সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
বাঙলা সাহিত্যে ধুমকেতুর ন্যায় আগমন যার। বিদ্রোহ-প্রেম-সাম্যবাদের মশাল হাতে যিনি আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নানাবিধ সমস্য-সংকটে যখন সারা বিশ্ব আলোড়িত। কাজী নজরুল ইসলামের(১৮৯৯-১৯৭৬) তখন আবির্ভাব। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে যখন মানবতা ধুলায় লুন্ঠিত তখন তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সাম্যবাদের গান। একই কন্ঠে হামদ- নাত এবং শ্যামা সংগীতের সুরের মূর্ছনায় মানব জাতিকে উপহার দিয়েছেন সাম্যবাদের মূলমন্ত্র। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসায় কবি হয়ে উঠেছেন মানবতাবাদী।
নজরুলের সাম্যবাদের প্রধান ক্ষেত্র মানুষ। কে কুলি-মজুর আর কে সাহেব? সবাই তার দৃষ্টিতে সমান। আশরাফ আর আতরাফের কোন ভেদাভেদ নেই এখানে। সবাই সৃষ্টির সেরা। সবাইকেই তিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। নজরুলের সাম্যবাদ তাঁর অন্তরের প্রেরণালব্ধ বস্তু। কবি কল্পনার রঙে রঙিন। মানবতাবোধই তার সাম্যবাদের ভিত্তি। তিনি সকল ধর্মের উর্ধে মানবধর্মকেই উচ্চাসনে বসিয়েছেন। মানবের মাঝে তিনি স্রষ্টাকে আবিস্কার করেছেন। তাঁর সাম্যবাদ স্রষ্টাকে অস্বীকার কওে নয়। কাল মার্কসের মত তাঁর সাম্যবাদ নাস্তিক্য সাম্যবাদ নয়। তাঁর সাম্যবাদ আস্তিক্য সাম্যবাদ। অসাম্প্রদায়িক হলেও তিনি পুরোপুরি আস্তিক ছিলেন।
নজরুলের সাম্যবাদ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে। ১৯৫২ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১১টি কবিতা স্থান পেয়েছে। যেমন- ‘সাম্যবাদী’, ‘নারী’, ‘মানুষ’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘রাজা-প্রজা’, ‘ঈশ্বর’, ‘পাপ’, কুলি-মজুর’, ‘চোর-ডাকাত’, ‘সাম্য’ ও ‘কান্ডারী হুশিয়ার’। মূলত ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের কবিতাগুলোতে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব রয়েছে।
তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের ‘নারী’ কবিতাটি বহুল প্রশংসিত। ‘নারী’ কবিতায় কবি নারী-পুরুষে সাম্যের বাণী উচ্চারণ করেছেন। কবি নারী-পুরুষের ভেদাভেদ অস্বীকার করেছেন। কবির ভাষায়-
“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
আর ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটি অধিক সমালোচিত। কবিতায় কবি বলেছেনÑ
“কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?
হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।”
তিনি মন্দির-কাবার চেয়ে মানুষের হৃদয়কে বড় জ্ঞান করেছেন। কবি বলেছেনÑ
“এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।”
‘সাম্য’ কবিতায় কবি বলেছেন-
“হেথা স্রষ্টার ভজন আলয় এই দেহ এই মন,
হেথা মানুষের বেদনায় তার দুঃখের সিংহাসন।
সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে নামে যে কেহ ডাকে,
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে নামে ডাকে সে মাকে।”
নজরুল মানুষের কবি। সাম্যের কবি। নজরুলের বড় পরিচয় তিনি সাম্যবাদী কবি। নজরুলের সাম্যবাদ সকল মানবের মহামিলন।
‘‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’’
কবি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। মানুষকে কখনো তিনি ঘৃণার চোখে দেখেন নি। কবি বলেছেনÑ
“বন্ধু, তোমার বুক ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।”
মানুষকে তিনি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। হিন্দু- মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কারো আসল পরিচয় হতে পারে না। আসল পরিচয় হলো- আমরা সবাই মানুষ। ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায় বলেছেন-
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
এছাড়াও তার কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
‘জাতের চাইতে মানুষ সত্য
অধিক সত্য প্রাণের টান
প্রাণ ঘরে সব এক সমান।’
‘ঈশ্বর’ কবিতায় নজরুল ইসলাম ঈশ্বর অন্বেষণের ব্যাপারে বলেছেন, বনে- জঙ্গলে, পর্বত চূড়ায় ঈশ্বর অন্বেষণের কোন প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর মানব মনেই অধিষ্ঠিত। আর শাস্ত্র অন্বেষণে না গিয়ে সত্যের সন্ধানে অগ্রসর হতে বলেছেন। ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই বিরাজিত, তাকে বাইরে না খুঁজে নিজের মধ্যে ডুব দিতে হবে। কবি বলেছেন- “স্রষ্টারে খোঁজো - আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।”
সর্বোপরি কবি ‘সাম্য’ কবিতায় স্বপ্নের দেশ- আদর্শ দেশের করেছেন। এমন দেশ যেখানে রাজা প্রজা নেই, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। ‘সাম্যবাদী’ এ স্থানে বর্ণবৈষম্য নেই, এখানে সাদা ও কালোদের জন্য আলাদা গোরস্থান বা গির্জা নেই। এখানে কোন ধর্মের বা শাস্ত্রের ভেদ নেই, নেই কোলাহল। সেখানে পাদ্রী পুরুত মোল্লা এক পাত্রে জল খেলেও জাত যাবে না, স্রষ্টা বাতিল হবে না।
‘সাম্য’ কবিতায় কবিতায় স্রষ্টাকে মহিমাময় এবং মানুষের দেহ মনকেই তার ভজনালয় রূপে বিবেচনা করেছেনÑ
“সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে নামে কেহ ডাকে
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যেই নামে ডাকে সে মা’কে।”
সাম্যবাদ বাঙলা সাহিত্যে নতুন কোন বিষয় নয়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম যে মমতায় মানবতা মিশ্রিত সাম্যের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন তা একান্তই অভিনব। এখানেই নজরুলের সাম্যবাদী চেতনার নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
কালকিনি, মাদারীপুর
২৩.০৮.২০১৩
বাঙলা সাহিত্যে ধুমকেতুর ন্যায় আগমন যার। বিদ্রোহ-প্রেম-সাম্যবাদের মশাল হাতে যিনি আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নানাবিধ সমস্য-সংকটে যখন সারা বিশ্ব আলোড়িত। কাজী নজরুল ইসলামের(১৮৯৯-১৯৭৬) তখন আবির্ভাব। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে যখন মানবতা ধুলায় লুন্ঠিত তখন তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সাম্যবাদের গান। একই কন্ঠে হামদ- নাত এবং শ্যামা সংগীতের সুরের মূর্ছনায় মানব জাতিকে উপহার দিয়েছেন সাম্যবাদের মূলমন্ত্র। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসায় কবি হয়ে উঠেছেন মানবতাবাদী।
নজরুলের সাম্যবাদের প্রধান ক্ষেত্র মানুষ। কে কুলি-মজুর আর কে সাহেব? সবাই তার দৃষ্টিতে সমান। আশরাফ আর আতরাফের কোন ভেদাভেদ নেই এখানে। সবাই সৃষ্টির সেরা। সবাইকেই তিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। নজরুলের সাম্যবাদ তাঁর অন্তরের প্রেরণালব্ধ বস্তু। কবি কল্পনার রঙে রঙিন। মানবতাবোধই তার সাম্যবাদের ভিত্তি। তিনি সকল ধর্মের উর্ধে মানবধর্মকেই উচ্চাসনে বসিয়েছেন। মানবের মাঝে তিনি স্রষ্টাকে আবিস্কার করেছেন। তাঁর সাম্যবাদ স্রষ্টাকে অস্বীকার কওে নয়। কাল মার্কসের মত তাঁর সাম্যবাদ নাস্তিক্য সাম্যবাদ নয়। তাঁর সাম্যবাদ আস্তিক্য সাম্যবাদ। অসাম্প্রদায়িক হলেও তিনি পুরোপুরি আস্তিক ছিলেন।
নজরুলের সাম্যবাদ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে। ১৯৫২ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১১টি কবিতা স্থান পেয়েছে। যেমন- ‘সাম্যবাদী’, ‘নারী’, ‘মানুষ’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘রাজা-প্রজা’, ‘ঈশ্বর’, ‘পাপ’, কুলি-মজুর’, ‘চোর-ডাকাত’, ‘সাম্য’ ও ‘কান্ডারী হুশিয়ার’। মূলত ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের কবিতাগুলোতে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব রয়েছে।
তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের ‘নারী’ কবিতাটি বহুল প্রশংসিত। ‘নারী’ কবিতায় কবি নারী-পুরুষে সাম্যের বাণী উচ্চারণ করেছেন। কবি নারী-পুরুষের ভেদাভেদ অস্বীকার করেছেন। কবির ভাষায়-
“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
আর ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটি অধিক সমালোচিত। কবিতায় কবি বলেছেনÑ
“কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?
হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।”
তিনি মন্দির-কাবার চেয়ে মানুষের হৃদয়কে বড় জ্ঞান করেছেন। কবি বলেছেনÑ
“এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।”
‘সাম্য’ কবিতায় কবি বলেছেন-
“হেথা স্রষ্টার ভজন আলয় এই দেহ এই মন,
হেথা মানুষের বেদনায় তার দুঃখের সিংহাসন।
সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে নামে যে কেহ ডাকে,
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে নামে ডাকে সে মাকে।”
নজরুল মানুষের কবি। সাম্যের কবি। নজরুলের বড় পরিচয় তিনি সাম্যবাদী কবি। নজরুলের সাম্যবাদ সকল মানবের মহামিলন।
‘‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’’
কবি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। মানুষকে কখনো তিনি ঘৃণার চোখে দেখেন নি। কবি বলেছেনÑ
“বন্ধু, তোমার বুক ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।”
মানুষকে তিনি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। হিন্দু- মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কারো আসল পরিচয় হতে পারে না। আসল পরিচয় হলো- আমরা সবাই মানুষ। ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায় বলেছেন-
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
এছাড়াও তার কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
‘জাতের চাইতে মানুষ সত্য
অধিক সত্য প্রাণের টান
প্রাণ ঘরে সব এক সমান।’
‘ঈশ্বর’ কবিতায় নজরুল ইসলাম ঈশ্বর অন্বেষণের ব্যাপারে বলেছেন, বনে- জঙ্গলে, পর্বত চূড়ায় ঈশ্বর অন্বেষণের কোন প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর মানব মনেই অধিষ্ঠিত। আর শাস্ত্র অন্বেষণে না গিয়ে সত্যের সন্ধানে অগ্রসর হতে বলেছেন। ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই বিরাজিত, তাকে বাইরে না খুঁজে নিজের মধ্যে ডুব দিতে হবে। কবি বলেছেন- “স্রষ্টারে খোঁজো - আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।”
সর্বোপরি কবি ‘সাম্য’ কবিতায় স্বপ্নের দেশ- আদর্শ দেশের করেছেন। এমন দেশ যেখানে রাজা প্রজা নেই, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। ‘সাম্যবাদী’ এ স্থানে বর্ণবৈষম্য নেই, এখানে সাদা ও কালোদের জন্য আলাদা গোরস্থান বা গির্জা নেই। এখানে কোন ধর্মের বা শাস্ত্রের ভেদ নেই, নেই কোলাহল। সেখানে পাদ্রী পুরুত মোল্লা এক পাত্রে জল খেলেও জাত যাবে না, স্রষ্টা বাতিল হবে না।
‘সাম্য’ কবিতায় কবিতায় স্রষ্টাকে মহিমাময় এবং মানুষের দেহ মনকেই তার ভজনালয় রূপে বিবেচনা করেছেনÑ
“সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে নামে কেহ ডাকে
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যেই নামে ডাকে সে মা’কে।”
সাম্যবাদ বাঙলা সাহিত্যে নতুন কোন বিষয় নয়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম যে মমতায় মানবতা মিশ্রিত সাম্যের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন তা একান্তই অভিনব। এখানেই নজরুলের সাম্যবাদী চেতনার নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
কালকিনি, মাদারীপুর
২৩.০৮.২০১৩