রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

কালকিনি শিল্পকলা একাডেমি চলছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মতো

- সালাহ উদ্দিন মাহমুদ :

মানুষ স্বভাবতই বিনোদন প্রিয়। শত ব্যস্ততার মাঝেও তারা একটু বিনোদন খোঁজে। দুঃখের সাগরে ডুব দিয়েও সুখের মনি-মুক্তা আহরণ করতে চায়। এটা মানুষের চিরন্তন ধারা। আপামর মানুষের বিনোদন আকাঙ্খা নিবারণ করতে একদল মানুষ ‘নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানো’র মতো বিনোদন দিতে দিনরাত খেটে মরে। স্বার্থকতা এইÑ মনের ক্ষুধা মেটে।
মানুষের ক্ষুধা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। এক. পেটের ক্ষুধা দুই. দেহের ক্ষুধা তিন. মনের ক্ষুধা। পেটের ক্ষুধার জন্য প্রয়োজন পরিশ্রম, দেহের ক্ষুধার জন্য প্রয়োজন সঙ্গম আর মনের ক্ষুধার জন্য প্রয়োজন বিনোদন।
বিনোদনের জন্যই গড়ে তুলতে হয় শিল্পকলা। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডই আবহমান বাঙলার বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। এই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে প্রস্ফুটিত করতে তৎকালীন কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ খালেকুজ্জামানসহ অনেকেই। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠল একটি প্রতিষ্ঠান।
যখন স্থানাভাব দেখা দিল- সর্বসম্মতিক্রমে সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের লাইব্রেরি ভবনের মিলায়তন হলো এর অস্থায়ী কার্যালয়। সেখানে থাকতে হলো না বেশি দিন। স্থানান্তর করা হলো উপজেলা অফিসার্স ক্লাবে। সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার ৫ টি বিভাগ নিয়ে চলতে থাকে এর কার্যক্রম।
দেখতে দেখতে দাতা সদস্য ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, কালকিনি এডিপি’র আর্থিক সহায়তায় উপজেলার কাঁঠাল তলায় তোলা হলো নতুন ভবন। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিনের তৎপরতায় ভাল একটি অবস্থানে চলে এলো কালকিনি শিল্পকলা একাডেমি ।
কিন্তু ‘অতি সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ হওয়ার মতো হঠাৎ করেই স্থবির হয়ে পড়লো একাডেমির কার্যক্রম। পরিচালনা পরিষদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সংকটসহ নানাবিধ কারনে দিনদিন পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীর মত চলছে প্রতিষ্ঠানটি। হতাশ হয়ে পড়লো বিনোদন প্রিয় মানুষগুলো।
একাডেমির বর্তমান অবস্থা বড়ই নাজুক। নৃত্য, সংগীত, চিত্রকলা, আবৃত্তি ও নাট্যকলা বিভাগ থাকলেও নৃত্য, সংগীত, চিত্রকলা চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। আবৃত্তি ও নাট্যকলা রয়েছে নিষ্ক্রিয়। যে তিনটি বিভাগ চালু আছে তাতে আবার দক্ষ প্রশিক্ষক না থাকায় আগ্রহ হারাতে বসেছে  শিক্ষার্থীরা। অনুষ্ঠানে স্বজনপ্রীতির অভিযোগেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অনেকে। একাডেমির বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৫০ জনের মতো। সবাই শিশু; যেন প্রাপ্তবয়স্কদের প্রবেশ নিষেধ। অনেকটা শিশু একাডেমির মতো। মাঝে মাঝে বিভ্রম হয় যে, এটা কি শিল্পকলা একাডেমি না শিশু একাডমি। সে যাই হোক, এখানে প্রশিক্ষক রয়েছেন তিন জন। সংগীতে সীমা সাহা ও মিলন বড়াল আর চিত্রকলায় আনোয়ার হোসেন। এদের সম্মানী ভাতা কম হওয়ায় কাজের প্রতি দরদও কম। এখানে কেয়ারটেকার ও প্রশিক্ষকের ভাতা সমান বলে অনেকের আত্মমর্যাদায় আঘাত হানে। এছাড়া প্রশিক্ষকদের চার - পাঁচ মাসের ভাতাও বকেয়া রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন তারা।
এখন কথা হচ্ছে- সবকিছুর মূলে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা। সাদামাঠাভাবে ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ বলে চালাতে  হচ্ছে অনুষ্ঠান। দিনদিন শিল্পকলা একাডেমির অনুষ্ঠানের প্রতি আগ্রহ হারাতে বসেছে সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মানুষ বিনোদনবিমুখ হয়ে পড়বে। আস্থা হারাবে শিল্প- সংস্কৃতির ওপর। এখনই সময় ঘুরে দাঁড়াবার। হারিয়ে যাওয়া যৌবন ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন মানসিক শক্তি। সঠিক পরিচর্যাই দূর করতে পারে পক্ষাঘাত সমস্যা।
একটু আন্তরিকতা, উদার মানসিকতা ও পরিষ‹ার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারে কালকিনি শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান চেহারা। মুখ ফেড়ানো মানুগুলোকে টেনে আনতে পারে বটতলা, হাটখোলা ও নবান্ন উৎসবে কিংবা বর্ষবরণে। ‘এসো মিলি সৃষ্টির মোহনায়, গড়ে তুলি সুন্দর আগামী’-এই হোক আমাদের দীপ্ত শপথ।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ,
লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন