সালাহ উদ্দিন মাহমুদ :
উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান বাঙালি মহিলা চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৭ নভেম্বর। যে মহিয়সী নারী জীবদ্দশায় মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। আজ তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করছি তাঁকে। অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। তিনিই প্রথম ধাত্রীবিদ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করে অজ্ঞ ও অবহেলিত নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। অবগুন্ঠিত নারী সমাজের উন্নত চিকিৎসার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির শক্ত বাধাকে অতিক্রম করে নারী সমাজের মুক্তিদাত্রী হিসেবে ধূমতেুর মত আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের অনগ্রসর চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে এসেছিলেন।
এ মহিয়সী নারী ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার গোপালপুর গ্রামের প্রভাবশালী সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ও আধুনিক চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। তিনি দেশভাগের ঘোরবিরোধী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করতেন না। ফলে বাবার মানবতাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হলে থাকে অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত কিশোরী জোহরার মননে ও চেতনায়। মাতা আঞ্জুমান নেছা রায়পুর পৌরসভার প্রথম মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কর্মনিষ্ঠ সাদাসিধে এক নারী।
তখন ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনের উত্তাল সময়। এ সময় ডা. জোহরা বেগম কাজীর শৈশব-কৈশোর কাটে মানবতাবাদী পিতার কর্মস্থল মহাত্মা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ। রাজনানগাঁওয়ের রানি সূর্যমুখী প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের টোল ‘পুত্রিশালায়’ তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ছাত্রজীবনে তিনি বরাবরই মেধাবী ছিলেন। ক্লাসে সব সময় প্রথম হতেন। ফলে সাফল্যের সাথে মেট্রিক পাস করেন। ১৯২৯ সালে তিনি আলীগড় মুসলিম মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে আইএসসি পাস করে কলেজ জীবন সমাপ্ত করেন। এরপর উপমহাদেশের প্রথম মহিলা মেডিকেল কলেজ দিল্লির লেডি হার্ডিং গার্লস মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে তিনিই প্রথম মুসলিম বাঙালি ছাত্রী। এখান থেকে ১৯৩৫ সালে এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। তখন তাকে সম্মানজনক ‘ভাইস রয়’ পদক প্রদান করা হয়।
ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা জোহরা বেগম কাজীর গান্ধী সেবাশ্রমে কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। এছাড়া অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩ বছর কাটিয়েছেন তিনি। পরে বৃত্তি নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য লন্ডনে পড়াশুনা করেছেন এবং চিকিৎসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি এফআরসিওজি লাভ করে ভারতে ফিরে আসেন। গান্ধী পরিবারের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে নাগপুরে অবস্থিত গান্ধীর সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ তিনি অবৈতনিক চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশবিভাগের পর তিনি বড়ভাই অধ্যাপক কাজী আশরাফ মাহমুদ ও ছোটবোন ডা. শিরিন কাজীর সাথে বাংলাদেশের ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যোগদান করেই গাইনি (স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা) বিভাগ চালু করেন। এছাড়াও তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন। পরবর্তীতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) অনারারি কর্নেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
সাতচল্লিশ- পরবর্তী বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। তিনি একাধারে চিকিৎসাশাস্ত্রে বাঙালি নারী চিকিৎসকদের অগ্রপথিক, মানবতাবাদী ও সমাজ-সংস্কারক ছিলেন। গর্ভবতী মায়েরা হাসপাতালে এসে যেন চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন, সে জন্য তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারীদের জন্য পৃথক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। পিছিয়ে পড়া নারীদের জাগরণ তথা চিকিৎসাশাস্ত্রে নারীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। তারই দেখানো পথে আজ বাংলাদেশে অসংখ্য নারী চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। তাঁর জ্বালিয়ে দেওয়া আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে আজ অনেক নারী চিকিৎসক আলোকিত করছে গ্রামবাংলার অবহেলিত জনপদের চিকিৎসা জগতের অন্ধকার প্রকোষ্ট।
শুধু তা-ই নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। এছাড়াও একজন ইতিহাস সচেতন মানুষ হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিনির্মাণের লক্ষে তিনি ২০০১ সালের ১১ জুলাই তাঁর কাছে সংরক্ষিত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত ঐতিহাসিক পত্র, ভাইস রয় পদক, সনদসমূহ এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি-স্মারক আমাদের জাতীয় জাদুঘরে দান করে গেছেন।
ডা. জোহারা বেগম কাজী জীবনের শুরু থেকেই সময়ের ধারাবাহিকতায় কর্মময় জীবনে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর স্ত্রী কন্তুরাবার øেহসিক্ত হয়েছেন। পরবর্তীতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও মহাত্মা গান্ধীর øেহভাজন কংগ্রেসের অন্যতম কর্মী ডা. সুশীলা নায়ারসহ অসংখ্য মানবতাবাদী বিপ্লবী মানুষের সাহচর্য লাভ করেছেন।
জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে ডা. জোহরা বেগম কাজী বিভিন্ন খেতাব ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘তখমা-ই পাকিস্তান’ খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ‘ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) তাকে বিএমএ স্বর্ণপদক প্রদান করে। ২০০২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘রোকেয়া পদক’ প্রদান করেন। ২০০৮ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) প্রদান করে সম্মানিত করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ৩২ বছর বয়সে তৎকালীন আইনজীবি ও সংসদ সদস্য রাজু উদ্দিন ভূইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আজীবন মানব সেবায় নিয়োজিত জোহরা বেগম কাজী ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর ৯৫ বছর বয়সে ঢাকার নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রতিবছর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকায় মাদারীপুর জেলা সমিতির উদ্যোগে স্মরণ সভা ও পৈতৃক নিবাস মাদারীপুরের কালকিনির মানুষ স্মরণ সভা ও মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করে। এ মহিয়সী নারী আমাদের মাঝে চিরদিন চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ,
সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান বাঙালি মহিলা চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৭ নভেম্বর। যে মহিয়সী নারী জীবদ্দশায় মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। আজ তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করছি তাঁকে। অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। তিনিই প্রথম ধাত্রীবিদ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করে অজ্ঞ ও অবহেলিত নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। অবগুন্ঠিত নারী সমাজের উন্নত চিকিৎসার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির শক্ত বাধাকে অতিক্রম করে নারী সমাজের মুক্তিদাত্রী হিসেবে ধূমতেুর মত আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের অনগ্রসর চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে এসেছিলেন।
এ মহিয়সী নারী ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার গোপালপুর গ্রামের প্রভাবশালী সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ও আধুনিক চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। তিনি দেশভাগের ঘোরবিরোধী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করতেন না। ফলে বাবার মানবতাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হলে থাকে অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত কিশোরী জোহরার মননে ও চেতনায়। মাতা আঞ্জুমান নেছা রায়পুর পৌরসভার প্রথম মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কর্মনিষ্ঠ সাদাসিধে এক নারী।
তখন ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনের উত্তাল সময়। এ সময় ডা. জোহরা বেগম কাজীর শৈশব-কৈশোর কাটে মানবতাবাদী পিতার কর্মস্থল মহাত্মা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ। রাজনানগাঁওয়ের রানি সূর্যমুখী প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের টোল ‘পুত্রিশালায়’ তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ছাত্রজীবনে তিনি বরাবরই মেধাবী ছিলেন। ক্লাসে সব সময় প্রথম হতেন। ফলে সাফল্যের সাথে মেট্রিক পাস করেন। ১৯২৯ সালে তিনি আলীগড় মুসলিম মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে আইএসসি পাস করে কলেজ জীবন সমাপ্ত করেন। এরপর উপমহাদেশের প্রথম মহিলা মেডিকেল কলেজ দিল্লির লেডি হার্ডিং গার্লস মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে তিনিই প্রথম মুসলিম বাঙালি ছাত্রী। এখান থেকে ১৯৩৫ সালে এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। তখন তাকে সম্মানজনক ‘ভাইস রয়’ পদক প্রদান করা হয়।
ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা জোহরা বেগম কাজীর গান্ধী সেবাশ্রমে কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। এছাড়া অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩ বছর কাটিয়েছেন তিনি। পরে বৃত্তি নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য লন্ডনে পড়াশুনা করেছেন এবং চিকিৎসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি এফআরসিওজি লাভ করে ভারতে ফিরে আসেন। গান্ধী পরিবারের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে নাগপুরে অবস্থিত গান্ধীর সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ তিনি অবৈতনিক চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশবিভাগের পর তিনি বড়ভাই অধ্যাপক কাজী আশরাফ মাহমুদ ও ছোটবোন ডা. শিরিন কাজীর সাথে বাংলাদেশের ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যোগদান করেই গাইনি (স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা) বিভাগ চালু করেন। এছাড়াও তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন। পরবর্তীতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) অনারারি কর্নেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
সাতচল্লিশ- পরবর্তী বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। তিনি একাধারে চিকিৎসাশাস্ত্রে বাঙালি নারী চিকিৎসকদের অগ্রপথিক, মানবতাবাদী ও সমাজ-সংস্কারক ছিলেন। গর্ভবতী মায়েরা হাসপাতালে এসে যেন চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন, সে জন্য তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারীদের জন্য পৃথক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। পিছিয়ে পড়া নারীদের জাগরণ তথা চিকিৎসাশাস্ত্রে নারীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। তারই দেখানো পথে আজ বাংলাদেশে অসংখ্য নারী চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। তাঁর জ্বালিয়ে দেওয়া আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে আজ অনেক নারী চিকিৎসক আলোকিত করছে গ্রামবাংলার অবহেলিত জনপদের চিকিৎসা জগতের অন্ধকার প্রকোষ্ট।
শুধু তা-ই নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। এছাড়াও একজন ইতিহাস সচেতন মানুষ হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিনির্মাণের লক্ষে তিনি ২০০১ সালের ১১ জুলাই তাঁর কাছে সংরক্ষিত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত ঐতিহাসিক পত্র, ভাইস রয় পদক, সনদসমূহ এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি-স্মারক আমাদের জাতীয় জাদুঘরে দান করে গেছেন।
ডা. জোহারা বেগম কাজী জীবনের শুরু থেকেই সময়ের ধারাবাহিকতায় কর্মময় জীবনে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর স্ত্রী কন্তুরাবার øেহসিক্ত হয়েছেন। পরবর্তীতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও মহাত্মা গান্ধীর øেহভাজন কংগ্রেসের অন্যতম কর্মী ডা. সুশীলা নায়ারসহ অসংখ্য মানবতাবাদী বিপ্লবী মানুষের সাহচর্য লাভ করেছেন।
জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে ডা. জোহরা বেগম কাজী বিভিন্ন খেতাব ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘তখমা-ই পাকিস্তান’ খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ‘ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) তাকে বিএমএ স্বর্ণপদক প্রদান করে। ২০০২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘রোকেয়া পদক’ প্রদান করেন। ২০০৮ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) প্রদান করে সম্মানিত করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ৩২ বছর বয়সে তৎকালীন আইনজীবি ও সংসদ সদস্য রাজু উদ্দিন ভূইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আজীবন মানব সেবায় নিয়োজিত জোহরা বেগম কাজী ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর ৯৫ বছর বয়সে ঢাকার নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রতিবছর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকায় মাদারীপুর জেলা সমিতির উদ্যোগে স্মরণ সভা ও পৈতৃক নিবাস মাদারীপুরের কালকিনির মানুষ স্মরণ সভা ও মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করে। এ মহিয়সী নারী আমাদের মাঝে চিরদিন চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ,
সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।