শুক্রবার, ১ জুন, ২০১২

মুক্তকথা: আর কত নির্যাতিত হলে সংবাদকর্মীরা নিরাপত্তা পাবে

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। আর জাতির বিবেকদের দুর্দশা দেখে মানুষের বিবেক আজ প্রশ্নবিদ্ধ। একের পর এক নির্যাতিত হচ্ছে সাংবাদিক। তাও আবার দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনীর হাতে। সাংবাদিকতার মতো এ মহান পেশা আজ হুমকীর সম্মুখীন। মফস্বলের সাংবাদিক নির্যাতনের ইতিহাস সেই পুরনো। কিন্তু খোদ রাজধানীতে এ কি অবস্থা? এর দায়ভার কার?
এ মুহূর্তে মনে পড়ে ঠিক দুই বছর আগে আওয়ামীলীগ তথা মহাজোট সরকারের পুলিশ বাহিনী দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়েছিল। পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে পত্রিকার প্রেসে তালাও ঝুলিয়ে দিয়েছিল। তখন হয়তো একটি রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতেই এমনটি করা হয়েছিল। কিন্তু পত্রিকাটি শত চড়াই-উৎরাই পেরিয়েও এখনো টিকে আছে। এবং টিকে থাকবে।
সম্প্রতি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির চাঞ্চল্যকর হত্যার ক্ষত না শুকাতেই পুলিশ ও সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি নজিরবিহীন ঘটনা জাতিকে করেছে হতবাক। জনমনে উদয় হয়েছে নানাবিধ প্রশ্ন। একটি ঘটনা হতে পারে অনাকাক্সিক্ষত। একই ঘটনার পূণরাবৃত্তি ঘটলে তাকে অনাকাক্সিক্ষত বলে চালানো যায় না। মিডিয়ার বদৌলতে জনগণও আজ অনেক সচেতন। ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই তা নিস্ফল হবে। পুলিশের এ ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের পিছনে কে বা কারা এ প্রশ্নের জবাব সরকারকেই দিতে হবে। জনগণ যদি ক্ষমতার উৎস হয় তবে সাংবাদিকরা জনগণেরই আত্মা। আত্মা ছাড়া দেহ যেমন মূল্যহীন; তেমন সাংবাদিক ছাড়া জনগণও মূল্যহীন। কারণ সাংবাদিকরাই জনগণের মনের কথা, দু:খ-দুর্দশা, সফলতা-ব্যর্থতা জাতির সমক্ষে তুলে আনেন। 
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের এ এক নজিরবিহীন ইতিহাস। এর আগে কারো বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় প্রতিহিংসাবশত অনেক হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। তাতে তেমন দু:খ ছিলনা। কারণ এটা একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। সব জেনে-শুনেই মানুষ এ পেশাকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাংবাদিক নির্যাতনে নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে সংবাদকর্মীরা। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়-তবে আর আশ্রয় চাইবে কার কাছে? যেভাবে সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিক সংবাদ মাধ্যমের ওপর সরকারি আক্রমণ শুরু হয়েছে। এর শেষ কোথায়? পুলিশ বাহিনীই বা এতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কি কারণে? কোন অশুভ ইশারায় আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সংবাদকর্মীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে নেমেছে। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় দি ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার বিভাস চন্দ্র সাহা বাসের চাঁপায় নিহত হলে সহকর্মী সাংবাদিকরা তার লাশ আনতে গেলে পুলিশ তাদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে। এতে ১০-১২জন সাংবাদিক গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার রেষ কাটতে না কাটতেই গত ২৬ মে শনিবার দুপুরে দায়িত্ব পালনের সময় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রথম আলোর তিন ফটোসাংবাদিক খালেদ সরকার, সাজিদ হোসেন ও জাহিদুল করিমকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দিয়েছে পুলিশ। ওদিকে বিডি নিউজ ২৪ ডটকম অফিসে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিযে আহত করেছে বেশ কয়েকজনকে। তাহলে পুলিশ আর সন্ত্রাসীদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? সর্বশেষ আগারগাঁওয়ে হামলার তিন দিনের মাথায় ঢাকার আদালত পাড়ায় বিচারপ্রার্থী মহিলাকে পুলিশ ক্লাবের ভেতর নিয়ে পুলিশ শ্লীলতাহানী ঘটায়। এ ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে পুলিশের হামলার শিকার হন প্রথম আলোর আদালত প্রতিবেদক প্রশান্ত কর্মকারসহ কয়েকজন সাংবাদিক। গত ২৯ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের প্রবেশ পথে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিনের উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে।
এ কেমন শত্র“তা? এ কেমন প্রতিশোধ? পুলিশের সাথে সাংবাদিকদের শত্র“তা কিসের? না কি পুলিশের যাবতীয় অপকর্ম সাংবাদিকরা তুলে ধরেন বলেই প্রতিশোধ নিতে এ হামলা। আবার কি না কাঁটা ঘায়ে লবন ছেটাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রি শামসুল হক টুকু। তিনি পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতে বলেন। এ পরামর্শ যেমন হাস্যকর তেমনি উদ্বেগজনক। তার এ বক্তব্যের জন্য চারিদিকে নিন্দার ঝড় ওঠে। প্রতিবাদ জানান সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ। এমনকি এ রকম বক্তব্যের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংবিধান প্রণেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। পক্ষান্তরে এটাই প্রমাণিত হয়-সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ইচ্ছাকৃত। এবং ক্ষমতাসীনরা এর সাথে জড়িত। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন পুলিশের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তিনি বললেন,‘পুলিশ এখন অনেক ভালো হয়েছে।’ এই যদি হয় ভালোর নমুনা। তাহলে জগতে মন্দ বলতে কী আছে? পুলিশের অধঃপতন প্রমাণ হয় তাদের মারমুখী ভুমিকা দেখে। পুলিশের অপকর্ম ধরা পড়ে গিয়েছিল বলেইতো তারা উপস্থিত আইনজীবি-সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়। সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাহলে কী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা হতাশাজনক নয়? এরপরও কী মন্ত্রীদের মুখে ‘অবস্থা ভালো’ কথাটি শোভা পায়। বরং এমন অবস্থার দায় স্বীকার করে তাদের পদত্যাগ করা উচিৎ। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে-এমন মন্ত্রী রেখে লাভ কী?
এমন ঘটনার জন্য সরকার কি বিব্রত বা বিন্দুমাত্র বিচলিত নন? অবস্থা দেখে তো তাই মনে হয়। এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘটনার নেপথ্য শক্তি কারা? তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব কার? এ ন্যাক্কারজনক অবস্থার মধ্যেও জল ঘোলা করার জন্য ‘সচেতন সাংবাদিক সমাজ’র ব্যানারে ‘সাংবাদিক নির্মূলের আহ্বান’ জানান কারা? তাদের শেকড় কোথায়? তা কি উপরে ফেলা সম্ভব নয়? মৌচাকে ঢিল ছুড়লে অবস্থা কি হয় তা হয়তো ভুক্তভোগিরা নিশ্চয়ই অবগত আছেন। রাতের আঁধারের এ সচেতন সাংবাদিক সমাজ কারা? সাংবাদিক ও পুলিশের মাঝে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে ফায়দা নেওয়ার ফন্দি আঁটেন কারা? তারা কি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে? তাই বলতে হয়-‘ভিক্ষা চাইনা কুত্তা সামলান!’
সাংবাদিকরা সরকার বা পুলিশের শত্র“ নয়। সরকার যদি জনগণের বন্ধু হয় তবে সাংবাদিকরা সে বন্ধুত্বের সোপান। সিঁড়ি ধ্বংস করে উপর তলায় ওঠার চেষ্টা করা বৃথা। তাই সাংবাদিক নির্যাতনের সাথে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তির মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা সরকারের দায়িত্ব। কারণ জাতির বিবেকরা যদি লাঞ্ছিত হয় তবে জাতিকেও লাঞ্ছিত করা হয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
০১৭২৫৪৩০৭৬৩