্লাটফর্ম পেয়ে যাই। কলেজের নোটিশ বোর্ডের মাধ্যমে গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম গল্পেই বিশেষ পুরস্কার পেয়ে গেলাম। পুরস্কারের সুবাদে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বিশ্লেষণ’, ‘সাপ্তাহিক আনন্দবাংলা’ও ‘দৈনিক সুবর্ণগ্রামে’ লেখার জন্য অনুমতি পেলাম। ২০০৮ সালে দৈনিক দেশবাংলার সাহিত্য পাতায় তানভীর আলাদিনের সম্পাদনায় কবিতা ছাপা হলো। এরপর থেমে থাকতে হয়নি। জেলার গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় দৈনিকসহ সাহিত্যের ছোটকাগজে লেখালেখি শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লেখা আহ্বান করে। খুলনা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, নীলফামারি, জামালপুর, হাতিয়া, আগৈলঝাড়াসহ বিভিন্ন শহর থেকে আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। জাতীয় দৈনিকগুলোর পাঠক পাতায় লেখা প্রকাশ হতে থাকে। পাঠকদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। এছাড়া দেশের বাইরে কলকাতার ‘কারক’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হয়।

এভাবেই দিন দিন আগ্রহ বাড়তে থাকে। তাই তো লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিতেই সাংবাদিকতাকে বেছে নেই। বলতে গেলে, মনের তাগিদেই লিখছি। লেখাটা একটা নেশায় পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে মন থেকে যখন ভাব ও অভাব দূর হয়ে যায়; তখন কিছুই লিখতে পারি না। চেষ্টা করেও পারি না। সে সময় অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগি। মনে হয়, আমি আমার লেখক সত্তাকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে অসহায় মনে হয়। ভাবের জন্য বিরহের দরকার। অভাবের জন্য ঔদাসিন্য দরকার। তখন দু’টাকেই অর্জনের চেষ্টা করি।

যখন মফস্বলে থাকতাম। প্রতি শুক্রবার সাহিত্যপাতা উল্টালে কতজনের লেখা পড়তাম। ভাবতাম, সবাই ঢাকায় বসে লিখছেন। আমি লেখা পাঠাতে থাকি। কিন্তু ছাপা হয় না। চেষ্টা করতে করতে একসময় নিয়মিত ছাপা হতে শুরু করে। যায়যায়দিন, জনতায় নিয়মিত কলাম লিখি। কোনো কোনো পত্রিকায় ফিচার। কালের কণ্ঠ থেকে বারোশ টাকার চেক পেয়েছিলাম, যা আজও চেক হয়েই আছে। কারণ তখন আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। বলা যায়, মফস্বল শহরে থাকি বলে লেখার জন্য তেমন কোন পারিশ্রমিক জোটে না। ফলে বাধ্য হয়ে অন্য কাজও করতে হয়। কিন্তু কোন কাজই আমার জন্য স্থায়ী হয় না। তাই পরিবারের গঞ্জনা, প্রিয়জনের তিরস্কার অবধারিত। ‘কিছু একটা করো’র তাগাদা। আমি তো কিছু একটা করছি। কিন্তু তাতে অর্থ নেই। আর সবাই তো অর্থই চায়।

পরনে পাঞ্জাবি-পাজামা আর পায়ে চটি জুতোর সঙ্গে কাঁধে একটা চটের ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। দুটি এনজিওর পথনাটক করি। কখনো কোচিং, কখনো কেজি স্কুল, কখনো বা কলেজে পড়াই। প্রথম দর্শনেই সবাই কবি বা লেখক বলেই ডাকেন। তাদের ভাবনাটা স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে মনে হয়, একসময় খালাতো ভাই মহিউদ্দিনের দেখাদেখিও লেখালেখি ও আবৃত্তির উৎসাহ পেয়েছিলাম। তার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনতাম। সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ বহুবার শুনেছি তার কণ্ঠে। তার লেখা একাধিক কবিতাও পড়েছি। তার স্টাইল আমাকে আকৃষ্ট করত। তাকেই অনুসরণ করেছি। এ নিয়ে আত্মীয়-স্বজনের গালমন্দও শুনেছি। কিন্তু আজ তিনি লেখালেখির জগতে নেই। পারিবারিক বেড়াজালে বিপর্যস্ত এক দিকহারা নাবিক। জীবন-জীবিকার সন্ধানে তার কবি প্রতিভা আজ বিলুপ্ত এক ঐতিহ্য। আমি কিন্তু থেমে যাইনি। হেরে যেতে চাইনি বা হেরে যাইনি। আমি এর শেষ দেখবো বলেই আজও লিখছি। লেখক হওয়ার স্বপ্ন এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

২০১৪ সালে মফস্বলের সব ছেড়ে পাড়ি জমালাম ঢাকায় বন্ধু সাংবাদিক বাদল খানের সহায়তায় একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করলাম। তখনো ঢাকার সাংবাদিকতা বা সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে কোনো আইডিয়া নেই। সেই আগের মতোই দিকনির্দেশনা ছাড়াই পথচলা। কী লিখবো, কেন লিখবো, কীভাবে লিখবো—বলার মতো কোনো অভিভাবক নেই। এভাবেই কেটে গেল দু’বছর। টিভি নাটকে অভিনয়ের জন্যও ছুটলাম বিভিন্ন থিয়েটার ও পরিচালকদের সান্নিধ্য পেতে। তাতেও সফল হতে পারিনি। একসময় অভিনয়, থিয়েটার ছেড়ে দিলাম। ভাবলাম, জীবিকার জন্য মন দিয়ে সাংবাদিকতাই করি। পাশাপাশি লেখালেখি। ব্রেকিং নিউজ ছেড়ে যোগ দিলাম জাগো নিউজে।

সেই সময়ে (২০১৬) হঠাৎ চিন্তাসূত্রের মেইলে একটা লেখা পাঠালাম। তখনো জানি না সম্পাদক কে? লেখাটি প্রকাশ হলো। ফিরতি মেইলে লিঙ্ক পেলাম। সাথে চিন্তাসূত্রের ফেসবুক লিঙ্ক। মাঝে মাঝে ইনবক্সে কথা হয়, লেখালেখির বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দেন। বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে বলেন। এভাবেই যেন আস্তে আস্তে চোখ খুলে গেল। লেখার বিস্তর আইডিয়া পেতে থাকলাম। তারপর থেকে নিয়মিত লিখেছি চিন্তাসূত্র ছাড়াও ভোরের কাগজ, জনকণ্ঠ, মানবকণ্ঠ, যায়যায়দিনে। এখনও ডাক পেলে বিভিন্ন পত্রিকায় লিখি। বর্তমানে সময়ের আলোতে নিয়মিত লিখছি। চিন্তাসূত্র ও জাগো নিউজকে তো নিজের বলেই ভাবি।

অপরদিকে ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত বই প্রকাশ হতে থাকে। মফস্বলে থাকতে যে স্বপ্ন দেখতাম। তাও বাস্তবতায় রূপ নেয়। কবিবন্ধু পলিয়ার ওয়াহিদের সাহায্যে পরিচয় হয় দোয়েলের সঙ্গে। এরপর অনুবাদ, মাতৃভাষা, অন্যধারাও আমার বই প্রকাশ করে। এ পর্যন্ত আটটি বই প্রকাশ হয়। বইগুলো যথাক্রমে—গল্পের বই ‘সার্কাসসুন্দরী’, ‘নিশিসুন্দরী’ ও ‘সুন্দরী সমগ্র’। কবিতার বই ‘মিথিলার জন্য কাব্য’ ও ‘তুমি চাইলে’। সাক্ষাৎকার সংকলন ‘আমার আমি’ ও সচেতনতামূলক বই ‘অগ্নিকাণ্ড সতর্কতা ও নির্বাপণ কৌশল’। আর প্রথম উপন্যাস ‘মমতা’। সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছি সুনীল সাহিত্য পুরস্কার- ২০০৬, ২০১০ ও ২০১১, কালকিনি প্রেসক্লাব সম্মাননা, কালকিনি কলেজ বাংলা বিভাগ সম্মাননা, এসইএল লেখক সম্মাননা ২০১৬, লেখকবাড়ি পুরস্কার ২০১৭, রকমারি সংবাদ স্টার অ্যাওয়ার্ড ২০১৮, এসবিএসপি-আরপি ফাউন্ডেশন লেখক সম্মাননা ২০১৮, আবুল মনসুর আহমদ প্রবন্ধ পুরস্কার ২০২০ ও সাহিত্য দিগন্ত লেখক পুরস্কার ২০২০।

তাই বলতে চাই, লেখক হতে গিয়ে অনেকের কটাক্ষ যেমন পেয়েছি, ভালোবাসাও কম পাইনি। বিশেষ করে আমার বাবা আমার একনিষ্ঠ পাঠক। তিনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষি। তিনি আমাকে এখনো ব্যাপক উৎসাহ দেন। যদিও একসময় বিরোধিতা করতেন। কারণ তাকে বোঝানো হয়েছিল, ‘বাংলা সাহিত্য পড়ে ছেলেটা উচ্ছন্নে যাবে। চটের ব্যাগ নিয়ে ঘুরবে। দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করবে। ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার করবে না।’ আজ আমি ভুলে গেছি সেসব কথা। বরং সেসব মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। কারণ তাদের তিরস্কারের কারণেই আজ আমি অনেক পুরস্কার পাচ্ছি। অনেক ভালোবাসা পাচ্ছি। বিরোধিতা করা অনেকেই এখন আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। আমার স্ত্রীও উৎসাহ জোগান। বাবা-মা, ভাই-বোন, ভাবিরাও সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন। জনপ্রিয় লেখক হতে না পারলেও তাদের আস্থাভাজন হতে পেরেছি।

আমার মনে হয়, লেখালেখিটা প্রধানত সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক ক্ষমতা। ইচ্ছে করলেই লেখক হওয়া যায় না। তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যবসায়। ত্যাগের মানসিকতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। সর্বোপরি লিখতে হলে পড়তে হবে। অনেকেই অনেক কবি-লেখক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে লেখকের কল্পনা শক্তি হতে হবে প্রখর। লেখকের ‘তৃতীয় নয়ন’ বলে একটা বিষয় আছে। যা আর দশজন সাধারণ মানুষের নেই। কবি ও অকবিদের মধ্যে মূল পার্থক্য এখানেই। সাধারণ মানুষ যে জিনিসটি সাধারণভাবে দেখেন; একজন অসাধারাণ মানুষ সেটাকে অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখেন। একজন লেখকের দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের অন্যান্য মানুষের চেয়ে আলাদা হতে হয়।

জানি না, আমি তেমন হতে পেরেছি কি-না? হওয়ার চেষ্টা করছি। আমি যদি ভালো লেখক না-ও হতে পারি; তবুও আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। নিন্দুকের নিন্দা, মানুষের কটাক্ষ, সমাজের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই এ সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। আমি ‘রামায়ণ’ না হোক অন্তত একটা নিটোল হাসির গল্প তো লিখে যেতে পারি। তা পড়ে যদি অন্তত একজনের মুখে হাসি ফোটে, তাতেই আমার সার্থকতা। তাই আমার মতে, প্রত্যেকটি সমাজে অন্তত একজন করে লেখক থাকা দরকার।