বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১২

বালেশ্বর যুদ্ধের কথা

দুলাল সরকার

বালেশ্বর যুদ্ধের কথা বলব তোমাকেÑ
১৯১৫ সাল, বাঘা যতীন, চিত্তপ্রিয়
মনোরঞ্জন, নীরেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিষচন্দ্র নামের চার বিপ্লবী
যুদ্ধাস্ত্র গ্রহণে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত অপেক্ষমান অবসরে
চিন্তামনি নামের ছদ্মবেশী দারোগার বিশ্বাসঘাতকতায়
সকলের মৃত্যু হলে বাঘা যতীন সব সাথীদের
মৃত্যুর দায় স্বীকার করে চিরবিপ্লবী যতীন সেই অসম যুদ্ধে
প্রাণ হারালে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে
হত্যাকারী পুলিশ কমিশনার টেগার্টকেও তাঁর
দেশপ্রেম ও বীরত্বের কাছে মাথা নোওয়াতে দেখে ভাবি
’৭১ এর হত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী, ধর্ষক
পাকিস্তানীরা আজো
বাঙালির কাছে মাথা নত না করে
যে অপরাধ করে চলেছে
তা কত ক্ষমাহীন ও মানবতাবিরোধী।

২২.১১.২০১২

বুধবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১২

ডা. জোহরা বেগম কাজী উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান বাঙালি মহিলা চিকিৎসক

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ :
উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান বাঙালি মহিলা চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৭ নভেম্বর। যে মহিয়সী নারী জীবদ্দশায় মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। আজ তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করছি তাঁকে। অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। তিনিই প্রথম ধাত্রীবিদ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করে অজ্ঞ ও অবহেলিত নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। অবগুন্ঠিত নারী সমাজের উন্নত চিকিৎসার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির শক্ত বাধাকে অতিক্রম করে নারী সমাজের মুক্তিদাত্রী হিসেবে ধূমতেুর মত আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের অনগ্রসর চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে এসেছিলেন।
এ মহিয়সী নারী ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার গোপালপুর গ্রামের প্রভাবশালী সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ও আধুনিক চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। তিনি দেশভাগের ঘোরবিরোধী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করতেন না। ফলে বাবার মানবতাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হলে থাকে অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত কিশোরী জোহরার মননে ও চেতনায়। মাতা আঞ্জুমান নেছা রায়পুর পৌরসভার প্রথম মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কর্মনিষ্ঠ সাদাসিধে এক নারী।
তখন ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনের উত্তাল সময়। এ সময় ডা. জোহরা বেগম কাজীর শৈশব-কৈশোর কাটে মানবতাবাদী পিতার কর্মস্থল মহাত্মা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ। রাজনানগাঁওয়ের রানি সূর্যমুখী প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের টোল ‘পুত্রিশালায়’ তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ছাত্রজীবনে তিনি বরাবরই মেধাবী ছিলেন। ক্লাসে সব সময় প্রথম হতেন। ফলে সাফল্যের সাথে মেট্রিক পাস করেন। ১৯২৯ সালে তিনি আলীগড় মুসলিম মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে আইএসসি পাস করে কলেজ জীবন সমাপ্ত করেন। এরপর উপমহাদেশের প্রথম মহিলা মেডিকেল কলেজ দিল্লির লেডি হার্ডিং গার্লস মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে তিনিই প্রথম মুসলিম বাঙালি ছাত্রী। এখান থেকে ১৯৩৫ সালে এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। তখন তাকে সম্মানজনক ‘ভাইস রয়’ পদক প্রদান করা হয়।
ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা জোহরা বেগম কাজীর গান্ধী সেবাশ্রমে কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। এছাড়া অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩ বছর কাটিয়েছেন তিনি। পরে বৃত্তি নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য লন্ডনে পড়াশুনা করেছেন এবং চিকিৎসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি এফআরসিওজি লাভ করে ভারতে ফিরে আসেন। গান্ধী পরিবারের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে নাগপুরে অবস্থিত গান্ধীর সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ তিনি অবৈতনিক চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশবিভাগের পর তিনি বড়ভাই অধ্যাপক কাজী আশরাফ মাহমুদ ও ছোটবোন ডা. শিরিন কাজীর সাথে বাংলাদেশের ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যোগদান করেই গাইনি (স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা) বিভাগ চালু করেন। এছাড়াও তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন। পরবর্তীতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) অনারারি কর্নেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
সাতচল্লিশ- পরবর্তী বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। তিনি একাধারে চিকিৎসাশাস্ত্রে বাঙালি নারী চিকিৎসকদের অগ্রপথিক, মানবতাবাদী ও সমাজ-সংস্কারক ছিলেন। গর্ভবতী মায়েরা হাসপাতালে এসে যেন চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন, সে জন্য তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারীদের জন্য পৃথক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। পিছিয়ে পড়া নারীদের জাগরণ তথা চিকিৎসাশাস্ত্রে নারীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। তারই দেখানো পথে আজ বাংলাদেশে অসংখ্য নারী চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। তাঁর জ্বালিয়ে দেওয়া আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে আজ অনেক নারী চিকিৎসক আলোকিত করছে গ্রামবাংলার অবহেলিত জনপদের চিকিৎসা জগতের অন্ধকার প্রকোষ্ট।
শুধু তা-ই নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। এছাড়াও একজন ইতিহাস সচেতন মানুষ হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিনির্মাণের লক্ষে তিনি ২০০১ সালের ১১ জুলাই তাঁর কাছে সংরক্ষিত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত ঐতিহাসিক পত্র, ভাইস রয় পদক, সনদসমূহ এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি-স্মারক আমাদের জাতীয় জাদুঘরে দান করে গেছেন।
ডা. জোহারা বেগম কাজী জীবনের শুরু থেকেই সময়ের ধারাবাহিকতায় কর্মময় জীবনে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর স্ত্রী কন্তুরাবার øেহসিক্ত হয়েছেন। পরবর্তীতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও মহাত্মা গান্ধীর øেহভাজন কংগ্রেসের অন্যতম কর্মী ডা. সুশীলা নায়ারসহ অসংখ্য মানবতাবাদী বিপ্লবী মানুষের সাহচর্য লাভ করেছেন।
জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে ডা. জোহরা বেগম কাজী বিভিন্ন খেতাব ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘তখমা-ই পাকিস্তান’ খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ‘ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) তাকে বিএমএ স্বর্ণপদক প্রদান করে। ২০০২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘রোকেয়া পদক’ প্রদান করেন। ২০০৮ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) প্রদান করে সম্মানিত করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ৩২ বছর বয়সে তৎকালীন আইনজীবি ও সংসদ সদস্য রাজু উদ্দিন ভূইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আজীবন মানব সেবায় নিয়োজিত জোহরা বেগম কাজী ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর ৯৫ বছর বয়সে ঢাকার নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রতিবছর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকায় মাদারীপুর জেলা সমিতির উদ্যোগে স্মরণ সভা ও পৈতৃক নিবাস মাদারীপুরের কালকিনির মানুষ স্মরণ সভা ও মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করে। এ মহিয়সী নারী আমাদের মাঝে চিরদিন চিরকাল বেঁচে থাকবেন।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ,
সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।

মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১২

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন কুন্ডুবাড়ির মেলা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন হিসাবে আখ্যায়িত করলে অত্যুক্তি করা হবে না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালী পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত কুন্ডুবাড়ির মেলায় আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানই কয়েকগুণ বেশি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়-‘ গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।’ এইতো ছিল আমাদের গ্রামবাংলার সম্প্রীতির চিরায়ত সংস্কৃতি। কিন্তু ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোড়ামী আজ যখন সাম্যের পথে বাধা হয়ে শক্ত প্রাচীর গড়তে যাচ্ছে সে সময়ে এমন মিলন মেলা আমাদের অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ আমরা ফিরে পেতে চাই সোনালী দিন। আমরা বলতে চাই- আমরা জন্মসুত্রে বাংলাদেশী। জাতিগত পরিচয়ে আমরা এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।
দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়- মেলার একদিকে মন্দিরে চলে পূজা-অর্চনা। অন্যদিকে বিশাল এলাকা জুড়ে পণ্যের বিকি-কিনি। সর্বোপরি বাধভাঙা আনন্দ উপচে পড়ে বিনোদন মঞ্চে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা আসে তাদের পণ্যের পসার সাজাতে। দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ আসবাবপত্রের মেলা হিসাবে খ্যাত কুন্ডুবাড়ির মেলা শতবছর পেরিয়ে সহস্র-অযুত-লক্ষ-নিযুত-কোটি বছর কিংবা আজীবন টিকে থাকবে। টিকে থাকবে এ অঞ্চল তথা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কারণ হিন্দুদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেলাকে সফল করতে নির্দ্বিধায় এগিয়ে আসে স্থানীয় মুসলমানরা। সম্প্রতি রামু ও উখিয়ায় ঘটে যাওয়া সহিংসতাও দমাতে পারেনি আয়োজকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা । গ্রামবাংলার শতবছরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে দলমত নির্বিশেষে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এক্ষেত্রে আন্তরিকতার কমতি নেই স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের।
কুন্ডুবাড়ির মেলার উৎপত্তির ইতিহাস দুর্বোধ্য হলেও ধারণা করা হয়- স্থানীয় সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালীপূজা উপলক্ষে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে মাদারীপুরের কালকিনি পৌর এলাকার গোপালপুর গ্রামের কুন্ডুবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা। সঠিক দিন তারিখ কেউ না জানলেও ধরে নেওয়া হয় আনুমানিক আঠারো শতকের শেষের দিকে কুন্ডুদের পূর্বপুরুষরা ধর্মীয় উৎসব কালীপূজার আয়োজন করে। ক্রমান্বয়ে তাদের পূজাকে ঘিরে প্রথমে বাদাম, বুট, রয়্যাল গুলি, লাঠি লজেন্স, মন্ডা-মিঠাই ও খেলনা নিয়ে অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ী বসতো। পরে আস্তে আস্তে প্রতিবছর ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় এখবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসতে শুরু করে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা এর নামকরণ করেন ‘কুন্ডুবাড়ির মেলা’ নামে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থিরতার মধ্যে মেলা বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ মেলা জমজমাটভাবে হয়ে আসছে।
প্রতিবছরের মতো এ বছরও ১৩ নভেম্বর সকাল থেকে ১৭ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কুন্ডুবাড়ির মেলা। তিন দিনব্যাপী হওয়ার কথা থাকলেও ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনা করে আরো দু’দিন বাড়িয়ে সমাপ্ত হলো। মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা বাঁশ, বেত, ইস্পাত-কাঠের আসবাবপত্র, খেলনা ও প্রসাধনীসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে আসেন। অনেকে আসেন পণ্য সামগ্রী কিনতে। পাশাপাশি নাগর দোলা, পুতুল নাচসহ বিভিন্ন বিনোদনে আকৃষ্ট হয় দর্শনার্থীরা। বস্তুত বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মেলা হয়ে ওঠে উপভোগ্য। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চাপ কম থাকলেও বিকেলের পরে বাড়তে থাকে জনস্রোত। বিশাল জনসমুদ্রে রূপ নেয় মেলা প্রাঙ্গন। তবুও মেলার দীর্ঘ ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনার নজির নেই।
মেলায় আগত দর্শনার্থীরা কেউ কেউ বাচ্চাদের জন্য খেলনা, আসবাবপত্র কিংবা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনছেন। আবার কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ব্যবসায়ীদের প্রচুর লাভ হয়। কোন ঝুট-ঝামেলাও নেই। মেলা উদযাপন কমিটিও যথেষ্ট আন্তরিক। কুন্ডুবাড়ির মেলা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্ণ। তাই বংশ পরম্পরায় তারা এ ঐতিহ্যকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। তিনি আরো জানালেন, তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি আঠারো শতকের শেষের দিকে এ মেলার প্রবর্তন করেন। শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ মিলন মেলা। এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সব ধর্মের মানুষ আসে। হিন্দু-মুসলমান কে কোন জাত সে বিচারের উর্ধ্বে গিয়ে সম্প্রীতির বন্ধন গড়াই সকলের উদ্দেশ্য। জাতিগত সীমাবদ্ধতার বাহিরে উদার মানসিকতার পরিচয় মেলে এখানে। বেচা-কেনা কেবল উপলক্ষ মাত্র। আমরা বাঙালি। আমাদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার একাত্মতা ঘোষণার একটা প্লাটফর্ম বলা যায়।
মেলার অগণিত মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য পূজা মন্ডপের পাশে স্থায়ীভাবে একটি পুলিশ কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব) ও গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তাদের সহযোগিতা করেন। ফলে বিশৃঙ্খলার কোন সুযোগ নেই। কুন্ডুদের পূর্বপুরুষদের প্রবর্তিত এ মেলা শতবছর পেরিয়েছে। মেলার আয়োজকরা হিন্দু হলেও এটা এখন এলাকার ঐতিহ্য ও সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। এ ঐতিহ্য ও সম্পদ টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের। ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা এ অঞ্চলের প্রাণের উৎসব। তাই পূর্ব নির্ধারিত তিনদিনের হলেও বর্ধিত আরো দু’দিন অর্থাৎ পাঁচদিনে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে এ উৎসব। কুন্ডুবাড়ির মেলা আমাদের শিক্ষা দেয়- রামুর মতো আর সহিংসতা নয়। মানুষে মানুষে হৃদ্যতাই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আমরা বাঁচতে চাই- হাতে হাত রেখে। আমরা বাঁচতে চাই- কাঁধে কাঁধ রেখে।
বিকাল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গন ঘুরেও মনে হয় ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ।’ জনসমুদ্র সাঁতরে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে পড়ে যায়- ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা/ অগ্রাণে নবান্ন উৎসবে/ আবার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়/ বিশ্ববাসী চেয়ে রবে।’ আমাদের শুধু একটাই প্রার্থনা, শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা টিকে থাকুক মানুষের ভালোবাসা আর বন্ধনে। সাম্য ও মৈত্রী হোক এর একমাত্র লক্ষ। কোন অসাম্প্রদায়িকতা যেন এর পবিত্রতাকে বিনষ্ট করতে না পারে এ প্রত্যাশা সকলের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ভরে উঠুক প্রিয় স্বদেশ। একই দুর্বা ঘাসের শিশিরে সিক্ত হোক সকলের চরণ। এক শীতল আবেশে সম্প্রীতির সুবাতাস বইয়ে দিক সবার অন্তরে। এক সামিয়ানার নিচে সব ব্যবধান ভুলে গিয়ে হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে গেয়ে উঠুক মানবতার জয়গান। কুন্ডুবাড়ির মেলা দীর্ঘজীবি হোক। অটুট বন্ধনে চিরজীবি হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কারণ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ এর সাথে তাল মিলিয়ে বলতে হয় সবার উপরে সম্প্রীতি সত্য তার উপরে নাই।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।

বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১২

প্রথম আলো’র কালকিনি প্রতিনিধির ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
প্রথম আলো’র কালকিনি প্রতিনিধি খায়রুল আলমের ওপর হামলাকারীদের বিচারের দাবীতে গত বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় কালকিনি বন্ধুসভার উদ্যোগে স্থানীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধন শেষে প্রতিবাদ সমাবেশে কালকিনি বন্ধুসভার সভাপতি সালাহ উদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে মিজানুর রহমানের সঞ্চালনে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক মোঃ জামাল উদ্দিন, খন্দকার মনিরুজ্জামান, আসাদুজ্জামান রিপন, সাইফুল ইসলাম, তপন বসু, ওমর আলী সানি, আঃ গফুর মোল্লা, জহিরুল ইসলাম খান, উপজেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন, মাদারীপুর উদীচীর সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী রতন কুমার দাস প্রমুখ। বক্তারা খায়রুল আলমের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।
উল্লেখ্য, গত শনিবার সকালে মাদারীপুরের কালকিনি পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দুলাল ও তার সমর্থকদের হামলায় প্রথম আলো’র কালকিনি প্রতিনিধি খায়রুল আলম গুরুতর আহত হন। তাকে প্রথমে কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শেরে-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরদিন চিরকাল

সালাহ উদ্দিন মাহমুদঃ
‘কেউ কথা রাখেনি’- কবিতাটি প্রথম শুনি খালাতো ভাই মহিউদ্দিনের কন্ঠে। খুব ভালো আবৃত্তি করতেন। কবিতার কবিকে চিনতাম না। তবে নাম শুনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতার সাথে সেই আমার প্রথম প্রেম। কবিতার বইটি খুঁজতে থাকি। নাম জানিনা। ২০০৩ সালে যখন ঢাকায় থাকি; তখন একদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশের রাস্তায় পুরনো বইয়ের দোকানে ‘সুনীলের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নামের একটি পুরনো বইয়ের ওপর চোখ পড়ে। হাতে নিয়ে খুলে দেখি-‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতা আছে। একটি কবিতার জন্য বিশ টাকা দিয়ে বইটা কিনলাম। একদিন পত্রিকায় দেখি- কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর জন্মস্থান কালকিনিতে এসে নোংড়া রাজনীতির শিকার হয়েছেন। কালকিনিবাসী তাঁর কথা রাখেনি।
২০০৫ সালে বাংলা সাহিত্যে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য আসি কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে। তখন কলেজে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বাছাই পর্বে ‘কেউ কথা রাখেনি’ আবৃত্তি করলাম। বাছাইতে টিকলেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারিনি। খুবই আহত হয়েছিলাম। কারণ বিচারকরা আমার কথা রাখেননি। এরপর আবৃত্তিটাকে আঁকড়ে ধরলাম। শিমুল মুস্তাফা, মাহিদুল ইসলাম, মেহেদি হাসানদের অডিও ক্যাসেট কিনে রোজ শুনতাম। তারপর অনেক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছি। আমার আবৃত্তি জীবনে ঐ একটা কবিতাই মুখস্থ। এরপর যত আবৃত্তি করেছি তা মুখস্থ করিনি। স্ক্রীপ্ট দেখে করেছি।
২০০৬ সালে কলেজের নোটিশ বোর্ডে সুনীল সাহিত্য ট্রাস্টের গল্পলেখা প্রতিযোগিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছি। পুরস্কারে সুনীলের লেখা ‘কাকাবাবু’ পেয়েছিলাম। এরপর আত্মীয়ের বাড়িতে ‘সোনালী দুঃখ’ পড়েছি। আস্তে আস্তে সুনীলের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়। সেই থেকে বছরে একটা ছোটগল্প লিখে জমা দিতাম। তারমধ্যে ২০১০ ও ২০১১ সালেও ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছি। পুরস্কারের সাথে কবির হাতের লেখা আশির্বাদ পত্র দেওয়া হয়। সেখানে লেখা ‘আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে রই চিরদিন চিরকাল!- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।’ কবির আর্শিবাদ আমাকে কবির কাছে ঋণী করে দেয়। এখন মনে হচ্ছে মাদারীপুরে প্রবর্তিত সুনীল সাহিত্য পুরস্কারকে জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। তবেই হয়তো কবির কথা না রাখার দীনতা ঘুচাতে পারবো।
২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার জন্মভিটায় পা রাখবেন। শুনে আনন্দিত হলাম। শরীরী কবিকে দেখব। এ যেন অন্যরকম অনুভূতি। অশরীরী সুনীলের সাথে প্রথম পরিচয় খালাবাড়ির ঘরোয়া আড্ডায়। দ্বিতীয় পরিচয় পল্টনের ফুটপাতের পুরনো বইয়ের দোকানে। তৃতীয় পরিচয় সুনীল সাহিত্য পুরস্কারে। কবির সাথে শেষ দেখা মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে। কবির কাছে গিয়েছি, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছি। কবি মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করেছেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনেছি। কবিকে দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে কবি-অকবিরা ছুটে এসেছেন। নির্জনে বা একান্তে কথা বলার সুযোগ কারোই হয়নি।
তবে সৌভাগ্য আরেক আবৃত্তি শিল্পী মেহেদী হাসানের। গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার ছেলে। চাকরি করতো পুলিশের বিশেষ শাখায়। পুলিশ হলেও রসবোধ চমৎকার। সংস্কৃতির চর্চা করেন। তার দায়িত্ব ছিল কবিকে বেনাপোল থেকে নিয়ে আসার। সাথে ছিলেন মাদারীপুর শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যপ্রশিক্ষক আ জ ম কামাল ও উদ্ভাস আবৃত্তি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কুমার লাভলু। মেহেদী হাসানরা কবিকে একা পেয়ে ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার গোড়ার কথা জানতে চেয়েছিলেন। কবি অকপটে সব বলেছেন। মেহেদী হাসান আবৃত্তি করছেন আর কবি ব্যাখা করছেন। কবি বলেছিলেন, তাঁর বয়স যখন তেত্রিশ পেরিয়ে গেছে তখন এমন অনুভূতি তাকে তাড়িত করেছে। তাই তিনি লিখলেন ‘কেউ কথা রাখেনি।’ কবিতার কিছু অংশে কল্পনার সংমিশ্রন থাকলেও পুরো কবিতাটিই বাস্তবতার আলোকে লেখা। কবিতায় বোষ্টুমীর প্রসঙ্গ কাল্পনিক হলেও অবাস্তব নয়। কবি ১৯৩৪ সালে ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রামের নানা বাড়িতে। তখন পৈতৃক নিবাস কালকিনির মাইজপাড়ায়। সম্ভবত ১০-১১ বছর বয়সে অর্থাৎ দেশভাগের আগেই পরিবারের সাথে চলে যান কলকাতা। সেখানেই কেটেছে তার পুরোটা জীবন। দেশভাগ তাকে আহত করেছে বারবার। যা তার বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। তবু তিনি ভুলতে পারেননি শৈশবের স্মৃতি। দেশভাগ করে কথা রাখেননি নেতারা। কিন্তু কবি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ‘পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায়’ থেকেছেন। সে সময় মনে হয়েছে তার মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী তাকে বলেছিল,‘বড় হও দাদাঠাকুর তোমাকে আমি/ তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব’। কবির আর সে বিল দেখা হয়নি।
তিন প্রহরের বিলে সাপ আর ভ্রমরের প্রসঙ্গ এলে কবি মুচকি হাসলেন। তিনি বললেন, তখন আমি ছোট ছিলাম। মামারা যখন নৌকা নিয়ে বিলে যেত। তখন আমিও বায়না ধরতাম। কিন্তু মামারা নিতেন না। ছোট্ট সুনীলকে ভয় দেখানোর জন্য বলতেন, সে বিলে যেতে- আসতে তিন প্রহর লেগে যায়। তুমি অতো দূরে কি করে যাবে। আর সেখানে ভয়ঙ্কর সাপ রয়েছে। সেই বোধ থেকেই বিলের নাম দেই তিন প্রহরের বিল। আর সাপ আর ভ্রমরের খেলাটা বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য বলা। এসময় আ জ ম কামাল অভিযোগ করে বললেন, কবি কবিতায় আপনি মুসলমানদের ছোট করেছেন। একটি মাত্র চরিত্র তাও আবার মাঝি। কবি তখনও হাসলেন। বললেন, আরে কামাল শোন, তখন মুসলমানরা এখনকার মতো এতো সচেতন ছিলেন না। আমি তাদের ছোট করিনি বরং তাদের পশ্চাৎপদতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তখনও মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। মামাবাড়ির আশপাশের মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের বাড়ির কামলা খাটত বা নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো।
কবিরা আর্থিকভাবে অতটা স্বচ্ছল ছিলেন না। মার্বেল খেলার জন্য একটা রয়্যালগুলিও তিনি কিনতে পারেননি। তখন মাইজপাড়ার লস্কররা খুবই বিত্তবান ছিলেন। লস্কর বাড়ির ছেলেদের লাঠি লজেন্স খেতে দেখে কবি বাবার কাছে বায়না ধরতেন। বাবা বলতেন, পরে কিনে দেব। কবি অপেক্ষায় থেকেছেন। বাবা স্কুল মাস্টার। বেতন কম। তাই তার মা কবিকে বলতেন, জীবনে অন্য কিছু করবে তবু মাস্টারি করবে না। তাই কবি কখনো মাস্টারি করতে যাননি। রাস উৎসবের যে অনুসঙ্গ এসেছে এব্যাপারে কবির বক্তব্য হচ্ছে- কবি ছেলেবেলায় খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। তাদের গাঙ্গুলি বাড়িতে যখন রাস উৎসব হতো তখন ভেতর বাড়িতে মহিলারা নাচ-গান করতেন। কবি তার ব্যাঘাত ঘটাবেন বলে তাকে সেখানে ডুকতে দেওয়া হতোনা। নিচেকে অসহায় কল্পনা করে কবি এমন অভিব্যক্তি করেছেন। কবি তখন ভাবতেন, একদিন আমিও সব পাব। রয়্যাল গুলি, লাঠি লজেন্স আর রাস উৎসব সবই তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তার বাবা এসব কিছুই দেখে যেতে পারেননি। আজ সুনীলের সব আছে কিন্তু তার স্কুলমাস্টার বাবা নেই। এই শূন্যতা তাকে বারবার গ্রাস করেছে।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে- কবিকে যখন বরুণার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলো; কবি তখন মুচকি হেসে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। হয়তো তখন কবির সঙ্গে তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বলে। কবি শুধু এইটুকু বললেন, এটা কল্পনা। বরুণা বলে কেউ ছিলনা। তবে পরে আমরা জেনেছি, কবির এক বন্ধুর বোনের প্রতি কবির দূর্বলতা বা ভালোবাসা জন্মেছিল। কবি তার কোন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সে সময়ে একমাত্র বন্ধুর সুবাদে কেবল বন্ধুর বোনের সাথেই কথা বলার বা ভাববিনিময়ের সুযোগ ছিল। হবে হয়ত বরুণা তার কল্পনার নারী। কিন্তু বরুণা বেঁচে আছে সব প্রেমিকের অন্তরে।
কবি কুমার লাভলুকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন, লাভলু তুইতো বিয়ে করলি না। চিরকুমার থেকে গেলি। আচ্ছা, তুই কি নাস্তিক হতে পেরেছিস? কুমার লাভলু বলেছিল, ভয় পাই। পূর্ব পুরুষের ধর্ম ত্যাগ করি কিভাবে? কবি বললেন, জানিস লাভলু ‘আস্তিক হওয়া খুব সহজ; কিন্তু নাস্তিক হওয়া বড়ই কঠিন।’ কথাটায় হাস্যরসাত্মক পরিবেশটা হঠাৎ গুরুগম্ভীর হয়ে উঠলো। গাড়ি বেনাপোল থেকে চলে এল মাদারীপুর। ৭৫ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতে কবি এলেন তার জন্মভিটায়। এটা কবির জন্য যতটা আনন্দের; মাদারীপুরবাসীর জন্য ততটা গর্বের। তিন দিন অবস্থান করে কবি আবার চলে গেলেন তার গড়িহাটির পারিজাতে। রেখে গেলেন স্মৃতি। অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দেশভাগের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে সৌহার্দের মিলনরেখা। কিন্তু সব ছেড়েই তাকে চলে যেতে হলো ২২ অক্টোবর। পড়ে রইল পারিজাত। পড়ে রইল জন্মভিটার সুনীল আকাশ। কেউ কথা না রাখলেও আমরা আগলে রেখেছি তার সুনীল আকাশ সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র এবং সুনীল সাহিত্য পুরস্কার। কবি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার কর্মে। কবি বেঁচে থাকবেন আমাদের মর্মে। আমাদের চিন্তা-চেতনায়, আমাদের উপলব্ধিতে। তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন চিরকাল।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ,
সুনীল সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।

নেই

দুলাল সরকার
(সদ্যপ্রয়াত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণে)

গৃহপালিত সকল শব্দের মধ্যে
‘নেই’ শব্দটি বড় বেশি কাছের
ও একি সাথে দূরের যেন দিগন্তের ওপাড়ে
এক বাস্তুভিটার ’পর মাটি কামড়ে পড়ে থাকা
এক পথের চুপচাপ, স্তব্ধতার হাসি;

‘নেই’ মানে শূন্যের আভাসÑ দৃশ্যান্তরে
বিমূর্ত সত্তার কারুকার্যখচিত পাথরÑ
পাথরে চুম্বন সদৃশ্য কিছু তন্ময় বেদনা,
কিছু অনুভূতি, ধূ ধূ রাত, তেপান্তর নামের বিরহ।
স্বাতীর কপাল লগ্ন চুলের বিদ্রোহÑ
কেউ ছিল, এইমাত্র উঠে যাওয়া
ঘামের গন্ধ নিয়ে ভাঙা বাতাস, অশ্লীল উত্তাপ;
চোরাগুপ্ত হামলার শিকার
অথবা কতটা সত্যÑ ‘নেই’ মানে
বিশ্রী সহ্যের শেষে গুমোট আঁধারে বসে পীড়িত জোছনা;

‘নেই’ মানে গন্ধহীন গোলাপের ভাজ
বিষণœ ত্বকের নিচে বাস্তুহারা ‘নেই’ এর সংবাদ
হারানো চাবির গোছাÑ
অনুমোদনহীন আত্মসমর্পণের দৃশ্য মঞ্চের উপর।
২৪.১০.২০১২