শুক্রবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৩

দেশপ্রেম কি কেবল দিবসভিত্তিক হয়ে যাবে

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’- এ ঘোষণা ইসলাম ধর্মের হলেও সকল ধর্মের মানুষই এ ঘোষণার সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কে দেশদ্রোহী হতে চায়? কেউ না। যারা দেশদ্রোহী; তারা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে তৎপর। তারা মানুষের কল্যাণে নয়, নিজের কল্যাণে সব করে। তারা ঘৃণ্য ও অপাঙক্তেয়। দেশদ্রোহীতার পরিণতি সকলেরই জানা। দেশপ্রেমকে ধর্মাচার বললেও অত্যুক্তি হবে না। সকল ধর্মেই দেশপ্রেমের কথা বলা হয়েছে। তাই দেশের প্রত্যেক নাগরিকের অন্তরে দেশপ্রেম অত্যাবশ্যক। কারণ, যে দেশের মাটি বায়ু জল বাতাসে প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠি আমি। সে দেশতো আমার মা। আর মাকে তো আর অস্বীকার করা যায় না। যে করে সে অকৃতজ্ঞ ও মহাপাপী। তাই আমরা সবাই দেশপ্রেমিক হতে চাই। মনে-প্রাণে দেশকে ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই ১৯৭১ সালে জীবনের বিনিময়ে দেশকে রক্ষা করেছিলাম। আমরা জাতির গর্বিত সন্তান।
কিন্তু আজকাল আমরা দেশপ্রেমের নামে প্রহসনে মেতে উঠেছি। ইদানীং দেশপ্রেম হয়ে গেছে স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার। হয়ে গেছে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের অংশ। শুধু রাজনীতিবীদরাই দেশপ্রেমের স্লোগান দেবেন। বাকিরা তাকিয়ে উপভোগ করবেন। সর্বোপরি দেশপ্রেম এখন দিবসভিত্তিক। প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ ও ২১ ফেব্র“য়ারি এলে নানাবিধ কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে তা পালন করি। পরদিন সকালেই দেশের বারোটা বাজানোর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠি। দেশকে ভালোবাসার নামে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ফ্যাশনে রুপান্তরিত করি।
‘দেশ আমার, মাটি আমার’- স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করি আকাশ। বিভিন্ন রঙের বাহারি পোস্টারে, ফেস্টুনে, ব্যানারে ও দেয়াল লিখনে তখন দেশের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে ব্যক্তির প্রচার। ‘ দেশদরদী, গরীবের বন্ধু অমুক নেতার পক্ষ থেকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা’ প্রভৃতি প্রচার-প্রচারণায় ছেয়ে যায় অলি-গলি, হাট-বাজার, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও রাজপথ। এ আমাদের দেশপ্রেমের নমুনা। অথচ আমাদের আশপাশের হতদরিদ্র মানুষগুলো দু’বেলা দু’মুঠো না খেতে পেয়ে বেছে নেয় ভিক্ষাবৃত্তির মত জঘন্য কাজ। কবির ভাষায়-‘ঘাতক শিল্পের দেশ তাকে আমি কখনোই স্বদেশ বলি না।’ ক্ষুধার তাড়নায় নারী বেছে নেয় বেশ্যাবৃত্তির মত জঘন্য পেশা। তাইতো কবি বলেছেন,‘বেশ্যালয়কে কখনো আমি স্বদেশ বলি না।’ তাতে কি আমাদের দেশ সারা বিশ্বের কাছে লজ্জিত হয় না? ব্যক্তির প্রচারে অর্থ ব্যয় না  করে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালে কী দেশপ্রেম প্রকাশিত হয় না। কয়দিন থাকে ঐ ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার? একদিন, একসপ্তাহ, একমাস বা একবছর। অথচ ডিসেম্বর মাসের এ কনকনে শীতের রাতে কোন বস্ত্রহীন মানুষকে একটি শীতবস্ত্র দিলে সেটার স্থায়ীত্ব বহুদিন। দেশের মানুষকে ভালোবাসা কী দেশপ্রেম নয়?
আসলে প্রকৃত দেশপ্রেম কী? আমরা অনেকেই জানিনা বা বুঝতে চাই না। শুধু মুখেই বলি দেশ ও দশের কল্যাণে আমি নিয়োজিত। অথচ দেশ ও দশের কল্যাণ সাধনের চেয়ে আমরা নিজেদের কল্যাণেই নিয়োজিত থাকি। তাইতো দেশপ্রেমিকের সংজ্ঞাও আমরা পাল্টে ফেলেছি। দেশ ও দশের কল্যাণে ব্যর্থ হয়েও আমরা ‘দেশপ্রেমিক’ উপাধি পেতে পারি। বেয়াদবি মাফ করবেন, ‘আসল কথা হইতেছে- আমরা যে যত বেশি দেশ ও দশের বারোটা বাজাইতে পারিব। সে তত বড় দেশপ্রেমিক হিসাবে উপাধি লাভ করিয়া থাকিবেন।’
আমি দেশপ্রেমিক। তা ঘোষণা দেওয়ারতো কিছু নাই। সেদিন গাড়ীর জন্য এক বাস স্টপেজে অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় প্যান্ট-শার্ট পড়া এক ভদ্রলোকের মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো। রিংটোনে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সুর। আমি চমকে উঠলাম! এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক ফোন রিসিভ করলেন। রিং থেমে গেল। জাতীয় সংগীতের সম্মান বা ব্যবহারের বিধিমালাও আমাদের জানা নেই। আমি যতটুকু জানি, তাতে জাতীয় সংগীতের সময় দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। যত্রতত্র জাতীয় সংগীত বেজে উঠলে আমরা কী করতে পারি? এতো ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’র মতো।
কিছুদিন আগের ঘটনা। গত শারদীয় দূর্গা পূজায় ‘আনন্দধারা নাট্যগোষ্ঠী’র আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের একটি গ্রামে। পূজার অনুষ্ঠান চলছে। সবশেষে নাটক মঞ্চস্থ হবে। নাটকের আগে পরিবেশিত হবে জাতীয় সংগীত। শিল্পীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন শুরু করলেন। কেউ দাঁড়ালো না। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে একাই দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার দেখাদেখি সাংবাদিক বন্ধু মিজানুর রহমানও দাঁড়ালেন। পরে আমাদের দেখাদেখি পূজামন্ডপ প্রাঙ্গনে যে যেখানে বসা ছিলেন; তারা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। জাতীয় সংগীত সহযোগে দেশকে সম্মান জানানো হলো। জনগণ কি বুঝেছে জানি না। তবে আমার মনে হয়, যেহেতু আমরা অনুষ্ঠানের অতিথি। অতিথিরা দাঁড়িয়েছে তাই সবাই দাঁড়িয়েছে।
আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বসে পরীক্ষা পাসের জন্য পৃষ্ঠা ভরে ‘দেশপ্রেম’ রচনা লিখেছি। কিন্তু তার সারমর্ম কিছুই অনুধাবন করিনি। দেশপ্রেমকে কেবল রচনার জন্যই উপযুক্ত মনে করেছি। আমরা বলি-‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।’ কিন্তু আজ সেটা উল্টে গেছে। বলতে হবে- দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়। তাই যদি না হবে তবে আমাদের দেশ আজ এত দুর্ভাগা কেন? দেশের অর্থ কেন বিদেশে পাচার হয়? কেন ‘নিবিড় পাটচাষের বদলে অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে নিবিড় কোটিপতির চাষ।’ দেশি পণ্য না কিনে আমরা বিদেশি পণ্য কিনে ধন্য হই। দেশি পণ্য ব্যবহার করলে না কি প্রেসটিজ নষ্ট হয়। এছাড়াও দেশি সংস্কৃতির চেয়ে পরগাছা সংস্কৃতি লালন করি। আমার মনে হয় না- এবার শতকরা বিশজন মানুষ বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান টেলিভিশনে দেখেছে। তার কারণ, আমার আকাশ দখল করে রেখেছে স্টার জলসা, জি বাংলা, স্টার প্লাস আর জি টিভিরা। ‘টাপুর টুপুর’, ‘সাতপাকে বাধা’ আর ‘মা’ (ঝিলিক) আমাদের নারী সমাজের মগজ এমনভাবে ধোলাই করেছে যে, তারা ঐ সিরিয়াল দেখে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবেন। ভুলেও চ্যানেল পাল্টে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান দেখবেন না। ছি! আমরা কতটাই অকৃতজ্ঞ। অথচ ভারত সরকার তাদের টেলিভিশনে আমাদের কোন চ্যানেল প্রচারে অনুমতি দেন নি। কবি যথার্থই বলেছেন-‘ আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো টিভি পর্দায় যখন পাশ্চাত্যের/ হাঙর-সংস্কৃতি এসে গিলে খাচ্ছে পদ্মার রূপালী ইলিশ।’
বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও মাতৃভাষা দিবস এলেই ফুল দেই। লাল-সবুজের রঙে নিজেকে সাজাই। একদিন পড়ে সে পোশাক তুলে রাখি আগামী বছরের জন্য। পত্র-পত্রিকাগুলো সাময়িকী ছাপে। পনের দিন দেশাত্মবোধ জাতীয় কলাম ও প্রতিবেদন ছাপে। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই। টেলিভিশনগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক, সিনেমা ও টকশো প্রভৃতি প্রচার করে। এরপর পাল্টে যায় সবার চেহারা। কেন? দেশপ্রেম কী কেবল দিবসভিত্তিক? দেশাত্মবোধকে কেন আমরা সঙ্কীর্ণ গন্ডির মধ্যে নিয়ে এসেছি। দেশাত্মবোধক নাটক, সিনেমা কী সারা বছর প্রচারিত হতে পারে না।
আসুন শুধু মুখেই নয় অন্তরেও ভালোবাসতে শিখি। রাজনীতির স্বার্থে নয়, ব্যক্তি স্বার্থে নয়, ক্ষমতার লোভে নয়। ঈমানী দায়িত্ব মনে করেই দেশকে ভালোবাসি। নিজের কল্যাণে নয়, দেশের কল্যাণে এগিয়ে আসি। দেশের প্রতিটি নাগরিককে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে আহ্বান জানাই। ‘দেশ আমার, মাটি আমার’- স্লোগানকে অন্তরে ধারণ করে দেশের অভ্যন্তরের যাবতীয় ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে ঐক্যবদ্ধ হই। দলের স্বার্থে দলাদলি না করে দেশের স্বার্থে সবাই এক হয়ে কাজ করি। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়-‘যখন আমাদের শত্র“রা সংঘবদ্ধ, বন্ধুরা ঐক্যভ্রষ্টÑ/ তখন এই কবিতাটির ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।’

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন