সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন হিসাবে আখ্যায়িত করলে অত্যুক্তি করা হবে না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালী পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত কুন্ডুবাড়ির মেলায় আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানই কয়েকগুণ বেশি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়-‘ গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।’ এইতো ছিল আমাদের গ্রামবাংলার সম্প্রীতির চিরায়ত সংস্কৃতি। কিন্তু ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোড়ামী আজ যখন সাম্যের পথে বাধা হয়ে শক্ত প্রাচীর গড়তে যাচ্ছে সে সময়ে এমন মিলন মেলা আমাদের অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ আমরা ফিরে পেতে চাই সোনালী দিন। আমরা বলতে চাই- আমরা জন্মসুত্রে বাংলাদেশী। জাতিগত পরিচয়ে আমরা এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।
দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়- মেলার একদিকে মন্দিরে চলে পূজা-অর্চনা। অন্যদিকে বিশাল এলাকা জুড়ে পণ্যের বিকি-কিনি। সর্বোপরি বাধভাঙা আনন্দ উপচে পড়ে বিনোদন মঞ্চে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা আসে তাদের পণ্যের পসার সাজাতে। দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ আসবাবপত্রের মেলা হিসাবে খ্যাত কুন্ডুবাড়ির মেলা শতবছর পেরিয়ে সহস্র-অযুত-লক্ষ-নিযুত-কোটি বছর কিংবা আজীবন টিকে থাকবে। টিকে থাকবে এ অঞ্চল তথা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কারণ হিন্দুদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেলাকে সফল করতে নির্দ্বিধায় এগিয়ে আসে স্থানীয় মুসলমানরা। সম্প্রতি রামু ও উখিয়ায় ঘটে যাওয়া সহিংসতাও দমাতে পারেনি আয়োজকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা । গ্রামবাংলার শতবছরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে দলমত নির্বিশেষে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এক্ষেত্রে আন্তরিকতার কমতি নেই স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের।
কুন্ডুবাড়ির মেলার উৎপত্তির ইতিহাস দুর্বোধ্য হলেও ধারণা করা হয়- স্থানীয় সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালীপূজা উপলক্ষে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে মাদারীপুরের কালকিনি পৌর এলাকার গোপালপুর গ্রামের কুন্ডুবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা। সঠিক দিন তারিখ কেউ না জানলেও ধরে নেওয়া হয় আনুমানিক আঠারো শতকের শেষের দিকে কুন্ডুদের পূর্বপুরুষরা ধর্মীয় উৎসব কালীপূজার আয়োজন করে। ক্রমান্বয়ে তাদের পূজাকে ঘিরে প্রথমে বাদাম, বুট, রয়্যাল গুলি, লাঠি লজেন্স, মন্ডা-মিঠাই ও খেলনা নিয়ে অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ী বসতো। পরে আস্তে আস্তে প্রতিবছর ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় এখবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসতে শুরু করে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা এর নামকরণ করেন ‘কুন্ডুবাড়ির মেলা’ নামে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থিরতার মধ্যে মেলা বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ মেলা জমজমাটভাবে হয়ে আসছে।
প্রতিবছরের মতো এ বছরও ১৩ নভেম্বর সকাল থেকে ১৭ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কুন্ডুবাড়ির মেলা। তিন দিনব্যাপী হওয়ার কথা থাকলেও ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনা করে আরো দু’দিন বাড়িয়ে সমাপ্ত হলো। মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা বাঁশ, বেত, ইস্পাত-কাঠের আসবাবপত্র, খেলনা ও প্রসাধনীসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে আসেন। অনেকে আসেন পণ্য সামগ্রী কিনতে। পাশাপাশি নাগর দোলা, পুতুল নাচসহ বিভিন্ন বিনোদনে আকৃষ্ট হয় দর্শনার্থীরা। বস্তুত বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মেলা হয়ে ওঠে উপভোগ্য। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চাপ কম থাকলেও বিকেলের পরে বাড়তে থাকে জনস্রোত। বিশাল জনসমুদ্রে রূপ নেয় মেলা প্রাঙ্গন। তবুও মেলার দীর্ঘ ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনার নজির নেই।
মেলায় আগত দর্শনার্থীরা কেউ কেউ বাচ্চাদের জন্য খেলনা, আসবাবপত্র কিংবা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনছেন। আবার কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ব্যবসায়ীদের প্রচুর লাভ হয়। কোন ঝুট-ঝামেলাও নেই। মেলা উদযাপন কমিটিও যথেষ্ট আন্তরিক। কুন্ডুবাড়ির মেলা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্ণ। তাই বংশ পরম্পরায় তারা এ ঐতিহ্যকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। তিনি আরো জানালেন, তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি আঠারো শতকের শেষের দিকে এ মেলার প্রবর্তন করেন। শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ মিলন মেলা। এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সব ধর্মের মানুষ আসে। হিন্দু-মুসলমান কে কোন জাত সে বিচারের উর্ধ্বে গিয়ে সম্প্রীতির বন্ধন গড়াই সকলের উদ্দেশ্য। জাতিগত সীমাবদ্ধতার বাহিরে উদার মানসিকতার পরিচয় মেলে এখানে। বেচা-কেনা কেবল উপলক্ষ মাত্র। আমরা বাঙালি। আমাদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার একাত্মতা ঘোষণার একটা প্লাটফর্ম বলা যায়।
মেলার অগণিত মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য পূজা মন্ডপের পাশে স্থায়ীভাবে একটি পুলিশ কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) ও গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তাদের সহযোগিতা করেন। ফলে বিশৃঙ্খলার কোন সুযোগ নেই। কুন্ডুদের পূর্বপুরুষদের প্রবর্তিত এ মেলা শতবছর পেরিয়েছে। মেলার আয়োজকরা হিন্দু হলেও এটা এখন এলাকার ঐতিহ্য ও সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। এ ঐতিহ্য ও সম্পদ টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের। ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা এ অঞ্চলের প্রাণের উৎসব। তাই পূর্ব নির্ধারিত তিনদিনের হলেও বর্ধিত আরো দু’দিন অর্থাৎ পাঁচদিনে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে এ উৎসব। কুন্ডুবাড়ির মেলা আমাদের শিক্ষা দেয়- রামুর মতো আর সহিংসতা নয়। মানুষে মানুষে হৃদ্যতাই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আমরা বাঁচতে চাই- হাতে হাত রেখে। আমরা বাঁচতে চাই- কাঁধে কাঁধ রেখে।
বিকাল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গন ঘুরেও মনে হয় ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ।’ জনসমুদ্র সাঁতরে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে পড়ে যায়- ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা/ অগ্রাণে নবান্ন উৎসবে/ আবার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়/ বিশ্ববাসী চেয়ে রবে।’ আমাদের শুধু একটাই প্রার্থনা, শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা টিকে থাকুক মানুষের ভালোবাসা আর বন্ধনে। সাম্য ও মৈত্রী হোক এর একমাত্র লক্ষ। কোন অসাম্প্রদায়িকতা যেন এর পবিত্রতাকে বিনষ্ট করতে না পারে এ প্রত্যাশা সকলের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ভরে উঠুক প্রিয় স্বদেশ। একই দুর্বা ঘাসের শিশিরে সিক্ত হোক সকলের চরণ। এক শীতল আবেশে সম্প্রীতির সুবাতাস বইয়ে দিক সবার অন্তরে। এক সামিয়ানার নিচে সব ব্যবধান ভুলে গিয়ে হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে গেয়ে উঠুক মানবতার জয়গান। কুন্ডুবাড়ির মেলা দীর্ঘজীবি হোক। অটুট বন্ধনে চিরজীবি হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কারণ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ এর সাথে তাল মিলিয়ে বলতে হয় সবার উপরে সম্প্রীতি সত্য তার উপরে নাই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।
শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন হিসাবে আখ্যায়িত করলে অত্যুক্তি করা হবে না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালী পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত কুন্ডুবাড়ির মেলায় আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানই কয়েকগুণ বেশি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়-‘ গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।’ এইতো ছিল আমাদের গ্রামবাংলার সম্প্রীতির চিরায়ত সংস্কৃতি। কিন্তু ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোড়ামী আজ যখন সাম্যের পথে বাধা হয়ে শক্ত প্রাচীর গড়তে যাচ্ছে সে সময়ে এমন মিলন মেলা আমাদের অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ আমরা ফিরে পেতে চাই সোনালী দিন। আমরা বলতে চাই- আমরা জন্মসুত্রে বাংলাদেশী। জাতিগত পরিচয়ে আমরা এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।
দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়- মেলার একদিকে মন্দিরে চলে পূজা-অর্চনা। অন্যদিকে বিশাল এলাকা জুড়ে পণ্যের বিকি-কিনি। সর্বোপরি বাধভাঙা আনন্দ উপচে পড়ে বিনোদন মঞ্চে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা আসে তাদের পণ্যের পসার সাজাতে। দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ আসবাবপত্রের মেলা হিসাবে খ্যাত কুন্ডুবাড়ির মেলা শতবছর পেরিয়ে সহস্র-অযুত-লক্ষ-নিযুত-কোটি বছর কিংবা আজীবন টিকে থাকবে। টিকে থাকবে এ অঞ্চল তথা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কারণ হিন্দুদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেলাকে সফল করতে নির্দ্বিধায় এগিয়ে আসে স্থানীয় মুসলমানরা। সম্প্রতি রামু ও উখিয়ায় ঘটে যাওয়া সহিংসতাও দমাতে পারেনি আয়োজকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা । গ্রামবাংলার শতবছরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে দলমত নির্বিশেষে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এক্ষেত্রে আন্তরিকতার কমতি নেই স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের।
কুন্ডুবাড়ির মেলার উৎপত্তির ইতিহাস দুর্বোধ্য হলেও ধারণা করা হয়- স্থানীয় সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালীপূজা উপলক্ষে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে মাদারীপুরের কালকিনি পৌর এলাকার গোপালপুর গ্রামের কুন্ডুবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা। সঠিক দিন তারিখ কেউ না জানলেও ধরে নেওয়া হয় আনুমানিক আঠারো শতকের শেষের দিকে কুন্ডুদের পূর্বপুরুষরা ধর্মীয় উৎসব কালীপূজার আয়োজন করে। ক্রমান্বয়ে তাদের পূজাকে ঘিরে প্রথমে বাদাম, বুট, রয়্যাল গুলি, লাঠি লজেন্স, মন্ডা-মিঠাই ও খেলনা নিয়ে অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ী বসতো। পরে আস্তে আস্তে প্রতিবছর ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় এখবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসতে শুরু করে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা এর নামকরণ করেন ‘কুন্ডুবাড়ির মেলা’ নামে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থিরতার মধ্যে মেলা বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ মেলা জমজমাটভাবে হয়ে আসছে।
প্রতিবছরের মতো এ বছরও ১৩ নভেম্বর সকাল থেকে ১৭ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কুন্ডুবাড়ির মেলা। তিন দিনব্যাপী হওয়ার কথা থাকলেও ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনা করে আরো দু’দিন বাড়িয়ে সমাপ্ত হলো। মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা বাঁশ, বেত, ইস্পাত-কাঠের আসবাবপত্র, খেলনা ও প্রসাধনীসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে আসেন। অনেকে আসেন পণ্য সামগ্রী কিনতে। পাশাপাশি নাগর দোলা, পুতুল নাচসহ বিভিন্ন বিনোদনে আকৃষ্ট হয় দর্শনার্থীরা। বস্তুত বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মেলা হয়ে ওঠে উপভোগ্য। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চাপ কম থাকলেও বিকেলের পরে বাড়তে থাকে জনস্রোত। বিশাল জনসমুদ্রে রূপ নেয় মেলা প্রাঙ্গন। তবুও মেলার দীর্ঘ ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনার নজির নেই।
মেলায় আগত দর্শনার্থীরা কেউ কেউ বাচ্চাদের জন্য খেলনা, আসবাবপত্র কিংবা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনছেন। আবার কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ব্যবসায়ীদের প্রচুর লাভ হয়। কোন ঝুট-ঝামেলাও নেই। মেলা উদযাপন কমিটিও যথেষ্ট আন্তরিক। কুন্ডুবাড়ির মেলা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্ণ। তাই বংশ পরম্পরায় তারা এ ঐতিহ্যকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। তিনি আরো জানালেন, তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি আঠারো শতকের শেষের দিকে এ মেলার প্রবর্তন করেন। শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ মিলন মেলা। এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সব ধর্মের মানুষ আসে। হিন্দু-মুসলমান কে কোন জাত সে বিচারের উর্ধ্বে গিয়ে সম্প্রীতির বন্ধন গড়াই সকলের উদ্দেশ্য। জাতিগত সীমাবদ্ধতার বাহিরে উদার মানসিকতার পরিচয় মেলে এখানে। বেচা-কেনা কেবল উপলক্ষ মাত্র। আমরা বাঙালি। আমাদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার একাত্মতা ঘোষণার একটা প্লাটফর্ম বলা যায়।
মেলার অগণিত মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য পূজা মন্ডপের পাশে স্থায়ীভাবে একটি পুলিশ কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) ও গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তাদের সহযোগিতা করেন। ফলে বিশৃঙ্খলার কোন সুযোগ নেই। কুন্ডুদের পূর্বপুরুষদের প্রবর্তিত এ মেলা শতবছর পেরিয়েছে। মেলার আয়োজকরা হিন্দু হলেও এটা এখন এলাকার ঐতিহ্য ও সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। এ ঐতিহ্য ও সম্পদ টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের। ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা এ অঞ্চলের প্রাণের উৎসব। তাই পূর্ব নির্ধারিত তিনদিনের হলেও বর্ধিত আরো দু’দিন অর্থাৎ পাঁচদিনে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে এ উৎসব। কুন্ডুবাড়ির মেলা আমাদের শিক্ষা দেয়- রামুর মতো আর সহিংসতা নয়। মানুষে মানুষে হৃদ্যতাই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আমরা বাঁচতে চাই- হাতে হাত রেখে। আমরা বাঁচতে চাই- কাঁধে কাঁধ রেখে।
বিকাল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গন ঘুরেও মনে হয় ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ।’ জনসমুদ্র সাঁতরে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে পড়ে যায়- ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা/ অগ্রাণে নবান্ন উৎসবে/ আবার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়/ বিশ্ববাসী চেয়ে রবে।’ আমাদের শুধু একটাই প্রার্থনা, শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা টিকে থাকুক মানুষের ভালোবাসা আর বন্ধনে। সাম্য ও মৈত্রী হোক এর একমাত্র লক্ষ। কোন অসাম্প্রদায়িকতা যেন এর পবিত্রতাকে বিনষ্ট করতে না পারে এ প্রত্যাশা সকলের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ভরে উঠুক প্রিয় স্বদেশ। একই দুর্বা ঘাসের শিশিরে সিক্ত হোক সকলের চরণ। এক শীতল আবেশে সম্প্রীতির সুবাতাস বইয়ে দিক সবার অন্তরে। এক সামিয়ানার নিচে সব ব্যবধান ভুলে গিয়ে হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে গেয়ে উঠুক মানবতার জয়গান। কুন্ডুবাড়ির মেলা দীর্ঘজীবি হোক। অটুট বন্ধনে চিরজীবি হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কারণ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ এর সাথে তাল মিলিয়ে বলতে হয় সবার উপরে সম্প্রীতি সত্য তার উপরে নাই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।