:: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ::
মাদারীপুরের প্রথম শ্রেণির আলোচিত ‘সাপ্তাহিক আনন্দবাংলা’য় নিয়মিত লিখতে গিয়ে অনেক প্রশংসা পেয়েছি আবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। মাদারীপুরের যৌনকর্মীদের ওপর লেখার জন্য পত্রিকার প্রকাশক শহীদুল কবির খোকন, সম্পাদক ইয়াকুব খান শিশির ও প্রধান সম্পাদক সুবল বিশ্বাস বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমি সম্পাদকের ছাত্র বা শিষ্য। তার দয়ায় লেখার অনুমতি পাই। তাই পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য লিখি। মূলত অন্যরা যা নিয়ে মাথা ঘামায় না আমি তা নিয়েই উঠে-পড়ে লাগি।
কেন লিখি? এমন প্রশ্ন করলে বলব, ভালো লাগে তাই। এছাড়া আমি চাঁপা স্বভাবের মানুষ। সব কথা বলতে পারিনা তাই লিখে প্রকাশ করি। ভালো লাগা থেকে শুরু হলেও এখন তা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। আর ভালোবাসার প্রতি একটা দায়িত্ববোধ এসে যায়। মূলতো আমি আশাবাদী ও স্বপ্নবিলাসী। তবে আমার কোন উচ্চাশা নেই। আমার আশাবাদ ও স্বপ্নবিলাসই আমাকে লেখক হতে উৎসাহ যুগিয়েছে। লেখকের মাঠে আমি কচ্ছপগতীর একজন প্রতিযোগী। অনেকের চেয়ে অনেক পেছনে। তাই বলে আমি থেমে নেই। লিখছি এবং লিখব। এটাই আমার দৃঢ় প্রত্যয়।
সেই তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন একটা গল্প লিখেছিলাম। লিখে লুকিয়ে রাখলাম। তবুও তা পরিবারের কর্তাব্যাক্তিদের হাতে পৌঁছে গেল। স্কুল থেকে ফিরে দেখি সবাই আমাকে দেখে মুচকি হাসছে। মা জানালেন আসল ঘটনা। আমি লজ্জা পেলাম। আমার লেখালেখির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার মরহুম নানাজান মাওলানা আফসার উদ্দিনের। ছোটবেলায় নানার কাছে থাকতাম। নানা রাত জেগে কী সব বই পড়তেন। আমিও পড়তে শুরু করি।
কবি-লেখকদের জীবনী আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। নিজেও লিখতে চেষ্টা করি। সে সময়ের লেখাগুলো এখন আমার কাছে নেই। থাকলে হয়তো নিজেই লজ্জা পেতাম। এখনো খুব ভালো লিখি কি না জানিনা। তবে প্রতি সপ্তাহে দু’একটা লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাঁপা হয়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন পাঠ্য বইয়ের একটা কবিতাকে নকল করে একটা কবিতা লিখেছিলাম। আমার মামা মাওলানা মেজবাহ উদ্দিন সেটা দেখে বললেন,‘অন্যেরটা নকল করে কেন? নিজে লেখার চেষ্টা করো।’ তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়। আমার নানা-মামা দু’জনেই ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলেও সাহিত্যকে সমাদর করতেন। নিজেরাও প্রচুর পড়তেন।
এক বালিকার প্রেমে পড়ে ডজনখানেক প্রেমের কবিতা লিখলাম। বন্ধুরা কবিতা ধার নিত। কাউকে আবার প্রেমপত্র লিখে দিতাম। নিজেও একটা প্রেমপত্র লিখে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলাম। ‘প্রিয় নদী, নদ যেমন নদীর কাছে ছুটে যায়। আমিও তেমন তোমার কাছে ছুটে যাই।’ এটা নিয়ে বকুনি খেতে হয়েছে। যদিও পত্রটা পাত্রীর কাছে পৌঁছানোর আগেই বড়ভাই মোসলেহ উদ্দিনের হাতে পড়ে। মূলত কবি বলেই ভেতরে একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব চলে আসে। এই ভাব থেকেই লেখক হওয়ার বাসনা আরো তীব্র হয়।
অভাব একটা মূল কারণ। দাদার মৃত্যু ও নদী ভাঙন আমাদের অভাবের মুখে ফেলে। টেনেটুনে সংসার চলছে। কোন আবদারই বাবা পূরণ করতে পারেন নি। অভাবের কারণেই নানা বাড়ি থাকতে হয়েছে আমাকে। এক কথায়, ভাব আর অভাবের সংমিশ্রণে কবিসত্ত্বা জেগে উঠেছে।
এখন ভাব আছে অভাব নেই। তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে শূন্য মনে হয়। কখনোই মানুষের জীবনে পূর্ণতা আসে না। কিছু না কিছুর অভাব থেকে যায়। বা লেখক-কবির অন্তরে অভাব থাকতে হয়। সেটা হতে পারে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম অভাব। এসএসসি পরীক্ষার আগ মুহূর্তে লেখার ভাবটা তীব্র হয়ে ওঠে। আমার মেজভাই নুরুদ্দিন আহমেদ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। রাতে ঘুমুতে গেলে তিনি বকতে থাকেন। ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল হবা। লেখা-পড়া নাই। সারাদিন কবিতা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আমি চুপ। কথার জবাব দিলেন বড়ভাই। ‘লিখুক না। সমস্যা কী লিখলে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলতো একদিনেই বিখ্যাত হননি।’ আমি মনে মনে আন্দোলিত হই। উৎসাহ পাই। যা হোক অন্তত একজন আমার পাশে আছে। পরীক্ষার রাতেও কবিতা লিখেছি। অনেক টেনশন হলে কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়।
এইচএসসি পড়ার সময় একটা টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে যাই। সবাই ধরে নিয়েছিল- আমাকে দ্বারা লেখা-পড়া হবে না। অবস্থাটাও তেমন। ভর্তি হয়ে ক্লাসে যাইনা। ঢাকা থেকে চলে আসি গ্রামের বাড়ি। উপন্যাস লিখতে শুরু করি। দু’তিনটা লিখেও ফেলি। কিভাবে ছাঁপানো যায়? চিন্তাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। উপায় খুঁজে পাইনা। বাংলাবাজারের অনেক প্রকাশনীর সাথে যোগাযোগ করি। তাতে টাকার প্রয়োজন। ফিরে আসি। তবুও থেমে নেই। লিখে যাই প্রতিনিয়ত। আমার কবিতার খাতার কিছু পাঠক তৈরি হয়। তারা পড়ে উৎসাহ দেন। ভালো লাগে। পোশাক-আশাক, চলা-ফেরায় পরিবর্তন আসে। চটের ব্যাগ কিনি। পাঞ্জাবী-পাজামা পড়ি। সবাই ‘কবি’ বলে ডাকে। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অপূর্ণতা থেকেই যায়। একটা লেখাও প্রকাশ হলোনা।
লেখা প্রথম প্রকাশ হয় খালাতো ভাই লুৎফর রহমানের সাহায্যে। ২০০৩ সালে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায়। ছাপার হরফে আমার কবিতা দেখে সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম। তা আজ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সম্মান শ্রেণিতে পড়তে এসে শ্রদ্ধেয় স্যার ইয়াকুব খান শিশিরের সান্নিধ্যে লেখালেখির তাড়নায় যুক্ত হয়ে যাই মফস্বল সাংবাদিকতায়। সংবাদের পাশাপাশি লেখালেখির একটা প্লাটফর্ম পেয়ে যাই। কলেজের নোটিশ বোর্ডের মাধ্যমে গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম গল্পেই বিশেষ পুরস্কার পেয়ে গেলাম। পুরস্কারের সুবাদে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বিশ্লেষণ’ ও ‘সাপ্তাহিক আনন্দবাংলা’য় লেখার জন্য অনুমতি পেলাম। ২০০৮ সালে দৈনিক দেশবাংলার সাহিত্য পাতায় কবিতা ছাপা হলো। এরপর থেমে থাকতে হয়নি। জেলার গন্ডি পেরিয়ে জাতীয় দৈনিকসহ সাহিত্যের ছোটকাগজে লেখালেখি শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লেখা আহ্বান করে। খুলনা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, নীলফামারি, জামালপুর, হাতিয়া, আগৈলঝাড়াসহ বিভিন্ন শহর থেকে আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। সর্বোপরি দেশের বাইরে ভারতের কোলকাতার ‘কারক’ সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হওয়ার আনন্দে এখনো চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। আর এ লেখাটা মূলত সম্পাদকের নির্দেশে। নির্দেশ বলবো একারণেই যে, আমার কাছে লেখা চেয়ে অনুরোধ করার মতো ক্ষুদ্র মানুষ তিনি নন। বরং আমার মতো ক্ষুদ্র লেখককে লেখার জন্য বরং নির্দেশ করা যায়।
কেন লিখি? এমন প্রশ্নের জবাবে এতক্ষণ নিজের ঢোল নিজে পেটালাম। আমার ঢোল আমি পেটালে অন্যরা পিটাবে কী? আমি শুধু বলবো- মনের তাগিদেই লিখছি। লেখাটা একটা নেশায় পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে মন থেকে যখন ভাব ও অভাব দূর হয়ে যায়; তখন কিছুই লিখতে পারিনা। চেষ্টা করেও পারি না। সে সময় অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগি। মনে হয় আমি আমার লেখক সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে অসহায় মনে হয়। ভাবের জন্য বিরহের দরকার। অভাবের জন্য ঔদাসিন্য দরকার। তখন দু’টাকেই অর্জনের চেষ্টা করি।
‘প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠে’ কিংবা কবিতার জন্য কবিকে প্রেমে পড়তে হয়। আমি প্রেমে পড়ি। কিন্তু আগলে রাখতে পারিনা। সঙ্গত কারণেই বিরহ অবধারিত। তখনই প্রত্যেকটি কথা হয়ে ওঠে একটি কবিতা বা গল্প। সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো যখন নাড়া দিয়ে ওঠে- হয়ে যাই বিদ্রোহী। আত্মার প্রশান্তির জন্য রচনা করি নাটক। এবং তাতে নিজেই অভিনয় করি।
লেখালেখি করি ঠিক কিন্তু সমস্যা পিছু ছাড়েনা। মফস্বল শহরে থাকি বলে লেখার জন্য কোন পারিশ্রমিক জোটেনা। ফলে বাধ্য হয়ে অন্য কাজও করতে হয়। কিন্তু কোন কাজই আমার জন্য স্থায়ী হয়না। কবিতার কারখানায় যেমন শ্রমিক- জীবিকার তাগিদেও শ্রমিক হতে হয়। এখনো পরিবারের গঞ্জনা রয়েছে। রয়েছে প্রিয়তমার তিরস্কার। ‘কিছু একটা করো’র তাগাদা। আমিতো কিছু একটা করছি। কিন্তু তাতে অর্থ নেই। আর সবাইতো অর্থই চায়। তবে আমি বিশ্বাস করি, অর্থ ও খ্যাতি একসাথে আসেনা। লেখালেখির ক্ষেত্রে অর্থ আশা করাটাও অরণ্যে রোদন মাত্র। দেশে হূমায়ুন আহমেদ আর ক’জন?
এবার মূল কথায় আসি। বাংলা সাহিত্যে প্রেম রোমান্স এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কবিতা লিখতে গিয়ে কবিকে প্রেমে পড়তে হয়। অথবা প্রেমে পড়ে তাকে কবিতা লিখতে হয়। দু’টাই চিরন্তন সত্য। কবি মনে প্রেম জাগ্রত না হলে কবিতা হয় না। সাহিত্যচর্চার জন্য প্রেম অনিবার্য। আর সে চর্চাকে অব্যাহত রাখতে হলে বেছে নিতে হয় বিরহকে। কারণ মিলনের চেয়ে বিরহ কবিকে নতুন স্বপ্ন দেখায়। নব সৃষ্টির উন্মাদনা জাগ্রত করে। কবিতার সাথে যেন প্রেমের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। লোকে বলে- কবি মানেই প্রেমিক। আর প্রেমিক মানেই কবি। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর যিনি জীবনে অন্তত এক লাইন প্রেমের কবিতা বা ছন্দ রচনা করেন নি। সবার জীবনে একবার প্রেম আসে- কথাটা যেমন সত্য; ঠিক তেমনি জীবনে অন্তত একবার কাব্য রচনা বা সাধনা করেন নি একথাও অস্বীকার করার জো নেই। কেউ যদি মনে-প্রাণে,ধ্যানে-জ্ঞানে কবি হন তবেতো কথাই নেই। বর্তমানে যারা খ্যাতনামা কবি বা যারা প্রতিষ্ঠার জন্য কাব্যচর্চা করছেন প্রত্যেকেই হয়তো প্রথম জীবনে কোন বালিকার উদ্দ্যেশ্যে প্রেমকাব্য রচনার মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন।
পড়নে পাঞ্জাবী-পায়জামা আর পায়ে চটি জুতো পড়ে কাধে একটা চটের ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে প্রথম দর্শনেই সবাই তাকে কবি বা লেখক ভাববেন। ভাবাটাই স্বাভাবিক। বেশ-ভূষায় কবি বা লেখক হলেই কী প্রকৃত লেখক হওয়া যায়? যায় না। লেখকের প্রাণশক্তি তার লেখনী। লেখনীর মাধ্যমেই সে পাঠক মহলে কবিখ্যাতি বা লেখক হিসাবে পরিচিতি লাভ করবেন। আসলে লেখক হওয়ার উপায় কী? শুধু কি কালি-কলম-মন দিয়েই লেখা যায়? নাকি আরও কিছু দরকার হয়? আপনারা যারা লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তারা নিশ্চয় এই প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজছেন।
খালাতো ভাই মহিউদ্দিনের দেখাদেখি লেখালেখি করার সাধ জাগে। তার কন্ঠে আবৃত্তি শুনতাম। সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ বহুবার শুনেছি। তার লেখা একাধিক কবিতাও পড়েছি। তার স্টাইল আমাকে আকৃষ্ট করে। তাকে অনুসরণ করতে শুরু করি। কিন্তু আজ তিনি লেখালেখি জগতে নেই। পারিবারিক সংঘাতে বিপর্যস্ত এক দিকহারা নাবিক। জীবন-জীবিকার সন্ধানে তার কবি প্রতিভা আজ বিলুপ্ত এক ঐতিহ্য। আমি কিন্তু থেমে যাইনি। হেরে যেতে চাইনি বা হেরে যাইনি। আমি এর শেষ দেখবো। লেখালেখির প্রসঙ্গ এলে খুব বেশি মনে পড়ে নানাজান, মামা, বড়ভাই, মেজভাই, বড়দা, শিশির স্যার, ঢাকার কবি মুনশী মোহাম্মদ উবাইদুল্লাহ, জামালপুরের কবি ও রচয়িতা সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ও হারিয়ে যাওয়া কবি সেজভাইকে। আমার পিছনে তারা প্রত্যেকেই অনুপ্রেরণা। আমার মাথার ওপরে তারা বটবৃক্ষের ছায়া।
বিশেষ করে আমার বাবা আমার একনিষ্ঠ পাঠক। আমার শুভাকাঙ্খি। তিনি আমাকে ব্যাপক উৎসাহ দেন। যদিও একসময় বিরোধিতা করতেন। কারণ তাকে বোঝানো হয়েছিল- বাংলায় পড়ে ছেলেটা উচ্ছন্নে যাবে। চটের ব্যাগ নিয়ে ঘুরবে। বিশ্রী অর্থে- দাঁড়িয়ে প্রসাব করবে। ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার করবেনা। আজ ভুলে গেছি সে সব কথা। বরং সে সমস্ত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়। কারণ তাদের তিরস্কারের কারণেই আজ আমি অনেক পুরস্কার পাচ্ছি। অনেক ভালোবাসা পাচ্ছি।
লেখা-লেখিটা প্রধানত সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক ক্ষমতা। ইচ্ছে করলেই লেখক হওয়া যায় না। তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যবসায়। ত্যাগের মানসিকতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। সর্বোপরি লিখতে হলে পড়তে হবে। বিশিষ্ট কবি-লেখকরা অবশ্য একথার সাথে একমত যে, ‘এক লাইন লিখতে হলে দশ লাইন পড়তে হবে।’ পড়ার বা জানার কোন বিকল্প নেই। তথ্য বা শব্দ ভান্ডার হতে হবে সমৃদ্ধ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাক বা না থাক তাতে কিছু যায় আসে না। সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় শিক্ষা একান্ত আবশ্যক। এছাড়া লিখতে গেলে অগ্রজ কাউকে না কাউকে অনুসরণ করতে হয়। অনেকেই অনেক কবি-লেখক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে লেখকের কল্পনা শক্তি হতে হবে প্রখর। লেখকের ‘তৃতীয় নয়ন’ বলে একটা বিষয় আছে। যা আর দশজন সাধারণ মানুষের নেই। কবি ও অকবিদের মধ্যে মূল পার্থক্য এখানেই। সাধারণ মানুষ যে জিনিসটি সাধারণ ভাবে দেখে; একজন অসাধারাণ মানুষ সেটাকে অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে। একজন লেখকের দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের অন্যান্য মানুষের চেয়ে আলাদা হতে হয়।
জানি না আমি তেমন হতে পেরেছি কি না? হওয়ার চেষ্টা করছি। আমি যদি ভালো লেখক নাও হতে পারি তবুও আমার অনুরোধ-আপনারা এগিয়ে আসুন। প্রত্যেকটি সমাজে অন্তত একজন করে লেখক থাকা দরকার। যদি বলেন কিভাবে সম্ভব। পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। সবকিছুর মূলে চেষ্টা। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায়। নিন্দুকের নিন্দা, মানুষের কটাক্ষ, সমাজের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই এ সাধনা চালিয়ে যেতে হয়। দস্যু রতœাকর তপস্যা করে যদি বাল্মিকী হতে পারেন। আপনি কেন পারবেন না। রামায়ণ না হোক একটা নিটোল হাসির গল্পতো লিখে যান। তা পড়ে যদি অন্তত একজনের মুখে হাসি ফোটে তাতেই আপনার সার্থকতা। এবার বলি বিখ্যাত জনেরা লেখক হওয়ার ব্যাপারে কী পরামর্শ দেন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করতেন, যদি আজকের দিনই হয় আমার জীবনের শেষ দিন, তাহলে আমার কোন কাজটি সবার আগে করা উচিত? একজন লেখকও এ রকমভাবে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেন শব্দে শব্দে কী লিখতে চান তিনি, কীভাবে লিখতে চান, কী কথাই বা বলতে চান? অমর একুশে বইমেলার বই-গন্ধ গায়ে মেখে তোমরা যারা লেখক হওয়ার পথ খুঁজছ, যারা স্বপ্ন দেখছ ভবিষ্যতের লেখক হওয়ার, তারা তো জানোই শব্দে শব্দে মিল- অমিল দিয়ে লেখক হওয়া এত সহজ কর্ম নয়। এর জন্যও লাগে দীর্ঘ প্রস্তুতি, পড়াশোনা। তোমাদের জন্য দেশের তিন খ্যাতিমান লেখক এবার জানাচ্ছেন কেন লেখক হলেন তাঁরা, কীভাবে লেখক হলেন। অভিজ্ঞতার আদ্যপান্ত।
লেখক হওয়ার উপায় সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন- লিখতে হলে পড়তে হবে। তরুণ লেখকদের প্রতি প্রথমত এটিই আমার বলার কথা। মনে রাখতে হবে, লেখকের পথ বড়ই বিপদসঙ্কুল। এটা সম্পূর্ণ একার পথ। কঠিন এক সাধনা। কোনো লেখকের পক্ষে কি বলা সম্ভব, তিনি কেন লেখক হয়েছেন? মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, লেখক না হয়ে উপায় ছিল না বলেই শেষ পর্যন্ত লেখক হয়েছি। খুব ছোটবেলা থেকে কেন যে কবিতা, গল্প এসব লিখতাম, আজ সেটা স্মৃতি খুঁড়ে বের করা কঠিন। বলা যায়, যে পৃথিবীতে বেঁচে আছি সেই পৃথিবীর একটা অর্থ ও ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারি লেখার মাধ্যমে। এটি হয়তো প্রত্যেক লেখকই পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে একজন লেখকের সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট একটা ধারণা থাকা জরুরি। লেখক হতে চাইলে তুমি যা কিছু করতে চাও, তার সবই তোমাকে লেখার ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত করতে হবে। ব্যক্তিভেদে একেকজন লেখকের লেখার কৌশল একেক রকম। আমি যেমন সাধারণত একটি লেখা একবারেই লিখে ফেলি। কিন্তু লেখাটি লেখার আগে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থাকে বিস্তর। কীভাবে আগের লেখা থেকে নতুন লেখাকে আলাদা করা যায়। এই ভাবনাও থাকে। আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকই তাঁর নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেন একান্ত তাঁর মতো করে।
কবি মহাদেব সাহা বলেছেন, আমি কি কবি হতে পেরেছি? জানি না। মনে পড়ে, ১৯৭৬ সালে প্রেসক্লাব-সংলগ্ন ফুটপাতের ওপর বসে একটানে লিখেছিলাম ‘চিঠি দিও’ কবিতাটি। পরে সেটি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়। শৈশবে আমার মা বিরাজমোহিনির মুখে রামায়ণ ও মহাভারত শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তখন মনে হতো, বাল্মীকি বা ব্যাসদেবের মতো যদি কবি হতে পারতাম!
তিনি আরো বলেছেন, একটি শব্দের জন্য বসে থেকেছি সারা রাত। জীবনানন্দ দাশ কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পড়েছি উন্মাদের মতো। পড়েছি জন কিটস, রাইনার মারিয়া রিলকে, ডব্লিউ বি ইয়েটস। পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে হয়তো কবি হয়ে উঠেছি আমি। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে কবি হচ্ছে একমাত্র অবিনাশী সত্ত্বা, রাজা, সম্রাট তাঁর কাছে কিছু নয়। তাই কবি বা লেখক হতে গেলে যেমন পড়াশোনা জরুরি, তেমনি দরকার লেখকের স্বাধীন সত্ত্বা। কারও পরামর্শ নিয়ে কেউ কোনো দিন কবি হতে পারে না।
অদিতি ফাল্গুনীর বক্তব্য এরকম, যদি মেয়ে না হতাম, তাহলে আমি হয়তো কখনোই লেখক হতাম না। কথাটি খোলাসা করি, মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী সঙ্কুচিত হয়েছে। সেই শৈশব উত্তীর্ণকালে আমার বয়সী বন্ধুগোত্রীয় ছেলেরা যেভাবে পৃথিবীকে দেখেছে, আমার দেখা ছিল তাঁদের থেকে ভিন্ন। শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী যে ছোট হয়ে এল, এই বেদনাবোধই আমাকে লেখক করে তুলেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, প্রতিকূলতা অনেক সময় আমাদের ভেতরের আগুনকে উসকে দেয়।
আমাদের বাড়িতে বড় একটি পাঠাগার ছিল। সেখানে ছিল রুশ সাহিত্যসহ নানা ধরনের বই। এ ছাড়া কলেজের গ্রন্থাগারে পড়েছি গ্রিক নাটক। এই পাঠ আমাকে পুষ্টি দিয়েছে। একসময় পাহাড়ে ওঠার খুব শখ ছিল, পারিনি। শেষমেষ দেখি, গল্প-কবিতা লিখতে লিখতে লেখকই হয়ে উঠেছি!
লেখালেখির জন্য প্রথমত ভাষাগত প্রস্তুতি থাকা খুব দরকার বলে আমার মনে হয়। আর ভাষাগত প্রস্তুতি গড়ে ওঠে মহৎ সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষায় লিখতে হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়া যেমন আবশ্যক তেমনি অন্য ভাষার মহৎ সাহিত্যিকদের লেখাও পাঠ করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত জীবনে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে আমার নানার অনুপ্রেরণায়। তিনি রাত জেগে পড়তেন। দেশি-বিদেশি সবধরণের সংগ্রহ ছিল তার। মাঝে মাঝে লিখতেন। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন। তার সংস্পর্শে আমিও পড়া ও লেখার অভ্যাস গড়ে তুলি। নানা বলতেন, লিখতে লিখতে লেখক হওয়া যায়। গ্রামীণ প্রবাদের মতো- ‘হাটতে হাটতে নলা/ গাইতে গাইতে গলা।’ সর্বোপরি কথা হচ্ছে- নিরলস চেষ্টা, চর্চা ও সাধনাই একজনকে লেখক হিসাবে গড়ে তুলতে পারে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কবি, কথাশিল্পী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।
মাদারীপুরের প্রথম শ্রেণির আলোচিত ‘সাপ্তাহিক আনন্দবাংলা’য় নিয়মিত লিখতে গিয়ে অনেক প্রশংসা পেয়েছি আবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। মাদারীপুরের যৌনকর্মীদের ওপর লেখার জন্য পত্রিকার প্রকাশক শহীদুল কবির খোকন, সম্পাদক ইয়াকুব খান শিশির ও প্রধান সম্পাদক সুবল বিশ্বাস বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমি সম্পাদকের ছাত্র বা শিষ্য। তার দয়ায় লেখার অনুমতি পাই। তাই পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য লিখি। মূলত অন্যরা যা নিয়ে মাথা ঘামায় না আমি তা নিয়েই উঠে-পড়ে লাগি।
কেন লিখি? এমন প্রশ্ন করলে বলব, ভালো লাগে তাই। এছাড়া আমি চাঁপা স্বভাবের মানুষ। সব কথা বলতে পারিনা তাই লিখে প্রকাশ করি। ভালো লাগা থেকে শুরু হলেও এখন তা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। আর ভালোবাসার প্রতি একটা দায়িত্ববোধ এসে যায়। মূলতো আমি আশাবাদী ও স্বপ্নবিলাসী। তবে আমার কোন উচ্চাশা নেই। আমার আশাবাদ ও স্বপ্নবিলাসই আমাকে লেখক হতে উৎসাহ যুগিয়েছে। লেখকের মাঠে আমি কচ্ছপগতীর একজন প্রতিযোগী। অনেকের চেয়ে অনেক পেছনে। তাই বলে আমি থেমে নেই। লিখছি এবং লিখব। এটাই আমার দৃঢ় প্রত্যয়।
সেই তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন একটা গল্প লিখেছিলাম। লিখে লুকিয়ে রাখলাম। তবুও তা পরিবারের কর্তাব্যাক্তিদের হাতে পৌঁছে গেল। স্কুল থেকে ফিরে দেখি সবাই আমাকে দেখে মুচকি হাসছে। মা জানালেন আসল ঘটনা। আমি লজ্জা পেলাম। আমার লেখালেখির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার মরহুম নানাজান মাওলানা আফসার উদ্দিনের। ছোটবেলায় নানার কাছে থাকতাম। নানা রাত জেগে কী সব বই পড়তেন। আমিও পড়তে শুরু করি।
কবি-লেখকদের জীবনী আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। নিজেও লিখতে চেষ্টা করি। সে সময়ের লেখাগুলো এখন আমার কাছে নেই। থাকলে হয়তো নিজেই লজ্জা পেতাম। এখনো খুব ভালো লিখি কি না জানিনা। তবে প্রতি সপ্তাহে দু’একটা লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাঁপা হয়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন পাঠ্য বইয়ের একটা কবিতাকে নকল করে একটা কবিতা লিখেছিলাম। আমার মামা মাওলানা মেজবাহ উদ্দিন সেটা দেখে বললেন,‘অন্যেরটা নকল করে কেন? নিজে লেখার চেষ্টা করো।’ তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়। আমার নানা-মামা দু’জনেই ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলেও সাহিত্যকে সমাদর করতেন। নিজেরাও প্রচুর পড়তেন।
এক বালিকার প্রেমে পড়ে ডজনখানেক প্রেমের কবিতা লিখলাম। বন্ধুরা কবিতা ধার নিত। কাউকে আবার প্রেমপত্র লিখে দিতাম। নিজেও একটা প্রেমপত্র লিখে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলাম। ‘প্রিয় নদী, নদ যেমন নদীর কাছে ছুটে যায়। আমিও তেমন তোমার কাছে ছুটে যাই।’ এটা নিয়ে বকুনি খেতে হয়েছে। যদিও পত্রটা পাত্রীর কাছে পৌঁছানোর আগেই বড়ভাই মোসলেহ উদ্দিনের হাতে পড়ে। মূলত কবি বলেই ভেতরে একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব চলে আসে। এই ভাব থেকেই লেখক হওয়ার বাসনা আরো তীব্র হয়।
অভাব একটা মূল কারণ। দাদার মৃত্যু ও নদী ভাঙন আমাদের অভাবের মুখে ফেলে। টেনেটুনে সংসার চলছে। কোন আবদারই বাবা পূরণ করতে পারেন নি। অভাবের কারণেই নানা বাড়ি থাকতে হয়েছে আমাকে। এক কথায়, ভাব আর অভাবের সংমিশ্রণে কবিসত্ত্বা জেগে উঠেছে।
এখন ভাব আছে অভাব নেই। তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে শূন্য মনে হয়। কখনোই মানুষের জীবনে পূর্ণতা আসে না। কিছু না কিছুর অভাব থেকে যায়। বা লেখক-কবির অন্তরে অভাব থাকতে হয়। সেটা হতে পারে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম অভাব। এসএসসি পরীক্ষার আগ মুহূর্তে লেখার ভাবটা তীব্র হয়ে ওঠে। আমার মেজভাই নুরুদ্দিন আহমেদ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। রাতে ঘুমুতে গেলে তিনি বকতে থাকেন। ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল হবা। লেখা-পড়া নাই। সারাদিন কবিতা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আমি চুপ। কথার জবাব দিলেন বড়ভাই। ‘লিখুক না। সমস্যা কী লিখলে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলতো একদিনেই বিখ্যাত হননি।’ আমি মনে মনে আন্দোলিত হই। উৎসাহ পাই। যা হোক অন্তত একজন আমার পাশে আছে। পরীক্ষার রাতেও কবিতা লিখেছি। অনেক টেনশন হলে কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়।
এইচএসসি পড়ার সময় একটা টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে যাই। সবাই ধরে নিয়েছিল- আমাকে দ্বারা লেখা-পড়া হবে না। অবস্থাটাও তেমন। ভর্তি হয়ে ক্লাসে যাইনা। ঢাকা থেকে চলে আসি গ্রামের বাড়ি। উপন্যাস লিখতে শুরু করি। দু’তিনটা লিখেও ফেলি। কিভাবে ছাঁপানো যায়? চিন্তাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। উপায় খুঁজে পাইনা। বাংলাবাজারের অনেক প্রকাশনীর সাথে যোগাযোগ করি। তাতে টাকার প্রয়োজন। ফিরে আসি। তবুও থেমে নেই। লিখে যাই প্রতিনিয়ত। আমার কবিতার খাতার কিছু পাঠক তৈরি হয়। তারা পড়ে উৎসাহ দেন। ভালো লাগে। পোশাক-আশাক, চলা-ফেরায় পরিবর্তন আসে। চটের ব্যাগ কিনি। পাঞ্জাবী-পাজামা পড়ি। সবাই ‘কবি’ বলে ডাকে। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অপূর্ণতা থেকেই যায়। একটা লেখাও প্রকাশ হলোনা।
লেখা প্রথম প্রকাশ হয় খালাতো ভাই লুৎফর রহমানের সাহায্যে। ২০০৩ সালে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায়। ছাপার হরফে আমার কবিতা দেখে সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম। তা আজ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সম্মান শ্রেণিতে পড়তে এসে শ্রদ্ধেয় স্যার ইয়াকুব খান শিশিরের সান্নিধ্যে লেখালেখির তাড়নায় যুক্ত হয়ে যাই মফস্বল সাংবাদিকতায়। সংবাদের পাশাপাশি লেখালেখির একটা প্লাটফর্ম পেয়ে যাই। কলেজের নোটিশ বোর্ডের মাধ্যমে গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম গল্পেই বিশেষ পুরস্কার পেয়ে গেলাম। পুরস্কারের সুবাদে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বিশ্লেষণ’ ও ‘সাপ্তাহিক আনন্দবাংলা’য় লেখার জন্য অনুমতি পেলাম। ২০০৮ সালে দৈনিক দেশবাংলার সাহিত্য পাতায় কবিতা ছাপা হলো। এরপর থেমে থাকতে হয়নি। জেলার গন্ডি পেরিয়ে জাতীয় দৈনিকসহ সাহিত্যের ছোটকাগজে লেখালেখি শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লেখা আহ্বান করে। খুলনা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, নীলফামারি, জামালপুর, হাতিয়া, আগৈলঝাড়াসহ বিভিন্ন শহর থেকে আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। সর্বোপরি দেশের বাইরে ভারতের কোলকাতার ‘কারক’ সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হওয়ার আনন্দে এখনো চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। আর এ লেখাটা মূলত সম্পাদকের নির্দেশে। নির্দেশ বলবো একারণেই যে, আমার কাছে লেখা চেয়ে অনুরোধ করার মতো ক্ষুদ্র মানুষ তিনি নন। বরং আমার মতো ক্ষুদ্র লেখককে লেখার জন্য বরং নির্দেশ করা যায়।
কেন লিখি? এমন প্রশ্নের জবাবে এতক্ষণ নিজের ঢোল নিজে পেটালাম। আমার ঢোল আমি পেটালে অন্যরা পিটাবে কী? আমি শুধু বলবো- মনের তাগিদেই লিখছি। লেখাটা একটা নেশায় পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে মন থেকে যখন ভাব ও অভাব দূর হয়ে যায়; তখন কিছুই লিখতে পারিনা। চেষ্টা করেও পারি না। সে সময় অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগি। মনে হয় আমি আমার লেখক সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে অসহায় মনে হয়। ভাবের জন্য বিরহের দরকার। অভাবের জন্য ঔদাসিন্য দরকার। তখন দু’টাকেই অর্জনের চেষ্টা করি।
‘প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠে’ কিংবা কবিতার জন্য কবিকে প্রেমে পড়তে হয়। আমি প্রেমে পড়ি। কিন্তু আগলে রাখতে পারিনা। সঙ্গত কারণেই বিরহ অবধারিত। তখনই প্রত্যেকটি কথা হয়ে ওঠে একটি কবিতা বা গল্প। সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো যখন নাড়া দিয়ে ওঠে- হয়ে যাই বিদ্রোহী। আত্মার প্রশান্তির জন্য রচনা করি নাটক। এবং তাতে নিজেই অভিনয় করি।
লেখালেখি করি ঠিক কিন্তু সমস্যা পিছু ছাড়েনা। মফস্বল শহরে থাকি বলে লেখার জন্য কোন পারিশ্রমিক জোটেনা। ফলে বাধ্য হয়ে অন্য কাজও করতে হয়। কিন্তু কোন কাজই আমার জন্য স্থায়ী হয়না। কবিতার কারখানায় যেমন শ্রমিক- জীবিকার তাগিদেও শ্রমিক হতে হয়। এখনো পরিবারের গঞ্জনা রয়েছে। রয়েছে প্রিয়তমার তিরস্কার। ‘কিছু একটা করো’র তাগাদা। আমিতো কিছু একটা করছি। কিন্তু তাতে অর্থ নেই। আর সবাইতো অর্থই চায়। তবে আমি বিশ্বাস করি, অর্থ ও খ্যাতি একসাথে আসেনা। লেখালেখির ক্ষেত্রে অর্থ আশা করাটাও অরণ্যে রোদন মাত্র। দেশে হূমায়ুন আহমেদ আর ক’জন?
এবার মূল কথায় আসি। বাংলা সাহিত্যে প্রেম রোমান্স এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কবিতা লিখতে গিয়ে কবিকে প্রেমে পড়তে হয়। অথবা প্রেমে পড়ে তাকে কবিতা লিখতে হয়। দু’টাই চিরন্তন সত্য। কবি মনে প্রেম জাগ্রত না হলে কবিতা হয় না। সাহিত্যচর্চার জন্য প্রেম অনিবার্য। আর সে চর্চাকে অব্যাহত রাখতে হলে বেছে নিতে হয় বিরহকে। কারণ মিলনের চেয়ে বিরহ কবিকে নতুন স্বপ্ন দেখায়। নব সৃষ্টির উন্মাদনা জাগ্রত করে। কবিতার সাথে যেন প্রেমের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। লোকে বলে- কবি মানেই প্রেমিক। আর প্রেমিক মানেই কবি। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর যিনি জীবনে অন্তত এক লাইন প্রেমের কবিতা বা ছন্দ রচনা করেন নি। সবার জীবনে একবার প্রেম আসে- কথাটা যেমন সত্য; ঠিক তেমনি জীবনে অন্তত একবার কাব্য রচনা বা সাধনা করেন নি একথাও অস্বীকার করার জো নেই। কেউ যদি মনে-প্রাণে,ধ্যানে-জ্ঞানে কবি হন তবেতো কথাই নেই। বর্তমানে যারা খ্যাতনামা কবি বা যারা প্রতিষ্ঠার জন্য কাব্যচর্চা করছেন প্রত্যেকেই হয়তো প্রথম জীবনে কোন বালিকার উদ্দ্যেশ্যে প্রেমকাব্য রচনার মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন।
পড়নে পাঞ্জাবী-পায়জামা আর পায়ে চটি জুতো পড়ে কাধে একটা চটের ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে প্রথম দর্শনেই সবাই তাকে কবি বা লেখক ভাববেন। ভাবাটাই স্বাভাবিক। বেশ-ভূষায় কবি বা লেখক হলেই কী প্রকৃত লেখক হওয়া যায়? যায় না। লেখকের প্রাণশক্তি তার লেখনী। লেখনীর মাধ্যমেই সে পাঠক মহলে কবিখ্যাতি বা লেখক হিসাবে পরিচিতি লাভ করবেন। আসলে লেখক হওয়ার উপায় কী? শুধু কি কালি-কলম-মন দিয়েই লেখা যায়? নাকি আরও কিছু দরকার হয়? আপনারা যারা লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তারা নিশ্চয় এই প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজছেন।
খালাতো ভাই মহিউদ্দিনের দেখাদেখি লেখালেখি করার সাধ জাগে। তার কন্ঠে আবৃত্তি শুনতাম। সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ বহুবার শুনেছি। তার লেখা একাধিক কবিতাও পড়েছি। তার স্টাইল আমাকে আকৃষ্ট করে। তাকে অনুসরণ করতে শুরু করি। কিন্তু আজ তিনি লেখালেখি জগতে নেই। পারিবারিক সংঘাতে বিপর্যস্ত এক দিকহারা নাবিক। জীবন-জীবিকার সন্ধানে তার কবি প্রতিভা আজ বিলুপ্ত এক ঐতিহ্য। আমি কিন্তু থেমে যাইনি। হেরে যেতে চাইনি বা হেরে যাইনি। আমি এর শেষ দেখবো। লেখালেখির প্রসঙ্গ এলে খুব বেশি মনে পড়ে নানাজান, মামা, বড়ভাই, মেজভাই, বড়দা, শিশির স্যার, ঢাকার কবি মুনশী মোহাম্মদ উবাইদুল্লাহ, জামালপুরের কবি ও রচয়িতা সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ও হারিয়ে যাওয়া কবি সেজভাইকে। আমার পিছনে তারা প্রত্যেকেই অনুপ্রেরণা। আমার মাথার ওপরে তারা বটবৃক্ষের ছায়া।
বিশেষ করে আমার বাবা আমার একনিষ্ঠ পাঠক। আমার শুভাকাঙ্খি। তিনি আমাকে ব্যাপক উৎসাহ দেন। যদিও একসময় বিরোধিতা করতেন। কারণ তাকে বোঝানো হয়েছিল- বাংলায় পড়ে ছেলেটা উচ্ছন্নে যাবে। চটের ব্যাগ নিয়ে ঘুরবে। বিশ্রী অর্থে- দাঁড়িয়ে প্রসাব করবে। ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার করবেনা। আজ ভুলে গেছি সে সব কথা। বরং সে সমস্ত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়। কারণ তাদের তিরস্কারের কারণেই আজ আমি অনেক পুরস্কার পাচ্ছি। অনেক ভালোবাসা পাচ্ছি।
লেখা-লেখিটা প্রধানত সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক ক্ষমতা। ইচ্ছে করলেই লেখক হওয়া যায় না। তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যবসায়। ত্যাগের মানসিকতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। সর্বোপরি লিখতে হলে পড়তে হবে। বিশিষ্ট কবি-লেখকরা অবশ্য একথার সাথে একমত যে, ‘এক লাইন লিখতে হলে দশ লাইন পড়তে হবে।’ পড়ার বা জানার কোন বিকল্প নেই। তথ্য বা শব্দ ভান্ডার হতে হবে সমৃদ্ধ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাক বা না থাক তাতে কিছু যায় আসে না। সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় শিক্ষা একান্ত আবশ্যক। এছাড়া লিখতে গেলে অগ্রজ কাউকে না কাউকে অনুসরণ করতে হয়। অনেকেই অনেক কবি-লেখক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে লেখকের কল্পনা শক্তি হতে হবে প্রখর। লেখকের ‘তৃতীয় নয়ন’ বলে একটা বিষয় আছে। যা আর দশজন সাধারণ মানুষের নেই। কবি ও অকবিদের মধ্যে মূল পার্থক্য এখানেই। সাধারণ মানুষ যে জিনিসটি সাধারণ ভাবে দেখে; একজন অসাধারাণ মানুষ সেটাকে অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে। একজন লেখকের দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের অন্যান্য মানুষের চেয়ে আলাদা হতে হয়।
জানি না আমি তেমন হতে পেরেছি কি না? হওয়ার চেষ্টা করছি। আমি যদি ভালো লেখক নাও হতে পারি তবুও আমার অনুরোধ-আপনারা এগিয়ে আসুন। প্রত্যেকটি সমাজে অন্তত একজন করে লেখক থাকা দরকার। যদি বলেন কিভাবে সম্ভব। পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। সবকিছুর মূলে চেষ্টা। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায়। নিন্দুকের নিন্দা, মানুষের কটাক্ষ, সমাজের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই এ সাধনা চালিয়ে যেতে হয়। দস্যু রতœাকর তপস্যা করে যদি বাল্মিকী হতে পারেন। আপনি কেন পারবেন না। রামায়ণ না হোক একটা নিটোল হাসির গল্পতো লিখে যান। তা পড়ে যদি অন্তত একজনের মুখে হাসি ফোটে তাতেই আপনার সার্থকতা। এবার বলি বিখ্যাত জনেরা লেখক হওয়ার ব্যাপারে কী পরামর্শ দেন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করতেন, যদি আজকের দিনই হয় আমার জীবনের শেষ দিন, তাহলে আমার কোন কাজটি সবার আগে করা উচিত? একজন লেখকও এ রকমভাবে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেন শব্দে শব্দে কী লিখতে চান তিনি, কীভাবে লিখতে চান, কী কথাই বা বলতে চান? অমর একুশে বইমেলার বই-গন্ধ গায়ে মেখে তোমরা যারা লেখক হওয়ার পথ খুঁজছ, যারা স্বপ্ন দেখছ ভবিষ্যতের লেখক হওয়ার, তারা তো জানোই শব্দে শব্দে মিল- অমিল দিয়ে লেখক হওয়া এত সহজ কর্ম নয়। এর জন্যও লাগে দীর্ঘ প্রস্তুতি, পড়াশোনা। তোমাদের জন্য দেশের তিন খ্যাতিমান লেখক এবার জানাচ্ছেন কেন লেখক হলেন তাঁরা, কীভাবে লেখক হলেন। অভিজ্ঞতার আদ্যপান্ত।
লেখক হওয়ার উপায় সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন- লিখতে হলে পড়তে হবে। তরুণ লেখকদের প্রতি প্রথমত এটিই আমার বলার কথা। মনে রাখতে হবে, লেখকের পথ বড়ই বিপদসঙ্কুল। এটা সম্পূর্ণ একার পথ। কঠিন এক সাধনা। কোনো লেখকের পক্ষে কি বলা সম্ভব, তিনি কেন লেখক হয়েছেন? মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, লেখক না হয়ে উপায় ছিল না বলেই শেষ পর্যন্ত লেখক হয়েছি। খুব ছোটবেলা থেকে কেন যে কবিতা, গল্প এসব লিখতাম, আজ সেটা স্মৃতি খুঁড়ে বের করা কঠিন। বলা যায়, যে পৃথিবীতে বেঁচে আছি সেই পৃথিবীর একটা অর্থ ও ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারি লেখার মাধ্যমে। এটি হয়তো প্রত্যেক লেখকই পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে একজন লেখকের সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট একটা ধারণা থাকা জরুরি। লেখক হতে চাইলে তুমি যা কিছু করতে চাও, তার সবই তোমাকে লেখার ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত করতে হবে। ব্যক্তিভেদে একেকজন লেখকের লেখার কৌশল একেক রকম। আমি যেমন সাধারণত একটি লেখা একবারেই লিখে ফেলি। কিন্তু লেখাটি লেখার আগে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থাকে বিস্তর। কীভাবে আগের লেখা থেকে নতুন লেখাকে আলাদা করা যায়। এই ভাবনাও থাকে। আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকই তাঁর নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেন একান্ত তাঁর মতো করে।
কবি মহাদেব সাহা বলেছেন, আমি কি কবি হতে পেরেছি? জানি না। মনে পড়ে, ১৯৭৬ সালে প্রেসক্লাব-সংলগ্ন ফুটপাতের ওপর বসে একটানে লিখেছিলাম ‘চিঠি দিও’ কবিতাটি। পরে সেটি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়। শৈশবে আমার মা বিরাজমোহিনির মুখে রামায়ণ ও মহাভারত শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তখন মনে হতো, বাল্মীকি বা ব্যাসদেবের মতো যদি কবি হতে পারতাম!
তিনি আরো বলেছেন, একটি শব্দের জন্য বসে থেকেছি সারা রাত। জীবনানন্দ দাশ কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পড়েছি উন্মাদের মতো। পড়েছি জন কিটস, রাইনার মারিয়া রিলকে, ডব্লিউ বি ইয়েটস। পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে হয়তো কবি হয়ে উঠেছি আমি। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে কবি হচ্ছে একমাত্র অবিনাশী সত্ত্বা, রাজা, সম্রাট তাঁর কাছে কিছু নয়। তাই কবি বা লেখক হতে গেলে যেমন পড়াশোনা জরুরি, তেমনি দরকার লেখকের স্বাধীন সত্ত্বা। কারও পরামর্শ নিয়ে কেউ কোনো দিন কবি হতে পারে না।
অদিতি ফাল্গুনীর বক্তব্য এরকম, যদি মেয়ে না হতাম, তাহলে আমি হয়তো কখনোই লেখক হতাম না। কথাটি খোলাসা করি, মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী সঙ্কুচিত হয়েছে। সেই শৈশব উত্তীর্ণকালে আমার বয়সী বন্ধুগোত্রীয় ছেলেরা যেভাবে পৃথিবীকে দেখেছে, আমার দেখা ছিল তাঁদের থেকে ভিন্ন। শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী যে ছোট হয়ে এল, এই বেদনাবোধই আমাকে লেখক করে তুলেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, প্রতিকূলতা অনেক সময় আমাদের ভেতরের আগুনকে উসকে দেয়।
আমাদের বাড়িতে বড় একটি পাঠাগার ছিল। সেখানে ছিল রুশ সাহিত্যসহ নানা ধরনের বই। এ ছাড়া কলেজের গ্রন্থাগারে পড়েছি গ্রিক নাটক। এই পাঠ আমাকে পুষ্টি দিয়েছে। একসময় পাহাড়ে ওঠার খুব শখ ছিল, পারিনি। শেষমেষ দেখি, গল্প-কবিতা লিখতে লিখতে লেখকই হয়ে উঠেছি!
লেখালেখির জন্য প্রথমত ভাষাগত প্রস্তুতি থাকা খুব দরকার বলে আমার মনে হয়। আর ভাষাগত প্রস্তুতি গড়ে ওঠে মহৎ সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষায় লিখতে হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়া যেমন আবশ্যক তেমনি অন্য ভাষার মহৎ সাহিত্যিকদের লেখাও পাঠ করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত জীবনে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে আমার নানার অনুপ্রেরণায়। তিনি রাত জেগে পড়তেন। দেশি-বিদেশি সবধরণের সংগ্রহ ছিল তার। মাঝে মাঝে লিখতেন। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন। তার সংস্পর্শে আমিও পড়া ও লেখার অভ্যাস গড়ে তুলি। নানা বলতেন, লিখতে লিখতে লেখক হওয়া যায়। গ্রামীণ প্রবাদের মতো- ‘হাটতে হাটতে নলা/ গাইতে গাইতে গলা।’ সর্বোপরি কথা হচ্ছে- নিরলস চেষ্টা, চর্চা ও সাধনাই একজনকে লেখক হিসাবে গড়ে তুলতে পারে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কবি, কথাশিল্পী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।