সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী এক রসিক মানব। তাঁর সাথে আমার পরিচয় বা যোগাযোগ বছর খানেকের। ২০১২ সালের জুলাই মাসে গাজীপুরের কোনাবাড়ি ক্যামব্রিজ কলেজে যোগদান করি। প্রথমদিন পাঠদানের পর আর ভালো লাগেনি। মন কেমন পালাই পালাই করছিল। পালাবার পথ খুঁজছিলাম। হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম। কলেজ জীবনের এক বড় আপার সাথে ফোনে কথা হয়। তিনি জানালেন সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজে একজন খন্ডকালিন বাংলা প্রভাষক দরকার। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তিনি তাঁর সাথে কথা বলে আমাকে বললেন, কালকিনি চলে যাও। স্যারের সাথে ফোনে কথা বলো। সেই তাঁর সাথে প্রথম কথা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে কথা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। খুব অল্প দিনেই আমার মনে হয়েছে তিনি লোকপ্রিয় এক মানুষ। কিন্তু আত্মপ্রচার বিমুখ। তবে স্বপ্নবিলাসী ও পুরোদস্তুর রসিক মানুষ। তাঁর নির্মল হাসি ও নিভাঁজ গল্পবলার ঢঙ দেখেই তার উদারতা ও মনের বিশালতা অনুমান করা যায়। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও তার কর্মচাঞ্চল্য ও আশাবাদ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি আমাদের অনুকরণিয় আদর্শ।
জন্মপরিচয়:
অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়নের সাহেবরামপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আলহাজ্ব আব্দুর রহমান রাঢ়ি ও মাতা মরহুমা জোবেদা খাতুন। ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। কিশোর বয়সেই তিনি প্রতিবেশি আ. মাজেদ আকনের কন্যা মোসা: মনোয়ারা বেগম বুনুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর এবং বর্তমানে তিনি পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক।
অধ্যয়ন:
১৯৪৭ সালে গ্রামের জুনিয়র স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথম বিভাগে পাস করে চলে যান জেলা শহরে। ১৯৫২ সালে মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৪ সালে মাদারীপুর সরকারি নাজিমুদ্দিন কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় সম্মানসহ এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন:
অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেন। তিনি মাদারীপুর সরকারি নাজিমুদ্দিন কলেজ, কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ, নরসিংদী সরকারি কলেজ ও টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের একত্রীকরণ পর্যন্ত এর সচিব হিসেবে এবং কিছুকাল তিনি এ সংস্থার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশনে প্রধান প্রতিবেদক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ভ্রমণ করার সুযোগ লাভ করেন। সর্বশেষ তিনি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) পরিচালকের পদ থেকে ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর ঢাকা সেনানিবাসস্থ শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কিছুকাল কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার্থে গঠিত সাত সদস্য বিশিষ্ট সুপারিশমালা প্রনয়ন কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। তিনি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়নের সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
সাহিত্যচর্চা:
স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫১ সালে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় পুরান বাজারের সাহিত্য মজলিসে যাতায়াত শুরু করেন। একই বছর মাদারীপুর এমএম হাফিজ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে মাসিক সাহিত্যপত্র ‘মোহাম্মদী’তে ছোটগল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যচর্চার সূচনা। ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে ‘শুধু কাহিনী’,‘কুমার নদীর ইতিকথা’,‘দাদুর আঙ্গিনা ও আকাশ’,‘অধিকার’ ও ‘কেচ্ছার মানুষ শৈজুদ্দিনের দ্বিতীয় মরণ’ নামে কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। অনুবাদ সাহিত্যে তার অবদান বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে ঢাকার তৎকালিন সিভিল সার্জন জেমস টেলর ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের মেডিক্যাল বোর্ডের সচিব লর্ড হাসিনসনের নির্দেশে এদেশের রোগব্যাধি সংক্রান্ত টপোগ্রাফি লিখতে গিয়ে ঢাকা তথা বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, মানুষ ও উদ্ভিদরাজির চমৎকার বিবরণ পেশ করেন এবং তা ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’ নামে কলকাতা মিলিটারি অরফ্যান প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান কর্তৃক এই দু®প্রাপ্য ও মূল্যবান গ্রন্থটি ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ নামে অনূদিত হয়ে বাঙলা একাডেমী থেকে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় এবং পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। তাঁর অন্য অনূদিত গ্রন্থের নাম ‘বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড)। তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘এই আঙিনা ও আকাশের উপাখ্যান’। এছাড়া ২০০৪ সালে ‘ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাঠামোঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা:
অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, শিক্ষানুরাগী, জনগণের ক্ষমতায়ন ধারার লেখক, গবেষক, আলোচক, সাহিত্যিক ও সমাজ কর্মী। তিনি ‘দৈনিক বাংলা’,‘সাপ্তাহিক রোববার’,‘দৈনিক ইনকিলাব’,‘দৈনিক সকালের খবর’ সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের নিয়মিত কলাম লেখক। তিনি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ক্যালেন্ডারে ইংরেজির সাথে বাংলা তারিখ সংযুক্ত করা, সমমান ও সমমর্যাদার ক্যাডার সার্ভিস গঠন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আন্তঃ ও বহিঃ পরীক্ষার গড় নম্বরে ফলাফল প্রকাশ ও প্যাকেট ভিত্তিক পাশ-ফেল রহিতকরণ, কৃষিভিত্তিক মিনি গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করেন। গত ২৯ জুলাই ২০১৩ তারিখে দৈনিক সকালের খবরের ‘সম্পাদকীয়’ পাতায় ‘গণতন্ত্র, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও জাতীয় সার্ভিস সিস্টেম থেকে বৈষম্যদূরীকরণ’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে তিনি বলেন,‘পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও শোষণের হাতিয়ার হিসেবে এই ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের ভিত আরো পাকাপোক্ত করা হয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে তৎকালিন সিএসপিরা অধিক ক্ষমতা ও মহিমায় শাসন চালাতে থাকে। জনগণ থাকে অপাঙক্তেয় ও অবহেলিত।’ এছাড়া চ্যানেল আই আয়োজিত টক শো’তে অতিথি হিসাবেও অংশগ্রহণ করেন।
লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী এক রসিক মানব:
তাঁর রসবোধ চমৎকার। গল্পে ঢঙে উপস্থাপনায় সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ। তৎকালিন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোকচিত্র দেখেছি তাঁর গ্রামের বাড়ি সাহেবরামপুরের ঘরের দেয়ালে। মেয়ের দেওয়া একটা শখের ক্যামেরায় গ্রামের প্রকৃতির ছবি তুলে তা ফ্রেমবন্দী করে রেখেছেন। মাঝে মাঝে তিনি বাড়ি আসেন। হাসি-আনন্দ-আড্ডায় মাতিয়ে রাখেন পুরো বাড়ি। নাতি-নাতনিদের নিয়ে গল্প করে, গ্রামের মেঠোপথ ঘুরে কিংবা ফসলের মাঠের কিনারে বসে কাটিয়ে দেন পড়ন্ত বিকাল কিংবা জ্যোৎøা রাতের গহীণ অবধি।
শেষ হয়েও হলো না শেষ:
তাঁর কথা কীভাবে এত স্বল্প কথনে শেষ করা যায়? আমার জানা নেই। আমার মনে হয় এ যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান মনে প্রাণে একজন কবি-স্বভাবের মানুষ। তাঁকে প্রকৃতিপ্রেমিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। গ্রামকে ভালোবাসেন মায়ের মতোই। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর আর্কষণ দুর্নিবার। এই লোকপ্রিয় মানুষটির মধ্যে একটি মহৎ ও সুন্দর মনের সন্ধান মেলে। তার সহজাত সারল্য, চিত্তের ঔদার্য, অনুভূতি ও উপলব্ধির তীব্রতা তাকে করেছে মহিমান্বিত। দীর্ঘ ও সফল অধ্যাপনা জীবনে তার সাহচর্যে ও স্নিগ্ধ মনের স্পর্শে উজ্জীবিত হয়েছে অগণিত ছাত্রছাত্রী ও অসংখ্য গুণগ্রাহী, অনুরাগী বন্ধুজন। এমন লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী রসিক মানুষ বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। তাঁর দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করছি।
তথ্যসুত্র: কোম্পানি আমলে ঢাকা: জেমস্ টেলর- মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অনূদিত।
দৈনিক সকালের খবর, ২৯ জুলাই’ ২০১৩ইং।
একজন লোকপ্রিয় মানুষ আসাদুজ্জামান তাঁর জীবন ভাবনা ও কর্মসাধনা- অধ্যাপক সফিউল আলম
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, কালকিনি প্রেস ক্লাব
কবি, কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী এক রসিক মানব। তাঁর সাথে আমার পরিচয় বা যোগাযোগ বছর খানেকের। ২০১২ সালের জুলাই মাসে গাজীপুরের কোনাবাড়ি ক্যামব্রিজ কলেজে যোগদান করি। প্রথমদিন পাঠদানের পর আর ভালো লাগেনি। মন কেমন পালাই পালাই করছিল। পালাবার পথ খুঁজছিলাম। হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম। কলেজ জীবনের এক বড় আপার সাথে ফোনে কথা হয়। তিনি জানালেন সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজে একজন খন্ডকালিন বাংলা প্রভাষক দরকার। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তিনি তাঁর সাথে কথা বলে আমাকে বললেন, কালকিনি চলে যাও। স্যারের সাথে ফোনে কথা বলো। সেই তাঁর সাথে প্রথম কথা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে কথা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। খুব অল্প দিনেই আমার মনে হয়েছে তিনি লোকপ্রিয় এক মানুষ। কিন্তু আত্মপ্রচার বিমুখ। তবে স্বপ্নবিলাসী ও পুরোদস্তুর রসিক মানুষ। তাঁর নির্মল হাসি ও নিভাঁজ গল্পবলার ঢঙ দেখেই তার উদারতা ও মনের বিশালতা অনুমান করা যায়। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও তার কর্মচাঞ্চল্য ও আশাবাদ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি আমাদের অনুকরণিয় আদর্শ।
জন্মপরিচয়:
অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়নের সাহেবরামপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আলহাজ্ব আব্দুর রহমান রাঢ়ি ও মাতা মরহুমা জোবেদা খাতুন। ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। কিশোর বয়সেই তিনি প্রতিবেশি আ. মাজেদ আকনের কন্যা মোসা: মনোয়ারা বেগম বুনুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর এবং বর্তমানে তিনি পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক।
অধ্যয়ন:
১৯৪৭ সালে গ্রামের জুনিয়র স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথম বিভাগে পাস করে চলে যান জেলা শহরে। ১৯৫২ সালে মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৪ সালে মাদারীপুর সরকারি নাজিমুদ্দিন কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় সম্মানসহ এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন:
অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেন। তিনি মাদারীপুর সরকারি নাজিমুদ্দিন কলেজ, কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ, নরসিংদী সরকারি কলেজ ও টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের একত্রীকরণ পর্যন্ত এর সচিব হিসেবে এবং কিছুকাল তিনি এ সংস্থার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশনে প্রধান প্রতিবেদক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ভ্রমণ করার সুযোগ লাভ করেন। সর্বশেষ তিনি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) পরিচালকের পদ থেকে ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর ঢাকা সেনানিবাসস্থ শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কিছুকাল কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার্থে গঠিত সাত সদস্য বিশিষ্ট সুপারিশমালা প্রনয়ন কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। তিনি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়নের সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
সাহিত্যচর্চা:
স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫১ সালে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় পুরান বাজারের সাহিত্য মজলিসে যাতায়াত শুরু করেন। একই বছর মাদারীপুর এমএম হাফিজ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে মাসিক সাহিত্যপত্র ‘মোহাম্মদী’তে ছোটগল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যচর্চার সূচনা। ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে ‘শুধু কাহিনী’,‘কুমার নদীর ইতিকথা’,‘দাদুর আঙ্গিনা ও আকাশ’,‘অধিকার’ ও ‘কেচ্ছার মানুষ শৈজুদ্দিনের দ্বিতীয় মরণ’ নামে কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। অনুবাদ সাহিত্যে তার অবদান বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে ঢাকার তৎকালিন সিভিল সার্জন জেমস টেলর ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের মেডিক্যাল বোর্ডের সচিব লর্ড হাসিনসনের নির্দেশে এদেশের রোগব্যাধি সংক্রান্ত টপোগ্রাফি লিখতে গিয়ে ঢাকা তথা বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, মানুষ ও উদ্ভিদরাজির চমৎকার বিবরণ পেশ করেন এবং তা ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’ নামে কলকাতা মিলিটারি অরফ্যান প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান কর্তৃক এই দু®প্রাপ্য ও মূল্যবান গ্রন্থটি ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ নামে অনূদিত হয়ে বাঙলা একাডেমী থেকে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় এবং পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। তাঁর অন্য অনূদিত গ্রন্থের নাম ‘বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড)। তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘এই আঙিনা ও আকাশের উপাখ্যান’। এছাড়া ২০০৪ সালে ‘ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাঠামোঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা:
অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, শিক্ষানুরাগী, জনগণের ক্ষমতায়ন ধারার লেখক, গবেষক, আলোচক, সাহিত্যিক ও সমাজ কর্মী। তিনি ‘দৈনিক বাংলা’,‘সাপ্তাহিক রোববার’,‘দৈনিক ইনকিলাব’,‘দৈনিক সকালের খবর’ সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের নিয়মিত কলাম লেখক। তিনি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ক্যালেন্ডারে ইংরেজির সাথে বাংলা তারিখ সংযুক্ত করা, সমমান ও সমমর্যাদার ক্যাডার সার্ভিস গঠন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আন্তঃ ও বহিঃ পরীক্ষার গড় নম্বরে ফলাফল প্রকাশ ও প্যাকেট ভিত্তিক পাশ-ফেল রহিতকরণ, কৃষিভিত্তিক মিনি গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করেন। গত ২৯ জুলাই ২০১৩ তারিখে দৈনিক সকালের খবরের ‘সম্পাদকীয়’ পাতায় ‘গণতন্ত্র, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও জাতীয় সার্ভিস সিস্টেম থেকে বৈষম্যদূরীকরণ’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে তিনি বলেন,‘পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও শোষণের হাতিয়ার হিসেবে এই ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের ভিত আরো পাকাপোক্ত করা হয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে তৎকালিন সিএসপিরা অধিক ক্ষমতা ও মহিমায় শাসন চালাতে থাকে। জনগণ থাকে অপাঙক্তেয় ও অবহেলিত।’ এছাড়া চ্যানেল আই আয়োজিত টক শো’তে অতিথি হিসাবেও অংশগ্রহণ করেন।
লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী এক রসিক মানব:
তাঁর রসবোধ চমৎকার। গল্পে ঢঙে উপস্থাপনায় সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ। তৎকালিন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোকচিত্র দেখেছি তাঁর গ্রামের বাড়ি সাহেবরামপুরের ঘরের দেয়ালে। মেয়ের দেওয়া একটা শখের ক্যামেরায় গ্রামের প্রকৃতির ছবি তুলে তা ফ্রেমবন্দী করে রেখেছেন। মাঝে মাঝে তিনি বাড়ি আসেন। হাসি-আনন্দ-আড্ডায় মাতিয়ে রাখেন পুরো বাড়ি। নাতি-নাতনিদের নিয়ে গল্প করে, গ্রামের মেঠোপথ ঘুরে কিংবা ফসলের মাঠের কিনারে বসে কাটিয়ে দেন পড়ন্ত বিকাল কিংবা জ্যোৎøা রাতের গহীণ অবধি।
শেষ হয়েও হলো না শেষ:
তাঁর কথা কীভাবে এত স্বল্প কথনে শেষ করা যায়? আমার জানা নেই। আমার মনে হয় এ যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান মনে প্রাণে একজন কবি-স্বভাবের মানুষ। তাঁকে প্রকৃতিপ্রেমিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। গ্রামকে ভালোবাসেন মায়ের মতোই। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর আর্কষণ দুর্নিবার। এই লোকপ্রিয় মানুষটির মধ্যে একটি মহৎ ও সুন্দর মনের সন্ধান মেলে। তার সহজাত সারল্য, চিত্তের ঔদার্য, অনুভূতি ও উপলব্ধির তীব্রতা তাকে করেছে মহিমান্বিত। দীর্ঘ ও সফল অধ্যাপনা জীবনে তার সাহচর্যে ও স্নিগ্ধ মনের স্পর্শে উজ্জীবিত হয়েছে অগণিত ছাত্রছাত্রী ও অসংখ্য গুণগ্রাহী, অনুরাগী বন্ধুজন। এমন লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী রসিক মানুষ বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। তাঁর দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করছি।
তথ্যসুত্র: কোম্পানি আমলে ঢাকা: জেমস্ টেলর- মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অনূদিত।
দৈনিক সকালের খবর, ২৯ জুলাই’ ২০১৩ইং।
একজন লোকপ্রিয় মানুষ আসাদুজ্জামান তাঁর জীবন ভাবনা ও কর্মসাধনা- অধ্যাপক সফিউল আলম
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, কালকিনি প্রেস ক্লাব
কবি, কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন