মো: খবির উদ্দিন
৯০’র গণ অভ্যূত্থানের কথা কাউকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আজ হঠাৎ মনে পরে গেল ৯০’র গণ অভ্যূত্থানের ইতিহাস। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। প্রতিদিনের মত বন্ধুদের সাথে মিরপুর পল্লবী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ‘চৈতালী’তে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গেলাম। ঐদিনকার প্রথম প্রিয়ড যথারীতি ১১ টায় শুরু হবে। সময় এদিক-সেদিক হওয়ার কোন সুযোগ নেই। হলোও ঠিক তাই। এগারটা বাজার সাথে সাথে কলা অনুষদের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশে যেখান থেকে তাকালেই রেজিষ্ট্রার বিল্ডিং ও মাষ্টার দা-সূর্যসেন হল চোখে পরে এমন একটি কক্ষে স্যারের লেকচার শুরু হলো। শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্বেয় ড. রুহুল আমীন স্যার। আমার খুব প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বহু গল্প করেছি স্যারের সাথে। অনেক প্রাণবন্ত আলোচনা যা আজও ভুলতে পারিনা। একটু নিরবে নিভৃতে থাকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে প্রফেসর ড. হাবিবুর রহমান স্যার, প্রফেসর ড. রুইছউদ্দিন স্যার, প্রফেসর ড. আবদুস সাত্তার স্যার, প্রফেসর ড. আবদুল বাকী স্যার, প্রফেসর শামছুল হক স্যারসহ অন্যান্য শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের কথা। যাদের কাছ থেকে অ-নে-ক জ্ঞানগর্ভ কথা ও আলোচনা শুনেছি। যখন স্যারদের ক্লাশ শুরু হতো তখন মাঝে মধ্যে মনে মনে ভাবতাম আজ যদি এই ক্লাশটা কোন বিরতি না দিয়ে অবিরাম চালিয়ে যেতেন। মনে পড়লেই হারিয়ে যাই সেই মধুময় স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোর মধ্যে।
যাক্ সে সব কথা, এখন যে উদ্দেশ্যে এই লেখা সে প্রসংগে আসা যাক। ড. রুহুল আমীন স্যার লেকচার শুরু করে এক পর্যায়ে বললেন, দেখেন গতকাল জহুরুল হক হলের উত্তর পাশের রাস্তায় চুন্নুকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। কার ভাগ্যে যে কোন সময় বিপদ এসে যায় বলা মুশকিল। তাই আপনারা একটু সাবধানে চলার চেষ্টা করবেন। যতটা সম্ভব সংঘাত এড়িয়ে নিজেদের রক্ষা করে চলবেন। স্যারের কথার মধ্যে অনেক উপদেশমূলক ইংগিত বহন করছিল যা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না। স্যারের কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ গুলির আওয়াজ হলো, গুলিটা যে খুব কাছে হচ্ছিল তা গুলির আওয়াজেই বুঝা গেল। এরপর শুধু গুলি আর গুলি। মনে হলো এ যেন সেই ছোট বেলার রমজান শেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত ঈদের চাঁদ ওঠার পরে একযোগে গ্রামের শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন রকম বাজি ফুটানোর আওয়াজের মত। স্যার আমাদের খুব জোর করে বললেন, তোমরা কেউ বেঞ্চ থেকে ঊঠোনা এবং জানালার পাশে এসোনা। এইতো পশ্চিম পাশের মাঠেই গোলাগুলির আওয়াজ চলতে লাগল অবিরাম। খবর শোনা গেল স্বৈরশাসক হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এর পালিত বাহিনীর নেতা অভি-নিরু মিডফোর্ট মেডিকেলের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রেজিষ্ট্রার বিল্ডিং ও কলা ভবনের মাঝখানের মাঠে ঢুকে পড়েছে। প্রাণপণ গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ক্যাম্পাস দখলে নেয়া। কিন্তু বহুদলীয় ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে পাল্টা জবাব দেয়া হলো। প্রায় এক ঘন্টার অধিক সময় ধরে উভয়পক্ষের মধ্যে আক্রমন ও পাল্টা আক্রমন চলতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ সংগ্রাম করে টিকতে না পেরে স্বৈরশাসকের বাহিনী শেষমেষ বিফল হয়ে সরকারী প্রশাসনের ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়েছিল। আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছিলাম তাতে জানা গেল ঐদিন প্রায় ৫০০ রাউন্ডের মত গুলি ছোড়া হয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সমস্ত ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্য Ÿন্ধ ঘোষণা করলেন।
দীর্ঘদিন যে সরকারবিরোধী একদফা আন্দোলন চলছিল তা আরও বেগবান হতে লাগল। সরকারের পক্ষ থেকে শুরু হলো সংঘাত, জুলুম, নির্যাতন, মিছিলের উপরে গুলিবর্ষণ। এর একপর্যায়ে ডা: মিলন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। আন্দোলন আরও তুমুল হতে লাগল। প্রতিদিনই সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম চলতে লাগল। অনেক রক্ত ঝরল, শেষমেষ রক্তের হলি খেলায় স্বৈরশাসক হেরে গেলেন। শেষ চেষ্টা করেও কোন কাজ হলোনা। অনেক তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত গদির লোভ তাকে ছাড়তে হলো এবং ১৯৯০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর সাধারণ জনগণ ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কঠোর প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। অবসান ঘটল নয় বছরের স্বৈরশাসনের। দেশের মানুষ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
সংকটকালিন মুহূর্তে দায়িত্ব এসে পড়ল বিচারপতি সাহাব উদ্দিনের কাঁধে, দায়িত্ব পড়ল একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করার। নির্ভেজাল চরিত্রের মানুষ বিচারপতি সাহাব উদ্দিন তাঁর শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে জাতিকে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য মানের একটি নির্বাচন উপহার দিলেন এবং প্রত্যেকটি দল এ নির্বাচনকে মেনে নিয়েছিলেন ।
১৯৯১ এর নির্বাচনে সাধারণ জনগণের মধ্যে স্বতস্ফূর্ত ভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। জনগণ তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। নির্বাচনী ফলাফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের সমমনা দলগুলো নিয়ে সরকার গঠন করলেন। বছর না ঘুরতেই আবার আন্দোলন দানা বেধে ঊঠতে লাগল, হরতাল মিছিল মিটিংসহ সংসদ বর্জনও চলতে লাগল। অনেক চড়ই-উৎরাই পেরিয়ে বিএনপি অনেকটা হঠকারী সিন্ধান্ত নিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্র“য়ারী বিরোধীদলবিহীন জাতীয় সংসদের নির্বাচন করলেন। প্রধান বিরোধী দল না থাকায় একচেটিয়া সংসদের প্রায় সকল আসন পেয়ে গেলেন তারা। কিন্তু বিরোধী দলের পক্ষ থেকে উক্ত নির্বাচনকে অবৈধ নির্বাচন আখ্যা দিয়ে তত্তাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে পূন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে তারা রাজ পথে তুখোড় আন্দোল গড়ে তুললেন। প্রচন্ড আন্দোলনের মুখে বিএনপি বিরোধীদলের দাবী মেনে নিয়ে তত্তাবধায়ক সরকার বিল পাশ করে ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ ক্ষমতা থেকে নেমে পরলেন। প্রমাণ হলো, জনগণের যে কোন যৌক্তিক দাবি সংসদের সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে অবহেলা করে মোটেও পার পাওয়া যায়না।
এবার জনগণ খুব স্বস্তি বোধ করলেন। ভাবলেন এবার বুঝি ক্ষমতার লড়াইয়ের জন্য সংঘাত আর হানাহানি থেকে বাঁচা গেল, ভবিষ্যতের জন্য আর কোন হানাহানির অবকাশ থাকলনা। যেহেতু ভবিষ্যতে প্রতিটা সরকারের মেয়াদ শেষে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¦াবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অতএব স্বাভাবিকভাবেই বোধগম্য হল যে, নির্বাচন অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের ও জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণ যোগ্যতা পাবে। এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¦াবধায়ক সরকারের বিষয়টি সাংবিধানিক ভাবে নিষ্পত্তি হয়ে গেল।
যেহেতু বিএনটি সংসদ ভেংগে দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তাই নিয়মানুযায়ী নির্দিস্ট (তিন মাস) মেয়াদের মধ্যেই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সে অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো এবং নির্বাচন হলো তত্ত্বাবধায় সরকারের মাধ্যমে। এবার সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে ক্ষমতায় এলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এভাবেই ক্ষমতার পালা বদলে আবার ২০০১ সালে সংসদের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন বিএনপি। কিন্তু বিএনপির মেয়াদ শেষে তত্ত্বাধায়ক সরকারে প্রধান ব্যাক্তি কে হবেন এ নিয়েই অনেক নাটক ঘটে গেল এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এ নিয়ে প্রচন্ড রকমের সংঘাতময় পরিস্থিরি সৃষ্টি হলো। এ অরাজক পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণ আবার অসহায় হয়ে পড়লেন। প্রতিদিনই নৃশংসতা চলতে লাগল। পল্টনের ঘটনা আমাদের অজানার কথা নয়। দেখা গেল চেহারা না চেনার কারনে নিজ দলের লোকদের হাতে নিজেরাই মার খাচ্ছে। যেমন আওয়ামীলীগের এ আমলেও বিশ্বজিৎ এর বেলায় ঘটল। এমনি এক সংকটময় পরিস্থিতিতে এক এগারোর সৃষ্টি হলো। এক এগারোর সময় বিএনপি ও আওয়ামীলীগের উপরে যে খড়গ নেমে এসছিল সে ইতিহাস আমাদের সকলকেই নাড়া দেয়। আজ এ লেখায় এক এগারোর ভালো মন্দ বিশ্লেষণে যাবনা এবং উদ্দেশ্য আমার সেটা নয়।
পাঠক হয়ত মনে করতে পারেন এই পুরনো ইতিহাস সকলেরই জানা আছে তাহলে কেন অহেতুক এই বাসি গল্প আলোচনায় আনা হলো? ঊদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। যে ঊদ্দেশ্যে এত পেছনে ফিরে তাকাতে হলো সেটা হলো আমরা আজ কোথায় ফিরে যাচ্ছি। যেহেতু ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ আন্দেলনের মাধ্যমে অর্জিত তত্ত্ববধায়ক সরকার পদ্ধতি মিমাংসিত হয়েছিল এবং বর্তমান সংসদের মাধ্যমে তত্ত্বধায়ক আইন বাতিল করা হয়েছে তাই ভবিষ্যত নির্বাচন নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অনিবার্য এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখন সহসাই প্রশ্ন আসতে পারে, আসলে আমাদের ভবিষ্যত রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে? আমরা দেশ ও জাতিকে আবার সেই পিছনের দিকে অর্থাৎ ১৯৮২, ১৯৯০-এর অভ্যূত্থান, ১৯৯৬’র মাত্র ১৫ দিনের সংসদ না কি এক-এগারোর দিকে নিয়ে যাচ্ছি? জানি, এ উত্তর রাজনীতিবিদরা মিলাতে পারলেও মিলাবেন না।
এ প্রসংগে আমার একটা উদহরণ মনে পড়ে গেল, সেটা হলো- আমাদের দেশের স্বাধীনতার বয়স ৪২ পেড়িয়েছে অর্থাৎ ৪২ বছর পূর্বে আমাদের দেশের জন্ম হয়েছে। এই ৪২ বছর পরেও আমরা কোথায় অবস্থান করছি। শিশু অবস্থায় না-কি ৪২ বছর বয়সের এক সুঠাম দেহের অধিকারীর ন্যায়। জন্মের পরে এক সময় মানুষ হাটতে শিখে। তারপরে একটু জোরে হাটে। তারপরে একা একা দৌঁড়াতে পারে। সারা জীবনতো আর মানুষ হাটা শিখেনা। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের অবস্থা প্রকৃত অর্থে ঐ শিশুটির ন্যায়। যে জন্মের ৪২ বছর পার হওয়ার পরেও বাপের হাত ধরে হাটা শিখছে।
আমি এ দেশের একজন অতি সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের দেশের শ্রদ্ধাভাজন দুই নেত্রীকেই বিনয়ের সাথে অনুরোধ জানাচ্ছি, আমরা এগিয়ে যেতে চাই। আমরা আর অন্যের হাত ধরে হাটা শিখতে চাইনা। আমরা আর হানাহানি চাইনা, আমরা এক ভাই আরেক ভাইয়ের রক্ত দেখতে চাইনা। আমরা অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে চাই। সর্বোপরি আমরা সহাবস্থান চাই। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা উভয়েই এই মহান স্বাধীনতার মাসকে শ্রদ্ধা করেন। বিশেষ করে এই স্বাধীনতার মাসের উপরে শ্রদ্ধা রেখে আপনারা পিছনের সব অপ্রীতিকর ইতিহাস ভুলে গিয়ে জনগণের ও দেশের কথা চিন্তা করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একটি যৌক্তিক সিন্ধান্তে এসে উপণীত হবেন। এদেশের সাধারণ জনগণ যারা কম শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চ শিক্ষিত আছেন তাদেরকে আর শ্রমিক বানিয়ে বিদেশে না পাঠিয়ে যাতে করে এ এদেশের মাটিতেই কর্মক্ষেত্র তৈরী করে দিতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনে একটি জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করুন এবং এ দেশের জনগণের হাতকেই কাজে লাগিয়ে দেশকে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে নিন। এদেশের ষোল কোটি মানুষ আপনাদেরকে আমরণ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দিয়ে যাবে। আমরা এই অপরাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে চাই।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক তিলোত্তমা ও সহকারী ব্যবস্থাপক, দৈনিক করতোয়া।
৯০’র গণ অভ্যূত্থানের কথা কাউকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আজ হঠাৎ মনে পরে গেল ৯০’র গণ অভ্যূত্থানের ইতিহাস। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। প্রতিদিনের মত বন্ধুদের সাথে মিরপুর পল্লবী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ‘চৈতালী’তে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গেলাম। ঐদিনকার প্রথম প্রিয়ড যথারীতি ১১ টায় শুরু হবে। সময় এদিক-সেদিক হওয়ার কোন সুযোগ নেই। হলোও ঠিক তাই। এগারটা বাজার সাথে সাথে কলা অনুষদের দ্বিতীয় তলার পশ্চিম পাশে যেখান থেকে তাকালেই রেজিষ্ট্রার বিল্ডিং ও মাষ্টার দা-সূর্যসেন হল চোখে পরে এমন একটি কক্ষে স্যারের লেকচার শুরু হলো। শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্বেয় ড. রুহুল আমীন স্যার। আমার খুব প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বহু গল্প করেছি স্যারের সাথে। অনেক প্রাণবন্ত আলোচনা যা আজও ভুলতে পারিনা। একটু নিরবে নিভৃতে থাকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে প্রফেসর ড. হাবিবুর রহমান স্যার, প্রফেসর ড. রুইছউদ্দিন স্যার, প্রফেসর ড. আবদুস সাত্তার স্যার, প্রফেসর ড. আবদুল বাকী স্যার, প্রফেসর শামছুল হক স্যারসহ অন্যান্য শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের কথা। যাদের কাছ থেকে অ-নে-ক জ্ঞানগর্ভ কথা ও আলোচনা শুনেছি। যখন স্যারদের ক্লাশ শুরু হতো তখন মাঝে মধ্যে মনে মনে ভাবতাম আজ যদি এই ক্লাশটা কোন বিরতি না দিয়ে অবিরাম চালিয়ে যেতেন। মনে পড়লেই হারিয়ে যাই সেই মধুময় স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোর মধ্যে।
যাক্ সে সব কথা, এখন যে উদ্দেশ্যে এই লেখা সে প্রসংগে আসা যাক। ড. রুহুল আমীন স্যার লেকচার শুরু করে এক পর্যায়ে বললেন, দেখেন গতকাল জহুরুল হক হলের উত্তর পাশের রাস্তায় চুন্নুকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। কার ভাগ্যে যে কোন সময় বিপদ এসে যায় বলা মুশকিল। তাই আপনারা একটু সাবধানে চলার চেষ্টা করবেন। যতটা সম্ভব সংঘাত এড়িয়ে নিজেদের রক্ষা করে চলবেন। স্যারের কথার মধ্যে অনেক উপদেশমূলক ইংগিত বহন করছিল যা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হলো না। স্যারের কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ গুলির আওয়াজ হলো, গুলিটা যে খুব কাছে হচ্ছিল তা গুলির আওয়াজেই বুঝা গেল। এরপর শুধু গুলি আর গুলি। মনে হলো এ যেন সেই ছোট বেলার রমজান শেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত ঈদের চাঁদ ওঠার পরে একযোগে গ্রামের শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন রকম বাজি ফুটানোর আওয়াজের মত। স্যার আমাদের খুব জোর করে বললেন, তোমরা কেউ বেঞ্চ থেকে ঊঠোনা এবং জানালার পাশে এসোনা। এইতো পশ্চিম পাশের মাঠেই গোলাগুলির আওয়াজ চলতে লাগল অবিরাম। খবর শোনা গেল স্বৈরশাসক হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ এর পালিত বাহিনীর নেতা অভি-নিরু মিডফোর্ট মেডিকেলের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রেজিষ্ট্রার বিল্ডিং ও কলা ভবনের মাঝখানের মাঠে ঢুকে পড়েছে। প্রাণপণ গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ক্যাম্পাস দখলে নেয়া। কিন্তু বহুদলীয় ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে পাল্টা জবাব দেয়া হলো। প্রায় এক ঘন্টার অধিক সময় ধরে উভয়পক্ষের মধ্যে আক্রমন ও পাল্টা আক্রমন চলতে থাকে। দীর্ঘক্ষণ সংগ্রাম করে টিকতে না পেরে স্বৈরশাসকের বাহিনী শেষমেষ বিফল হয়ে সরকারী প্রশাসনের ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়েছিল। আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছিলাম তাতে জানা গেল ঐদিন প্রায় ৫০০ রাউন্ডের মত গুলি ছোড়া হয়েছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ সমস্ত ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্য Ÿন্ধ ঘোষণা করলেন।
দীর্ঘদিন যে সরকারবিরোধী একদফা আন্দোলন চলছিল তা আরও বেগবান হতে লাগল। সরকারের পক্ষ থেকে শুরু হলো সংঘাত, জুলুম, নির্যাতন, মিছিলের উপরে গুলিবর্ষণ। এর একপর্যায়ে ডা: মিলন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। আন্দোলন আরও তুমুল হতে লাগল। প্রতিদিনই সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম চলতে লাগল। অনেক রক্ত ঝরল, শেষমেষ রক্তের হলি খেলায় স্বৈরশাসক হেরে গেলেন। শেষ চেষ্টা করেও কোন কাজ হলোনা। অনেক তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত গদির লোভ তাকে ছাড়তে হলো এবং ১৯৯০ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর সাধারণ জনগণ ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কঠোর প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। অবসান ঘটল নয় বছরের স্বৈরশাসনের। দেশের মানুষ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।
সংকটকালিন মুহূর্তে দায়িত্ব এসে পড়ল বিচারপতি সাহাব উদ্দিনের কাঁধে, দায়িত্ব পড়ল একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করার। নির্ভেজাল চরিত্রের মানুষ বিচারপতি সাহাব উদ্দিন তাঁর শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে জাতিকে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য মানের একটি নির্বাচন উপহার দিলেন এবং প্রত্যেকটি দল এ নির্বাচনকে মেনে নিয়েছিলেন ।
১৯৯১ এর নির্বাচনে সাধারণ জনগণের মধ্যে স্বতস্ফূর্ত ভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। জনগণ তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। নির্বাচনী ফলাফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের সমমনা দলগুলো নিয়ে সরকার গঠন করলেন। বছর না ঘুরতেই আবার আন্দোলন দানা বেধে ঊঠতে লাগল, হরতাল মিছিল মিটিংসহ সংসদ বর্জনও চলতে লাগল। অনেক চড়ই-উৎরাই পেরিয়ে বিএনপি অনেকটা হঠকারী সিন্ধান্ত নিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্র“য়ারী বিরোধীদলবিহীন জাতীয় সংসদের নির্বাচন করলেন। প্রধান বিরোধী দল না থাকায় একচেটিয়া সংসদের প্রায় সকল আসন পেয়ে গেলেন তারা। কিন্তু বিরোধী দলের পক্ষ থেকে উক্ত নির্বাচনকে অবৈধ নির্বাচন আখ্যা দিয়ে তত্তাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে পূন নির্বাচনের দাবি জানিয়ে তারা রাজ পথে তুখোড় আন্দোল গড়ে তুললেন। প্রচন্ড আন্দোলনের মুখে বিএনপি বিরোধীদলের দাবী মেনে নিয়ে তত্তাবধায়ক সরকার বিল পাশ করে ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬ ক্ষমতা থেকে নেমে পরলেন। প্রমাণ হলো, জনগণের যে কোন যৌক্তিক দাবি সংসদের সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে অবহেলা করে মোটেও পার পাওয়া যায়না।
এবার জনগণ খুব স্বস্তি বোধ করলেন। ভাবলেন এবার বুঝি ক্ষমতার লড়াইয়ের জন্য সংঘাত আর হানাহানি থেকে বাঁচা গেল, ভবিষ্যতের জন্য আর কোন হানাহানির অবকাশ থাকলনা। যেহেতু ভবিষ্যতে প্রতিটা সরকারের মেয়াদ শেষে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¦াবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অতএব স্বাভাবিকভাবেই বোধগম্য হল যে, নির্বাচন অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের ও জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণ যোগ্যতা পাবে। এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¦াবধায়ক সরকারের বিষয়টি সাংবিধানিক ভাবে নিষ্পত্তি হয়ে গেল।
যেহেতু বিএনটি সংসদ ভেংগে দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তাই নিয়মানুযায়ী নির্দিস্ট (তিন মাস) মেয়াদের মধ্যেই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সে অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো এবং নির্বাচন হলো তত্ত্বাবধায় সরকারের মাধ্যমে। এবার সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে ক্ষমতায় এলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এভাবেই ক্ষমতার পালা বদলে আবার ২০০১ সালে সংসদের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন বিএনপি। কিন্তু বিএনপির মেয়াদ শেষে তত্ত্বাধায়ক সরকারে প্রধান ব্যাক্তি কে হবেন এ নিয়েই অনেক নাটক ঘটে গেল এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এ নিয়ে প্রচন্ড রকমের সংঘাতময় পরিস্থিরি সৃষ্টি হলো। এ অরাজক পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণ আবার অসহায় হয়ে পড়লেন। প্রতিদিনই নৃশংসতা চলতে লাগল। পল্টনের ঘটনা আমাদের অজানার কথা নয়। দেখা গেল চেহারা না চেনার কারনে নিজ দলের লোকদের হাতে নিজেরাই মার খাচ্ছে। যেমন আওয়ামীলীগের এ আমলেও বিশ্বজিৎ এর বেলায় ঘটল। এমনি এক সংকটময় পরিস্থিতিতে এক এগারোর সৃষ্টি হলো। এক এগারোর সময় বিএনপি ও আওয়ামীলীগের উপরে যে খড়গ নেমে এসছিল সে ইতিহাস আমাদের সকলকেই নাড়া দেয়। আজ এ লেখায় এক এগারোর ভালো মন্দ বিশ্লেষণে যাবনা এবং উদ্দেশ্য আমার সেটা নয়।
পাঠক হয়ত মনে করতে পারেন এই পুরনো ইতিহাস সকলেরই জানা আছে তাহলে কেন অহেতুক এই বাসি গল্প আলোচনায় আনা হলো? ঊদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। যে ঊদ্দেশ্যে এত পেছনে ফিরে তাকাতে হলো সেটা হলো আমরা আজ কোথায় ফিরে যাচ্ছি। যেহেতু ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ আন্দেলনের মাধ্যমে অর্জিত তত্ত্ববধায়ক সরকার পদ্ধতি মিমাংসিত হয়েছিল এবং বর্তমান সংসদের মাধ্যমে তত্ত্বধায়ক আইন বাতিল করা হয়েছে তাই ভবিষ্যত নির্বাচন নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অনিবার্য এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখন সহসাই প্রশ্ন আসতে পারে, আসলে আমাদের ভবিষ্যত রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে? আমরা দেশ ও জাতিকে আবার সেই পিছনের দিকে অর্থাৎ ১৯৮২, ১৯৯০-এর অভ্যূত্থান, ১৯৯৬’র মাত্র ১৫ দিনের সংসদ না কি এক-এগারোর দিকে নিয়ে যাচ্ছি? জানি, এ উত্তর রাজনীতিবিদরা মিলাতে পারলেও মিলাবেন না।
এ প্রসংগে আমার একটা উদহরণ মনে পড়ে গেল, সেটা হলো- আমাদের দেশের স্বাধীনতার বয়স ৪২ পেড়িয়েছে অর্থাৎ ৪২ বছর পূর্বে আমাদের দেশের জন্ম হয়েছে। এই ৪২ বছর পরেও আমরা কোথায় অবস্থান করছি। শিশু অবস্থায় না-কি ৪২ বছর বয়সের এক সুঠাম দেহের অধিকারীর ন্যায়। জন্মের পরে এক সময় মানুষ হাটতে শিখে। তারপরে একটু জোরে হাটে। তারপরে একা একা দৌঁড়াতে পারে। সারা জীবনতো আর মানুষ হাটা শিখেনা। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের অবস্থা প্রকৃত অর্থে ঐ শিশুটির ন্যায়। যে জন্মের ৪২ বছর পার হওয়ার পরেও বাপের হাত ধরে হাটা শিখছে।
আমি এ দেশের একজন অতি সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের দেশের শ্রদ্ধাভাজন দুই নেত্রীকেই বিনয়ের সাথে অনুরোধ জানাচ্ছি, আমরা এগিয়ে যেতে চাই। আমরা আর অন্যের হাত ধরে হাটা শিখতে চাইনা। আমরা আর হানাহানি চাইনা, আমরা এক ভাই আরেক ভাইয়ের রক্ত দেখতে চাইনা। আমরা অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে চাই। সর্বোপরি আমরা সহাবস্থান চাই। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা উভয়েই এই মহান স্বাধীনতার মাসকে শ্রদ্ধা করেন। বিশেষ করে এই স্বাধীনতার মাসের উপরে শ্রদ্ধা রেখে আপনারা পিছনের সব অপ্রীতিকর ইতিহাস ভুলে গিয়ে জনগণের ও দেশের কথা চিন্তা করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একটি যৌক্তিক সিন্ধান্তে এসে উপণীত হবেন। এদেশের সাধারণ জনগণ যারা কম শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চ শিক্ষিত আছেন তাদেরকে আর শ্রমিক বানিয়ে বিদেশে না পাঠিয়ে যাতে করে এ এদেশের মাটিতেই কর্মক্ষেত্র তৈরী করে দিতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনে একটি জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করুন এবং এ দেশের জনগণের হাতকেই কাজে লাগিয়ে দেশকে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে নিন। এদেশের ষোল কোটি মানুষ আপনাদেরকে আমরণ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দিয়ে যাবে। আমরা এই অপরাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে চাই।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক তিলোত্তমা ও সহকারী ব্যবস্থাপক, দৈনিক করতোয়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন