‘১ ডিসেম্বর- বিশ্ব এইডস দিবস’
এইচআইভি/এইডস: প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
এক সময় মানুষ জানতো না এইচআইভি/এইডস কী? শুরু হলো প্রচার-প্রচারণা। আন্তর্জাতিক, সরকারি, বেসরকারি, এনজিও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এগিয়ে এসে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে সোচ্চার হলেন। ফলে কিছু সংখ্যক শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল এইডস এর ধারণা। কিছু সংখ্যক মানুষকে শেখানো হলো কিভাবে এইডস প্রতিরোধ করতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে চলল কাজ। প্রকল্প শেষ; সচেতনতার কাজও শেষ। সচেতনতা আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়নি। কারণ আমরা প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে শতভাগ সফলতা অর্জন করতে পারিনি। বাংলাদেশে এইডস সনাক্ত হওয়ার বিশ বছর পরও ৬৮হাজার গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে তার ধারণা পৌঁছে দিতে পারিনি। যে কারণে এখনো মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা, অসচেতনতা ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়।
এইচআইভি/এইডস একটি মরণব্যাধি। এটা মানব জাতির মধ্যেই সংক্রমিত হয়। যথাযথ কোন প্রতিকার ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। পুরোপুরি নির্মূল করেতে না পারলেও অবদমিত করার কিছুটা উপায়ও তারা এ পর্যন্ত আবিস্কার করেছেন। তবে আশা করি একদিন তারা এর নির্মূলের গবেষণায় সফল হবেন। বিজ্ঞরা গবেষণা করছেন আর অজ্ঞরা একে অবজ্ঞা করছেন। তাই এখনো এইচআইভি/এইডসকে অনেকে অভিশাপ হিসাবেও গণ্য করেন। তারা মনে করেন শুধু মানুষের নৈতিক অধ:পতনই এর জন্য দায়ি। ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার জন্য প্রত্যেক ধর্মের পক্ষ থেকে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এ রোগের গোড়ার ইতিহাস সমকামীতাকে দায়ি করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের তথ্য মতে, ১৯৮১ সালের জুন মাসে লস এ্যাঞ্জেলস শহরে পাঁচ জন সমকামীর মধ্যে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। যে কারণে গবেষকরা ১৯৮২ সালে প্রথম একে এইডস হিসাবে নামকরণ করেন। ১৯৮৩ সালে ড. লুক মন্টাগনিয়ের এর নাম দেন লিম্ফোঅ্যাডেনোপ্যাথি অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস। ১৯৮৪ সালে ড. রবার্ট গ্যালো নিশ্চিত করেন যে, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংসকারী ভাইরাসই এইডস রোগের কারণ। ১৯৮৫ সালে হলিউডের অভিনেতা রক হাডসন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন বিশ্বব্যাপি হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনমি এইডস এর জীবাণুর নাম রাখেন এইচআইভি। ১৯৮৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘লন্ডন ঘোষণা’ অনুসারে ১ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব এইডস দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়।
বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস ১৯৮৯ সালে প্রথম সনাক্ত করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ২০৮৮ জন এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৪১ জন। বাংলাদেশে এইডস এখনো মহামারি আকারে দেখা না দিলেও অসতর্ককা, অসচেতনতা ও উদাসীনতার ফলে অচিরেই এ মরণব্যাধি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কারণ এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সব রকমের নমুনা বা ঝুঁকি বাংলাদেশে বিদ্যমান। তাছাড়া ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে এইডস বিস্তারের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠি যেমন পতিতালয়ের যৌনকর্মী, ভাসমান যৌনকর্মী, মাদকসেবী, হিজড়া, প্রবাসী, যুবক-যুবতীর নৈতিক অবক্ষয়, কারখানা ও পরিবহণ শ্রমিক সংখ্যায় অনেক। এছাড়া যৌন মিলনে কনডম ব্যবহারে অনিহা, সঠিক নিয়মে ব্যবহার না করা ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা এইডস বিস্তারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সঙ্গত কারণে আমাদের নারী শিশু ও যুবক-যুবতীরা আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। তাই এখনই আমাদের একটি মজবুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
যেহেতু আমাদের হাতে এইডস রোগ প্রতিকারের কোন উপায় নেই। গবেষকরা মাত্র মানবদেহে এইচআইভি জীবাণু নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ঔষধ আবিস্কার করেছেন। যা কেবল মৃত্যুটাকে বিলম্বিত করতে পারে। আক্রান্তকে কেবল চিকিৎসা হিসাবে এন্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি দেওয়া হয়। ঔষধ হিসাবে রয়েছে জাইডোভুডিন, নেভিরাপিন, ডাইডেনোসিন, লেমিভুডিন ইত্যাদি। কিন্তু এ থেরাপির আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যায়। এতে অগ্নাশয়ে প্রদাহ, হাত-পা শুকিযে যাওয়া, পরিপাকতন্ত্রে জটিলতা, বৃক্কে পাথর হওয়া, অরুচি, মুখে বিস্বাদ, স্বপ্ন, ঘুমের অভাব ও যকৃতে প্রদাহ ইত্যাদি হতে পারে। তবুও উন্নত দেশগুলোতে এ থেরাপির কারণে মৃত্যুর হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্রাজিলে মৃত্যুর হার শতকরা আশি ভাগ কমে এসেছে। একজন আক্রান্ত এ থেরাপি গ্রহণের ফলে গড়ে প্রায় ৬-৭ বছর বেশি বাঁচতে পারে। তবে মৃত্যু অবধারিত।
তাই প্রতিকারের চেয়ে আগে আমাদের শরীরে এইচআইভি আছে কি না? তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া জরুরী। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে এইচআইভির উপস্থিতি সনাক্ত করা যায়। মূলত এইচআইভি পরীক্ষার জন্য শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষার জন্য যে পরিমাণ এন্টিবডির প্রয়োজন সে পরিমাণ এন্টিবডি শরীর তৈরি করতে পারেনা। ফলে এসময় পরীক্ষায় এইচআইভির উপস্থিতি ধরা পড়ে না। এ সময়কালকে দি উইনডো পিরিয়ড বলা হয় যা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস হতে পারে। এছাড়া যদি শরীরে জীবাণু পাওয়া যায় তখন তাকে এইডস রোগী বলা যায় না। তখন তাকে এইচআইভি পজেটিভ বা এইচআইভি বাহক বলা হয়। ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশের পর থেকে সাধারণত ৮-১০ বছর পর আক্রান্ত হয়। যদিও তখন আক্রান্তকে সুস্থ্য সবল দেখায়। এমন অবস্থাতেও তার থেকে অন্যজন আক্রান্ত হতে পারে। তাই প্রথমে এ্যালাইজা টেস্ট করতে হয়। তাতে যদি জীবাণু ধরা না পড়ে তবে তিনি নিশ্চিন্তথাকতে পারেন। আর যদি ধরা পড়ে তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাথে সাথে ওয়েস্টার্ন ব্লট টেস্ট করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে কেউ আক্রান্ত হলে সাধারণত তিন বছরের মধ্যে মারা যায়।
কেবল সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষণের মাধ্যমে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এইডস সনাক্ত করতে পারেন। বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনামূলে গোপনীয়তা রক্ষা করে এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়। ঢাকার শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজী বিভাগ, মহাখালীর মাইক্রোবায়োলজী ল্যাবরেটরী জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনিষ্টিটিউট, ক্যান্টনমেন্ট আর্মড ফোর্সেস প্যাথলজী ল্যাবরেটরী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, খুলনা মেডিকেল কলেজ ও সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্যাথলজী বিভাগ ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ল্যাবরেটরীতে এইচআইভি পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। অন্তত বৈবাহিক বন্ধনের পূর্বে উভয়ের রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া উচিৎ।
এ মরণব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়া আরো কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু দিবস ভিত্তিক সচেতনতা নয়। প্রত্যেকটি টিভি চ্যানেল ও বেতার কেন্দ্রের সৌজন্যে এইডস সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন ও নাটক প্রচার করতে হবে। পত্রিকাগুলোকে বিজ্ঞাপন ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রত্যেক ধর্মের প্রতিটি উপাসনালয়ে এইডস সংক্রান্ত আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামে অন্তত মাসে একবার হলেও এইডস বিষয়ক ভিডিও প্রদর্শন, সিনেমা স্লাইড প্রদর্শন, মঞ্চ বা পথনাটক, জারি বা গণ সংগীত পরিবেশনসহ পোস্টার, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিলবোর্ড, হাট-বাজার বা পরিবহণে লিফলেট ও বুকলেটস বিতরণ করতে হবে। তাহলে হয়তো সচেতনতা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।
মোট কথা এইডস বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের প্রতিমুহূর্তে কাজ করতে হবে। আর যারা এইডস আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ঘৃণা না করে ভালোবাসতে হবে। তাদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যদিও কিছু স্পর্শকাতর বিষয় এর সাথে জড়িত। তাই যে কারণে এইচআইভি ছড়ায় সে কারণগুলো সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যেহেতু এ রোগ সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এখনো স্বচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে। মানুষ এইডস সম্পর্কে নানা রকম ভুল ধারণা পোষণ করে থাকেন। ফলে এইডস রোগীরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ঘৃণার বস্তু হয়ে যান। তাদের প্রতি করা হয় অমানবিক আচরণ। এইডস রোগিরা যেন সমাজের অন্য রোগিদের মত সেবা পেতে পারে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এইডস কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। সবচেয়ে বড় কথা আমরা যে কেউ যে কোন সময়ে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারি। তাই রোগিকে ঘৃণা না করে রোগকে ঘৃণা করতে হবে। সংক্রমিতের প্রতি সহনশীলতা এবং মানবিক আচরণ করতে হবে। আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রতিকার না খুঁজে। আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা করি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
এইচআইভি/এইডস: প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
এক সময় মানুষ জানতো না এইচআইভি/এইডস কী? শুরু হলো প্রচার-প্রচারণা। আন্তর্জাতিক, সরকারি, বেসরকারি, এনজিও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এগিয়ে এসে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে সোচ্চার হলেন। ফলে কিছু সংখ্যক শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেল এইডস এর ধারণা। কিছু সংখ্যক মানুষকে শেখানো হলো কিভাবে এইডস প্রতিরোধ করতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে চলল কাজ। প্রকল্প শেষ; সচেতনতার কাজও শেষ। সচেতনতা আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়নি। কারণ আমরা প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে শতভাগ সফলতা অর্জন করতে পারিনি। বাংলাদেশে এইডস সনাক্ত হওয়ার বিশ বছর পরও ৬৮হাজার গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে তার ধারণা পৌঁছে দিতে পারিনি। যে কারণে এখনো মানুষের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা, অসচেতনতা ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়।
এইচআইভি/এইডস একটি মরণব্যাধি। এটা মানব জাতির মধ্যেই সংক্রমিত হয়। যথাযথ কোন প্রতিকার ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। পুরোপুরি নির্মূল করেতে না পারলেও অবদমিত করার কিছুটা উপায়ও তারা এ পর্যন্ত আবিস্কার করেছেন। তবে আশা করি একদিন তারা এর নির্মূলের গবেষণায় সফল হবেন। বিজ্ঞরা গবেষণা করছেন আর অজ্ঞরা একে অবজ্ঞা করছেন। তাই এখনো এইচআইভি/এইডসকে অনেকে অভিশাপ হিসাবেও গণ্য করেন। তারা মনে করেন শুধু মানুষের নৈতিক অধ:পতনই এর জন্য দায়ি। ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার জন্য প্রত্যেক ধর্মের পক্ষ থেকে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এ রোগের গোড়ার ইতিহাস সমকামীতাকে দায়ি করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের তথ্য মতে, ১৯৮১ সালের জুন মাসে লস এ্যাঞ্জেলস শহরে পাঁচ জন সমকামীর মধ্যে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। যে কারণে গবেষকরা ১৯৮২ সালে প্রথম একে এইডস হিসাবে নামকরণ করেন। ১৯৮৩ সালে ড. লুক মন্টাগনিয়ের এর নাম দেন লিম্ফোঅ্যাডেনোপ্যাথি অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস। ১৯৮৪ সালে ড. রবার্ট গ্যালো নিশ্চিত করেন যে, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংসকারী ভাইরাসই এইডস রোগের কারণ। ১৯৮৫ সালে হলিউডের অভিনেতা রক হাডসন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন বিশ্বব্যাপি হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অন ট্যাক্সোনমি এইডস এর জীবাণুর নাম রাখেন এইচআইভি। ১৯৮৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘লন্ডন ঘোষণা’ অনুসারে ১ ডিসেম্বরকে ‘বিশ্ব এইডস দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়।
বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস ১৯৮৯ সালে প্রথম সনাক্ত করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ২০৮৮ জন এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৪১ জন। বাংলাদেশে এইডস এখনো মহামারি আকারে দেখা না দিলেও অসতর্ককা, অসচেতনতা ও উদাসীনতার ফলে অচিরেই এ মরণব্যাধি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। কারণ এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সব রকমের নমুনা বা ঝুঁকি বাংলাদেশে বিদ্যমান। তাছাড়া ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে এইডস বিস্তারের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠি যেমন পতিতালয়ের যৌনকর্মী, ভাসমান যৌনকর্মী, মাদকসেবী, হিজড়া, প্রবাসী, যুবক-যুবতীর নৈতিক অবক্ষয়, কারখানা ও পরিবহণ শ্রমিক সংখ্যায় অনেক। এছাড়া যৌন মিলনে কনডম ব্যবহারে অনিহা, সঠিক নিয়মে ব্যবহার না করা ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা এইডস বিস্তারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সঙ্গত কারণে আমাদের নারী শিশু ও যুবক-যুবতীরা আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। তাই এখনই আমাদের একটি মজবুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
যেহেতু আমাদের হাতে এইডস রোগ প্রতিকারের কোন উপায় নেই। গবেষকরা মাত্র মানবদেহে এইচআইভি জীবাণু নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ঔষধ আবিস্কার করেছেন। যা কেবল মৃত্যুটাকে বিলম্বিত করতে পারে। আক্রান্তকে কেবল চিকিৎসা হিসাবে এন্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি দেওয়া হয়। ঔষধ হিসাবে রয়েছে জাইডোভুডিন, নেভিরাপিন, ডাইডেনোসিন, লেমিভুডিন ইত্যাদি। কিন্তু এ থেরাপির আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যায়। এতে অগ্নাশয়ে প্রদাহ, হাত-পা শুকিযে যাওয়া, পরিপাকতন্ত্রে জটিলতা, বৃক্কে পাথর হওয়া, অরুচি, মুখে বিস্বাদ, স্বপ্ন, ঘুমের অভাব ও যকৃতে প্রদাহ ইত্যাদি হতে পারে। তবুও উন্নত দেশগুলোতে এ থেরাপির কারণে মৃত্যুর হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্রাজিলে মৃত্যুর হার শতকরা আশি ভাগ কমে এসেছে। একজন আক্রান্ত এ থেরাপি গ্রহণের ফলে গড়ে প্রায় ৬-৭ বছর বেশি বাঁচতে পারে। তবে মৃত্যু অবধারিত।
তাই প্রতিকারের চেয়ে আগে আমাদের শরীরে এইচআইভি আছে কি না? তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া জরুরী। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে এইচআইভির উপস্থিতি সনাক্ত করা যায়। মূলত এইচআইভি পরীক্ষার জন্য শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে পরীক্ষার জন্য যে পরিমাণ এন্টিবডির প্রয়োজন সে পরিমাণ এন্টিবডি শরীর তৈরি করতে পারেনা। ফলে এসময় পরীক্ষায় এইচআইভির উপস্থিতি ধরা পড়ে না। এ সময়কালকে দি উইনডো পিরিয়ড বলা হয় যা কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস হতে পারে। এছাড়া যদি শরীরে জীবাণু পাওয়া যায় তখন তাকে এইডস রোগী বলা যায় না। তখন তাকে এইচআইভি পজেটিভ বা এইচআইভি বাহক বলা হয়। ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশের পর থেকে সাধারণত ৮-১০ বছর পর আক্রান্ত হয়। যদিও তখন আক্রান্তকে সুস্থ্য সবল দেখায়। এমন অবস্থাতেও তার থেকে অন্যজন আক্রান্ত হতে পারে। তাই প্রথমে এ্যালাইজা টেস্ট করতে হয়। তাতে যদি জীবাণু ধরা না পড়ে তবে তিনি নিশ্চিন্তথাকতে পারেন। আর যদি ধরা পড়ে তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাথে সাথে ওয়েস্টার্ন ব্লট টেস্ট করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে কেউ আক্রান্ত হলে সাধারণত তিন বছরের মধ্যে মারা যায়।
কেবল সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষণের মাধ্যমে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এইডস সনাক্ত করতে পারেন। বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিনামূলে গোপনীয়তা রক্ষা করে এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়। ঢাকার শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজী বিভাগ, মহাখালীর মাইক্রোবায়োলজী ল্যাবরেটরী জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, মহাখালী রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনিষ্টিটিউট, ক্যান্টনমেন্ট আর্মড ফোর্সেস প্যাথলজী ল্যাবরেটরী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, খুলনা মেডিকেল কলেজ ও সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্যাথলজী বিভাগ ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ল্যাবরেটরীতে এইচআইভি পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। অন্তত বৈবাহিক বন্ধনের পূর্বে উভয়ের রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া উচিৎ।
এ মরণব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশের ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়া আরো কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু দিবস ভিত্তিক সচেতনতা নয়। প্রত্যেকটি টিভি চ্যানেল ও বেতার কেন্দ্রের সৌজন্যে এইডস সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন ও নাটক প্রচার করতে হবে। পত্রিকাগুলোকে বিজ্ঞাপন ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রত্যেক ধর্মের প্রতিটি উপাসনালয়ে এইডস সংক্রান্ত আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামে অন্তত মাসে একবার হলেও এইডস বিষয়ক ভিডিও প্রদর্শন, সিনেমা স্লাইড প্রদর্শন, মঞ্চ বা পথনাটক, জারি বা গণ সংগীত পরিবেশনসহ পোস্টার, গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিলবোর্ড, হাট-বাজার বা পরিবহণে লিফলেট ও বুকলেটস বিতরণ করতে হবে। তাহলে হয়তো সচেতনতা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।
মোট কথা এইডস বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের প্রতিমুহূর্তে কাজ করতে হবে। আর যারা এইডস আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ঘৃণা না করে ভালোবাসতে হবে। তাদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যদিও কিছু স্পর্শকাতর বিষয় এর সাথে জড়িত। তাই যে কারণে এইচআইভি ছড়ায় সে কারণগুলো সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যেহেতু এ রোগ সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এখনো স্বচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে। মানুষ এইডস সম্পর্কে নানা রকম ভুল ধারণা পোষণ করে থাকেন। ফলে এইডস রোগীরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ঘৃণার বস্তু হয়ে যান। তাদের প্রতি করা হয় অমানবিক আচরণ। এইডস রোগিরা যেন সমাজের অন্য রোগিদের মত সেবা পেতে পারে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এইডস কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। সবচেয়ে বড় কথা আমরা যে কেউ যে কোন সময়ে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারি। তাই রোগিকে ঘৃণা না করে রোগকে ঘৃণা করতে হবে। সংক্রমিতের প্রতি সহনশীলতা এবং মানবিক আচরণ করতে হবে। আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রতিকার না খুঁজে। আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা করি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী