রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

বাচ্চু মিয়ার বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরাম পুর ইউনিয়নের আন্ডার চর গ্রামে পৌঁছতেই দেখা গেল সারিবদ্ধভাবে দাাঁড়িয়ে আছে কিছু দরিদ্র মানুষ। লাইনের সামনে একটা কাঠের টেবিলে কিছু ঔষধ নিয়ে বসে আছেন একজন। তিনি রোগী দেখছেন আর রোগ নির্ণয়ের পর বিনামুল্যে ঔষধ দিচ্ছেন। পিছনে ঝোলানো একটি ব্যানার। তাতে ‘শৃঙ্খলা ও সুস্থ্যতাই সুন্দর জীবন’ স্লোগান লেখা। এরপর ‘মানব স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচী’ ও ‘বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা’সহ বিস্তারিত বিবরণ।
লোকটির নাম বিএম বাচ্চু মিয়া। এ নামটি এখন হতদরিদ্র মানুষের মুখে মুখে। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তিনি দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ঔষধ দিয়ে থাকেন। তার এ কর্মকান্ডে উপকৃত হচ্ছে নিজের গ্রামসহ পাশ্ববর্তী আরও ৪টি ইউনিয়নের মানুষ। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রায় ৫ শতাধিক অসহায় মানুষ ছুটে আসে তার কাছে স্বাস্থ্য সেবা নিতে। চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি মানুষকে সুস্থ্য থাকার নানাবিধ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তার এ কর্মকান্ডের খবর পেয়ে কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ মসিউর রহমান স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম পরিদর্শণ করেন। এবং ২০১১ সালের ২৮ অক্টোবর একটি প্রত্যয়ন পত্র দেন। সবাইকে তিনি একটা কথাই বলেন,‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়। রোগ হওয়ার আগে নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ও সচেতন হওয়া জরুরী।’ তিনি সুস্থ্য থাকতে রীতিমত শাক-সবজি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ছোটবেলা থেকে অসহায় অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করার কথা চিন্তা করতেন। বিশেষ করে হতদরিদ্র মানুষ যখন বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তখন তিনি খুব ব্যথিত হতেন। সে চিন্তা ও দর্শন থেকেই নিজের উপার্জিত অর্থ থেকে ব্যয় করে শুরু করেন তার কার্যক্রম। কেমিস্ট প্যারাডাইস কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ থাকাকালীন ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মানব সেবা ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন। ঐ বছর ৩ ডিসেম্বর শুক্রবার দিন তিনি তার স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচী আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন। সেদিন ২০ জন মেডিকেল অফিসার এনে দিনভর এলাকার অসুস্থ্য মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেন। তার এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রফেসর আসাদুজ্জামান। পরে রিপ্রেজেন্টিটিভের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ঢাকার আইয়ূব মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের সাথে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। আর নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে চালিয়ে যান মানব সেবা। চিকিৎসার স্বার্থে ২০১০ সালের ৩০ জুন পল্লী চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। প্রায় একযুগ ধরে তিনি মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রত্যেক রোগীকে ৪০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত মূল্যের ঔষধ দিয়ে থাকেন। শুরুর দিকে প্রতি শুক্রবার ক্রোকির চর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালালেও প্রতিষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞায় এখন পাশ্ববর্তী আন্ডার চর গ্রামের আনোয়ার হোসেন মাস্টারের বাড়িতে প্রতি বৃহস্পতিবার এ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কোন মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা না করেও কেন এমন কাজের প্রতি বাচ্চু মিয়ার আগ্রহ। এটা তো একটা জটিল বিষয়। রোগ নির্ণয় কিভাবে করবেন। এমন সব প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘আমি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ থাকাকালীন রোগসংক্রান্ত যে বিদ্যা অর্জন করেছি। তা-ই আমাকে সহায়তা করে। এরপর পল্লী চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তাছাড়া আমিতো জটিল রোগের চিকিৎসাও করি না, ঔষধও দেই না। শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তাতে ইনশাআল্লাহ শতকরা নব্বই জন লোকই আমার ঔষধে আরোগ্য লাভ করেছে।’
স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচি ছাড়াও তার আরো কয়েকটি কর্মসূচি রয়েছে। তার মধ্যে বাচ্চু মিয়া নিজ অর্থায়নে সাহেবরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও ক্রোকির চর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র তেরি করে দিয়েছেন। তার দর্জি বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে অর্ধশতাধিক নারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ঘরে বসে অর্থ উপার্জন করছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় গরিব মানুষদেরকে আর্থিকভাবে সহায়তাও করেন।
বিএম বাচ্চু মিয়া এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন সমবায় সমিতি। সমিতির সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে ২০ টাকা করে চাঁদা দেন। সমিতির বর্তমান সঞ্চয় হয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা। এ সমিতির মাধ্যমে বিনা সুদে বিপদগ্রস্ত মানুষকে ঋণ দিয়ে থাকেন। যাতে উপকৃত হয় হতদরিদ্র মানুষ।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেল, অনেক মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিকিৎসার জন্য। নিবিষ্ট মনে রোগী দেখছেন বাচ্চু মিয়া। তাকে সহযোগিতা করছেন দুই নারী। তারা এই মানব সেবা ফাউন্ডেশনের কর্মী। একজন রুনু কাওসারি। তিনি আগত রোগীদের তালিকা করছেন এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। আরেকজন পল্লবী বিশ্বাস। তিনি রোগীদের ঔষধ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে রুনু কাওসারি জানান,‘প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। পাশ্ববর্তী কয়ারিয়া, রমজানপুর, চর দৌলতখান, শিকার মঙ্গলসহ প্রায় ৫টি ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামে এ সেবা কার্যক্রম চলে। ২০০১ সাল থেকে এপর্যন্ত প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে।’
চিকিৎসা নিতে আসা আন্ডার চর গ্রামের ফরনা বেগম জানান,‘ এর আগেও দুই বার আইছি। কোন টাহা পয়সা লাগে না। রোগও ভালো অয়। উপকার পাই, তাই আহি। মোগোতো আর অত টাহা খরচ কইরা বড় ডাক্তার দেহানোর ক্ষমতা নাই। তাই মোগো বাচ্চু মিয়াই ভরসা।’ এছাড়াও রিণা বেগম, ওয়াজেদ হাওলাদার, লিলি, সুখী, সুমি ও স্বপন ঘরামিসহ বেশ কয়েকজন বলেন,‘আমাগো অসুখ-বিসুখে বাচ্চু মিয়ার কাছে ছুইট্টা আহি। উপকারও পাই। বিনা পয়সায় ওষুধ দেয়। একযুগ ধইরা এই কাম কইরা আইতাছে। আইজ পর্যন্ত কোন মাইনষের অপকার বা সমস্যা অয় নাই।’ ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ বাহারুল ও ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আজাহার মীর জানান,‘বাচ্চু মিয়া একটি মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা তাকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করি। তার মতো এরকম কাজ আরো হওয়া উচিৎ।’
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেব রামপুর ইউনিয়নের ক্রোকির চর গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিএম বাচ্চু মিয়ার জন্ম। পিতা এসকান্দার আলী ও মা আমেনা বেগম। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে বাচ্চুই সবার বড়। ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। স্ত্রী আরজু বেগম ও সন্তানদের নিয়ে মাদারীপুর শহরে বসবাস করেন। সাদা মনের এ আলোকিত মানুষটি প্রথম আলোকে জানান,‘ রাজনৈতিক বা অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে মানব সেবা করছিনা। নিজে পরিবারসহ খেয়ে পড়ে যা থাকে তাই দিয়ে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করি। বর্তমানে বসার জায়গা নিয়ে সমস্যায় আছি। পাশাপাশি আরো কিছু অর্থ দরকার। তবে সকলের সহযোগিতা পেলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারব। আমি চাই আমার এলাকার একটা মানুষও যাতে বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।’
বিএম বাচ্চু মিয়ার বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা ও মানব সেবা ফাউন্ডেশন সম্পর্কে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ মসিউর রহমান বলেন,‘বাচ্চু মিয়ার এ কার্যক্রম অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। আমি তার কার্যক্রম পরিদর্শণ করেছি। আমার মতে, তার মতো আমাদের প্রত্যেককেই এরকম জনসেবা মূলক কাজে এগিয়ে আসা উচিৎ।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শাহরিয়াজ বলেন,‘এমন জনসেবা মূলক কাজের জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। তার মতো প্রত্যেক গ্রামে বা ইউনিয়নে তা নাহলে অন্তত উপজেলা পর্যায়ে আরো অনেকের এগিয়ে আসা উচিৎ। আমি তাকে যে কোন ধরণের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিচ্ছি। যাতে সে তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারে।’