শুক্রবার, ৪ জানুয়ারী, ২০১৩

চল্লিশ বছর পরও উপেক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
৮ ডিসেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে কমান্ডার আবদুর রহমানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা লালপোল সংলগ্ন ও থানার অভ্যন্তরে পাক হানাদার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে কালকিনিকে হানাদার মুক্ত করেন। এ দিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ বিজয়ের আনন্দে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং কালকিনি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রকাশ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। কালকিনি মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা মাদারীপুর সদর মুক্ত করার জন্য রওয়ানা হন। ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হয় মাদারীপুর সদর। কিন্তু স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও এ দিনটি কালকিনিবাসীর কাছে উপেক্ষিত বা অজ্ঞাত। মুক্ত দিবস উপলক্ষে নেই কোন কর্মসূচি।
শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও কালকিনিতে নির্মিত হয়নি স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ। প্রবীণ থেকে শুরু করে বর্তমান প্রজন্মও জানে না কালকিনি মুক্ত হয় কত তারিখে। লজ্জার বিষয়, অনেক মুক্তিযোদ্ধাও দিনটির কথা বেমালুম ভুলে বসে আছেন। তার কারণ, কালকিনি মুক্ত দিবস উপলক্ষে চল্লিশ বছরে একবারও কোন কর্মসূচি পালিত হয়নি। এমনকি এনায়েত নগর ইউনিয়নের ফাসিয়াতলার গণহত্যা দিবসও ভুলে গেছে সবাই। ভুলে গেছে শহীদ বীর বিক্রম এম নুরুল ইসলাম ও শহীদ নুরুল আলম পান্নাসহ অনেক শহীদের নাম। তার কারণ, স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও নির্মিত হয়নি স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বা অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক।
বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার এনায়েত নগর ইউনিয়নের ফাসিয়াতলা বন্দর সাপ্তাহিক হাটের দিন বলে সরগরম। নিয়মিত নিয়মে চলছে বেচা-কেনা। হঠাৎ সন্ধ্যার ঠিক আগে দু’জন অপরিচিত লোক ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করল,‘মুক্তিবাহিনী আইছে। তারা আপনাগো লইয়া মিটিং করব। আপনারা বাজার ছাইড়া যাইবেন না।’ ঘোষণার ১৫ মিনিট যেতে না যেতেই রাজাকার ও আল বদর বাহিনী বাজার ঘেরাও করে ফেলে। এর ১০ মিনিট পর নদীতে গানবোটে চরে আসে পাক বাহিনী। রাজাকার ও পাক হানাদার বাহিনী সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র হাটুরে মানুষের ওপর। হানাদারদের অতর্কিত হামলায় শহীদ হয় প্রায় দেড়শতাধিক মুক্তিকামী মানুষ। অনেককে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। লুটপাট শেষে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বাজারের দোকানপাট। যাওয়ার সময় ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ১৮ জনকে। এর মধ্যে ১০জন আজো ফিরে আসেনি।
১৯৭১ এর মে মাসে বর্তমান পৌর এলাকার দক্ষিণ রাজদী গ্রামের নুরুল আলম পান্না যোগ দেন ৩০৩ নম্বর রাইফেলে। মেজর মনজুর নেতৃত্বে ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে কালকিনি অঞ্চলে নুরু কবিরাজের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। যুদ্ধকালীন তাঁর কাজ ছিল পাক বাহিনীর গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একাত্তরের ১০ অক্টোবর উপজেলার ফাসিয়াতলা বাজারে যান। সেখানে রাজাকারদের সহায়তায় পাক বাহিনী তাকে আটক করে মাদারীপুর এ.আর হাওলাদার জুট মিলের মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। হত্যার পর নিশ্চিহ্ণ করে দেওয়া হয় মৃতদেহ। এরপর কেটে গেছে চল্লিশ বছর। অথচ নিখোঁজ শহীদ নুরে আলম পান্নার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নেই। আজ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর তাঁর আত্মীয়-স্বজনের কাছে খোঁজ নিয়ে শুনতে হয় তাঁর নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি। বহুবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন শহীদের ভাই জহিরুল আলম সিদ্দিকী ডালিম।
১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে পাক বাহিনীর যাতায়াতে বিঘœ ঘটানোর জন্য গোপালপুর ব্রীজে মাইন বিস্ফোরণ শেষে ফেরার পথে রাজাকার ও পাক বাহিনীর নির্মম বুলেটে শাহাদাত বরণ করেন উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের পরিপত্তর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা এম নুরুল ইসলাম। তাঁর লাশ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিজের ভিটায় দাফন করার সৌভাগ্য হয়নি স্বজনের। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর বীর বিক্রম উপাধীতে ভূষিত করেন। অথচ তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণেও আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি স্মৃতিস্তম্ভ। কিংবা কোন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বা স্থাপনার নামকরণও হয়নি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আজ ভুলতে বসেছে কালকিনিবাসী। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের কোন পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০৮ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন ‘মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ উপলক্ষে উপজেলা গেট সংলগ্ন সুরভী সিনেমা হলের পাশে স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু চার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও তার কাজ শুরু হয়নি। ঠিক তেমনি অযতœ অবহেলায় পড়ে আছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসার পরও উপেক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। দানবীর, শিক্ষাণুরাগী স্থানীয় সাংসদ সৈয়দ আবুল হোসেনও পরপর চার বার নির্বাচিত হয়েও কর্ণপাত করেননি স্মৃতি সংরক্ষণের ব্যাপারে। অথচ নিজের নামে, বাবার নামে অনেক কিছু করলেও এলাকার মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদদের নামে কিছুই করেন নি।
কিন্তু ২০১০ সালে উপজেলার বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের খাসের হাট বন্দরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর স্থাপিত হয়। ২০১১ সালের ৯ এপ্রিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কিন্তু অর্থাভাবে ঢিমেতালে চলছে তার কাজ। কাজ শেষ না হওয়ায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ কালকিনির মুক্তিযোদ্ধারা। যার ফলে গত ২৫ মার্চ কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত ‘স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পূর্তি’ অনুষ্ঠানে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। পরে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সৈয়দ আবুল হোসেন তাদের শান্ত করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা আকন মোশাররফ হোসেন ক্ষোভের সাথে বলেন, দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীন দেশের স্রষ্টারাই আজ ধুুকে ধুকে মরে। এমনকি তাদের স্মৃতিটুকুও সংরক্ষণ করা হয়নি। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এসকান্দার আলী বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে চল্লিশ বছর আগে। এখনো ফাসিয়াতলা গণহত্যা, স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয় সবই কালের ধুলায় বিলীন হতে চলেছে।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে শত্র“মুক্ত হয়েছে আমাদের স্বদেশ। আজ স্বাধীন দেশের মাটিতে পালিত হয় না কালকিনি মুক্ত দিবস। গড়ে ওঠে না স্মৃতিস্তম্ভ। সংরক্ষিত হয় না গণহত্যার স্মৃতি। এ লজ্জা রাখবো কোথায়? এ দীনতা কাদের? তবে কী জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ। হয়তো একদিন মরতে মরতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা শূন্য হয়ে যাবে। সেদিন কী আমরা তাদের স্মরণ করবো? আগামী প্রজন্ম কী মনে রাখবে তাদের কথা। কীভাবেই বা রাখবে? আমরা যদি তাদের স্মৃৃতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করি তবে সেই ব্যর্থতা কেবল আমাদের।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন