মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১২

কথা না রাখার দু:খ নিয়ে প্রস্থান সুনীলের

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
সকালে ঘুম ভাঙে সাংবাদিক বন্ধু রফিকুল ইসলামের ফোন পেয়ে। কিছুক্ষণ পর কবি দুলাল সরকারের ফোন। তারপর নাট্যব্যক্তিত্ব আ জ ম কামাল। কবি আকন মোশাররফ হোসেনও ফোন দিলেন। সবার একই কথা- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নেই। অনেকটা বিদ্যুতাড়িত হওয়ার মত। ঝিম মেরে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম তাঁকে। তাঁর জন্মস্থানে শেষবারের মত যখন এলেন। অনেক হাসি-আনন্দের স্মৃতি রয়েছে প্রত্যেকের অন্তরে। বন্ধনের সুতোয় যেন টান পড়েছে। কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয়-তাই ছুটে গেলাম তার জন্মভিটায়। একটু স্বান্তনা, একটু শেষ শ্রদ্ধা জানাবার তাগিদে।
‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি’- এভাবেই আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমরা তার কথা রাখার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানি না। ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ’- এভাবে অঅর নিখিলেশকে ডাকবেন না তিনি। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
২২ অক্টোবর রাত ২টায় কলকাতার নিজ বাড়িতে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর চলে আসে তাঁর জন্মস্থান মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত পুরো উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ। ভোর থেকেই তাঁর জন্মস্থানে ছুটে আসেন স্থানীয় কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিককর্মী ও সাংবাদিকসহ তাঁর ভক্ত অনুরাগিরা। সবাই শোকাহত। শোকে স্তব্ধ তার সুনীল আকাশ (সুনীল সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র)। তাঁর হাতে লাগানো নারিকেল গাছের চিড়ল পাতা বেয়ে ভোরের শিশির হয়ে ঝরে পড়ছে কবি হারানোর শোক। গাঁয়ের আকা-বাঁকা মেঠো পথে শোকাহত মানুষের দীর্ঘ সারি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেশবিভাগের আগেই ১০-১১ বছর বয়সে কষ্ট আর অভিমান নিয়ে পরিবারের সাথে চলে যান ভারতের কলকাতায়। অনেক বছর পর প্রথম এসেছিলেন ২০০৩ সালে। চারিদিকে তখন অনেক খ্যাতি। তবু তিনি ভোলেননি তাঁর জন্মস্থানের মাটি। তখন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের একাডেমিক ভবনের শুভ উদ্বোধন করার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নোংরা রাজনীতির শিকার হন তিনি। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করেই অনেক কষ্ট নিয়ে চলে যান কলকাতায়।
এরপর সর্বশেষ ৭৫তম জন্মদিনে ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর এসেছিলেন নিজ গ্রামে। তাঁর জন্মবার্ষিকী ও আগমন উপলক্ষে তিন দিনব্যাপি সুনীল মেলা বসেছিল। চারিদিকে অফুরন্ত উচ্ছ্বাস। নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সফর সঙ্গী হয়েছিলেন স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, কবি বেলাল চৌধুরী ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনসহ বাংলাদেশ ও কলকাতার অনেক গুণীজন।
তিন দিন অবস্থান করেছিলেন কালকিনির মাইজপাড়ায়। ঘুরে ঘুরে দেখেছেন আর বাল্যকালের স্মৃতি হাতড়ে বেরিয়েছেন। যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন-‘কালকিনির মানুষের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি শুধু ওপার বাংলার কবি নই। আমি বাংলা ভাষার কবি।’
আজ তাঁর প্রস্থানে ছুটে গিয়েছিলাম মাইজপাড়ায়। অযতœ অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্র। লতায় জড়িয়ে আছে কবির রোপন করা নারিকেল গাছ। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। তবে কি তার স্মৃতিবিজড়িত এসব কালের গর্ভে একদিন বিলীন হয়ে যাবে? আমাদের কি কিছুই করার নেই। তিনি হয়তো আর আসবেন না। তার পদস্পর্শ আর স্মৃতিময় তিনটি দিনকে কি আমরা স্মৃতির ফ্রেমে আটকে রাখতে পারবো না? এমন আকুতি আর সংশয় আজ সবার মনে।
কবির বাল্যবন্ধু আব্দুর রাজ্জাক কাজী বললেন, সুনীল ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। আজ সে চঞ্চলতা চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল। বাবারা তোমরা ওর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একটু ব্যবস্থা করো। আমরা চাই সুনীল মেলা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হোক। তার স্মৃতি অম্লান থাকুক। তিনি জানালেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মস্থানে এসে গ্রামসহোদর কানাডা প্রবাসী লেখক রাজ্জাক হাওলাদারের বাড়িতে ছিলেন। তারা তাঁর পছন্দের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। কবি খাল-বিলের মাছ খুব পছন্দ করতেন। কৈ, শিং ও মাগুর মাছ ছিল তাঁর প্রিয়।
আমাদের পেয়ে এলাকাবাসী একটি দাবি জানায়। আমরাও তার সাথে ঐকমত্য পোষণ করি। সে দাবিটি হলো- তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বালিগ্রাম ইউনিয়নের পাথুরিয়া পাড় থেকে মাইজপাড়া পর্যন্ত সড়কটি ‘সুনীল সড়ক’ নামে নামকরণ করা হোক। তিনি বেঁচে থাকুক আমাদের মাঝে। সুস্থ্য থাকলে এবারের সুনীল মেলায় তাঁর আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সংস্কার প্রয়োজন। সুনীল মেলা যাতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মেলা থেকে যেন আমরা কিনতে পারি কবির প্রিয় রয়্যাল গুলি, লাঠি-লজেন্স। তাহলে হয়তো আমরা তাঁর কথা রাখতে পারবো। যে কথা বরুণা রাখতে পারেনি। আমরা তা রাখার চেষ্টা করবো। দুরন্ত ষাড়ের চোখে বাঁধবো লাল কাপড়। খুঁজে এনে দেব একশ’ আটটা নীল পদ্ম। জয়তু সুনীল দা। আশির্বাদ করো- আমরা যাতে তোমার কথা রাখতে পারি।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১২

অসমাপ্ত কথা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

১.
যার সাথে তোমার আজন্ম শত্র“তা
তার সাথে তোমার চির বসবাস,
যাকে দেখলে তুমি আঁৎকে ওঠ
পুলকিত করবে তার পরশ।

২.
ছাই ভেবে যেই ছুঁতে গেলাম
হয়ে গেল সোনা,
ভালোবাসি তোমায় শুধু
আর কিছু বলবো না।

৩.
চিটচিটে বালিশ
খিটখিটে মেজাজ
ছেঁড়া কাঁথা-কম্বল,
ফুটো মশারী
বিরহী সুখ
এসবই আজ সম্বল।

কালকিনি, মাদারীপুর
২২.১০.২০১২

মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০১২

অবহেলিত আজ মানুষ গড়ার কারিগর

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
বাদশাহ আলমগীর তাঁর ছেলেকে বিদ্যা অর্জনের জন্য দিল্লীর এক শিক্ষকের কাছে দিয়েছিলেন। একদিন সকাল বেলা তিনি ছেলেকে দেখতে শিক্ষকের বাড়ি গেলেন। গিয়ে দেখলেন তাঁর ছেলে শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর শিক্ষক নিজ হাতে পা ধুয়ে নিচ্ছেন। এটা দেখে তিনি কিছু না বলে চলে এলেন। পরে শিক্ষককে ডাকলেন। বললেন, আপনি কাজটি ঠিক করেন নি। এ কথায় শিক্ষক ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, বাদশাহর ছেলেকে দিয়ে কাজ করিয়েছি। নিশ্চয়ই মহা অন্যায় হয়ে গেছে। তিনি তার অপরাধ জানতে চাইলেন। বাদশাহ আলমগীর তখন বললেন, আপনি আমার ছেলেকে আদব-কায়দা কিছুই শেখান নি। আমার ছেলে শুধু আপনার পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছিল। তার তো উচিৎ ছিল নিজ হাতে আপনার পা ধুইয়ে দেওয়া।
এতো অনেক আগের কথা। গল্পের মতো মনে হয়। আমরা কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় এ ঘটনা জেনেছি। ইতিহাসও সাক্ষী। এখন বাদশাহ আলমগীরের যুগ নেই। তাই বলে কি শিক্ষকদের মর্যাদাও নেই। ইতিহাস আজ ভিন্নভাবে লিখতে হয়। সে ইতিহাস শিক্ষকদের অবহেলার ইতিহাস। লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের ইতিহাস। আমরা অতীত ভুলে যাচ্ছি। সরকার বাহাদুরই শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে জানেন না। তার পোষা সন্তানেরা কীভাবে শিক্ষকের মর্যাদা দিবে। তা নাহলে গত চার অক্টোবর সরকার বাহাদুরের পোষা পেটোয়া পুলিশ সন্তানেরা কীভাবে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলে। এ কথা লিখতে গিয়ে যেখানে আমাদের হাত কেঁপে উঠছে। সেখানে তাদের বুক এতটুকুও কাঁপলো না।
নিয়তির নির্মম পরিহাস! যে পুলিশের হাতে আজ শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছে, তারা কোন না কোন শিক্ষকের ছাত্র ছিল। তাদের মানুষ করার দায়িত্ব ঐ শিক্ষকরাই নিয়েছিল। আজ প্রাক্তন ছাত্রদের ছোড়া কাদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও লাঠিপেটার যন্ত্রণা নিয়ে পরদিন চোখের জলে পালন করতে হলো বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকরা দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তাঁরা হয়ত তাঁদের বেয়াদব ছাত্রদের বরাবরই ক্ষমা করে দেন। কিন্তু বিবেকবান মানুষ এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের যথাযোগ্য শাস্তি কামনা করেন। বাকিটা নির্ভর করে সরকার বাহাদুরের ওপর। কারণ এ ব্যর্থতা তার এবং এমন আচরণের দায়ভারও তার। জাতির এমন কলঙ্কজনক অধ্যায়ের যেন আর পুণরাবৃত্তি না ঘটে- এ প্রত্যাশা সকলের। 
‘যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত’-কথাটাকে আজ উল্টে বলার সময় চলে এসেছে। তাই অতীব দুঃখের সাথে বলতে হয়-‘যে জাতি যত বেশি শিক্ষকদের পেটায় সে জাতি তত বর্বর।’ এটাই আজ নির্মম বাস্তব সত্য। এটা অস্বীকার করার কোন পথ বা উপায় নেই।
সরকার বাহাদুর আইন করে শিক্ষকদের হাত থেকে বেত বা লাঠি কেড়ে নিয়েছেন। সে লাঠি আজ তাদের পিঠেই। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়-‘বাহ! কী চমৎকার দেখা গেল।’ শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীকে পেটানো বা কোন রকম সাজা দেওয়া আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। শিক্ষকরা তা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু রাজপথে পুলিশ দ্বারা শিক্ষক পেটানো কি অপরাধ নয়? এমন অপরাধও কি মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। শ্রেণীকক্ষের বাইরে প্রাইভেট পড়ানো কিংবা কোচিং করানো সরকার বাহাদুর অবৈধ ঘোষণা করেছেন। শিক্ষকরা তাও মেনে নিয়েছেন। তাহলে শিক্ষকদের দাবি সরকার বাহাদুর কেন মেনে নেবেন না। মেনে নিলে তো আজ এ রকম লজ্জাজনক ইতিহাস লিখতে হতো না।
শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীর মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার চেয়ে শিক্ষকের অবদানই বেশি। এ কথা আমরা স্বীকার করি কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে তা মানতে চাই না। ভুলে গেলে চলবে না- শিক্ষকেরা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। অথচ পুলিশি নির্যাতনের পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসে শিক্ষকরা তাদের আন্দোলন স্থগিত করে দিলেন। তারা ইচ্ছা করলে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারতেন। শুধু শিক্ষার্থীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে বুকে-পিঠে ক্ষত নিয়েও পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী মেনে নেবেন তাদের দাবিগুলো? গত রোববার বা সোমবার শিক্ষকদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বসার কথা ছিল। কিন্তু বসা হয় নি। কেন বসা হয় নি, সে কারণ হয়ত অজ্ঞাত। তবে কেন এই মিথ্যা আশ্বাস? নাকি জাতির প্রধান চালিকাশক্তির চাঁকা স্তব্ধ করে দেবার প্রয়াস। তাঁর আশ্বাসের ফলাফল কী হবে? এটাই এখন দেখার বিষয়।
আমাদের শিক্ষকরা এতো অবহেলিত কেন? যুগ যুগ ধরে তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে কেন? জাতির মেরুদন্ডকে সচল রাখতে নিরলস পরিশ্রম করেও যথাযোগ্য পারিশ্রমিক হতে তারা বঞ্চিত কেন? যদিও শিক্ষকতাকে অপরাপর পেশার মানদন্ডে পরিমাপ করা যায় না বলে অনাদিকাল থেকে এটি মহান পেশা হিসাবে সমাজ-সংসারে পরিগণিত। তারপরও সেই ‘তালসোনা পুরের তালেব মাস্টারের অবস্থার’ আর পরিবর্তণ হয় না। শিক্ষকদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটে না। যুগের সাথে, দ্রব্য মূল্যের উর্দ্ধগতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়।
সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতা গুরুত্বপূর্ণ পেশা হলেও জাতীয়ভাবে শিক্ষকদের তেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। যুগের পর যুগ বহতা নদীর মতো বয়ে গেলেও শিক্ষকদের নির্মম ভাগ্যের কোন পরিবর্তণ আজও ঘটে নি। শিক্ষকদের প্রতি কেন এই উদাসীনতা? অথচ তাঁরা প্রদীপের মতো অন্যকে আলোকিত করে নিজেরা জ্বলে জ্বলে নিঃশেষিত হন। একথা এজন্য বলতে হয়- যখন বিশ্ব শিক্ষকসমাজ যুগোপযোগী ও উন্নত শিক্ষার কথা ভাবছেন, তখন আমাদের দেশের শিক্ষকসমাজ অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন করছেন। কারণ গোটা শিক্ষাব্যবস্থার নব্বই ভাগ নিয়ন্ত্রণকারী বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থসামাজিক অবস্থান অনেকটাই অবহেলিত। ফলে ইউনেসকো-আইএলও সনদের ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ এবং অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও আমাদের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও কোন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন তো দূরের কথা গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি। একটি স্বাধীন জাতির জন্য এ অবস্থা যেমন দুর্ভাগ্যজনক, তেমনই লজ্জার। বর্তমান সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি -২০১০ প্রণয়ন করলেও এর বাস্তবায়ন সে অর্থে শুরু হয় নি। শিক্ষানীতিতে অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বৈষম্য অবসানের কোন দিকনির্দেশনা নেই।ূ
বর্তমান সরকার যদি শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল, বেসরকারি শিক্ষদের বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুযোগ, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর জীবনে পেনশনের ব্যবস্থা ও পরিপূর্ণ উৎসব ভাতার মতো শিক্ষানীতির কল্যাণমূলক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে তা হবে জাতির জন্য মঙ্গলজনক। শিক্ষকদের জন্য আশাব্যঞ্জক। পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা না করে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তবেই শিক্ষকরা তাদের মর্যাদা ফিরে পাবেন। সুতরাং আর কোন বঞ্চনা নয়, আর কোন হতাশা নয়। সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক- এ প্রত্যাশা গোটা শিক্ষকসমাজের।
 
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১২

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’- বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানের এ কথাগুলো আজ মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো। হাজার রছরের পুরনো আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগকেও হার মানিয়েছে রামুর সহিংসতা। রামুর ঘটনার জন্য আমরা কাকে দায়ি করবো? নিশ্চয়ই উগ্রতা আর ধর্মান্ধতাকে। আর ব্যর্থতা প্রশাসনের। দায়ভার অবশ্যই সরকারের। এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকের কারণে নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্কজনক অধ্যায়। তবে অবাক হতে হয় যখন রাজনৈতিকভাবে এ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। যা অনভিপ্রেত। রামুর সহিংসতা নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দল এখন দাবা খেলায় মেতে উঠেছে। দাবার গুটি বানানো হচ্ছে নির্যাতিত সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে।
বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাদের উজ্জ্বল ঐতিহ্যের অংশ। পৌষ-পার্বণে কিংবা ঈদ উৎসবে বুকে বুক মিলানোর ইতিহাস আমাদের পুরনো। অথচ অতি উৎসাহি কিছু ধর্মান্ধ মানুষের জন্য সে সম্প্রীতি ভেঙ্গে চুড়মাড় হয়ে গেল। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত আটটার দিকে কক্সবাজারের রামু উপজেলার মেরুংলোয়া বড়–য়া পাড়ার উত্তম কুমার বড়–য়ার ফেসবুকে কে বা কারা পবিত্র কুরআন শরিফ অবমাননার একটি ছবি যুক্ত (ট্যাগ) করে। ছবিটি অন্যান্যরাও শেয়ার করে। ফলে রাত দশটার দিকে কয়েক হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে রামুর চৌমুহনী চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
শুধু প্রতিবাদেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। সমাবেশ শেষে সংঘবদ্ধ লোকজন সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শত বছরের পুরনো ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে। পুড়িয়ে দেয় চল্লিশটির মতো বসতবাড়ি এবং ভাঙচুর করেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। একই কারণে ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়ায় দু’টি বৌদ্ধবিহার ও একটি হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
হযরত মুহম্মদ(স:) কে নিয়ে নির্মিত ব্যঙ্গ চলচ্চিত্র ‘ইনোসেন্স অফ মুসলিমস’ ও ফ্রান্সের পত্রিকায় প্রকাশিত ব্যঙ্গ কার্টুনের কারণে এমনিতেই মুসলিম বিশ্ব ছিল উত্তপ্ত। ফলে জ্বলন্ত আগুনে তেল ঢেলে দেওয়ার মতোই রামুর এ ঘটনা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ভাঙন ধরাতেই এমন কর্মকান্ড করা হয়েছে বলে বিজ্ঞজনের ধারণা। তবে এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরো ধৈর্যশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিৎ ছিল কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ কোন এক যুবকের অপরাধের জন্য শতাধিক মানুষের জান ও মালের ক্ষতি সাধন করার ব্যাপারে ইসলামি শরীয়াও হয়ত সমর্থন করবে না। যেহেতু বিষয়টি জানার সাথে সাথে যুবক তার ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া সে নিজেতো আর ছবি পোস্ট করেনি। কে বা কারা ট্যাগ (যুক্ত) করেছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে এটা বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। যা তৃতীয় পক্ষের দ্বারা সংঘটিত হওয়াটা অমূলক নয়। ঐ যুবক যদি স্বেচ্ছায় করে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এতবড় সহিংস ঘটনার পিছনে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ছিল এটা নিশ্চিত। কারণ একটি অপরাধ হাজারো অপরাধের জন্ম দেয়। কোরআন অবমাননার বিষয়টি মোটেই ছোট কোন অপরাধ নয়। কিন্তু যে ঘটনা ঘটলো তাকেও ছোট করে দেখার উপায় নেই। তাই আমরা বাধ্য হয়েই দু’টি ঘটনাকে অনাকাঙ্খিত ঘটনা বলছি। তবে এভাবে অনাকাঙ্খিত ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটলে সংঘাতময় পরিস্থিতি কোনভাবেই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ফলে বিশ্বজুড়ে অশান্তির পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা শান্তির পক্ষে-আমরা সম্প্রীতির পক্ষে।
অনাকাঙ্খিত ঘটনা পরিদর্শণে গেলেন সরকারের দুই মন্ত্রী। তাদের বক্তব্যে উচ্চারিত হয় ভিন্ন সুর। সেখানে না আছে শান্তির বাণী না আছে সম্প্রীতির জয়গান। প্রথমেই তাদের দৃষ্টি মৌলবাদী ও বিরোধীদলের ওপর। বিরোধী দলও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তারাও অভিযোগ আনেন ক্ষমতাসীন দলের ওপর। ফলে ঘটনা মোড় নিতে থাকে ভিন্ন খাতে। যেটা সাধারণ নিরীহ মানুষের কাছে কাম্য নয়। দায়িত্বশীল দু’টি দল বা ব্যক্তির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সহিংসতা দীর্ঘজীবি হোক- এটা কারোই কাম্য নয়। এতে হয়ত প্রকৃত দোষিরা ছাড়া পেয়ে যাবে। আর দুর্ভোগ পোহাবে নিরীহ শান্তিপ্রিয় কিছু মানুষ। গ্রামীণ প্রবাদের মতো-‘পাটা-পুতায় ঘঁষাঘঁষি মরিচের শ্যাষ’ হওয়ার মতো অবস্থা ছাড়া আর কি হতে পারে। তবে ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবি- এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার হোক। যাতে এমন কলঙ্কজনক অধ্যায়ের পুণরাবৃত্তি না ঘটে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর ঘটনাস্থল পরিদর্শণ শেষে এক সমাবেশে বলেছেন,‘সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে মন্দিরে হামলা করেছে।’ কিন্তু জামায়াতের সেক্রেটারি জি এম রহি মোল্লা বলেছেন,‘ফেসবুকে ছবি প্রকাশ হওয়ার পর রামুতে যেসব মিছিল-মিটিং হয়েছে, সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামীলীগের নেতারাই।’ বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বঙ্কিম বড়–য়া দাবি করেন,‘ পুলিশ শুরু থেকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। রাত তিনটার পর সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মাঠে না নামলে অবশিষ্ট মন্দিরগুলোও রক্ষা করা সম্ভব হতো না।’ রামু উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার বলেন,‘ জামাত-শিবির মৌলবাদী চক্র এঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারেন’। তাই যদি হবে তবে আপনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কী ভূমিকা রেখেছিলেন। এ প্রশ্ন এখন সকলের মনে।
তাছাড়া পুলিশ যদি সময়মতো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারে এমনকি চেষ্টাও যদি না করে তাহলে সরকারের এত টাকা ব্যয় করে পুলিশ পোষার দরকার কী? আর যারা এখন পরস্পর বিরোধী কথা বলেন; ঘটনা ঘটার আগে তারা কি কোন আলামত পাননি। তাহলে আপনারা বসে বসে কি করছিলেন? তামাশা দেখছিলেন। চোখের সামনে কীভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতিগত সভ্যতা।
আসলে আমরা কেউ নির্দোষ নই। ‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপাতেই আমরা ওস্তাদ। ধ্বংসলীলা দেখে আমরা মর্মাহত হইনা। আমাদের মানবতা আজ পাথরের নিচে চাপা পড়ে গেছে। ধর্মান্ধতা আর গোড়ামী আমাদের মনুষ্যত্বকে গলা টিপে হত্যা করেছে। এর কি কোন প্রতিকার নেই। সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত দোষিদের বিচারের আওতায় আনা কি সম্ভব নয়। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির নোংড়া খেলা কি কখনোই শেষ হবার নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আসুন আমরা অসহায় নির্যাতিত মানুষের পাশে দাড়াই। খোলা আকাশের নিচে যে শতাধিক মানুষ অন্নহীন-বস্ত্রহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে-তাদের মাথার ওপরে একটু ছায়ার ব্যবস্থা করে দেই। আমার কী তাও পারবো না? আসলে মানুষ না ধর্ম; আমরা কোন দিকে যাবো? সবশেষে বাউল শাহ আব্দুল করিমের সুরে বলতে হয়-‘করি যে ভাবনা, সেদিন আর পাব না। ছিল বাসনা সুখি হইতাম। দিন হতে দিন, আসে যে কঠিন। করিম দীনহীন কোনপথে যাইতাম। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। আমরা আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

লাবণ্যময়ী অন্ধকার

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

অন্ধকারের কী এমন বিশেষত্ব আছে?
আমি জানিনা। তবে এইটুকু জানি,
রোজ অন্ধকার হাতড়ে খুঁজে পাইÑ
ফেলে আসা স্মৃতির টুকরো,
উঁইপোকায় খাওয়া সুখের বান্ডেল,
ইঁদুরে কাটা প্রেমের চাঁদর,
বানের জলে ভেসে যাওয়া আশা।
কভূ মনে হয়, অন্ধকার আছে বলে
তবুও তো কিছু পাওয়া যায়। তাই
অন্ধকারের লাবণ্যে আমি নিখোঁজ হইÑ
কারণ অন্ধকার আমাকে ঝাপটে ধরে
হারানো প্রেয়সি- øেহময়ী জননী-
অভিমানী বোন আর লাজুক খুকীর মতো।