মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

রচয়িতা: অনুর্বর জমিতে কবিতার চাষ

:: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ::
সাহিত্যের ছোটকাগজ সৃষ্টির চেয়ে তাকে টিকিয়ে রাখাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। সে অসাধ্যকেই সাধন করে চলেছেন রচয়িতা সাহিত্য পরিষদ। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শক্ত হাতে হাল ধরে আছেন ‘রচয়িতা’র সম্পাদক কবি আরিফুল ইসলাম। দেখতে দেখতে প্রকাশিত হলো দুই বাংলার একশ’ কবির কবিতা নিয়ে ষান্মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘রচয়িতা’। ‘আমরা সৃজনশীলতার পথে’ স্লোগানকে ধারণ করে জামালপুর জেলার ইসলামপুরের একঝাঁক নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকের প্রাণের সংগঠন ‘রচয়িতা সাহিত্য পরিষদের’ উদ্যোগে নিয়মিত প্রকাশ হয়ে আসছে ‘রচয়িতা’। আরিফুল ইসলামের সম্পাদনায় জুন-২০১৩ খ্রিস্টাব্দ, আষাঢ়-১৪২০ বঙ্গাব্দ ও শাবান-১৪৩৪ হিজরী মাসে তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হলো।
ধন্যবাদ ‘রচয়িতা সাহিত্য পরিষদ’ ও সম্পাদক আরিফুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে। দুই বাংলার একশ’ কবির কবিতা গ্রন্থিত করা নিঃসন্দেহ জটিল কর্ম। এ কর্ম সম্পাদনা আরো জটিল। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। ভুল-ভ্রান্তি অবশ্যই কিছু আছে। তবে তার চেয়ে বড় কথা ‘রচয়িতা’ আবারো আলোর মুখ দেখলো- সেটাই বা কম কিসের? ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে কোন আলোচনা করার বদমতলব আমার নেই। বা সে সমালোচনা করার যোগ্যতাও আমার নেই। কর্মনিষ্ঠা ও আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। দেশের প্রথম সারির (সবাই যেটা বলে) কবিদের কবিতাসহ নবীনদের কবিতা প্রকাশের একটা প্লাটফর্ম তেরি করার জন্য সত্যিই আমি আনন্দিত। অনেকেই লেখা দিয়েছেন কিন্তু স্থানাভাবে তা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি বলে সম্পাদকও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিনীতভাবে।
প্রকাশের আগে মাঝে মাঝে কথা হয় আরিফুল ইসলামের সাথে। তার হতাশা ও দীর্ঘশ্বাসকে আমি উপলব্ধি করেছি। তবু তাকে পিছু হটতে দেখিনি। সীমাহিন স্পৃহা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। প্রকাশের পর তার তৃপ্তির প্রশ্বাস আমাকেও প্রকম্পিত করেছে। বানের জলে শস্য ভেসে যাবে বলেও যেমন কৃষক তার জমিতে চাষ বন্ধ করে দেয় না। ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক দৈন্যদশাও রচয়িতাকে দমাতে পারেনা। অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে অনুর্বর জমিতে চাষ করে যাওয়ার মতো। অনেকে আবার ছোটকাগজ বলে লেখা দিতে কার্পণ্য করেন। সম্পাদকের ‘অভিসন্ধি’ থেকেই উদ্ধৃতি করতে হয়-‘কেউ কেউ ‘দেই-দিচ্ছি’ বলে মাস কাটিয়ে দেন। আবার অনেকেই বলে বসেন ‘ছোটকাগজে লেখা দেই না’। ফলে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। লেখকদের আত্মতুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতার কথাও স্মরণ রাখতে হয়। নবীন-প্রবীণ কবিদের সমন্বয়ে সাজানো ‘রচয়িতা’ সর্বস্তরের পাঠকের মনে দাগ কাটতে পেরেছেÑ এ আমার বিশ্বাস।
হেলাল হাফিজের কবিতা ‘ওড়না’ এখনো আমাকে প্রতিমুহূর্তে ভাবায়। আমি মনে হয় উঠতে-বসতে ‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ’ কথাটি নিজের অজান্তে সহস্রবার উচ্চারণ করি। একটি পঙক্তিতে এত গভীর আবেদন আর কোথাও পাই নি। ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ কথাটা আসলেই সত্যি। একটি সহজ-সরল কথাকে কত কঠিন এবং বক্র ভাবে ছুড়ে দেওয়া যায়-তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘ওড়না’ কবিতা। কবির ‘তুমি নিউট্রন বোমা বোঝ/ মানুষ বোঝ না’ কবিতার অনুরূপ। কবি বরাবরই তার পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। ‘রচয়িতা’র প্রথম কবিতা কবি আল মাহমুদের। পাতা উল্টে প্রথমেই নজরে আসে তাঁর ‘অলীক দেবদারু’ কবিতাটি। আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে অনেকেই বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন। আমি করজোড়ে মিনতি করছি- কবিকে কখনো গোষ্ঠীবদ্ধ করবেন না। কবি সীমাবদ্ধ কোন জায়গা বা বস্তু নন। তাঁর অন্তরের বিশালতার চেয়ে তাঁর কাব্যের বিশালতাই আমাদের কাছে বড়। মহাদেব সাহার ‘যতোই বলো’, হেলাল হাফিজের ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’, হাসান হাফিজের ‘পতাকার ইতিহাস’, বেলাল চৌধুরীর ‘বাল্যকাল’ ও মলয় রায়চৌধুরীর ‘রাবনের চোখ’ এক গভীর আবেশে জড়িয়ে রাখে। এছাড়া ‘রচয়িতা’য় প্রকাশিত অন্য কোনো লেখা বা কবিতা সম্পর্কে সমালোচনা করার দুঃসাহস আমার নেই। সবার কাছেই আমি নস্যি মাত্র। শুধু নিজের সম্পর্কে এটুকুই বলব, সবার কবিতার চেয়ে আমার ‘ঈশ্বর বনাম তুমি’ কবিতাটিই কেবল দূর্বল মানের। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ‘রচয়িতা’র সহ-সম্পাদক হিসাবে অনেক ফোন বা মন্তব্য পেয়েছি। একটা দায়বদ্ধতা থেকেই সকলের পরামর্শ বা তিরস্কার হাসিমুখে মেনে নিয়েই রচয়িতার অগ্রযাত্রায় ব্রতী হয়েছি। আমার তিন কথা- ছিলাম, আছি ও থাকবো।  
এবারের সংখ্যায় আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, হেলাল হাফিজ, হাসান হাফিজ, বেলাল চৌধুরী, মলয় রায় চৌধুরী, মতিন বৈরাগী, মৃণাল বসু চৌধুরী, কাজী রোজী, প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সরোজ দেব. মনোজিৎ কুমার দাস, অলক বিশ্বাস, অরুণ সেন, মনির ইউসুফ, শর্মিষ্ঠা ঘোষ, ধ্র“বজ্যোতি ঘোষ মুকুল, পাবলো শাহি, রেজা রহমান, রায়হান রাইন, নজরুল জাহান, পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত, সঞ্জয় ঋষি, রহমান হেনরী, টোকন ঠাকুর, ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত, পরিতোষ হালদার, অমূল্য রতন পাল, কচি রেজা, ভাস্কর চৌধুরী, হাসান আল আব্দুল্লাহ, অমিতাভ দাশ, সপ্তর্ষি বিশ্বাস, জিয়াউল হক, সরসিজ আলীম, অদ্বৈত মারুত, হিজল জোবায়ের, হালিম আজাদ, অতনু তিয়াস, সৌভিক দা, আমজাদ সুজন, মধুমঙ্গল বিশ্বাস, এলিজা আজাদ, জসীম মেহবুব, ওয়াহিদ জালাল, সজল সমুদ্র, মেঘ অদিতি, সিপাহী রেজা, রমজান বিন মোজাম্মেল, রোকসানা রফিক, জিনাত জাহান খান, যাহিদ সুবহান, ইন্দ্রাণী সরকার, বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্য, গোলাম মোস্তফা ডিহিদার, সেলিম রেজা, শিমুল সুলতানা হেপি ও ভোলা দেবনাথদের মতো কবির কবিতা ‘রচয়িতা’কে আরো সমৃদ্ধ করেছে। নবীনদের এ মিছিলে প্রবীণরা যুক্ত হয়ে যাত্রার গতিবেগ ও পথচলার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এছাড়াও পীযূষ রাউত, হাসান সাব্বির, গোপাল বাইন, রুদ্রশংকর, শিকদার ওয়ালি উজ্জামান, ইমেল নাঈম, মো. ওয়াহিদুজ্জামান, দেলোয়ার হোসাইন, নরেশ মন্ডল, মুনমুন দাশগুপ্ত, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, কুসুমিকা সাহা, রুদ্র গোস্বামী, প্রশান্ত সরকার, কাজরী তিথি জামান, রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ, নুরুল আলম, ফারহানা খানম, দীপিকা রায়, সুবীর সরকার, মুহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, আলী ইদ্রিস, নাজমুল হাসান, সৈকত আহমেদ বিল্লাল, লাবণ্য কান্তা, সুমন হাফিজ, উৎপলকান্তি বড়–য়া, মৈনাক মজুমদার, আলী আফজাল খান, রেজওয়ান তানিম, রেজা নুর, সৈয়দ মাসুদ রাজা, এম এস আই সাগর, বিশ্বজিৎ লায়েক, লিখন মোরশেদ, লিখন মোরশেদ, রাজেশ শর্মা, অভিজিৎ মন্ডল, বিশ্বজিৎ মন্ডল, শুভ্রনীল, হাবিব সিদ্দিকী, অনিন্দ্য তুহিন, কল্পনা মিত্র, শৈলেন দাস, আজিজ আহমেদ, পিটু রশিদ, সীমা রানী বন্দ্য, কাঙ্খিতা কায়েম সাইকি, ছবি গুপ্তা ও আরিফুল ইসলামের কবিতা নি:সন্দেহে পাঠককে আকৃষ্ট করেছে।
কবিতা ছাড়াও নব্বই দশকের তুখোড় তারুণ্যপ্রাণ নিবেদিত লেখক, গবেষক ও কথাসাহিত্যিক মুহাম্মদ ছানোয়ার হোসেনের ‘জীবন শিকল’ বই নিয়ে আরিফুল ইসলামের আলোচনা, সৈকত আহমেদ বিল্লালের ‘আমার চোখে রচয়িতা, পাঠক এবং আমি’, সুমন হাফিজের ‘শুভেচ্ছা কথন’, সালাহ উদ্দিন মাহমুদের ‘রচয়িতা: দুই বাংলার কবিদের মিলন মেলা’, জাফরুল আহসানের লিটলম্যাগ আলোচনা ‘পুরাতন পাতা’র নতুন স্বাদ’, চিন্ময় বিবেকের ‘ময়ূখ একটা আন্দোলন ক্ষেত্র’, লেখা প্রাপ্তি স্বীকার, ছোটকাগজের প্রাপ্তি স্বীকার ‘রচয়িতা’র কলেবরকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করেছে। রচয়িতার প্রতি সংখ্যার জন্য ‘লেখক সম্মাননা পদক’ সত্যিকারের প্রশংসার দাবিদার। গত সংখ্যার জন্য সাত জনকে সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়েছে। এ থেকে একটা বিষয় উপলব্ধি করতে পারি- রচয়িতা একটা ব্যাপক আন্দেলন ক্ষেত্র। আমরা ক’জনকেই সম্মাননা জানাতে পারি। রাষ্ট্রীয়ভাবেও আমরা তা যথাযথভাবে পারি না।
আমি এই প্রথম দেখলাম, লেখা প্রকাশিত না হলে তার প্রাপ্তি স্বীকার করতে। এতে লেখকরা অন্তত একটু সান্ত্বনা পেতে পারে যে আমার লেখা যথাযথ গন্তব্যে পৌঁচেছে। বিশেষ কৃতজ্ঞতা রচয়িতা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি কবি ও শিশু সাহিত্যিক নজরুল জাহানের প্রতি। পরম মমতায় তিনি আগলে রেখেছেন সকলকে। তবে তাঁর ‘বাণী’ পাতা বিন্যাসের পরে সম্পাদকীয়র আগে স্থাপন করলে যথাযথ সম্মান দেখানো হত। সম্পাদকের কাছে বিনীত অনুরোধ রইল-পরবর্তী সংখ্যায় যেন সেটা করা হয়।
এবারও এম আসলাম লিটনের আঁকা প্রচ্ছদ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ধন্যবাদ নিপূণ প্রচ্ছদশিল্পীকে। চমৎকার বাঁধাই ও অফসেট প্রিন্ট সব দীনতা ছাড়িয়ে সাফল্যের স্বর্ণ শিখড়ে পৌঁছানোর দীপ্ত শপথের উচ্চারণকে আরো অনুরণিত করবে। এ প্রত্যাশা সকলের।
ধন্য অনুর্বর জমির অক্লান্ত পরিশ্রমী কবিতাচাষী আরিফুল ইসলাম।
জয়তু রচয়িতা, জয়তু রচয়িতা সাহিত্য পরিষদ।
কবিতার জয় হোক। ‘রচয়িতা’ দীর্ঘজীবি হোক।

কালকিনি, মাদারীপুর।
০৯.০৯.২০১৩

1 টি মন্তব্য:

  1. রচয়িতা’র এই সংখ্যাটি আমি দেখেছি। একঝাঁক কবিকে এক করা আসলেই একটা দুঃসাধ্য কাজ। আপনার লেখাটি পড়লাম। ভালো লাগল। কিন্তু সম্পাদক যে কাজটি করেছেন, আপনি সেটিকে বৈধতা দিতে চেয়েছেন। আমার মনে হয়, এটা দুঃখ জনক। হ্যাঁ, কবিকে কোনো গ-ীর মধ্যে আটকে রাখা ঠিক না। আল মাহমুদ, কবি হিসেবে অবশ্যই বড় মাপের। কিন্তু তাঁর বর্তমান অবস্থান, রাজনীতিক অবস্থান, অবশ্যই কারো কাছে কাম্য নয়। যখন জানি, রচয়িতা প্রিয় কবি, কবি বন্ধু আর প্রিয় মানুষের কবিতা আছে, খুব আগ্রহ নিয়ে পত্রিকাটি হাতে নিই। কিন্তু প্রচ্ছদ ওল্টাতেই চোখে পড়ে আল মাহমুদের নাম। পত্রিকাটি শুরুই হয়েছে তাঁর নাম দিয়ে। শ্রদ্ধেয় সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সবিনয়ে জানাতে চাই, আমি শিখেছি, ‘দুর্জন, বিদ্যান হইলেও পরিত্যাজ্য’। সেই হিসেবেই বাংলার সাহিত্য জগতে আল মাহমুদ নির্বাসিত - এটা সকলেরই জানা। নিশ্চয়ই ‘রচয়িতা’ সম্পাদকও ব্যাপারটি জানেন।
    তবুও আরিফুল ইসলামকে ধন্যবাদ তার উদ্যোগের জন্য। শুভেচ্ছা।

    উত্তরমুছুন