সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
সকালে ঘুম ভাঙে সাংবাদিক বন্ধু রফিকুল ইসলামের ফোন পেয়ে। কিছুক্ষণ পর কবি দুলাল সরকারের ফোন। তারপর নাট্যব্যক্তিত্ব আ জ ম কামাল। কবি আকন মোশাররফ হোসেনও ফোন দিলেন। সবার একই কথা- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নেই। অনেকটা বিদ্যুতাড়িত হওয়ার মত। ঝিম মেরে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম তাঁকে। তাঁর জন্মস্থানে শেষবারের মত যখন এলেন। অনেক হাসি-আনন্দের স্মৃতি রয়েছে প্রত্যেকের অন্তরে। বন্ধনের সুতোয় যেন টান পড়েছে। কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয়-তাই ছুটে গেলাম তার জন্মভিটায়। একটু স্বান্তনা, একটু শেষ শ্রদ্ধা জানাবার তাগিদে।
‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি’- এভাবেই আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমরা তার কথা রাখার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানি না। ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ’- এভাবে অঅর নিখিলেশকে ডাকবেন না তিনি। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
২২ অক্টোবর রাত ২টায় কলকাতার নিজ বাড়িতে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর চলে আসে তাঁর জন্মস্থান মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত পুরো উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ। ভোর থেকেই তাঁর জন্মস্থানে ছুটে আসেন স্থানীয় কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিককর্মী ও সাংবাদিকসহ তাঁর ভক্ত অনুরাগিরা। সবাই শোকাহত। শোকে স্তব্ধ তার সুনীল আকাশ (সুনীল সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র)। তাঁর হাতে লাগানো নারিকেল গাছের চিড়ল পাতা বেয়ে ভোরের শিশির হয়ে ঝরে পড়ছে কবি হারানোর শোক। গাঁয়ের আকা-বাঁকা মেঠো পথে শোকাহত মানুষের দীর্ঘ সারি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেশবিভাগের আগেই ১০-১১ বছর বয়সে কষ্ট আর অভিমান নিয়ে পরিবারের সাথে চলে যান ভারতের কলকাতায়। অনেক বছর পর প্রথম এসেছিলেন ২০০৩ সালে। চারিদিকে তখন অনেক খ্যাতি। তবু তিনি ভোলেননি তাঁর জন্মস্থানের মাটি। তখন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের একাডেমিক ভবনের শুভ উদ্বোধন করার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নোংরা রাজনীতির শিকার হন তিনি। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করেই অনেক কষ্ট নিয়ে চলে যান কলকাতায়।
এরপর সর্বশেষ ৭৫তম জন্মদিনে ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর এসেছিলেন নিজ গ্রামে। তাঁর জন্মবার্ষিকী ও আগমন উপলক্ষে তিন দিনব্যাপি সুনীল মেলা বসেছিল। চারিদিকে অফুরন্ত উচ্ছ্বাস। নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সফর সঙ্গী হয়েছিলেন স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, কবি বেলাল চৌধুরী ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনসহ বাংলাদেশ ও কলকাতার অনেক গুণীজন।
তিন দিন অবস্থান করেছিলেন কালকিনির মাইজপাড়ায়। ঘুরে ঘুরে দেখেছেন আর বাল্যকালের স্মৃতি হাতড়ে বেরিয়েছেন। যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন-‘কালকিনির মানুষের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি শুধু ওপার বাংলার কবি নই। আমি বাংলা ভাষার কবি।’
আজ তাঁর প্রস্থানে ছুটে গিয়েছিলাম মাইজপাড়ায়। অযতœ অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্র। লতায় জড়িয়ে আছে কবির রোপন করা নারিকেল গাছ। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। তবে কি তার স্মৃতিবিজড়িত এসব কালের গর্ভে একদিন বিলীন হয়ে যাবে? আমাদের কি কিছুই করার নেই। তিনি হয়তো আর আসবেন না। তার পদস্পর্শ আর স্মৃতিময় তিনটি দিনকে কি আমরা স্মৃতির ফ্রেমে আটকে রাখতে পারবো না? এমন আকুতি আর সংশয় আজ সবার মনে।
কবির বাল্যবন্ধু আব্দুর রাজ্জাক কাজী বললেন, সুনীল ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। আজ সে চঞ্চলতা চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল। বাবারা তোমরা ওর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একটু ব্যবস্থা করো। আমরা চাই সুনীল মেলা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হোক। তার স্মৃতি অম্লান থাকুক। তিনি জানালেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মস্থানে এসে গ্রামসহোদর কানাডা প্রবাসী লেখক রাজ্জাক হাওলাদারের বাড়িতে ছিলেন। তারা তাঁর পছন্দের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। কবি খাল-বিলের মাছ খুব পছন্দ করতেন। কৈ, শিং ও মাগুর মাছ ছিল তাঁর প্রিয়।
আমাদের পেয়ে এলাকাবাসী একটি দাবি জানায়। আমরাও তার সাথে ঐকমত্য পোষণ করি। সে দাবিটি হলো- তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বালিগ্রাম ইউনিয়নের পাথুরিয়া পাড় থেকে মাইজপাড়া পর্যন্ত সড়কটি ‘সুনীল সড়ক’ নামে নামকরণ করা হোক। তিনি বেঁচে থাকুক আমাদের মাঝে। সুস্থ্য থাকলে এবারের সুনীল মেলায় তাঁর আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সংস্কার প্রয়োজন। সুনীল মেলা যাতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মেলা থেকে যেন আমরা কিনতে পারি কবির প্রিয় রয়্যাল গুলি, লাঠি-লজেন্স। তাহলে হয়তো আমরা তাঁর কথা রাখতে পারবো। যে কথা বরুণা রাখতে পারেনি। আমরা তা রাখার চেষ্টা করবো। দুরন্ত ষাড়ের চোখে বাঁধবো লাল কাপড়। খুঁজে এনে দেব একশ’ আটটা নীল পদ্ম। জয়তু সুনীল দা। আশির্বাদ করো- আমরা যাতে তোমার কথা রাখতে পারি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
সকালে ঘুম ভাঙে সাংবাদিক বন্ধু রফিকুল ইসলামের ফোন পেয়ে। কিছুক্ষণ পর কবি দুলাল সরকারের ফোন। তারপর নাট্যব্যক্তিত্ব আ জ ম কামাল। কবি আকন মোশাররফ হোসেনও ফোন দিলেন। সবার একই কথা- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নেই। অনেকটা বিদ্যুতাড়িত হওয়ার মত। ঝিম মেরে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম তাঁকে। তাঁর জন্মস্থানে শেষবারের মত যখন এলেন। অনেক হাসি-আনন্দের স্মৃতি রয়েছে প্রত্যেকের অন্তরে। বন্ধনের সুতোয় যেন টান পড়েছে। কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয়-তাই ছুটে গেলাম তার জন্মভিটায়। একটু স্বান্তনা, একটু শেষ শ্রদ্ধা জানাবার তাগিদে।
‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি’- এভাবেই আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমরা তার কথা রাখার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানি না। ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ’- এভাবে অঅর নিখিলেশকে ডাকবেন না তিনি। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
২২ অক্টোবর রাত ২টায় কলকাতার নিজ বাড়িতে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর চলে আসে তাঁর জন্মস্থান মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত পুরো উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ। ভোর থেকেই তাঁর জন্মস্থানে ছুটে আসেন স্থানীয় কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিককর্মী ও সাংবাদিকসহ তাঁর ভক্ত অনুরাগিরা। সবাই শোকাহত। শোকে স্তব্ধ তার সুনীল আকাশ (সুনীল সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র)। তাঁর হাতে লাগানো নারিকেল গাছের চিড়ল পাতা বেয়ে ভোরের শিশির হয়ে ঝরে পড়ছে কবি হারানোর শোক। গাঁয়ের আকা-বাঁকা মেঠো পথে শোকাহত মানুষের দীর্ঘ সারি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেশবিভাগের আগেই ১০-১১ বছর বয়সে কষ্ট আর অভিমান নিয়ে পরিবারের সাথে চলে যান ভারতের কলকাতায়। অনেক বছর পর প্রথম এসেছিলেন ২০০৩ সালে। চারিদিকে তখন অনেক খ্যাতি। তবু তিনি ভোলেননি তাঁর জন্মস্থানের মাটি। তখন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের একাডেমিক ভবনের শুভ উদ্বোধন করার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নোংরা রাজনীতির শিকার হন তিনি। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করেই অনেক কষ্ট নিয়ে চলে যান কলকাতায়।
এরপর সর্বশেষ ৭৫তম জন্মদিনে ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর এসেছিলেন নিজ গ্রামে। তাঁর জন্মবার্ষিকী ও আগমন উপলক্ষে তিন দিনব্যাপি সুনীল মেলা বসেছিল। চারিদিকে অফুরন্ত উচ্ছ্বাস। নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সফর সঙ্গী হয়েছিলেন স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, কবি বেলাল চৌধুরী ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনসহ বাংলাদেশ ও কলকাতার অনেক গুণীজন।
তিন দিন অবস্থান করেছিলেন কালকিনির মাইজপাড়ায়। ঘুরে ঘুরে দেখেছেন আর বাল্যকালের স্মৃতি হাতড়ে বেরিয়েছেন। যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন-‘কালকিনির মানুষের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি শুধু ওপার বাংলার কবি নই। আমি বাংলা ভাষার কবি।’
আজ তাঁর প্রস্থানে ছুটে গিয়েছিলাম মাইজপাড়ায়। অযতœ অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্র। লতায় জড়িয়ে আছে কবির রোপন করা নারিকেল গাছ। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। তবে কি তার স্মৃতিবিজড়িত এসব কালের গর্ভে একদিন বিলীন হয়ে যাবে? আমাদের কি কিছুই করার নেই। তিনি হয়তো আর আসবেন না। তার পদস্পর্শ আর স্মৃতিময় তিনটি দিনকে কি আমরা স্মৃতির ফ্রেমে আটকে রাখতে পারবো না? এমন আকুতি আর সংশয় আজ সবার মনে।
কবির বাল্যবন্ধু আব্দুর রাজ্জাক কাজী বললেন, সুনীল ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। আজ সে চঞ্চলতা চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল। বাবারা তোমরা ওর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একটু ব্যবস্থা করো। আমরা চাই সুনীল মেলা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হোক। তার স্মৃতি অম্লান থাকুক। তিনি জানালেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মস্থানে এসে গ্রামসহোদর কানাডা প্রবাসী লেখক রাজ্জাক হাওলাদারের বাড়িতে ছিলেন। তারা তাঁর পছন্দের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। কবি খাল-বিলের মাছ খুব পছন্দ করতেন। কৈ, শিং ও মাগুর মাছ ছিল তাঁর প্রিয়।
আমাদের পেয়ে এলাকাবাসী একটি দাবি জানায়। আমরাও তার সাথে ঐকমত্য পোষণ করি। সে দাবিটি হলো- তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বালিগ্রাম ইউনিয়নের পাথুরিয়া পাড় থেকে মাইজপাড়া পর্যন্ত সড়কটি ‘সুনীল সড়ক’ নামে নামকরণ করা হোক। তিনি বেঁচে থাকুক আমাদের মাঝে। সুস্থ্য থাকলে এবারের সুনীল মেলায় তাঁর আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সংস্কার প্রয়োজন। সুনীল মেলা যাতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মেলা থেকে যেন আমরা কিনতে পারি কবির প্রিয় রয়্যাল গুলি, লাঠি-লজেন্স। তাহলে হয়তো আমরা তাঁর কথা রাখতে পারবো। যে কথা বরুণা রাখতে পারেনি। আমরা তা রাখার চেষ্টা করবো। দুরন্ত ষাড়ের চোখে বাঁধবো লাল কাপড়। খুঁজে এনে দেব একশ’ আটটা নীল পদ্ম। জয়তু সুনীল দা। আশির্বাদ করো- আমরা যাতে তোমার কথা রাখতে পারি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন