বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১২

বালেশ্বর যুদ্ধের কথা

দুলাল সরকার

বালেশ্বর যুদ্ধের কথা বলব তোমাকেÑ
১৯১৫ সাল, বাঘা যতীন, চিত্তপ্রিয়
মনোরঞ্জন, নীরেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিষচন্দ্র নামের চার বিপ্লবী
যুদ্ধাস্ত্র গ্রহণে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত অপেক্ষমান অবসরে
চিন্তামনি নামের ছদ্মবেশী দারোগার বিশ্বাসঘাতকতায়
সকলের মৃত্যু হলে বাঘা যতীন সব সাথীদের
মৃত্যুর দায় স্বীকার করে চিরবিপ্লবী যতীন সেই অসম যুদ্ধে
প্রাণ হারালে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে
হত্যাকারী পুলিশ কমিশনার টেগার্টকেও তাঁর
দেশপ্রেম ও বীরত্বের কাছে মাথা নোওয়াতে দেখে ভাবি
’৭১ এর হত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী, ধর্ষক
পাকিস্তানীরা আজো
বাঙালির কাছে মাথা নত না করে
যে অপরাধ করে চলেছে
তা কত ক্ষমাহীন ও মানবতাবিরোধী।

২২.১১.২০১২

বুধবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১২

ডা. জোহরা বেগম কাজী উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান বাঙালি মহিলা চিকিৎসক

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ :
উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান বাঙালি মহিলা চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৭ নভেম্বর। যে মহিয়সী নারী জীবদ্দশায় মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। আজ তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করছি তাঁকে। অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজী স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। তিনিই প্রথম ধাত্রীবিদ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করে অজ্ঞ ও অবহেলিত নারী সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। অবগুন্ঠিত নারী সমাজের উন্নত চিকিৎসার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির শক্ত বাধাকে অতিক্রম করে নারী সমাজের মুক্তিদাত্রী হিসেবে ধূমতেুর মত আবির্ভূত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের অনগ্রসর চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনিই প্রথম আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে এসেছিলেন।
এ মহিয়সী নারী ১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজনানগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার গোপালপুর গ্রামের প্রভাবশালী সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ও আধুনিক চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। তিনি দেশভাগের ঘোরবিরোধী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করতেন না। ফলে বাবার মানবতাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হলে থাকে অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত কিশোরী জোহরার মননে ও চেতনায়। মাতা আঞ্জুমান নেছা রায়পুর পৌরসভার প্রথম মহিলা কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কর্মনিষ্ঠ সাদাসিধে এক নারী।
তখন ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনের উত্তাল সময়। এ সময় ডা. জোহরা বেগম কাজীর শৈশব-কৈশোর কাটে মানবতাবাদী পিতার কর্মস্থল মহাত্মা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ। রাজনানগাঁওয়ের রানি সূর্যমুখী প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের টোল ‘পুত্রিশালায়’ তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ছাত্রজীবনে তিনি বরাবরই মেধাবী ছিলেন। ক্লাসে সব সময় প্রথম হতেন। ফলে সাফল্যের সাথে মেট্রিক পাস করেন। ১৯২৯ সালে তিনি আলীগড় মুসলিম মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে আইএসসি পাস করে কলেজ জীবন সমাপ্ত করেন। এরপর উপমহাদেশের প্রথম মহিলা মেডিকেল কলেজ দিল্লির লেডি হার্ডিং গার্লস মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে তিনিই প্রথম মুসলিম বাঙালি ছাত্রী। এখান থেকে ১৯৩৫ সালে এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। তখন তাকে সম্মানজনক ‘ভাইস রয়’ পদক প্রদান করা হয়।
ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা জোহরা বেগম কাজীর গান্ধী সেবাশ্রমে কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। এছাড়া অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩ বছর কাটিয়েছেন তিনি। পরে বৃত্তি নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য লন্ডনে পড়াশুনা করেছেন এবং চিকিৎসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি এফআরসিওজি লাভ করে ভারতে ফিরে আসেন। গান্ধী পরিবারের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে নাগপুরে অবস্থিত গান্ধীর সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ তিনি অবৈতনিক চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশবিভাগের পর তিনি বড়ভাই অধ্যাপক কাজী আশরাফ মাহমুদ ও ছোটবোন ডা. শিরিন কাজীর সাথে বাংলাদেশের ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যোগদান করেই গাইনি (স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা) বিভাগ চালু করেন। এছাড়াও তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন। পরবর্তীতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) অনারারি কর্নেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
সাতচল্লিশ- পরবর্তী বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। তিনি একাধারে চিকিৎসাশাস্ত্রে বাঙালি নারী চিকিৎসকদের অগ্রপথিক, মানবতাবাদী ও সমাজ-সংস্কারক ছিলেন। গর্ভবতী মায়েরা হাসপাতালে এসে যেন চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন, সে জন্য তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারীদের জন্য পৃথক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। পিছিয়ে পড়া নারীদের জাগরণ তথা চিকিৎসাশাস্ত্রে নারীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছেন। তারই দেখানো পথে আজ বাংলাদেশে অসংখ্য নারী চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। তাঁর জ্বালিয়ে দেওয়া আলোক বর্তিকা হাতে নিয়ে আজ অনেক নারী চিকিৎসক আলোকিত করছে গ্রামবাংলার অবহেলিত জনপদের চিকিৎসা জগতের অন্ধকার প্রকোষ্ট।
শুধু তা-ই নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। এছাড়াও একজন ইতিহাস সচেতন মানুষ হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিনির্মাণের লক্ষে তিনি ২০০১ সালের ১১ জুলাই তাঁর কাছে সংরক্ষিত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত ঐতিহাসিক পত্র, ভাইস রয় পদক, সনদসমূহ এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি-স্মারক আমাদের জাতীয় জাদুঘরে দান করে গেছেন।
ডা. জোহারা বেগম কাজী জীবনের শুরু থেকেই সময়ের ধারাবাহিকতায় কর্মময় জীবনে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর স্ত্রী কন্তুরাবার øেহসিক্ত হয়েছেন। পরবর্তীতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও মহাত্মা গান্ধীর øেহভাজন কংগ্রেসের অন্যতম কর্মী ডা. সুশীলা নায়ারসহ অসংখ্য মানবতাবাদী বিপ্লবী মানুষের সাহচর্য লাভ করেছেন।
জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে ডা. জোহরা বেগম কাজী বিভিন্ন খেতাব ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘তখমা-ই পাকিস্তান’ খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ‘ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) তাকে বিএমএ স্বর্ণপদক প্রদান করে। ২০০২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘রোকেয়া পদক’ প্রদান করেন। ২০০৮ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) প্রদান করে সম্মানিত করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ৩২ বছর বয়সে তৎকালীন আইনজীবি ও সংসদ সদস্য রাজু উদ্দিন ভূইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আজীবন মানব সেবায় নিয়োজিত জোহরা বেগম কাজী ২০০৭ সালের ৭ নভেম্বর ৯৫ বছর বয়সে ঢাকার নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রতিবছর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকায় মাদারীপুর জেলা সমিতির উদ্যোগে স্মরণ সভা ও পৈতৃক নিবাস মাদারীপুরের কালকিনির মানুষ স্মরণ সভা ও মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করে। এ মহিয়সী নারী আমাদের মাঝে চিরদিন চিরকাল বেঁচে থাকবেন।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ,
সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।

মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১২

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন কুন্ডুবাড়ির মেলা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন হিসাবে আখ্যায়িত করলে অত্যুক্তি করা হবে না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালী পূজাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত কুন্ডুবাড়ির মেলায় আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানই কয়েকগুণ বেশি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়-‘ গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।’ এইতো ছিল আমাদের গ্রামবাংলার সম্প্রীতির চিরায়ত সংস্কৃতি। কিন্তু ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোড়ামী আজ যখন সাম্যের পথে বাধা হয়ে শক্ত প্রাচীর গড়তে যাচ্ছে সে সময়ে এমন মিলন মেলা আমাদের অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দেয় ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ আমরা ফিরে পেতে চাই সোনালী দিন। আমরা বলতে চাই- আমরা জন্মসুত্রে বাংলাদেশী। জাতিগত পরিচয়ে আমরা এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।
দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়- মেলার একদিকে মন্দিরে চলে পূজা-অর্চনা। অন্যদিকে বিশাল এলাকা জুড়ে পণ্যের বিকি-কিনি। সর্বোপরি বাধভাঙা আনন্দ উপচে পড়ে বিনোদন মঞ্চে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা আসে তাদের পণ্যের পসার সাজাতে। দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ আসবাবপত্রের মেলা হিসাবে খ্যাত কুন্ডুবাড়ির মেলা শতবছর পেরিয়ে সহস্র-অযুত-লক্ষ-নিযুত-কোটি বছর কিংবা আজীবন টিকে থাকবে। টিকে থাকবে এ অঞ্চল তথা বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কারণ হিন্দুদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেলাকে সফল করতে নির্দ্বিধায় এগিয়ে আসে স্থানীয় মুসলমানরা। সম্প্রতি রামু ও উখিয়ায় ঘটে যাওয়া সহিংসতাও দমাতে পারেনি আয়োজকদের উৎসাহ-উদ্দীপনা । গ্রামবাংলার শতবছরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে দলমত নির্বিশেষে সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এক্ষেত্রে আন্তরিকতার কমতি নেই স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের।
কুন্ডুবাড়ির মেলার উৎপত্তির ইতিহাস দুর্বোধ্য হলেও ধারণা করা হয়- স্থানীয় সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কালীপূজা উপলক্ষে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে মাদারীপুরের কালকিনি পৌর এলাকার গোপালপুর গ্রামের কুন্ডুবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা। সঠিক দিন তারিখ কেউ না জানলেও ধরে নেওয়া হয় আনুমানিক আঠারো শতকের শেষের দিকে কুন্ডুদের পূর্বপুরুষরা ধর্মীয় উৎসব কালীপূজার আয়োজন করে। ক্রমান্বয়ে তাদের পূজাকে ঘিরে প্রথমে বাদাম, বুট, রয়্যাল গুলি, লাঠি লজেন্স, মন্ডা-মিঠাই ও খেলনা নিয়ে অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ী বসতো। পরে আস্তে আস্তে প্রতিবছর ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় এখবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসতে শুরু করে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা এর নামকরণ করেন ‘কুন্ডুবাড়ির মেলা’ নামে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থিরতার মধ্যে মেলা বন্ধ থাকলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ মেলা জমজমাটভাবে হয়ে আসছে।
প্রতিবছরের মতো এ বছরও ১৩ নভেম্বর সকাল থেকে ১৭ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়ে গেল কুন্ডুবাড়ির মেলা। তিন দিনব্যাপী হওয়ার কথা থাকলেও ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনা করে আরো দু’দিন বাড়িয়ে সমাপ্ত হলো। মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা বাঁশ, বেত, ইস্পাত-কাঠের আসবাবপত্র, খেলনা ও প্রসাধনীসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে আসেন। অনেকে আসেন পণ্য সামগ্রী কিনতে। পাশাপাশি নাগর দোলা, পুতুল নাচসহ বিভিন্ন বিনোদনে আকৃষ্ট হয় দর্শনার্থীরা। বস্তুত বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মেলা হয়ে ওঠে উপভোগ্য। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চাপ কম থাকলেও বিকেলের পরে বাড়তে থাকে জনস্রোত। বিশাল জনসমুদ্রে রূপ নেয় মেলা প্রাঙ্গন। তবুও মেলার দীর্ঘ ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনার নজির নেই।
মেলায় আগত দর্শনার্থীরা কেউ কেউ বাচ্চাদের জন্য খেলনা, আসবাবপত্র কিংবা প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনছেন। আবার কেউ কেউ ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ব্যবসায়ীদের প্রচুর লাভ হয়। কোন ঝুট-ঝামেলাও নেই। মেলা উদযাপন কমিটিও যথেষ্ট আন্তরিক। কুন্ডুবাড়ির মেলা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্ণ। তাই বংশ পরম্পরায় তারা এ ঐতিহ্যকে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। তিনি আরো জানালেন, তাদের পূর্বপুরুষরা নাকি আঠারো শতকের শেষের দিকে এ মেলার প্রবর্তন করেন। শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ মিলন মেলা। এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সব ধর্মের মানুষ আসে। হিন্দু-মুসলমান কে কোন জাত সে বিচারের উর্ধ্বে গিয়ে সম্প্রীতির বন্ধন গড়াই সকলের উদ্দেশ্য। জাতিগত সীমাবদ্ধতার বাহিরে উদার মানসিকতার পরিচয় মেলে এখানে। বেচা-কেনা কেবল উপলক্ষ মাত্র। আমরা বাঙালি। আমাদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার একাত্মতা ঘোষণার একটা প্লাটফর্ম বলা যায়।
মেলার অগণিত মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য পূজা মন্ডপের পাশে স্থায়ীভাবে একটি পুলিশ কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব) ও গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) তাদের সহযোগিতা করেন। ফলে বিশৃঙ্খলার কোন সুযোগ নেই। কুন্ডুদের পূর্বপুরুষদের প্রবর্তিত এ মেলা শতবছর পেরিয়েছে। মেলার আয়োজকরা হিন্দু হলেও এটা এখন এলাকার ঐতিহ্য ও সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। এ ঐতিহ্য ও সম্পদ টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের। ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা এ অঞ্চলের প্রাণের উৎসব। তাই পূর্ব নির্ধারিত তিনদিনের হলেও বর্ধিত আরো দু’দিন অর্থাৎ পাঁচদিনে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে এ উৎসব। কুন্ডুবাড়ির মেলা আমাদের শিক্ষা দেয়- রামুর মতো আর সহিংসতা নয়। মানুষে মানুষে হৃদ্যতাই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আমরা বাঁচতে চাই- হাতে হাত রেখে। আমরা বাঁচতে চাই- কাঁধে কাঁধ রেখে।
বিকাল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গন ঘুরেও মনে হয় ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ।’ জনসমুদ্র সাঁতরে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে পড়ে যায়- ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা/ অগ্রাণে নবান্ন উৎসবে/ আবার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়/ বিশ্ববাসী চেয়ে রবে।’ আমাদের শুধু একটাই প্রার্থনা, শতবছরের ঐতিহ্যবাহী কুন্ডুবাড়ির মেলা টিকে থাকুক মানুষের ভালোবাসা আর বন্ধনে। সাম্য ও মৈত্রী হোক এর একমাত্র লক্ষ। কোন অসাম্প্রদায়িকতা যেন এর পবিত্রতাকে বিনষ্ট করতে না পারে এ প্রত্যাশা সকলের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ভরে উঠুক প্রিয় স্বদেশ। একই দুর্বা ঘাসের শিশিরে সিক্ত হোক সকলের চরণ। এক শীতল আবেশে সম্প্রীতির সুবাতাস বইয়ে দিক সবার অন্তরে। এক সামিয়ানার নিচে সব ব্যবধান ভুলে গিয়ে হিন্দু-মুসলিম এক হয়ে গেয়ে উঠুক মানবতার জয়গান। কুন্ডুবাড়ির মেলা দীর্ঘজীবি হোক। অটুট বন্ধনে চিরজীবি হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। কারণ ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ এর সাথে তাল মিলিয়ে বলতে হয় সবার উপরে সম্প্রীতি সত্য তার উপরে নাই।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।

বৃহস্পতিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১২

প্রথম আলো’র কালকিনি প্রতিনিধির ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
প্রথম আলো’র কালকিনি প্রতিনিধি খায়রুল আলমের ওপর হামলাকারীদের বিচারের দাবীতে গত বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় কালকিনি বন্ধুসভার উদ্যোগে স্থানীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধন শেষে প্রতিবাদ সমাবেশে কালকিনি বন্ধুসভার সভাপতি সালাহ উদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে মিজানুর রহমানের সঞ্চালনে বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক মোঃ জামাল উদ্দিন, খন্দকার মনিরুজ্জামান, আসাদুজ্জামান রিপন, সাইফুল ইসলাম, তপন বসু, ওমর আলী সানি, আঃ গফুর মোল্লা, জহিরুল ইসলাম খান, উপজেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন, মাদারীপুর উদীচীর সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী রতন কুমার দাস প্রমুখ। বক্তারা খায়রুল আলমের ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।
উল্লেখ্য, গত শনিবার সকালে মাদারীপুরের কালকিনি পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দুলাল ও তার সমর্থকদের হামলায় প্রথম আলো’র কালকিনি প্রতিনিধি খায়রুল আলম গুরুতর আহত হন। তাকে প্রথমে কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শেরে-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চিরদিন চিরকাল

সালাহ উদ্দিন মাহমুদঃ
‘কেউ কথা রাখেনি’- কবিতাটি প্রথম শুনি খালাতো ভাই মহিউদ্দিনের কন্ঠে। খুব ভালো আবৃত্তি করতেন। কবিতার কবিকে চিনতাম না। তবে নাম শুনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতার সাথে সেই আমার প্রথম প্রেম। কবিতার বইটি খুঁজতে থাকি। নাম জানিনা। ২০০৩ সালে যখন ঢাকায় থাকি; তখন একদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশের রাস্তায় পুরনো বইয়ের দোকানে ‘সুনীলের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নামের একটি পুরনো বইয়ের ওপর চোখ পড়ে। হাতে নিয়ে খুলে দেখি-‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতা আছে। একটি কবিতার জন্য বিশ টাকা দিয়ে বইটা কিনলাম। একদিন পত্রিকায় দেখি- কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর জন্মস্থান কালকিনিতে এসে নোংড়া রাজনীতির শিকার হয়েছেন। কালকিনিবাসী তাঁর কথা রাখেনি।
২০০৫ সালে বাংলা সাহিত্যে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য আসি কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজে। তখন কলেজে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বাছাই পর্বে ‘কেউ কথা রাখেনি’ আবৃত্তি করলাম। বাছাইতে টিকলেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারিনি। খুবই আহত হয়েছিলাম। কারণ বিচারকরা আমার কথা রাখেননি। এরপর আবৃত্তিটাকে আঁকড়ে ধরলাম। শিমুল মুস্তাফা, মাহিদুল ইসলাম, মেহেদি হাসানদের অডিও ক্যাসেট কিনে রোজ শুনতাম। তারপর অনেক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছি। আমার আবৃত্তি জীবনে ঐ একটা কবিতাই মুখস্থ। এরপর যত আবৃত্তি করেছি তা মুখস্থ করিনি। স্ক্রীপ্ট দেখে করেছি।
২০০৬ সালে কলেজের নোটিশ বোর্ডে সুনীল সাহিত্য ট্রাস্টের গল্পলেখা প্রতিযোগিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছি। পুরস্কারে সুনীলের লেখা ‘কাকাবাবু’ পেয়েছিলাম। এরপর আত্মীয়ের বাড়িতে ‘সোনালী দুঃখ’ পড়েছি। আস্তে আস্তে সুনীলের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়। সেই থেকে বছরে একটা ছোটগল্প লিখে জমা দিতাম। তারমধ্যে ২০১০ ও ২০১১ সালেও ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছি। পুরস্কারের সাথে কবির হাতের লেখা আশির্বাদ পত্র দেওয়া হয়। সেখানে লেখা ‘আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে রই চিরদিন চিরকাল!- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।’ কবির আর্শিবাদ আমাকে কবির কাছে ঋণী করে দেয়। এখন মনে হচ্ছে মাদারীপুরে প্রবর্তিত সুনীল সাহিত্য পুরস্কারকে জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। তবেই হয়তো কবির কথা না রাখার দীনতা ঘুচাতে পারবো।
২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার জন্মভিটায় পা রাখবেন। শুনে আনন্দিত হলাম। শরীরী কবিকে দেখব। এ যেন অন্যরকম অনুভূতি। অশরীরী সুনীলের সাথে প্রথম পরিচয় খালাবাড়ির ঘরোয়া আড্ডায়। দ্বিতীয় পরিচয় পল্টনের ফুটপাতের পুরনো বইয়ের দোকানে। তৃতীয় পরিচয় সুনীল সাহিত্য পুরস্কারে। কবির সাথে শেষ দেখা মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে। কবির কাছে গিয়েছি, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছি। কবি মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করেছেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনেছি। কবিকে দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে কবি-অকবিরা ছুটে এসেছেন। নির্জনে বা একান্তে কথা বলার সুযোগ কারোই হয়নি।
তবে সৌভাগ্য আরেক আবৃত্তি শিল্পী মেহেদী হাসানের। গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার ছেলে। চাকরি করতো পুলিশের বিশেষ শাখায়। পুলিশ হলেও রসবোধ চমৎকার। সংস্কৃতির চর্চা করেন। তার দায়িত্ব ছিল কবিকে বেনাপোল থেকে নিয়ে আসার। সাথে ছিলেন মাদারীপুর শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যপ্রশিক্ষক আ জ ম কামাল ও উদ্ভাস আবৃত্তি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কুমার লাভলু। মেহেদী হাসানরা কবিকে একা পেয়ে ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার গোড়ার কথা জানতে চেয়েছিলেন। কবি অকপটে সব বলেছেন। মেহেদী হাসান আবৃত্তি করছেন আর কবি ব্যাখা করছেন। কবি বলেছিলেন, তাঁর বয়স যখন তেত্রিশ পেরিয়ে গেছে তখন এমন অনুভূতি তাকে তাড়িত করেছে। তাই তিনি লিখলেন ‘কেউ কথা রাখেনি।’ কবিতার কিছু অংশে কল্পনার সংমিশ্রন থাকলেও পুরো কবিতাটিই বাস্তবতার আলোকে লেখা। কবিতায় বোষ্টুমীর প্রসঙ্গ কাল্পনিক হলেও অবাস্তব নয়। কবি ১৯৩৪ সালে ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রামের নানা বাড়িতে। তখন পৈতৃক নিবাস কালকিনির মাইজপাড়ায়। সম্ভবত ১০-১১ বছর বয়সে অর্থাৎ দেশভাগের আগেই পরিবারের সাথে চলে যান কলকাতা। সেখানেই কেটেছে তার পুরোটা জীবন। দেশভাগ তাকে আহত করেছে বারবার। যা তার বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছে। তবু তিনি ভুলতে পারেননি শৈশবের স্মৃতি। দেশভাগ করে কথা রাখেননি নেতারা। কিন্তু কবি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ‘পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায়’ থেকেছেন। সে সময় মনে হয়েছে তার মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী তাকে বলেছিল,‘বড় হও দাদাঠাকুর তোমাকে আমি/ তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব’। কবির আর সে বিল দেখা হয়নি।
তিন প্রহরের বিলে সাপ আর ভ্রমরের প্রসঙ্গ এলে কবি মুচকি হাসলেন। তিনি বললেন, তখন আমি ছোট ছিলাম। মামারা যখন নৌকা নিয়ে বিলে যেত। তখন আমিও বায়না ধরতাম। কিন্তু মামারা নিতেন না। ছোট্ট সুনীলকে ভয় দেখানোর জন্য বলতেন, সে বিলে যেতে- আসতে তিন প্রহর লেগে যায়। তুমি অতো দূরে কি করে যাবে। আর সেখানে ভয়ঙ্কর সাপ রয়েছে। সেই বোধ থেকেই বিলের নাম দেই তিন প্রহরের বিল। আর সাপ আর ভ্রমরের খেলাটা বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য বলা। এসময় আ জ ম কামাল অভিযোগ করে বললেন, কবি কবিতায় আপনি মুসলমানদের ছোট করেছেন। একটি মাত্র চরিত্র তাও আবার মাঝি। কবি তখনও হাসলেন। বললেন, আরে কামাল শোন, তখন মুসলমানরা এখনকার মতো এতো সচেতন ছিলেন না। আমি তাদের ছোট করিনি বরং তাদের পশ্চাৎপদতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তখনও মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। মামাবাড়ির আশপাশের মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের বাড়ির কামলা খাটত বা নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো।
কবিরা আর্থিকভাবে অতটা স্বচ্ছল ছিলেন না। মার্বেল খেলার জন্য একটা রয়্যালগুলিও তিনি কিনতে পারেননি। তখন মাইজপাড়ার লস্কররা খুবই বিত্তবান ছিলেন। লস্কর বাড়ির ছেলেদের লাঠি লজেন্স খেতে দেখে কবি বাবার কাছে বায়না ধরতেন। বাবা বলতেন, পরে কিনে দেব। কবি অপেক্ষায় থেকেছেন। বাবা স্কুল মাস্টার। বেতন কম। তাই তার মা কবিকে বলতেন, জীবনে অন্য কিছু করবে তবু মাস্টারি করবে না। তাই কবি কখনো মাস্টারি করতে যাননি। রাস উৎসবের যে অনুসঙ্গ এসেছে এব্যাপারে কবির বক্তব্য হচ্ছে- কবি ছেলেবেলায় খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। তাদের গাঙ্গুলি বাড়িতে যখন রাস উৎসব হতো তখন ভেতর বাড়িতে মহিলারা নাচ-গান করতেন। কবি তার ব্যাঘাত ঘটাবেন বলে তাকে সেখানে ডুকতে দেওয়া হতোনা। নিচেকে অসহায় কল্পনা করে কবি এমন অভিব্যক্তি করেছেন। কবি তখন ভাবতেন, একদিন আমিও সব পাব। রয়্যাল গুলি, লাঠি লজেন্স আর রাস উৎসব সবই তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তার বাবা এসব কিছুই দেখে যেতে পারেননি। আজ সুনীলের সব আছে কিন্তু তার স্কুলমাস্টার বাবা নেই। এই শূন্যতা তাকে বারবার গ্রাস করেছে।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে- কবিকে যখন বরুণার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলো; কবি তখন মুচকি হেসে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। হয়তো তখন কবির সঙ্গে তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বলে। কবি শুধু এইটুকু বললেন, এটা কল্পনা। বরুণা বলে কেউ ছিলনা। তবে পরে আমরা জেনেছি, কবির এক বন্ধুর বোনের প্রতি কবির দূর্বলতা বা ভালোবাসা জন্মেছিল। কবি তার কোন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সে সময়ে একমাত্র বন্ধুর সুবাদে কেবল বন্ধুর বোনের সাথেই কথা বলার বা ভাববিনিময়ের সুযোগ ছিল। হবে হয়ত বরুণা তার কল্পনার নারী। কিন্তু বরুণা বেঁচে আছে সব প্রেমিকের অন্তরে।
কবি কুমার লাভলুকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন, লাভলু তুইতো বিয়ে করলি না। চিরকুমার থেকে গেলি। আচ্ছা, তুই কি নাস্তিক হতে পেরেছিস? কুমার লাভলু বলেছিল, ভয় পাই। পূর্ব পুরুষের ধর্ম ত্যাগ করি কিভাবে? কবি বললেন, জানিস লাভলু ‘আস্তিক হওয়া খুব সহজ; কিন্তু নাস্তিক হওয়া বড়ই কঠিন।’ কথাটায় হাস্যরসাত্মক পরিবেশটা হঠাৎ গুরুগম্ভীর হয়ে উঠলো। গাড়ি বেনাপোল থেকে চলে এল মাদারীপুর। ৭৫ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতে কবি এলেন তার জন্মভিটায়। এটা কবির জন্য যতটা আনন্দের; মাদারীপুরবাসীর জন্য ততটা গর্বের। তিন দিন অবস্থান করে কবি আবার চলে গেলেন তার গড়িহাটির পারিজাতে। রেখে গেলেন স্মৃতি। অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দেশভাগের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে সৌহার্দের মিলনরেখা। কিন্তু সব ছেড়েই তাকে চলে যেতে হলো ২২ অক্টোবর। পড়ে রইল পারিজাত। পড়ে রইল জন্মভিটার সুনীল আকাশ। কেউ কথা না রাখলেও আমরা আগলে রেখেছি তার সুনীল আকাশ সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র এবং সুনীল সাহিত্য পুরস্কার। কবি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার কর্মে। কবি বেঁচে থাকবেন আমাদের মর্মে। আমাদের চিন্তা-চেতনায়, আমাদের উপলব্ধিতে। তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন চিরকাল।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ,
সুনীল সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।

নেই

দুলাল সরকার
(সদ্যপ্রয়াত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় স্মরণে)

গৃহপালিত সকল শব্দের মধ্যে
‘নেই’ শব্দটি বড় বেশি কাছের
ও একি সাথে দূরের যেন দিগন্তের ওপাড়ে
এক বাস্তুভিটার ’পর মাটি কামড়ে পড়ে থাকা
এক পথের চুপচাপ, স্তব্ধতার হাসি;

‘নেই’ মানে শূন্যের আভাসÑ দৃশ্যান্তরে
বিমূর্ত সত্তার কারুকার্যখচিত পাথরÑ
পাথরে চুম্বন সদৃশ্য কিছু তন্ময় বেদনা,
কিছু অনুভূতি, ধূ ধূ রাত, তেপান্তর নামের বিরহ।
স্বাতীর কপাল লগ্ন চুলের বিদ্রোহÑ
কেউ ছিল, এইমাত্র উঠে যাওয়া
ঘামের গন্ধ নিয়ে ভাঙা বাতাস, অশ্লীল উত্তাপ;
চোরাগুপ্ত হামলার শিকার
অথবা কতটা সত্যÑ ‘নেই’ মানে
বিশ্রী সহ্যের শেষে গুমোট আঁধারে বসে পীড়িত জোছনা;

‘নেই’ মানে গন্ধহীন গোলাপের ভাজ
বিষণœ ত্বকের নিচে বাস্তুহারা ‘নেই’ এর সংবাদ
হারানো চাবির গোছাÑ
অনুমোদনহীন আত্মসমর্পণের দৃশ্য মঞ্চের উপর।
২৪.১০.২০১২

মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১২

কথা না রাখার দু:খ নিয়ে প্রস্থান সুনীলের

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
সকালে ঘুম ভাঙে সাংবাদিক বন্ধু রফিকুল ইসলামের ফোন পেয়ে। কিছুক্ষণ পর কবি দুলাল সরকারের ফোন। তারপর নাট্যব্যক্তিত্ব আ জ ম কামাল। কবি আকন মোশাররফ হোসেনও ফোন দিলেন। সবার একই কথা- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর নেই। অনেকটা বিদ্যুতাড়িত হওয়ার মত। ঝিম মেরে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমরা খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম তাঁকে। তাঁর জন্মস্থানে শেষবারের মত যখন এলেন। অনেক হাসি-আনন্দের স্মৃতি রয়েছে প্রত্যেকের অন্তরে। বন্ধনের সুতোয় যেন টান পড়েছে। কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয়-তাই ছুটে গেলাম তার জন্মভিটায়। একটু স্বান্তনা, একটু শেষ শ্রদ্ধা জানাবার তাগিদে।
‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি’- এভাবেই আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমরা তার কথা রাখার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানি না। ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ’- এভাবে অঅর নিখিলেশকে ডাকবেন না তিনি। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
২২ অক্টোবর রাত ২টায় কলকাতার নিজ বাড়িতে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবর চলে আসে তাঁর জন্মস্থান মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে। তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত পুরো উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ। ভোর থেকেই তাঁর জন্মস্থানে ছুটে আসেন স্থানীয় কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিককর্মী ও সাংবাদিকসহ তাঁর ভক্ত অনুরাগিরা। সবাই শোকাহত। শোকে স্তব্ধ তার সুনীল আকাশ (সুনীল সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র)। তাঁর হাতে লাগানো নারিকেল গাছের চিড়ল পাতা বেয়ে ভোরের শিশির হয়ে ঝরে পড়ছে কবি হারানোর শোক। গাঁয়ের আকা-বাঁকা মেঠো পথে শোকাহত মানুষের দীর্ঘ সারি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেশবিভাগের আগেই ১০-১১ বছর বয়সে কষ্ট আর অভিমান নিয়ে পরিবারের সাথে চলে যান ভারতের কলকাতায়। অনেক বছর পর প্রথম এসেছিলেন ২০০৩ সালে। চারিদিকে তখন অনেক খ্যাতি। তবু তিনি ভোলেননি তাঁর জন্মস্থানের মাটি। তখন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের একাডেমিক ভবনের শুভ উদ্বোধন করার কথা ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নোংরা রাজনীতির শিকার হন তিনি। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করেই অনেক কষ্ট নিয়ে চলে যান কলকাতায়।
এরপর সর্বশেষ ৭৫তম জন্মদিনে ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর এসেছিলেন নিজ গ্রামে। তাঁর জন্মবার্ষিকী ও আগমন উপলক্ষে তিন দিনব্যাপি সুনীল মেলা বসেছিল। চারিদিকে অফুরন্ত উচ্ছ্বাস। নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর সফর সঙ্গী হয়েছিলেন স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, কবি বেলাল চৌধুরী ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনসহ বাংলাদেশ ও কলকাতার অনেক গুণীজন।
তিন দিন অবস্থান করেছিলেন কালকিনির মাইজপাড়ায়। ঘুরে ঘুরে দেখেছেন আর বাল্যকালের স্মৃতি হাতড়ে বেরিয়েছেন। যাবার সময় বলে গিয়েছিলেন-‘কালকিনির মানুষের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি শুধু ওপার বাংলার কবি নই। আমি বাংলা ভাষার কবি।’
আজ তাঁর প্রস্থানে ছুটে গিয়েছিলাম মাইজপাড়ায়। অযতœ অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্র। লতায় জড়িয়ে আছে কবির রোপন করা নারিকেল গাছ। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠল। তবে কি তার স্মৃতিবিজড়িত এসব কালের গর্ভে একদিন বিলীন হয়ে যাবে? আমাদের কি কিছুই করার নেই। তিনি হয়তো আর আসবেন না। তার পদস্পর্শ আর স্মৃতিময় তিনটি দিনকে কি আমরা স্মৃতির ফ্রেমে আটকে রাখতে পারবো না? এমন আকুতি আর সংশয় আজ সবার মনে।
কবির বাল্যবন্ধু আব্দুর রাজ্জাক কাজী বললেন, সুনীল ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। আজ সে চঞ্চলতা চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল। বাবারা তোমরা ওর স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একটু ব্যবস্থা করো। আমরা চাই সুনীল মেলা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হোক। তার স্মৃতি অম্লান থাকুক। তিনি জানালেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জন্মস্থানে এসে গ্রামসহোদর কানাডা প্রবাসী লেখক রাজ্জাক হাওলাদারের বাড়িতে ছিলেন। তারা তাঁর পছন্দের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। কবি খাল-বিলের মাছ খুব পছন্দ করতেন। কৈ, শিং ও মাগুর মাছ ছিল তাঁর প্রিয়।
আমাদের পেয়ে এলাকাবাসী একটি দাবি জানায়। আমরাও তার সাথে ঐকমত্য পোষণ করি। সে দাবিটি হলো- তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বালিগ্রাম ইউনিয়নের পাথুরিয়া পাড় থেকে মাইজপাড়া পর্যন্ত সড়কটি ‘সুনীল সড়ক’ নামে নামকরণ করা হোক। তিনি বেঁচে থাকুক আমাদের মাঝে। সুস্থ্য থাকলে এবারের সুনীল মেলায় তাঁর আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সংস্কার প্রয়োজন। সুনীল মেলা যাতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মেলা থেকে যেন আমরা কিনতে পারি কবির প্রিয় রয়্যাল গুলি, লাঠি-লজেন্স। তাহলে হয়তো আমরা তাঁর কথা রাখতে পারবো। যে কথা বরুণা রাখতে পারেনি। আমরা তা রাখার চেষ্টা করবো। দুরন্ত ষাড়ের চোখে বাঁধবো লাল কাপড়। খুঁজে এনে দেব একশ’ আটটা নীল পদ্ম। জয়তু সুনীল দা। আশির্বাদ করো- আমরা যাতে তোমার কথা রাখতে পারি।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

রবিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১২

অসমাপ্ত কথা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

১.
যার সাথে তোমার আজন্ম শত্র“তা
তার সাথে তোমার চির বসবাস,
যাকে দেখলে তুমি আঁৎকে ওঠ
পুলকিত করবে তার পরশ।

২.
ছাই ভেবে যেই ছুঁতে গেলাম
হয়ে গেল সোনা,
ভালোবাসি তোমায় শুধু
আর কিছু বলবো না।

৩.
চিটচিটে বালিশ
খিটখিটে মেজাজ
ছেঁড়া কাঁথা-কম্বল,
ফুটো মশারী
বিরহী সুখ
এসবই আজ সম্বল।

কালকিনি, মাদারীপুর
২২.১০.২০১২

মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০১২

অবহেলিত আজ মানুষ গড়ার কারিগর

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
বাদশাহ আলমগীর তাঁর ছেলেকে বিদ্যা অর্জনের জন্য দিল্লীর এক শিক্ষকের কাছে দিয়েছিলেন। একদিন সকাল বেলা তিনি ছেলেকে দেখতে শিক্ষকের বাড়ি গেলেন। গিয়ে দেখলেন তাঁর ছেলে শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে আর শিক্ষক নিজ হাতে পা ধুয়ে নিচ্ছেন। এটা দেখে তিনি কিছু না বলে চলে এলেন। পরে শিক্ষককে ডাকলেন। বললেন, আপনি কাজটি ঠিক করেন নি। এ কথায় শিক্ষক ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন, বাদশাহর ছেলেকে দিয়ে কাজ করিয়েছি। নিশ্চয়ই মহা অন্যায় হয়ে গেছে। তিনি তার অপরাধ জানতে চাইলেন। বাদশাহ আলমগীর তখন বললেন, আপনি আমার ছেলেকে আদব-কায়দা কিছুই শেখান নি। আমার ছেলে শুধু আপনার পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছিল। তার তো উচিৎ ছিল নিজ হাতে আপনার পা ধুইয়ে দেওয়া।
এতো অনেক আগের কথা। গল্পের মতো মনে হয়। আমরা কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় এ ঘটনা জেনেছি। ইতিহাসও সাক্ষী। এখন বাদশাহ আলমগীরের যুগ নেই। তাই বলে কি শিক্ষকদের মর্যাদাও নেই। ইতিহাস আজ ভিন্নভাবে লিখতে হয়। সে ইতিহাস শিক্ষকদের অবহেলার ইতিহাস। লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের ইতিহাস। আমরা অতীত ভুলে যাচ্ছি। সরকার বাহাদুরই শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে জানেন না। তার পোষা সন্তানেরা কীভাবে শিক্ষকের মর্যাদা দিবে। তা নাহলে গত চার অক্টোবর সরকার বাহাদুরের পোষা পেটোয়া পুলিশ সন্তানেরা কীভাবে শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলে। এ কথা লিখতে গিয়ে যেখানে আমাদের হাত কেঁপে উঠছে। সেখানে তাদের বুক এতটুকুও কাঁপলো না।
নিয়তির নির্মম পরিহাস! যে পুলিশের হাতে আজ শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছে, তারা কোন না কোন শিক্ষকের ছাত্র ছিল। তাদের মানুষ করার দায়িত্ব ঐ শিক্ষকরাই নিয়েছিল। আজ প্রাক্তন ছাত্রদের ছোড়া কাদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও লাঠিপেটার যন্ত্রণা নিয়ে পরদিন চোখের জলে পালন করতে হলো বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকরা দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তাঁরা হয়ত তাঁদের বেয়াদব ছাত্রদের বরাবরই ক্ষমা করে দেন। কিন্তু বিবেকবান মানুষ এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের যথাযোগ্য শাস্তি কামনা করেন। বাকিটা নির্ভর করে সরকার বাহাদুরের ওপর। কারণ এ ব্যর্থতা তার এবং এমন আচরণের দায়ভারও তার। জাতির এমন কলঙ্কজনক অধ্যায়ের যেন আর পুণরাবৃত্তি না ঘটে- এ প্রত্যাশা সকলের। 
‘যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত’-কথাটাকে আজ উল্টে বলার সময় চলে এসেছে। তাই অতীব দুঃখের সাথে বলতে হয়-‘যে জাতি যত বেশি শিক্ষকদের পেটায় সে জাতি তত বর্বর।’ এটাই আজ নির্মম বাস্তব সত্য। এটা অস্বীকার করার কোন পথ বা উপায় নেই।
সরকার বাহাদুর আইন করে শিক্ষকদের হাত থেকে বেত বা লাঠি কেড়ে নিয়েছেন। সে লাঠি আজ তাদের পিঠেই। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়-‘বাহ! কী চমৎকার দেখা গেল।’ শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীকে পেটানো বা কোন রকম সাজা দেওয়া আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। শিক্ষকরা তা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু রাজপথে পুলিশ দ্বারা শিক্ষক পেটানো কি অপরাধ নয়? এমন অপরাধও কি মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। শ্রেণীকক্ষের বাইরে প্রাইভেট পড়ানো কিংবা কোচিং করানো সরকার বাহাদুর অবৈধ ঘোষণা করেছেন। শিক্ষকরা তাও মেনে নিয়েছেন। তাহলে শিক্ষকদের দাবি সরকার বাহাদুর কেন মেনে নেবেন না। মেনে নিলে তো আজ এ রকম লজ্জাজনক ইতিহাস লিখতে হতো না।
শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষার্থীর মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার চেয়ে শিক্ষকের অবদানই বেশি। এ কথা আমরা স্বীকার করি কিন্তু ক্ষমতার দম্ভে তা মানতে চাই না। ভুলে গেলে চলবে না- শিক্ষকেরা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। অথচ পুলিশি নির্যাতনের পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসে শিক্ষকরা তাদের আন্দোলন স্থগিত করে দিলেন। তারা ইচ্ছা করলে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারতেন। শুধু শিক্ষার্থীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে বুকে-পিঠে ক্ষত নিয়েও পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী মেনে নেবেন তাদের দাবিগুলো? গত রোববার বা সোমবার শিক্ষকদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর বসার কথা ছিল। কিন্তু বসা হয় নি। কেন বসা হয় নি, সে কারণ হয়ত অজ্ঞাত। তবে কেন এই মিথ্যা আশ্বাস? নাকি জাতির প্রধান চালিকাশক্তির চাঁকা স্তব্ধ করে দেবার প্রয়াস। তাঁর আশ্বাসের ফলাফল কী হবে? এটাই এখন দেখার বিষয়।
আমাদের শিক্ষকরা এতো অবহেলিত কেন? যুগ যুগ ধরে তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে কেন? জাতির মেরুদন্ডকে সচল রাখতে নিরলস পরিশ্রম করেও যথাযোগ্য পারিশ্রমিক হতে তারা বঞ্চিত কেন? যদিও শিক্ষকতাকে অপরাপর পেশার মানদন্ডে পরিমাপ করা যায় না বলে অনাদিকাল থেকে এটি মহান পেশা হিসাবে সমাজ-সংসারে পরিগণিত। তারপরও সেই ‘তালসোনা পুরের তালেব মাস্টারের অবস্থার’ আর পরিবর্তণ হয় না। শিক্ষকদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটে না। যুগের সাথে, দ্রব্য মূল্যের উর্দ্ধগতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হয়।
সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতা গুরুত্বপূর্ণ পেশা হলেও জাতীয়ভাবে শিক্ষকদের তেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। যুগের পর যুগ বহতা নদীর মতো বয়ে গেলেও শিক্ষকদের নির্মম ভাগ্যের কোন পরিবর্তণ আজও ঘটে নি। শিক্ষকদের প্রতি কেন এই উদাসীনতা? অথচ তাঁরা প্রদীপের মতো অন্যকে আলোকিত করে নিজেরা জ্বলে জ্বলে নিঃশেষিত হন। একথা এজন্য বলতে হয়- যখন বিশ্ব শিক্ষকসমাজ যুগোপযোগী ও উন্নত শিক্ষার কথা ভাবছেন, তখন আমাদের দেশের শিক্ষকসমাজ অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন করছেন। কারণ গোটা শিক্ষাব্যবস্থার নব্বই ভাগ নিয়ন্ত্রণকারী বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থসামাজিক অবস্থান অনেকটাই অবহেলিত। ফলে ইউনেসকো-আইএলও সনদের ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ এবং অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
বিভিন্ন সময়ে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও আমাদের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও কোন শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন তো দূরের কথা গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি। একটি স্বাধীন জাতির জন্য এ অবস্থা যেমন দুর্ভাগ্যজনক, তেমনই লজ্জার। বর্তমান সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি -২০১০ প্রণয়ন করলেও এর বাস্তবায়ন সে অর্থে শুরু হয় নি। শিক্ষানীতিতে অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বৈষম্য অবসানের কোন দিকনির্দেশনা নেই।ূ
বর্তমান সরকার যদি শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল, বেসরকারি শিক্ষদের বাড়িভাড়া বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুযোগ, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর জীবনে পেনশনের ব্যবস্থা ও পরিপূর্ণ উৎসব ভাতার মতো শিক্ষানীতির কল্যাণমূলক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে তা হবে জাতির জন্য মঙ্গলজনক। শিক্ষকদের জন্য আশাব্যঞ্জক। পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা না করে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তবেই শিক্ষকরা তাদের মর্যাদা ফিরে পাবেন। সুতরাং আর কোন বঞ্চনা নয়, আর কোন হতাশা নয়। সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক- এ প্রত্যাশা গোটা শিক্ষকসমাজের।
 
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

বুধবার, ৩ অক্টোবর, ২০১২

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’- বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানের এ কথাগুলো আজ মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো। হাজার রছরের পুরনো আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগকেও হার মানিয়েছে রামুর সহিংসতা। রামুর ঘটনার জন্য আমরা কাকে দায়ি করবো? নিশ্চয়ই উগ্রতা আর ধর্মান্ধতাকে। আর ব্যর্থতা প্রশাসনের। দায়ভার অবশ্যই সরকারের। এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকের কারণে নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম। সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্কজনক অধ্যায়। তবে অবাক হতে হয় যখন রাজনৈতিকভাবে এ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়। যা অনভিপ্রেত। রামুর সহিংসতা নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দল এখন দাবা খেলায় মেতে উঠেছে। দাবার গুটি বানানো হচ্ছে নির্যাতিত সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে।
বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ ধর্মীয় সম্প্রীতি আমাদের উজ্জ্বল ঐতিহ্যের অংশ। পৌষ-পার্বণে কিংবা ঈদ উৎসবে বুকে বুক মিলানোর ইতিহাস আমাদের পুরনো। অথচ অতি উৎসাহি কিছু ধর্মান্ধ মানুষের জন্য সে সম্প্রীতি ভেঙ্গে চুড়মাড় হয়ে গেল। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত আটটার দিকে কক্সবাজারের রামু উপজেলার মেরুংলোয়া বড়–য়া পাড়ার উত্তম কুমার বড়–য়ার ফেসবুকে কে বা কারা পবিত্র কুরআন শরিফ অবমাননার একটি ছবি যুক্ত (ট্যাগ) করে। ছবিটি অন্যান্যরাও শেয়ার করে। ফলে রাত দশটার দিকে কয়েক হাজার মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে রামুর চৌমুহনী চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
শুধু প্রতিবাদেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। সমাবেশ শেষে সংঘবদ্ধ লোকজন সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শত বছরের পুরনো ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে। পুড়িয়ে দেয় চল্লিশটির মতো বসতবাড়ি এবং ভাঙচুর করেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। একই কারণে ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পটিয়ায় দু’টি বৌদ্ধবিহার ও একটি হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
হযরত মুহম্মদ(স:) কে নিয়ে নির্মিত ব্যঙ্গ চলচ্চিত্র ‘ইনোসেন্স অফ মুসলিমস’ ও ফ্রান্সের পত্রিকায় প্রকাশিত ব্যঙ্গ কার্টুনের কারণে এমনিতেই মুসলিম বিশ্ব ছিল উত্তপ্ত। ফলে জ্বলন্ত আগুনে তেল ঢেলে দেওয়ার মতোই রামুর এ ঘটনা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ভাঙন ধরাতেই এমন কর্মকান্ড করা হয়েছে বলে বিজ্ঞজনের ধারণা। তবে এ ক্ষেত্রে মুসলমানদের আরো ধৈর্যশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিৎ ছিল কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ কোন এক যুবকের অপরাধের জন্য শতাধিক মানুষের জান ও মালের ক্ষতি সাধন করার ব্যাপারে ইসলামি শরীয়াও হয়ত সমর্থন করবে না। যেহেতু বিষয়টি জানার সাথে সাথে যুবক তার ফেসবুক একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া সে নিজেতো আর ছবি পোস্ট করেনি। কে বা কারা ট্যাগ (যুক্ত) করেছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে এটা বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। যা তৃতীয় পক্ষের দ্বারা সংঘটিত হওয়াটা অমূলক নয়। ঐ যুবক যদি স্বেচ্ছায় করে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেত। এতবড় সহিংস ঘটনার পিছনে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ছিল এটা নিশ্চিত। কারণ একটি অপরাধ হাজারো অপরাধের জন্ম দেয়। কোরআন অবমাননার বিষয়টি মোটেই ছোট কোন অপরাধ নয়। কিন্তু যে ঘটনা ঘটলো তাকেও ছোট করে দেখার উপায় নেই। তাই আমরা বাধ্য হয়েই দু’টি ঘটনাকে অনাকাঙ্খিত ঘটনা বলছি। তবে এভাবে অনাকাঙ্খিত ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটলে সংঘাতময় পরিস্থিতি কোনভাবেই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। ফলে বিশ্বজুড়ে অশান্তির পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা শান্তির পক্ষে-আমরা সম্প্রীতির পক্ষে।
অনাকাঙ্খিত ঘটনা পরিদর্শণে গেলেন সরকারের দুই মন্ত্রী। তাদের বক্তব্যে উচ্চারিত হয় ভিন্ন সুর। সেখানে না আছে শান্তির বাণী না আছে সম্প্রীতির জয়গান। প্রথমেই তাদের দৃষ্টি মৌলবাদী ও বিরোধীদলের ওপর। বিরোধী দলও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তারাও অভিযোগ আনেন ক্ষমতাসীন দলের ওপর। ফলে ঘটনা মোড় নিতে থাকে ভিন্ন খাতে। যেটা সাধারণ নিরীহ মানুষের কাছে কাম্য নয়। দায়িত্বশীল দু’টি দল বা ব্যক্তির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সহিংসতা দীর্ঘজীবি হোক- এটা কারোই কাম্য নয়। এতে হয়ত প্রকৃত দোষিরা ছাড়া পেয়ে যাবে। আর দুর্ভোগ পোহাবে নিরীহ শান্তিপ্রিয় কিছু মানুষ। গ্রামীণ প্রবাদের মতো-‘পাটা-পুতায় ঘঁষাঘঁষি মরিচের শ্যাষ’ হওয়ার মতো অবস্থা ছাড়া আর কি হতে পারে। তবে ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবি- এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার হোক। যাতে এমন কলঙ্কজনক অধ্যায়ের পুণরাবৃত্তি না ঘটে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দিন খান আলমগীর ঘটনাস্থল পরিদর্শণ শেষে এক সমাবেশে বলেছেন,‘সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে মন্দিরে হামলা করেছে।’ কিন্তু জামায়াতের সেক্রেটারি জি এম রহি মোল্লা বলেছেন,‘ফেসবুকে ছবি প্রকাশ হওয়ার পর রামুতে যেসব মিছিল-মিটিং হয়েছে, সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন আওয়ামীলীগের নেতারাই।’ বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বঙ্কিম বড়–য়া দাবি করেন,‘ পুলিশ শুরু থেকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। রাত তিনটার পর সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মাঠে না নামলে অবশিষ্ট মন্দিরগুলোও রক্ষা করা সম্ভব হতো না।’ রামু উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার বলেন,‘ জামাত-শিবির মৌলবাদী চক্র এঘটনার সাথে যুক্ত থাকতে পারেন’। তাই যদি হবে তবে আপনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কী ভূমিকা রেখেছিলেন। এ প্রশ্ন এখন সকলের মনে।
তাছাড়া পুলিশ যদি সময়মতো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে না পারে এমনকি চেষ্টাও যদি না করে তাহলে সরকারের এত টাকা ব্যয় করে পুলিশ পোষার দরকার কী? আর যারা এখন পরস্পর বিরোধী কথা বলেন; ঘটনা ঘটার আগে তারা কি কোন আলামত পাননি। তাহলে আপনারা বসে বসে কি করছিলেন? তামাশা দেখছিলেন। চোখের সামনে কীভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতিগত সভ্যতা।
আসলে আমরা কেউ নির্দোষ নই। ‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপাতেই আমরা ওস্তাদ। ধ্বংসলীলা দেখে আমরা মর্মাহত হইনা। আমাদের মানবতা আজ পাথরের নিচে চাপা পড়ে গেছে। ধর্মান্ধতা আর গোড়ামী আমাদের মনুষ্যত্বকে গলা টিপে হত্যা করেছে। এর কি কোন প্রতিকার নেই। সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে প্রকৃত দোষিদের বিচারের আওতায় আনা কি সম্ভব নয়। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির নোংড়া খেলা কি কখনোই শেষ হবার নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আসুন আমরা অসহায় নির্যাতিত মানুষের পাশে দাড়াই। খোলা আকাশের নিচে যে শতাধিক মানুষ অন্নহীন-বস্ত্রহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে-তাদের মাথার ওপরে একটু ছায়ার ব্যবস্থা করে দেই। আমার কী তাও পারবো না? আসলে মানুষ না ধর্ম; আমরা কোন দিকে যাবো? সবশেষে বাউল শাহ আব্দুল করিমের সুরে বলতে হয়-‘করি যে ভাবনা, সেদিন আর পাব না। ছিল বাসনা সুখি হইতাম। দিন হতে দিন, আসে যে কঠিন। করিম দীনহীন কোনপথে যাইতাম। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। আমরা আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

লাবণ্যময়ী অন্ধকার

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

অন্ধকারের কী এমন বিশেষত্ব আছে?
আমি জানিনা। তবে এইটুকু জানি,
রোজ অন্ধকার হাতড়ে খুঁজে পাইÑ
ফেলে আসা স্মৃতির টুকরো,
উঁইপোকায় খাওয়া সুখের বান্ডেল,
ইঁদুরে কাটা প্রেমের চাঁদর,
বানের জলে ভেসে যাওয়া আশা।
কভূ মনে হয়, অন্ধকার আছে বলে
তবুও তো কিছু পাওয়া যায়। তাই
অন্ধকারের লাবণ্যে আমি নিখোঁজ হইÑ
কারণ অন্ধকার আমাকে ঝাপটে ধরে
হারানো প্রেয়সি- øেহময়ী জননী-
অভিমানী বোন আর লাজুক খুকীর মতো।

মঙ্গলবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২

আবুলের বাগানে গোলাপের সৌরভ

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বারবার হোচট খাওয়াকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী এলাকা মাদারীপুর-৩ আসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারি আব্দুস সোবহান গোলাপ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে উঠেছেন। হঠাৎ করে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’র মতো নিজ এলাকায় গণসংযোগ, শুভেচ্ছা বিনিময়সহ বিভিন্ন কর্মকান্ড শুরু করেছেন। দল ক্ষমতায় আসার তিন বছর পরে হঠাৎ করে গোলাপের এমন কর্মকান্ডে স্থানীয় আওয়ামীলীগ পড়েছে মহা বিপাকে। গোলাপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের দোহাই দিয়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। ফলে স্থানীয় আওয়ামীলীগ এখন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। যা আগামী নির্বাচনে কাল হতে পারে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সুত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ি, মাদারীপুর-৩ (কালকিনি-সদর) নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামীলীগের বর্তমান সাংসদ ও সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ২৪ বছরের দূর্গ ভাঙতে আব্দুস সোবহান গোলাপের সাথে স্থানীয় আওয়মীলীগ, বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন সংগঠনের বঞ্চিত নেতারা হাত মিলিয়েছেন। আবুল হোসেনের মন্ত্রিত্ব হারানো, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি ও মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগকে পুঁজি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন বলে দাবি আবুল হোসেন পন্থিদের।
স্থানীয় আওয়ামীলীগ এখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল সুবিধাভোগি অন্যদল সুবিধা বঞ্চিত। ফলে আওয়ামীলীগের বঞ্চিত নেতারা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চান, সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনির উন্নয়নের জন্য কিছুই করেন নি। তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবাসীদের মধ্যেও এ তথ্য প্রচার করছেন। কালকিনি ছাড়াও সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা দেখে জনগণের মনে প্রশ্ন জাগে, সারাদেশের কথা বাদ দিলেও আবুল হোসেন তার নিজ এলাকার জন্যও কিছুই করেন নি। সঙ্গত কারণে মানুষের মনে ক্ষোভ দেখা দেয়। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও তার ব্যর্থতার চিত্র ফুটে ওঠে। বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। তারা প্রতিদিন পত্রিকা পড়েন। টেলিভিশনে নিয়মিত খবর দেখেন। তারা এখন চায়ের দোকানে বসে সংবাদ দেখে স্বিদ্ধান্ত নিতে শিখেছেন। আবুল হোসেন না সোবহান গোলাপ। কে হবেন কালকিনির আগামী রাজনীতির কান্ডারী।
পদ্মা সেতুর ব্যর্থতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ বঙ্গের মানুষ। সময় মতো প্রতিশ্র“তির বাস্তবায়ন না করা তার ব্যর্থতা। যা শুধু স্থানীয় রাজনীতি নয় জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন সবাই। দুর্নীতির কথা বাদ দিলেও এ ব্যর্থতার দায়ভার কখনোই এড়ানো সম্ভব নয়। যদিও লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৈয়দ আবুল হোসেনকে ‘একজন দেশপ্রেমিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশের বৃহৎ স্বার্থেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। তবে জনগণ এখনো বুঝে উঠতে পারেনি যে, বিশ্ব ব্যাংক এত অভিযোগ করার পরও কেন প্রধানমন্ত্রী তাকে দেশ প্রেমিক বললেন। তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন কোন দিকে যাবে? স্থানীয় রাজনীতিইতো এখন হুমকির মুখে।
এদিকে আব্দুস সোবহান গোলাপের অনুসারিরা কালকিনির আওয়ামীলীগের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিরোধী দলের সাথে আওয়ামীলীগের কোন রকম সংঘাত-সংঘর্ষ না থাকলেও নিজ দলের সাথে সংঘর্ষের কারণে তিনটি মামলা হয়েছে। নিজ দলের নেতা-কর্মীরা মার খেয়েছেন, জেল খেটেছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীরা। তারা দাবি করেন, গোলাপ একটি সাজানো গোছানো দলের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। যেখানে সৈয়দ আবুল হোসেন চার বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন; সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হয়ে উপজেলা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ ছাড়া বঞ্চিতদের নিয়ে কীভাবে ঈদ শুভেচ্ছা জানান।
যে কারণে গত ৩১ জুলাই কালকিনির এনায়েতনগরের খালেকেরহাটে আবদুস সোবাহানের গণসংযোগে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীরা বাধা দিয়েছেন। স্থানীয় মহিলারা ঝাড়– মিছিল করে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এসময় দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। যা কালকিনির রাজনৈতিক ইহিাসে প্রথম। তাই সচেতন মহল মনে করেন, আবুল হোসেনের সাজানো বাগানে এখন গোলাপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে। হয়ত আগামীতে সে গোলাপ সৌরভ ছড়াবে। হতে পারে তা স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে। এখন অপেক্ষা শুধু সময়ের। ‘কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়’ তা দেখার জন্য উৎসুক হয়ে আছে তৃতীয় পক্ষ।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী

শুক্রবার, ২৪ আগস্ট, ২০১২

শিশুতোষ মঞ্চ নাটক: উভয় সঙ্কট

রচনা- সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, 
পরিচালক, প্রথমা রঙ্গমঞ্চ, কালকিনি।
আলাপ- ০১৭২৫৪৩০৭৬৩, ০১৮২৯৭৬৭২৫৮
প্রযোজনা- ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ,কালকিনি এডিপি।
পরিবেশনা- শিশু ফোরাম, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ,কালকিনি এডিপি।
চরিত্র: অভি,রনি,নুসরাত,জাকির,রাজিয়া,পুলিশ,আকাশ ও আফিয়া
প্রথম দৃশ্য:
রাস্তায় অভি ও রনি দাঁড়িয়ে আছে। কারো জন্য অপো। এদিক ওদিক তাকায়। এমন সময় নুসরাতের আগমন।
অভি: দোস্ত, ওই যে তোর পেয়ারের নুসরাত আইতাছে।
রনি: কই, কই?
অভি: আরে ওইযে, দ্যাক্ চাইয়া।
রনি: ইয়েস, তাইতো। কিন্তু মাইয়ারতো অনেক দেমাগ। মা মারা মাইয়া, কেবল কাস নাইনে পড়ে। তাতেই ভাব কত দ্যাকছোস?
অভি: হ্যা, লাইনে আনতে সময় লাগবো। ছোট মানুষতো। তাছাড়া তোর তো আবার রেকর্ড ভালো না। (কাছাকাছি আসলে গতিরোধ করে)
অভি: দাড়াও নুসরাত, রনি তোমারে যা কইছে তার উত্তর দিয়া যাও।
নুসরাত: আমি তার সাথে কথা বলতে রাজি নই। আমিতো আগেই বলেছি আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না। তাহলে বাবার কাছে বলতে বাধ্য হব।
রনি: ডিস্টার্ব, কিসের ডিস্টার্ব। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। এতে বাবার কাছে বলার কি আছে?
নুসরাত: দ্যাখ তোমরা ডিস্টার্ব কর বলে এই অল্প বয়সে বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মেয়ে বলে কি এ সমাজে আমাদের কোন অধিকার নাই।
রনি: আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
নুসরাত: অসম্ভব। তোমার মতো একটা বখাটেকে বিয়ে করবো আমি। মরে গেলেও না। তোমার জন্য তায়েবা আত্মহত্যা করেছে। তুমি জেল খেটেছো। জেল থেকে বের হয়ে আমার পিছু নিয়েছ। আর এখনোতো আমার বিয়ের বয়সই হয়নি।
রনি: তোমাকে পেলে আমি ভালো হয়ে যাব।
নুসরাত: যে ভালো হবার সে এমনিতেই হয়। আমার পথ ছাড়ো। বাবা আামার জন্য বসে অছে।
রনি: তুমি আমার সাথে চল। আমি আজ তোমাকে নিয়ে যাব। (হাত ধরে)
নুসরাত: অসম্ভব। ( থাপ্পড় দেয়) (নুসরাতের প্রস্থান)
রনি: (গালে হাত দিয়ে) আমি তোকে দেখে নেব শালি। তোর জীবন আমি তছনছ করে দেব। তোর সংসারে আগুন লাগিয়ে দেব। হু.. কত বড় সাহস, রনির গায়ে হাত তোলে।
অভি: আমি জানতাম, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, আঙুল একটু বাকা করতে হবে। চল, একদিন না একদিন এর খেসারাত ওকে দিতে হবে। রাজিয়ার সাথে কথা বলে প্ল্যান করতে হবে। আর সুযোগের অপোয় থাকতে হবে। (প্রস্থান)

দ্বিতীয় দৃশ্য:
নুসরাতের চুলের মুঠি ধরে নিয়ে আসে জাকির। ছুঁড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। নুসরাত উবু হয়ে কাঁদতে থাকে।
জাকির: ইকটু খানি মাইয়া তার আবার বড় বড় কথা। আমার টাকা চাই টাকা। টাকা কই? আনতে পারোস নাই। পারবি কেমনে? বাপের থাকলে তো। বিয়ার সময় তো বড় বড় কতা কইছিলো তোর বাপ।
নুসরাত: আর কত দিব। দিতে দিতে তো বাপজান জমি-জিরাত সব বেইচ্যা দিছে। আর পাইবো কই।
জাকির: টাকা কই পাইবো, তা আমি কি জানি। টাকা দিতে না পারলে সোজা বাপের বাড়ি চইলা যা। ( জাকিরের প্রস্থান)
নুসরাত: হ যামু, এই নরকের মধ্যে আর এক মুহূর্তও থাকমু না। ( নুসরাতের প্রস্থান।)
(রাস্তায় পূর্ব পরিচিত রাজিয়ার সাথে দেখা।)
রাজিয়া: কিরে নুসরাত তোর খবর কি?
নুসরাত: আপা আমার সব শ্যাষ অইয়া গেছে।
রাজিয়া: ক্যান কি অইছে?
নুসরাত: দ্যাহো আপা, বখাটে রনির ভয়ে বাজানে অল্প বয়সে বিয়া দিলো। লেখাপড়া বন্ধ অইলো। এহন আবার যৌতুকের কারণে আমার স্বামী বাড়ি থিকা বাইর কইরা দিলো। আামি এহন কি করুম আপা। আমারতো উভয় সঙ্কট।
রাজিয়া: ও তাই। যাক, তুমি কোন চিন্তা কইরো না। আচ্ছা চাকরি করবা তুমি?
নুসরাত: চাকরি? কেডা দিবো আমারে চাকরি।
রাজিয়া: সেই ব্যবস্থা আমি করুম। শোন, শহরে আমার পরিচিত একজন আছে। একটা এনজিওর জন্য কিছু মেয়ে চাইছিলো। দাড়াও ফোন দিয়া দেখি। (ফোন দেয়)
হ্যালো, দাদা আমি রাজিয়া। হ হ । একটা মেয়ে আছে।  হ হ । পারবো।  না না ।  কোন চিন্তা নাই। হ হ । আমি কাইল নিয়া আসবো। হ হ  । রাখি। ( ফোন রেখে)
হ কাজ হয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে কালকে যেতে বলেছে।
নুসরাত: এহন তাইলে আমি কই যামু। এইভাবে বাজানের কাছে যাইতে পারমু না।
রাজিয়া: আচ্ছা তাইলে চল আমার বাসায়।
নুসরাত: হ, তাইলে তোমার বাসাতেই চলো।
রাজিয়া: হ, খালি এক রাইতের ব্যাপার। সকালে তো তোওে নিয়া শহরেই চইলা যামু। তারপর নতুন জায়গা, নতুন চাকরি, নতুন দুনিয়া। (প্রস্থান)

তৃতীয় দৃশ্য:
নুসরাত ও রাজিয়া শহরে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়। এমন সময় পুলিশসহ আকাশ ও আফিয়ার আগমন। পুলিশ দেখে রাজিয়া পালাবার পথ খোঁজে। পুলিশ রাজিয়ার পথ আগলে দাঁড়ায়Ñ
পুলিশ: দাঁড়ান, আপনি রাজিয়া?
রাজিয়া: (এদিক ওদিক তাকিয়ে) ক্যান বলুন তো।
নুসরাত: হ্যা সার, ওনার নাম রাজিয়া। আমারে চাকরি দিব। আমারে নিয়া শহরে যাইব।
পুলিশ: (নুসরাতের উদ্দেশ্যে) ও আপনাকে মিথ্যা বলেছে। (রাজিয়ার উদ্দেশ্যে) রাজিয়া নারী ও শিশু পাচারের অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।
রাজিয়া: অফিসার আপনি ভুল করছেন।
পুলিশ: না সব প্রমাণ নিয়েই আমরা এসেছি। এর আগে আপনি পাঁচ জন নারী ও শিশুকে পাচার করেছেন। (আকাশকে উদ্দেশ্য করে) আকাশ তোমরা নুসরাতকে নিয়ে বাড়ি গিয়ে ওর বাবাকে নিয়ে থানায় এসো। রাজিয়া আপনি থানায় চলুন। (প্রস্থান)
আকাশ: নুসরাত তুমি অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছ। রাজিয়া ভালো মেয়ে নয়। ও কাজ দেওয়ার কথা বলে মেয়েদেও নিয়ে বিক্রি কওে দেয়।
আফিয়া: হ্যা নুসরাত, আকাশ ঠিকই বলেছে। তোমার বিপদের কথা আমরা শুনেছি । তুমি চিন্তা করো না। আমারা তোমাকে ওয়ার্ল্ড ভিশনে নিয়ে যাব। আমাদের সাথে তুমিও কাজ করবে।
নুসরাত: ( আফিয়াকে জড়িয়ে ধরে) তোমরা আমাকে বাঁচাও। আমি বাঁচতে চাই। বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। অঅমি আমার অধিকার চাই।
আকাশ: সব হবে। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ অবহেলিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে। শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে।
আফিয়া: সে সব পরে হবে। আগে চলো ওর বাবার কাছে যাই। তার কাছে সব ঘটনা খুলে বলে তাকে নিয়ে থানায় যেতে হবে। থানার কাজ শেষ হলে তাকে নিয়ে আমাদের অফিসে যাব।
আকাশ: হ্যা চল, (দর্শকের উদ্দেশ্যে) আপনারা শুনুন, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ শিশুদের পরিপূর্ণ জীবন গঠনের জন্য কাজ করে।
আফিয়া: আসুন, শিশু ফোরামে যুক্ত হোন। শিশু অধিকার নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসুন।
সবাই: ‘আর সইব না অত্যাচার, ফিরিয়ে আনবো অধিকার।’
(সবাই ফ্রিজ)

বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১২

জন্মভূমি

আশ্রাফুন নাহার

তোমার আমার জন্মভূমি
তোমার আমার মা,
তোমার আমার স্বপ্ন আশা
দুঃখ- বেদনা।
তোমার আমার মুখের হাসি
দু’চোখ ভরা জল,
এদেশ মোদের সুখের আকাশ
তারায় ঝলমল।
তোমার আমার রক্ত দেহের
বেঁচে থাকার শ্বাস,
জন্মভূমি বাংলা মোদের
বসন্তের আশ্বাস।

সাধারণ সম্পাদক, খেলাঘর আসর,
খাসের হাট শাখা, কালকিনি।

শীত আসবে উড়ন্ত পাখির ডানায়

হেনরী স্বপন

যে পাখিরা এলো পুচ্ছ নাড়িয়ে ডানায় ;
এরাই যে শীত খুঁজে এনেছে গরমকাল
থেকে বরফের চাক...

যেখানে কিছু পালক Ñফাটলে রেখেছি গুঁজে
কিছু বেখেয়ালে পুড়ে গেছে ;
গোপন মনিটরে আগুন ছিলো
নম্বরগুলো ঘেমে উঠলে
অবয়ব চিনে রাখা ভালো : ০১৭১-৪৫৩২৩৯...

হ্যাঁ... বলুন ; প্রচন্ড শীতের অতীত এখনো
মনে আছে ; লিখেই জানাবো...

এখনো খড়ের তাপ শুকোয় নি ;
নিুাঞ্চলে ডাকাত পড়বে বলেÑ ধানক্ষেতে
আজও জোয়ারের জল নামে...

হিংস্রতায় ভরা সাইবার গেমগুলো
ঘিরে আছে মৃত্যুকাল !
বিপন্ন শব্দের কুয়াশায় ; হিম গায়ে গরম পোশাকে

এতোবার রিং-টোন পাল্টালে ;
তবে- বুঝি ? শীত আসবে উড়ন্ত পাখির ডানায়।

১৩.১০.২০১০ ইং।

সোমবার, ১৩ আগস্ট, ২০১২

আমি কোন জীবন পাব



সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

আমার একদিকে অনল
আমার অন্যদিকে সাগর
আমি কোন পথে যাব?

আমার এক হাতে গরল
আমার অন্য হাতে মরণ
আমি কোনটা বেছে নেব?

আমার এক পাশে কাঁটা
আমার অন্য পাশে নরক
আমি কোন দিকে যাব?

আমার এক পৃথিবী লাঞ্ছনার
আমার অন্য পৃথিবী হতাশার
আমি কোন পৃথিবী চাইব?

আমার এক জীবনে যৌনতা
আমার অন্য জীবনে ভালোবাসা
আমি কোন জীবন পাব?

বুধবার, ৮ আগস্ট, ২০১২

শ্রদ্ধাঞ্জলি:শিল্পী এস.এম সুলতান

আ. জ. ম কামাল:
কিছু কিছু মানুষ সমাজ সংস্কৃতি, জাতি তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চলমান বিশ্বের সৃজন ধারায় কিছু অবদান রেখে যান যা আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃতির মতই øিগ্ধতায় অনুভবে অনুরণন তোলে। ত্যাগ আর সেবার সারল্যতায় সংস্কারের বেড়াজাল ভেঙ্গে ফুলের মত নির্মল শিশুদের থেকে শুরু করে দিন মান খেটে খাওয়া ফুটিয়ে তোলেন রঙ আর তুলির আলতো পরশে ক্যানভাসের পাতায়,ফুটিয়ে তোলে মানবতার আকুতিকে সংগ্রাম আর সহনশীল ভালবাসায় উদ্দীপ্ত চেতনার মধ্য দিয়ে। তেমনি একজন মানুষ একজন শিল্পী এস এম সুলতান।
আমার সাথে এ মহান শিল্পীর পরিচয় করিয়ে দেন গণসঙ্গীত শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর। একুশে বই মেলায় গিয়েছিলাম আমার দুই বন্ধু তোফাজ্জেল হোসেন হিরু ও ফজলুর রহমান। আলমগীর ভাই বলেন সালাম কর। আমি তাই করলাম। কালো রংয়ের সালোয়ার, পাঞ্জাবী, ওড়না পড়া মেয়েদের মত মাথায় বড় চুল। আমার মধ্যে জানার ভীষণ আগ্রহ। ফকির ভাই বলেন, আমার পীর। পৃথিবীর বড় মাপের চিত্রশিল্পী। একা একা থাকেন। মাঝে মাঝে তার কাছে যেও। ভোলা মনের মানুষ। কিছু পরে মহিউদ্দিন ফারুকী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, খ. ম. হাসান, শামীম শিকদার, কামরুল হাসানসহ আরো গুণীজন এলেন। আমরা সবাই তাদের কথা শুনছিলাম। এক ফাঁকে সালাম দিয়ে শিল্পীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম।
তারপর থেকে রোজ একুশে বই মেলায় যেতাম সুলতান সাহেবের সাথে কথা বলতে, জানতে। মাঝে মাঝে তার বাসায় যেতাম। এস এম সুলতান সবার সাথে আপনি বলে কথা বলতেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক একবার বলেছিলেন,‘লাল মিয়া মানে এশিয়া’। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, ‘এস এম সুলতানকে যে চিনবে সে এশিয়াকে চিনবে।’ চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান জ্বীদ্দশায় তার প্রতিভার স্বীকৃতি যে পাননি তা নয়। ১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ম্যান অব দ্যা ইয়ার অর্থাৎ বছরের শ্রেষ্ঠ মানব ঘোষণা করে। এ ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট এবং এশিয়া উইক পত্রিকা কর্তৃক ম্যান অব এশিয়া সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৮১ সালে তাকে আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্ট ঘোষণার মাধ্যমে সম্মানিত করে।
এস এম সুলতানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামে। বাবা রাজমিস্ত্রী মেছের আলী। বাবা তার নাম রাখেন লাল মিয়া।
৫ বছর বয়সে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে লাল মিয়া ৫ম শ্রেণিতে পড়েন। সে সময় ড. শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় আসেন স্কুল পরিদর্শনে। লাল মিয়া তার একটি পোট্রেট এঁকে তাকে দেন, সবাই মুগ্ধ। পড়ার ফাঁকে বাবাকে সাহায্য করতেন তিনি। ১৯৩৮ সালে অজানার উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন লাল মিয়া। বাড়ি তাকে ধরে রাখতে পারেনি। সোজা চলে এলেন কোলকাতায়। কোলকাতার ভবানীপুর রুবী স্টুডিওর মালিক ছিলেন তার স্কুলের শিক। কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্যের বাড়ি সেখান থেকে একদিন হাজির হন নড়াইল জমিদারদের কোলকাতার কাশিমপুরের বাড়িতে। জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় লাল মিয়াকে খুব ভালোবাসতেন, øেহ করতেন। তাকে জানালেন তিনি আর বাড়ি ফিরে যাবেন না। তিনি বলেন, জমিদার বাড়ির অরুণ রায়ের মতন শিল্পী হবেন। আর্ট কলেজে ভর্তি হতে মেট্রিক পাশ লাগে। লাল মিয়ার আগ্রহ দেখে অরুণ বাবু ব্যবস্থা করেন। ভর্তি পরীায় লাল মিয়া প্রথম হন। হৈচৈ পড়ে গেল কলেজে। কিন্তু কি হবে। মেট্রিক পাশ ছাড়া ভর্তি হওয়া যাবে না।
জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় এবং অরুণ রায় শহীদ সোহরাওযার্দীর কাছে গিযে ঘটনা বলেন। বিখ্যাত চিত্র সমালোচক শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর্ট কলেজের কার্যকরি কমিটির প্রভাবশালী সদস্য। তার অনুরোধে লাল মিয়াকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে। লাল মিয়ার প্রতিভায় তার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে। তার দামী গাড়িতে করে মাছিমদিয়ার রাজমিস্ত্রীর ছেলে লাল মিয়া প্রতিদিন আর্ট কলেজে যাতায়াত করে।
সময় ১৯৩৮ সাল। জযনুল আবেদিন সে বছর আর্ট কলেজে শিক হিসাবে যোগদান করে। লাল মিয়া ও কামরুল হাসান সহপাঠী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী লাল মিয়ার নাম রাখেন এস এম সুলতান। এ নামেই সে পৃথিবী জোড়া পরিচিতি লাভ করে। সুলতান প্রতিবছর প্রথম হন। কারো কাছে না বলে বেড়িয়ে পড়েন পথে। প্রথমে আগ্রা। পকেটে মাত্র চার আনা। তাজমহলে আসতেই চার আনা শেষ। দারুণ ুধা নিয়ে ছবি আঁকেন। তিনজন আমেরিকান সৈনিককে ছবি এঁকে দিতে হবে। তারা তাকে ১৫০টাকা দেন। সোজা গিয়ে ওঠেন বিসমিল্লাহ হোটেলে। এসময় ড. বি এম জহুরীর সাথে তার পরিচয় হয়। জহুরী তাকে চাকুরী করার অনুরোধ করেন। কাজ ছবি আঁকা। সুলতান রাজী হন এবং তার সাথে চলে যান।
চার মাস পর চলে আসেন দিল্লী। সেখানে এক শিল্পীর বাড়ি এক মাস থাকেন। তাদের সাথে আজমীর শরীফ আসেন। আজমীরে এক মাস থাকার পর তিনি চলে আসেন লাক্ষ্মৌতে। সেখান থেকে হিমালয়ের
 প্রতি হিল স্টেশনে পায়ে হেটে ঘুরে বেড়ান, দেখেন দেরাদুন কাগন জালি। লক্ষ্মৌ ছেড়ে আসেন সিমলা। সেখানে অনেক ছবি আঁকেন। সিমলায় বসে এক কানাডিয়ান মহিলার সাথে তার পরিচয় হয়। তার সহযোগিতায় সিমলা সেন্টার পিটার্স স্কুলে তার ছবির প্রদর্শনী হয়। উদ্বোধন করেন কাপুরতলার মহারাজ। প্রদর্শনীতে চার শত টাকার ছবি বিক্রি হয়। সেখান থেকে চলে আসেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। পরিচিত হন সেখানকার নবাব ফরিদ খানের সাথে। ফরিদ খান তার ভালো বন্ধু হয়েছিলেন। পরে চলে আসেন কাশ্মীরে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় করাচি এসে পরিচয় হয় কবি জসীম উদ্দীনের সাথে। এসময় শাকের আলী , শেখ আহমেদসহ আরো নামিদামি শিল্পীদের সাথে পরিচিত হন। এবং আর্ট কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এস এম সুলতান করাচিতে প্রদর্শনী করেন। যা উদ্বোধন করেন ফিরোজ খান নুন। এরপর করাচী ুসিবধ হলে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। টিকেট এক টাকা। প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিল।
১৯৫০ সালে পাকিস্তান চিত্রশিল্পীদের মধ্য থেকে তাকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য মনোনিত করা হয়। তিনি ২০টি ছবি নিয়ে ১ জানুয়ারি আমেরিকা যান। আমেরিকা যাওয়ার আগে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কোথায় কোথায় যাবেন। তিনি জানান, শিশুদের স্কুল দেখতে যাবেন। আমেরিকার ওয়াশিংটন, বোস্টন,শিলানা, মিসিগান শহরে তার একক প্রদর্শনী হয়। আমেরিকা থেকে আসেন লন্ডনে। সেখানে তার একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়। ভিক্টোরিয়া ডুস্বি ডালি,পন, ব্র্যাক,ক্রীব’র মত বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে তার ছবি সমমর্যাদায় প্রদর্শীত হয়।
এস এম সুলতানের আগে এশিয়া মহাদেশের এমন দুর্লভ সম্মান কোন চিত্রশিল্পী পান নি। লন্ডনের লিসার গ্যালারীর প্রদর্শনী শেষে ছবিগুলো গ্যালারীকে দান করে যান। ১৯৫৩ সালে তিনি দেশে ফেরেন। সরকার তাকে আর্ট কলেজের উপাধ্য পদের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। জয়নুল আবেদিন তখন অধ্য। তিনি রাজী হলেন না। বিশ্বজয়ের মুকুট মাথায় নিয়ে তিনি চলে আসেন নড়াইল। ১৯৫৮ সালে সরকারি ভাবে বিশ শতাংশ জমিসহ একটি পুরাতন বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে তিনি ১৯৫৯ সালে ‘দি ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। স্বরূপে স্বতন্ত্র এ মানুষটির হৃদয় জুড়ে ছিল প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। চিত্রা নদীর তীরে তিনি গড়ে তুললেন এক তপোবন। বিভিন্ন জাতের বিচিত্র বৃরাজিতে পরিপূর্ণ এ তপোবনে প্রবেশ করলে মন ভরে যাবে।  এরপর গড়ে তোলেন চিড়িয়াখানা। এখানে বানর, হনুমান, ঘোড়া, খরগোশ, গিনিপিগ, বনবিড়াল, দেশি-বিদেশি কুকুর, জাতি সাপ ও নানান জাতের নানান রঙের পাখি রয়েছে। এ মহান শিল্পীর মৃত্যুর পর তার চিড়িযাখানার জীব-জন্তু সব ঢাকা চিড়িয়াখানায় নিযে যাওয়া হয়। লাল মিয়া সুন্দর সুরে বাঁশি বাজাতেন। গভীর রাতে জমিদার বাড়ির পুকুর ঘাটে বসে বাঁশি বাজাতেন। এলাকার লোকেরা বলেছে তার বাঁশির সুরের তালে তালে সাপ ফণা তুলতো।
১৯৫৯ সালে রফিকুন নবী ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হন। তিনি বলেন, অধ্য জয়নুল আবেদিন, কামরুর হাসান, শফি উদ্দিন আহমেদ চারুকলার চত্বরে জলসভায় বসা। তারা সবাই এক মহিলা অতিথির সাথে গল্প করছেন। মহিলা অতিথি আমাদের কাসের দিকে পিঠ করে বসা। মাথায় ঢেউ খেলানো কোকড়ানো চুল। পড়নে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। ঠিক এগারটার দিকে স্যারদের সাথে অতিথি আমাদের কাসে আসে। আমরা সবাই চমকে উঠলাম। অতিথি মহিলা নন; সে একজন জ্বলজ্যান্ত পুরুষ মানুষ। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। হাতে বাঁশের বাঁশি। অধ্য সার পরিচয় করিয়ে দিলেনÑ নাম এস এম সুলতান। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও এস এম সুলতানের বন্ধু ছিলেন। এস এম সুলতানের যক্ষ্মা হয়েছিল ৮০ সালের দিকে। ব্যাংককের সুমিতভেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়; ভালো হয়ে দেশে এলেন।
এস এম সুলতান সর্ববৃহৎ ক্যানভাসে ছবি এঁকেছেন। যার আয়তন ২০ বর্গফুট। নড়াইলের লাল মিয়া চির কুমার ছিলেন। আমি তাকে যত কাছ তেকে দেখেছি। তার কাছে থাকার সৌভাগ্য হয় আমার। আজ মনে হয়, আর বাঁশি বাজবেনা, ইঞ্জিনের নৌকা চলবেনা, কেউ জানতে চাইবে না, ডাক্তার আসবেনা,সাংবাদিক জানবে না, সবাইকে আড়ালে রেখে, জাতিকে ফাঁকি দিয়ে নড়াইলের চিত্রা নদীর পারের মাছিমদিয়া গ্রামের এস এম সুলতান (লাল মিয়া) ১০ অক্টোবর চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ধন্য নড়াইলের মাটি, ধন্য চিত্রা নদী, ধন্য মাছিমদিয়া গ্রাম।

আ.জ.ম কামাল,
প্রশিক, নাটক বিভাগ
জেলা শিল্পকলা একাডেমী, মাদারীপুর।

রবিবার, ৫ আগস্ট, ২০১২

অস্থির বাতাসে নিভে যাচ্ছে শিক্ষাঙ্গনের জ্বলন্ত প্রদীপ

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
অস্থির হয়ে উঠছে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন। যা জাতির জন্য উদ্বেগজনক বিষয়। জাতির মেরুদন্ড আক্রান্ত হচ্ছে সন্ত্রাস,দলীয়করণ ও রাজনীতিসহ জঘন্যতম কর্মকান্ডে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সহিংসতায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষাঙ্গন। ফলে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে । মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে বাবা-মা সন্তানকে জ্ঞানের আলো অন্বেষণে পাঠান; তারা সর্বদাই উৎকন্ঠিত থাকেন অনাকাক্সিক্ষত কোন দুঃসংবাদের জন্য। অথচ শিক্ষাঙ্গন হওয়ার কথা পুষ্প সৌরভে সুরভিত। পাখির কুঞ্জন আর শিক্ষার্থীর পদভারে মুখরিত। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত শিক্ষাঙ্গন গোলাগুলি,মারধর আর ভাঙচুরের শব্দে অশান্ত হয়ে উঠছে।
নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার শুরু থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে রাজনীতি প্রবেশ করে। ফলে নষ্ট হতে থাকে শিক্ষার পরিবেশ। বাড়তে থাকে সহিংসতা, সংঘর্ষ, গোলাগুলি, খুন ও জখমের মত অপ্রীতিকর ঘটনা। সহিংসতার অতল গহ্বরে ডুবতে থাকে শিক্ষাঙ্গন। ছাত্র-শিক্ষকদের নোংরা রাজনীতির রাহুগ্রাসে অস্থির হয়ে ওঠে সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্য দলীয়করণ ও ছাত্ররাজনীতি এর জন্য দায়ি। সে কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। পাশাপাশি শিক্ষকদের চক্রান্ত, রেষারেষি ও দায়িত্বহীনতাও কম দায়ি নয়। শিক্ষকরাও নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে প্রিয় ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করেন অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিতে। ছাত্ররা কী শিখছে, কেন শিখছে, কিভাবে শিখছে এ দিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ না থাকলেও নিজেদের কর্তৃত্ব বা অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে তারা সচেতন।
গোয়েন্দা সূত্র মতে, কেবল মহাজোট সরকারের সাড়ে তিন বছরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৩ জন শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র দু’জন ব্যক্তিগত কোন্দলে এবং বাকি ২১ জন নোংরা রাজনীতির শিকার। ২০০৯ সাল থেকে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-শিবিরের পরস্পর দলীয় কোন্দল, হলদখল ও প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীফুজ্জামান নোমানী, ফারুক হোসেন, নসরুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজাহিদ, মাসুদ বিন হাবিব, মহিউদ্দিন, হারুন অর রশীদ কায়সার, আসাদুজ্জামান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবায়ের আহমেদ, ঢাকা মেডিকেল  কলেজের আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীব, সিলেট এমসি কলেজের পলাশ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের আবিদুর রহমান, রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের রেজানুল ইসলাম চৌধুরী, পাবনা টেক্সটাইল কলেজের মোস্তফা কামাল শান্ত ও সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহেল রানা নিহত হন।
এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী সহিংসতায় জখম হন। তাদের মধ্যে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে ৫৪ জনকে। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে ২৩ জনের।
চোখের সামনে শিক্ষাঙ্গনের অস্থির বাতাসে নিভে যাচ্ছে জ্বলন্ত প্রদীপগুলো। ধীরে ধীরে আঁধারে নিমজ্জিত হচ্ছে গোটা জাতি এবং কতগুলো পরিবারের আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠার আগেই দপ্ করে নিভে যাচ্ছে। জাতি হারাচ্ছে তার অমুল্য সম্পদ। এ অবস্থা থেকে উত্তরোণের পথ খোঁজে না কেউ। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের জন্য তৈরি হয় না কোন নীতিমালা। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্বার্থেই তারা নেন না কোন পদক্ষেপ। শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধ হয়ে গেলে রাজনৈতিক দলগুলো নিঃস্ব হবার ভয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন দেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় মেধাবী সন্তানদের।
শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা নতুন কিছু না হলেও ইদানিং এর মাত্রাটা বেড়ে গেছে। সারাদেশের প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত কলেজগুলোতে অস্থিতীশীল অবস্থা বিরাজ করছে। শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ হচ্ছে বিঘিœত। ভোগান্তিতে পড়ছে নিরীহ শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি প্রধান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেশ কয়েকটি কলেজ ও আটটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে চরম অশান্তি বিরাজ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে কেবল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সরিয়ে দেওযা ছাড়া অন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আদালতের রায়ে বুয়েটের আন্দোলন বন্ধ থাকলেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসছেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের কারণে বন্ধ হয়ে আছে বুয়েটের শিক্ষা কার্যক্রম। চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। বর্তমানে আদালতের রায়ে আন্দেলন বন্ধ থাকলেও ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য চাঁদার টাকা আদায়ের পর তা ভাগাভাগির জের ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দু’গ্র“পের গোলাগুলি, বোমাবাজি ও সংঘর্ষের ঘটনায় গত মাসে এক ছাত্র প্রাণ হারায়। এরপর থেকে স্বাভাবিক হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। ঢাকসু নির্বাচনের দাবিতে গত ১৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। সে থেকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন ইস্যুতে যে কোন সময় ঢাবিতেও বড় ধরণের সংঘর্ষ ঘটতে পারে।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির ফলে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে চলছে জগন্নাথ বিম্ববিদ্যালয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। ফলে প্রতিষ্ঠানটির উচ্চ শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘিœত হচ্ছে। এছাড়া রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা করেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, ঢাকা কবি নজরুল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা পলিটেকনিক কলেজসহ সারাদেশের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের কারণে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সর্বশেষ গত ২ আগস্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনভর ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা বলেছেন,‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখলের একটি প্রবণতাও তেরি হয়েছে।’ সাম্প্রতিককালে সরকারের দলীয়করণকে অস্থিরতার অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন তিনি। তিনি আরো বলেন,‘একটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন মতের লোকজন থাকবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি ঢালাওভাবে নিজ দলের লোকজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয় তাহলে এ সঙ্কট সহজেই কাটবে না।’
অন্যদিকে চলমান অস্থিরতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেছেন,‘বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ ঘটানাগুলো দুঃখজনক। আমরা অস্থিরতা নিরসনে পদক্ষেপ নিয়েছি।’ এখন কথা হচ্ছে সব ঘটনারই তো পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু সে পদক্ষেপের পথ আর ফুরায় না। কাজের কাজ কিছুই হয় না। তবে শিক্ষাঙ্গনে নোংরা রাজনীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করলেই কেবল সহিংসতা এড়ানো সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতির ঘাঁটিগুলো উচ্ছেদ করতে হবে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে দলমত নির্বিশেষে সকলকে। শিক্ষাঙ্গন রাখতে হবে রাজনীতির সব রকম প্রভাবমুক্ত। তবেই দূর হবে অস্থিরতা। শিক্ষার্থীরা পাবে তাদের কাক্সিক্ষত পরিবেশ। শিক্ষাঙ্গনের অস্থির বাতাসে আর নিভে যাবে না জ্বলন্ত প্রদীপ। জাতি পাবে তার মেধাবী সন্তান। উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত হবে আমাদের প্রিয় স্বদেশ।

বৃহস্পতিবার, ২ আগস্ট, ২০১২

আলী ইদ্রিসের গুচ্ছ কবিতা

*এখানে বিকেল নামে

শরতের বিকেল নির্জণ নিশ্চুপ
মসৃন পাতার চকচকে পিঠ
সুর্য রূপালী রং ঢালে তরুশাখে
এখানে প্রেমিক হৃদয় শত সহস্র
স্বপ্ন আাঁকে প্রেয়সীর চোখে।
এখানে নিদাঘ আকাশ সুবোধ বালকের কায়া,
উঠোনের ঘাসে পড়ে বিকেলের ছায়া।
এখানে অপূর্ণ আশা ফোটে মেঘের সরোবরে,
একটি নয় দুটি নয় অজস্র স্বপ্ন ভাসে লতার ভীড়ে।
এখানে মাছরাঙ্গা ভালবেসে মাছরাঙ্গীর ঠোঁটে
তুলে দেয় প্রতীক্ষার ফসল
অবশিষ্ট সুখ খোঁজে পালকে মুখ ঘষে ঘষে,
এখানে মানুষ বাঁচে স্বপ্নের জমিন চষে চষে।
সরু পা ফেলে ডাহুক চলে পাতার উপর
জলের স্বাধীনতা লুফে নেয় দুর্জয় খোকা হংসশাবক।
এই বিকেল প্রশাšিতর প্রলেপ টানে নগরীর ক্ষতচিহ্নে।
এই বিকেল ধিঙ্গি মেয়ের ডিঙ্গি বাওয়া সুখ।

এই বাংলায় যেখানে বিকেল নামে
হলদে ডানায় কাশফুলের নরম ছোয়ায়
অনিন্দ্যসুন্দর লাজনম্র কুমারীর চোখে।

*শিকার

গতকাল দেখেছি কঁচুবনে ব্যাঙ হল সাপের শিকার
বর্ষা অবধি আমার চারপাশের জলাভূমিতে
নানা পদ্ধতিতে চলছে মাছ শিকার
অহরহই দেখি জলের ধারে মাছরাঙ্গার নিবাস
এছারা প্রতিদিনই দেখি মাঠে ঘাটে এমনকি আমার
বারান্দার কাছে চাতালের ঘাসে শালিক, কানিবক
ডাহুক আরও নানান জাতের পাখি
তারা সবাই শিকারের নেশায় ঘুরঘুর করে
ছোট ছোট কীটপতঙ্গ এদের শিকার
এইসব শিকারের আছে অনেক শিকার
সুন্দরবনে বাঘে হরিণ খায়
হরিণের শিকার ঘাস ও লতাপাতা
বাজপাখি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ইঁদুর, মুরগী ছানা
ছোটমাছ বড়মাছের শিকার
অনাদিকাল থেকেই চলছে এই হত্যাযজ্ঞ
পরিবেশের ভারসম্য রক্ষায় ও বেঁচে থাকার তাগিদে
চলছে এই শৃঙখল
জায়েজ না জায়েজের প্রশ্ন এখানে অবাšতর
হত্যা; প্রয়োজন এবং লালসার কারণে
আশরাফুল মাখলুকাত আজ ভুলে গেছে
প্রয়োজন আর লালসার তফাৎ
ড্রয়িং রুমে ঝুলছে হরিণের শিং, বাঘের চামড়া
শোকেসে হাতির দাঁত
বিজ্ঞান বলে মানুষ সর্বভূক তাই বলে এমন শিকার?
ছোট দেশ বড় দেশের শিকার
নীতি দুর্নীতির শিকার
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মত এভাবে অনেক সঙ্গা পাল্টে গেছে পৃথিবীতে
ইতিহাস ঐতিহ্য সমাজ সংস্কৃতি আইন আদালত
সব উপাদানই “মাইট ইজ রাইট” এর জবরদখলে
তবে খাদ্য শৃঙ্খলের সঙ্গাটাও যে এত সহজে
রাতারাতি পাল্টে যাবে ভাবতে অবাক লাগে
হয়ত এই অবদানটাও আধুনিক সভ্যতার
আজ মানুষ মানুষের শিকার।

*তোমাকে ভালবেসে

তোমাকে ভালবেসে একখন্ড আকাশ দিয়েছিলাম
তারায় তারায় ভরিয়ে দিতে
বিনিময় তুমি দিলে শ্বাসরুদ্ধকর চিলেকোঠা
ছলনার বিষবাষ্পে অস্পষ্ট নীলাকাশ
একটা ফুল দিয়েছিলাম সৌরভে জগত ভরিয়ে দিতে
তুমি পাঁপড়িগুলো শুকিয়েছ সাহারার মরুতে
তোমাকে ভালবেসে একটা নদী দিয়েছিলাম
ধরণীর তৃষ্ণা মেটাতে
তৃষ্ণার অধিক মিটিয়ে তুমি ঠাঁই করে দিলে
নদী সিক¯িত তালিকাতে
এভাবে আর কত?
তোমাকে ভালবেসে  হারিয়েছি অনেক কিছু
হারিয়েছি একমাত্র প্রেম
আমার আকাশে আর কোনদিন যা হবেনা উদয়
তোমাকে ভালবেসে পেয়েছি অনেক কিছু
তার মধ্যে একটা ভগ্ন হৃদয়।

*কাঁচের টুকরার মত

প্রতিদিন কত টেলিফোন আসে
বেজে ওঠে নকিয়া টিউন
পরিচিত পাখির মত প্রতিদিন
মনিটরে বাসে হাজারো মুখের চিন
তারে আর দেখিনা‘ক খুঁজেছি অনেক দিন
তৃতীয়া চাঁদের মত মৃদু হেসে
নিরবে হারাল সে আধার ভালবেসে।

এই ফুল পাখি লতা পাতা আর
কোনোদিন মনে রাখিবেনা তারে
ঝরা পাঁপড়ির মত ভুলে যাবে
তরুশাখা ক্ষণিক মিলনের সাথিটারে
ভুলিবনা আমি তারে আসুক যন্ত্রনা শত
এইসব দিনরাত্রির মাঝে তার স্মৃতি ভাসে
হৃদয়ের গভীরে কাঁচের টুকরার মত।

বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১২

কালকিনিতে হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে শোকসভা


আছিয়া নূপুর:
নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে প্রথম আলো বন্ধুসভা, কালকিনির উদ্যোগে শোক র‌্যালী ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ শহীদ মিনার থেকে শোক র‌্যালী শুরু হয়ে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদণি শেষে শহীদ মিনারে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে নাফিজ সিদ্দিকী তপুর সঞ্চালনে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্য মো: খালেকুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন কবি ও অধ্যাপক দুলাল সরকার, সাংবাদিক ইয়াকুব খান শিশির, সাংবাদিক মিজানুর রহমান। বক্তব্য রাখেন শহিদুল ইসলাম, খায়রুল আলম, জাহিদ হাসান, মেহেদী হাসান, মাইনুল ইসলাম ও বি এ কে মামুন প্রমুখ।

আছিয়া নূপুর,
কালকিনি বন্ধুসভা

বৃহস্পতিবার, ২৬ জুলাই, ২০১২

নন্দিত নরক থেকে পুষ্পিত বিদায়

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাঁর আপন ঠিকানায়। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। সাহিত্য, নাটক ও সিনেমা জগতে এনেছেন নতুন বাঁক। হাতে ফুল, চোখে জল নিয়ে আমার তাঁকে সমাহিত করেছি তাঁর প্রিয় নুহাশ পল্লীতে। আলোকিত নত্রের আকস্মিক পতনে আমরা গভীর ভাবে শোকাহত।
‘শোয়াচান পাখি আমি ডাকিতাছি, তুমি ঘুমাইছ নাকি’- হাজার ভক্তের ডাকেও পাখি সাড়া দেয় না। পাখি চিরনিদ্রায় শায়িত। তিনি চলে গেলেন ১৯ জুলাই ১১ টা ২০ মিনিটে। তাঁকে সমাহিত করা হয় ২৪ জুলাই বাদ জোহর।
তিনি আসবেন ‘চান্নি পসর রাতে’। ‘ময়ূরাী’র তীরে হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে। তিনি বেঁচে থাকবেন হিমু, মিসির আলী আর বাকের ভাইদের মাঝে। দহন সাহিত্যপত্রে’র প থেকে হুমায়ূন আহমেদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

সোমবার, ২৩ জুলাই, ২০১২

যাওয়া তো নয় যাওয়া

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
তুমি কোন অভিমানে চলে গেলে সব ফেলে?
তোমার শূন্যতায় ‘ময়ূরাী’র বুকে চর জাগে।
হারানোর বেদনায় নিঃসঙ্গ বসে থাকে হিমুÑ
অযতেœ ঝরে পরে ‘হিমুর হাতে সাতটি নীলপদ্ম’।
মিসির আলী, বাকের ভাই হয়ে যায় নিরুদ্দেশ,
নিস্তব্ধ নুহাশপল্লী-কুতুবপুর,শোকাহত বাংলাদেশ।
‘যাওয়া তো নয় যাওয়া’-তবুও কী চলে যেতে হয়?
চলেই যদি যাবে ণিকের তরে কেন এসেছিলে তবে?
তুমি কী আর ফিরবে না এই ‘শ্যামল ছায়া’র মাঠে।
কেন ‘নন্দিত নরকে’ রেখে গেলে ‘আগুনের পরশমনি’,
এত বেহেশতি সুখ ছোঁয়ার পরেও ‘সবাই গেছে বনে’।
তুমিও কী তাই চলে গেলে আজ একাকী আনমনে।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কালকিনি, মাদারীপুর
০১৭২৫৪৩০৭৬৩।

মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, ২০১২

এখানে আমি একা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
আসলে এখানে আমি একা, এখানে আমার কেউ নেই।
আমি বারবার ভুলে যাই- এখানে আমি শুধুই পরবাসী।
এখানে স্বার্থের বাইরে এক চিলতে সম্পর্ক নেই।
এখানে নেই ভালোবাসার লেনদেন- সবাই জয়ী হতে চায় ।
এখানে স্বার্থের কাছে ভালোবাসাও মুখ ফিরিয়ে নেয়।
এখানে কর্মকে লুটপাট করে আমাকে ছুঁড়ে দেয় শূন্য ভাগাড়ে।
এখানে আমার অহংকার থাকতে নেই, তাই প্রতিনিয়ত মা চাইতে হয়।
এখানে আমি কার- কে আমার? রক্তের বন্ধন এখানে তুচ্ছ।
এখানে আমি ণিকের অতিথি তাই সূর্যাস্তের পূর্বে ফিরে যেতে হয়।
বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়-রক্তের বন্ধনই আমার শ্রেষ্ঠ আশ্রয়।

কালকিনি, মাদারীপুর।
17.07.2012

বুধবার, ৪ জুলাই, ২০১২

জাতীয় নাট্যোৎসবে ‘একটাই চাওয়া’

আ জ ম কামাল:
‘স্বাধীনতার ৪০ বছর ও শিল্পের আলোয় মহান মুক্তিযুদ্ধ’- স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় নাট্যোৎসবে মাদারীপুর সরকারি নাজিমুদ্দিন কলেজ ও কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে গত ৩ জুলাই রাত সাড়ে আটটায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে কলেজ পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক ‘একটাই চাওয়া’ মঞ্চস্থ হয়।
আজিজুল ইসলাম স্বপনের রচনায় আ জ ম কামালের নির্দেশনায় এতে অভিনয় করেন মাহমুদা খান লিটা, আজিজুল ইসলাাম স্বপন, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সাজ্জাদ হোসেন, লুবনা জাহান নিপা, আশিষ রায়, শাকিলা আক্তার, নাহিদুল ইসলাম মুকুল, সঞ্জীব তালুকদার, শান্ত কুমার, আসাদুজ্জামান রুপম, বি এ কে মামুন, মাইনুল ইসলাম ও সাইদুল ইসলাম।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর জেলায় ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা ফুটে ওঠে‘ একটাই চাওয়া’ নাটকে। সোলেমান বয়াতির সংসারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যেতে থাকে নাটকের কাহিনী। সোলেমান বয়াতীর স্ত্রী আমিরনের সম্ভ্রম হারানো। পাক হানাদারের নির্যাতনে সাজুর মৃত্যু। যুদ্ধে গিয়ে শেষ অবধি রফিকের ফিরে না আসা। কিশোর বাচ্চুর যুদ্ধে অংশগ্রহণ। রাজাকার ওয়াজেদ আলী ও কেতর আলীর কুদৃষ্টি একাত্তরের পৈশাচিক দৃশ্য ফুটে উঠবে। সুফিয়া, বেনু, পান্না ও নুরুল ইসলামের আত্মত্যাগ দর্শকদের আবেগাপ্লুত করে তোলে। সবশেষে বাচ্চুর বাবা, বয়াতী, বাদল ও মানিকের কন্ঠে দৃঢ়তার সাথে উচ্চারিত হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি। অভিনেতাদের সাথে সাথে দর্শকরাও গর্জে ওঠে।
নাটক শেষে নির্দেশক আ জ ম কামালের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মৃণাল কান্তি দে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব শংকর সাওজাল, ঝুনা চৌধুরী ও তৌফিক হোসেন ময়না প্রমুখ।

বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

মাদক বিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

নুরুদ্দিন আহমেদ:
মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ কালকিনি এডিপি’র উদ্যোগে গত ২৬ জুন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জারী গান পরিবেশন করেন আঃ সাত্তার বয়াতী ও তার দল, সংগীত পরিবেশন করেন ইব্রাহীম, জামাল ও শান্তা ইসলাম। আবৃত্তি করেন সুবর্ণা, জারিন তাসনিম রাইসা ও জান্নাতুল ফেরদাউস মীম। নৃত্য পরিবেশন করেন রোজিনা, সুমী, মিতু, নিপা, তামান্না, নাসিমা, রিয়া, রুহুল াামিন, মাসুম ও লিমা।
সবশেষে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের রচনায় মাইনুল ইসলামের পরিচালনায় মেহেদী হাসানের নির্দেশনায় আ জ ম কামালের রূপসজ্জায় ও প্রথম আলো কালকিনি বন্ধুসভার পরিবেশনায় মাদক বিরোধী নাটক ‘আলোর পথে’ মঞ্চস্থ হয়। এতে অভিনয় করেন বি এ কে মামুন, লিমা, মাইনুল ইসলাম, মহিউদ্দিন, সিমন, মেহেদী হাসান, সাইফুল ইসলাম, সজল নন্দী ও মাসুম।

মাদকবিরোধী দিবস পালিত

আফিয়া মুন:
মাদক দ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ কালকিনি এডিপি’র উদ্যোগে গত ২৬ জুন শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।সকাল ১০টায় কালকিনি এডিপি কার্যালয় থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়ে শেষে কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ডা. শামীম চৌধুরীর সভাপতিত্বে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের সঞ্চালনে প্রধান অতিথি ছিলেন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ খালেকুজ্জামান। বিশেষ অতিথি ছিলেন কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের সমাজ কর্ম বিভাগের প্রধান জাহাঙ্গীর হোসেন ও উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মোঃ এনামুল হক। বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হোসেন, মনিরুল ইসলাম ও মোঃ সেলিমুল্লাহ প্রমুখ।

রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

বাচ্চু মিয়ার বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরাম পুর ইউনিয়নের আন্ডার চর গ্রামে পৌঁছতেই দেখা গেল সারিবদ্ধভাবে দাাঁড়িয়ে আছে কিছু দরিদ্র মানুষ। লাইনের সামনে একটা কাঠের টেবিলে কিছু ঔষধ নিয়ে বসে আছেন একজন। তিনি রোগী দেখছেন আর রোগ নির্ণয়ের পর বিনামুল্যে ঔষধ দিচ্ছেন। পিছনে ঝোলানো একটি ব্যানার। তাতে ‘শৃঙ্খলা ও সুস্থ্যতাই সুন্দর জীবন’ স্লোগান লেখা। এরপর ‘মানব স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচী’ ও ‘বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা’সহ বিস্তারিত বিবরণ।
লোকটির নাম বিএম বাচ্চু মিয়া। এ নামটি এখন হতদরিদ্র মানুষের মুখে মুখে। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তিনি দরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা ও ঔষধ দিয়ে থাকেন। তার এ কর্মকান্ডে উপকৃত হচ্ছে নিজের গ্রামসহ পাশ্ববর্তী আরও ৪টি ইউনিয়নের মানুষ। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রায় ৫ শতাধিক অসহায় মানুষ ছুটে আসে তার কাছে স্বাস্থ্য সেবা নিতে। চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি মানুষকে সুস্থ্য থাকার নানাবিধ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তার এ কর্মকান্ডের খবর পেয়ে কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ মসিউর রহমান স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম পরিদর্শণ করেন। এবং ২০১১ সালের ২৮ অক্টোবর একটি প্রত্যয়ন পত্র দেন। সবাইকে তিনি একটা কথাই বলেন,‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়। রোগ হওয়ার আগে নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ও সচেতন হওয়া জরুরী।’ তিনি সুস্থ্য থাকতে রীতিমত শাক-সবজি ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ছোটবেলা থেকে অসহায় অবহেলিত মানুষের জন্য কিছু করার কথা চিন্তা করতেন। বিশেষ করে হতদরিদ্র মানুষ যখন বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তখন তিনি খুব ব্যথিত হতেন। সে চিন্তা ও দর্শন থেকেই নিজের উপার্জিত অর্থ থেকে ব্যয় করে শুরু করেন তার কার্যক্রম। কেমিস্ট প্যারাডাইস কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ থাকাকালীন ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মানব সেবা ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন। ঐ বছর ৩ ডিসেম্বর শুক্রবার দিন তিনি তার স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচী আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন। সেদিন ২০ জন মেডিকেল অফিসার এনে দিনভর এলাকার অসুস্থ্য মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেন। তার এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রফেসর আসাদুজ্জামান। পরে রিপ্রেজেন্টিটিভের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ঢাকার আইয়ূব মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের সাথে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। আর নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করে চালিয়ে যান মানব সেবা। চিকিৎসার স্বার্থে ২০১০ সালের ৩০ জুন পল্লী চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন। প্রায় একযুগ ধরে তিনি মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রত্যেক রোগীকে ৪০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত মূল্যের ঔষধ দিয়ে থাকেন। শুরুর দিকে প্রতি শুক্রবার ক্রোকির চর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালালেও প্রতিষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞায় এখন পাশ্ববর্তী আন্ডার চর গ্রামের আনোয়ার হোসেন মাস্টারের বাড়িতে প্রতি বৃহস্পতিবার এ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কোন মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা না করেও কেন এমন কাজের প্রতি বাচ্চু মিয়ার আগ্রহ। এটা তো একটা জটিল বিষয়। রোগ নির্ণয় কিভাবে করবেন। এমন সব প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘আমি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ থাকাকালীন রোগসংক্রান্ত যে বিদ্যা অর্জন করেছি। তা-ই আমাকে সহায়তা করে। এরপর পল্লী চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তাছাড়া আমিতো জটিল রোগের চিকিৎসাও করি না, ঔষধও দেই না। শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তাতে ইনশাআল্লাহ শতকরা নব্বই জন লোকই আমার ঔষধে আরোগ্য লাভ করেছে।’
স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচি ছাড়াও তার আরো কয়েকটি কর্মসূচি রয়েছে। তার মধ্যে বাচ্চু মিয়া নিজ অর্থায়নে সাহেবরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও ক্রোকির চর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র তেরি করে দিয়েছেন। তার দর্জি বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে অর্ধশতাধিক নারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ঘরে বসে অর্থ উপার্জন করছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় গরিব মানুষদেরকে আর্থিকভাবে সহায়তাও করেন।
বিএম বাচ্চু মিয়া এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন সমবায় সমিতি। সমিতির সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে ২০ টাকা করে চাঁদা দেন। সমিতির বর্তমান সঞ্চয় হয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা। এ সমিতির মাধ্যমে বিনা সুদে বিপদগ্রস্ত মানুষকে ঋণ দিয়ে থাকেন। যাতে উপকৃত হয় হতদরিদ্র মানুষ।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেল, অনেক মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিকিৎসার জন্য। নিবিষ্ট মনে রোগী দেখছেন বাচ্চু মিয়া। তাকে সহযোগিতা করছেন দুই নারী। তারা এই মানব সেবা ফাউন্ডেশনের কর্মী। একজন রুনু কাওসারি। তিনি আগত রোগীদের তালিকা করছেন এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। আরেকজন পল্লবী বিশ্বাস। তিনি রোগীদের ঔষধ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে রুনু কাওসারি জানান,‘প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। পাশ্ববর্তী কয়ারিয়া, রমজানপুর, চর দৌলতখান, শিকার মঙ্গলসহ প্রায় ৫টি ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামে এ সেবা কার্যক্রম চলে। ২০০১ সাল থেকে এপর্যন্ত প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে।’
চিকিৎসা নিতে আসা আন্ডার চর গ্রামের ফরনা বেগম জানান,‘ এর আগেও দুই বার আইছি। কোন টাহা পয়সা লাগে না। রোগও ভালো অয়। উপকার পাই, তাই আহি। মোগোতো আর অত টাহা খরচ কইরা বড় ডাক্তার দেহানোর ক্ষমতা নাই। তাই মোগো বাচ্চু মিয়াই ভরসা।’ এছাড়াও রিণা বেগম, ওয়াজেদ হাওলাদার, লিলি, সুখী, সুমি ও স্বপন ঘরামিসহ বেশ কয়েকজন বলেন,‘আমাগো অসুখ-বিসুখে বাচ্চু মিয়ার কাছে ছুইট্টা আহি। উপকারও পাই। বিনা পয়সায় ওষুধ দেয়। একযুগ ধইরা এই কাম কইরা আইতাছে। আইজ পর্যন্ত কোন মাইনষের অপকার বা সমস্যা অয় নাই।’ ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোঃ বাহারুল ও ৫নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আজাহার মীর জানান,‘বাচ্চু মিয়া একটি মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা তাকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করি। তার মতো এরকম কাজ আরো হওয়া উচিৎ।’
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেব রামপুর ইউনিয়নের ক্রোকির চর গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিএম বাচ্চু মিয়ার জন্ম। পিতা এসকান্দার আলী ও মা আমেনা বেগম। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে বাচ্চুই সবার বড়। ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। স্ত্রী আরজু বেগম ও সন্তানদের নিয়ে মাদারীপুর শহরে বসবাস করেন। সাদা মনের এ আলোকিত মানুষটি প্রথম আলোকে জানান,‘ রাজনৈতিক বা অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে মানব সেবা করছিনা। নিজে পরিবারসহ খেয়ে পড়ে যা থাকে তাই দিয়ে মানুষের উপকার করার চেষ্টা করি। বর্তমানে বসার জায়গা নিয়ে সমস্যায় আছি। পাশাপাশি আরো কিছু অর্থ দরকার। তবে সকলের সহযোগিতা পেলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারব। আমি চাই আমার এলাকার একটা মানুষও যাতে বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।’
বিএম বাচ্চু মিয়ার বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা ও মানব সেবা ফাউন্ডেশন সম্পর্কে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ মসিউর রহমান বলেন,‘বাচ্চু মিয়ার এ কার্যক্রম অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। আমি তার কার্যক্রম পরিদর্শণ করেছি। আমার মতে, তার মতো আমাদের প্রত্যেককেই এরকম জনসেবা মূলক কাজে এগিয়ে আসা উচিৎ।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শাহরিয়াজ বলেন,‘এমন জনসেবা মূলক কাজের জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। তার মতো প্রত্যেক গ্রামে বা ইউনিয়নে তা নাহলে অন্তত উপজেলা পর্যায়ে আরো অনেকের এগিয়ে আসা উচিৎ। আমি তাকে যে কোন ধরণের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিচ্ছি। যাতে সে তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারে।’

বুধবার, ২০ জুন, ২০১২

বৃষ্টি নয় খরা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

ভেবেছিলাম- তোমায় নিয়ে যাব বৃষ্টিøানে;
কিন্তু বৃষ্টি কোথায়? সারাটা দিন খরা।
বর্ষা এলো তবু দেখ শুকিয়ে যায় কদম,
এমন সময় এর আগে দেখিনি কোন জনম।

তাইতো তোমায় একটুখানি
চাইতে গেলেই চতুর্মুখী বাঁধা।
এখন আর মৌসুমও নেই ভালোবাসার,
জগত জুড়েই হতাশা আর হাহাকার।

বৃষ্টির আশায় আকাশ পানে চাইতে গেলে
মরার খরা পোড়ায় এ দেহটারে।
তার চেয়ে সেই কি নয় ভালোÑ
তোমার চোখের জলে আমি ভিজি,
আমার চোখের জলে তুমি।

সোমবার, ১৮ জুন, ২০১২

মঞ্চ নাটক: একটাই চাওয়া

রচনাঃ মোঃ আজিজুল ইসলাম স্বপন
নির্দেশনায়: আ.জ.ম কামাল
প্রশিক্ষকঃ জেলা শিল্পকলা একাডেমী মাদারীপুর
সার্বিক তত্ত্বাবধানে:
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
ছাত্র, নাটক বিভাগ
 জেলা শিল্পকলা একাডেমী মাদারীপুর
চরিত্রলিপি:
বয়াতী, আমীরন,সাজু , রফিক, বাদল, মানিক , রফিকের মা , বাচ্চুর বাবা, ওয়াজেদ আলী, কেতর আলী, মেজর. আরও কিছু আর্মি ও মুক্তিযোদ্ধা।
প্রথম দৃশ্য:
স্থান: বয়তীর বাড়ী
সময়ঃ সকাল
সারারাত গানবাজনা করে ভোর বেলা বাড়ী ফেরে সোলেমান বয়াতী। সোলেমান বয়াতীর স্ত্রী আমিরন তখন উঠান ঝাড়– দিচ্ছিল। সোলেমান বয়াতী উঠানে গান গাইতে পা রাখতেই আমিরনের তাছ্যিলের সুর।
আমিরনঃ আইজ কি সূর্য্য পশ্চিম দিক দিয়া উঠল নাকি? ব্যাপার কি? বয়াতী যে সাত-সকালে দোতারা হাতে নিয়া বাড়িীতে হাজির। গানের আসর কি ভালো জমে নাই?
বয়াতীঃ তুমি মনে হয় ভূল দ্যাখতাছো। সূর্যতো তোমাগো বাড়ীর পিছন দিয়া উঠছে।
আমিরনঃ সংসার চালানোর মুরদ নাই, আবার মুখে মুখে তর্ক, ভালো হইবোনা কইয়া দিতাছি।
বয়াতীঃ কেউ তর্ক করতে চাইলে কি মুখ বন্ধ কইরা থাকুম। তর্ক করলে কি করবা তুমি? কিছুই করতে পারবানা  আমার। আমি বিজয়ের ডাক শুনতে পাইতাছি(উদাস ভঙ্গি)পরাধীনতার শিকল ছেড়ার আওয়াজ শুনতাছি।
আমিরনঃ কথা ঘুরাইবানা কইতাছি, ইসস.. রে আমার জুয়ান মরদ, কথা হুইন্না মনে অইতাছে দ্যাশটারে একেবারে স্বাধীন কইরা আইছো
বয়াতীঃ বউরে একলা যদিও পারুম না, তবে চেষ্টা করতে দোষ কি? আহারে, খুব মনে চায় দেশটা যদি স্বাধীন করতে পারতাম(দীর্ঘশ্বাষ)। হের লাইগ্যাইতো মুখে বানছি দেশের গান, হাতে নিছি দোতারা
আমিরনঃ কতায় আছে না, গুজায় চায় চিৎ অইয়া হুইতে বয়াতীর অইছে হেই দশা।
বয়াতীঃ তুমি কিন্তু আমারে অপমান করতাছো। তুমি জানো, প্রয়োজনে আমি দোতারা ছাইরা হাতে রাইফেলও নিতে পারি।
আমিরনঃ হ......... যার মানই নাই তার আবার অপমান, ভাত পায় না আবার চা খায়, হাটতে পারে না বন্দুক ঝুলায়
বয়াতীঃ এই, মান নাই মানে? তুই কি কইতে চাস।
আমীরনঃ কি কইতে চাই বোঝ না? একজন জোয়ান মরদের বউ মাইয়া মাইনষের বাড়ীতে কাম কইরা প্যারে খুদা মিডায়। হেইয় মনে থাকে না
বয়াতীঃ তাও তো তোর বাপের বাড়ী থিকা ভালো আছোস।
আমীরনঃ তোমার ভালোর খ্যাতা পুরি। সারাদিন রাইত পইড়া থাকে দোতারা লইয়া, আর বাড়ী আইয়া করে ঝগড়া, আগে জানলে এমন পোড়া কপাইল্যার সংসারেই আমি আইতাম না।
বয়াতীঃ অহন তো জানছোস, তয় যা গিয়া, আমার লগে আমার মাইয়া আছে, আর আছে দোতারা, তোর মতন অমন বান্দরনীরে আমার লাগবোনা, তোর তোন আমার দোতারা অনেক বেশি সুন্দর। আহারে কি সুন্দর সুর দেয়, এই দোতারা আমারে দ্যাশের মাটিতে মিশাইয়া দেয়, যার তারে বাইজা উঠে দ্যাশের গান। (একটি দেশের গান)
আমীরনঃ কি কইলা আমার তোনে তোমার দোতারা সুন্দর, তোমার দোতারা আমি ভাইঙ্গাই ছাড়–ম, (এমন সময় ঘর থেকে মেয়ের প্রবেশ,মেয়ে বলে উঠে)
সাজুঃ ওমা তোমরা এ কি শুরু করলা, কাম কাইজ বাদ দিয়া শুধু ঝগড়া করো
আমীরনঃ থাক তুমি তোমার দোতারা লইয়া, আমি ও দ্যাখতে চাই তোমার প্যাডের যোগান কেডা দেয়, তোমার দোতারা  না আমি।
সাজুঃ মা,থাম তো, বাজান তুমিও থামো
বয়াতীঃ আয় মা, আমার কাছে আয় , দ্যাখ তোর মায় সকাল বেলা আমার মেজাজটা বিগরাইয়া দিছে। (আমীরন নিজের কাজে মন দেয়)
সাজুঃ বাজান, হুনছো-দ্যাশে না-কি আগুন লাগছে, পাকিস্তানি মেলেটারিরা নাকি খালি বাঙ্গালিগো ধইর‌্যা ধইর‌্যা মারতাছে।
বয়াতীঃ তোর কাছে কেডা কইল?
সাজুঃ শহরের মানুষ লাইন ধইরা গেরামে আইতাছে, শহরে নাকি মেলা গন্ডগোল অইতাছে।
বয়াতীঃ আমি ও একটু একটু হুনছি। তয় এহনতো মনে অইতাছে ঘটনা আসলেই হাছা।(আমীরন ভয় পেয়ে এসে বলে)
আমীরণঃ এই সব কতা হুইন্যা আমার খুব ডর করতাছে। হোনেন আমনে আর গান গাইতে দুরে দুরে যাইয়েন না, মাইডা বড়ো অইছে, কহন কি অইয়া যায় আমার কিন্তু আসলেই ডর করতাছে।
বয়াতীঃ ডরের কিছু নাই,(আনমনে ......... ভয় কি মরনে গান ধরে)
আমীরনঃ রাখেন আমনের গান, আমনে সব কিছুতেই খালি হেলামী করেন
বয়াতীঃ আইচ্ছা, আমি দুরে চইল¬া গ্যালেইতো তুমি খুশি অইবা, ঠিক না?
আমীরনঃ (অভিমান নিয়ে), আমনে খালি আমার বাহিরডাই দ্যাখলেন, ভিতরডা দ্যাখলেন না, ভিতরে ভিতরে যে আমার মনডা আমনের লাইগ্যা পুইড়া ছারখার হয়,হেইডা কোনদিন বুজলেন না।
বয়াতীঃ হেইডাতো তুমি ও বুজলানা।
আমীরনঃ হোনেন, আসল কতা কইতেই ভুইল্যা গেছি,  কাইল সন্ধ্যাকালে মানিক ভাই আইছিলো, আমনেরে দ্যাহা করতে কইছে।
বয়াতীঃ কও কি?এই কতা আরও আগে কইবা না, আমি অহোনি যাইতাছি....(দ্রুত প্রস্থান)
আমীরনঃ কিছু মুখে দিয়া যান....... হায়রে মানুষ( সবার প্রস্থান)
২য় দৃশ্য:
*( কোন এক গোপন স্থানে কয়েকজন মুক্তিকামি যুবক বসে আলোচনা করছে, এমন সময় বয়াতীর আগমন)
বয়াতীঃ মানিক ভাই তুমি আমারে আইতে কইছো?
মানিকঃ শোন বয়াতীভাই দ্যাশের অবস্থা ভালো না, গত ২৫ শে মার্চ রাইতে পাক আর্মিরা ইয়াহিয়া খানে নির্দেশে নিরীহ বাঙ্গালীর উপর ঝাপাইয়া পড়ছে, জাগায় জাগায় আগুন ধরাইয়া দিছে।
বাদলঃ হ বয়াতী ভাই, হুনলাম বাশগাড়ীর নুরুল ইসলাম শিকদার তখন ইপিআরে আছিলো, সে পিলখানা থেকে পালইয়া আইছে, যুদ্ধ শুরু অইয়া গ্যাছে, এহন আর সময় নাই, আমরা দ্যাহাইয়া দিমু আমাগো ভারী অস্ত্র নাথাকলেও মনোবল আছে, আছে দ্যাশের প্রতি ভালোবাসা, মাটির প্রতি আছে গভীর টান, আর থাকবোইবা না ক্যান? বঙ্গবন্ধু কইছে না যার যা কিছু আছে তাই শত্র“র বিরুদ্ধে ঝাপাইয়া পড়ো, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।
বয়াতীঃ হ, ঠিকই কইছো, আমরা ও দেখাইয়া দিমু এখনোই আমাগো উপযুক্ত সময়। কিন্তু কীভাবে কি করবা? ঠিক করছো কিছু?
বাদলঃ শোন, আগে আমাদের মনোবল বাড়াতে হবে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ঘর থিকা বাহির হইয়া আসতে হবে, আমাগো যুদ্ধের প্রস্তুুতি নিতে হইবো, আমাগো এহন ট্রেনিং দরকার, লিডারদের সাথে যোগাযোগ অইতাছে। তারা সবাই আসমত আলী খান সাহেবের বাসায় আছে, ইলিয়াস চৌধুরী, শওকত ছ্যার, স্টুয়ার্ড মুজিব ও ফনি বাবু ও আছে।
মানিকঃ বাদল ভাই তুমি না কইলা, শওকত ছ্যার আর স্টুয়ার্ড মুজিব নাকি আমাগো দ্যাখা করতে কইছে।
বাদলঃ হ, হাতে সময় খুব কম, তোমরা যার যার বাড়ী থিকা বিদায় নিয়া আসবা। আগামীকাল সকালে আমরা নাজিমুদ্দিন কলেজে হইমু, জাগো জাগো বাছাই করবো তারা আমরা ট্রেনিং এ যামু।
বয়াতীঃ এহন তয়লে উডি, কাইল সকাল সাতটার মধ্যে কলেজ মাডে থাকুম।
মানিকঃ হ, স্টুয়ার্ড মুজিবের নেতৃত্বে একটা টিম ইন্ডিয়ায় ট্রেনিং এর জন্যে পাঠানো অইবো, শোন, যারা ট্রেনিং এ যাইতে চায় তাগো আসতে কইবা
বয়াতীঃ বুজছি, আমি তাইলে পোটলা পাটিলি লইয়া হাজির অইয়া যামু, তয় সবাই খুব সাবধান, আমাগো সলা পরামর্শ য্যান কেউ জানতে না পারে, হুনছি আমাগো এলাকার কয়েকজন বেঈমান নাকি গোপানে পাকিস্তানিগো সাহায্যে করে, খোজ-খবর দেয়,
বাদলঃ ঠিক আছে, আমরা এহন তাইলে, সবাই যার যার বাড়ী যাই (সকলের প্রস্থান)
৩য় দৃশ্য:
স্থানঃ বয়াতীর বাড়ী
সময়ঃ ভোরবেলা
(বয়াতী পোটলা পাটলি বাধছে, আমীরনের প্রবেশ)
আমীরনঃ আমনে পোটলা পাটলি বান্ধেন ক্যান, কই যাইবেন, দ্যাহো দেহি, মুখখান ক্যামোন হুগাইয়া আমসীর মতো অইয়া গ্যাছে। কতা কন না ক্যান?
বয়াতীঃ (সম্বিৎ ফিরে পেয়ে) আমারে কিছু কও?
আমীরনঃ হ, কই, সাত সকালে আমনে কই যান? সারাদিন কিছু খান নাই, রাইতে খান নাই, এহনো না খাইয়া পোটলা পাটলি বাইন্ধা আমনে কই যান।  কাইলকের রাগ বুঝি এহনো আছে? ইচ্ছা কইর‌্যা কি আমনের লগে অমন করি,
বয়াতীঃ নারে, সাজুর মা তুই যা ভাবতাছোস, আসলে তা না, আমি তোর লগে রাগ যাইতাছি না। হুনছোস পাকিস্থানীরা আমাগো উপর অত্যাচার করতাছে, অগো আমার ঘেন্যা ধইরা গ্যাছে। অগো খতম কইরা আমি বাড়ী ফিরুম।
আমীরনঃ আমনে কই যাইবেন, আমনে গ্যালে আমাগো কেডা দ্যাখবো?
বয়াতীঃ তোগো আল¬ায় দ্যাখবো, তোগা লাইগ্যা আমি কিছুই করতে পারি নাই। তয় এইবার মনে অয় কিছু করতে পারুম, খালি তোগো লাইগ্যা না দ্যাশের লাইগ্যাও কিছু করতে পারুম। বউরে যদি বাইচ্যা আহি তো আইলাম, না আইলে তুই গর্ব কইরা কবি তোর স্বামী দ্যাশের লাইগ্যা যুদ্ধ কইরা শহীদ অইছে।
আমীরনঃ সাজু তো ঘুমাই রইছে, অর লগে কতা কইয়া যাইবেন না, আমি অরে ডাইক্যা দেই।
বয়াতীঃ না, অরে ডাকোনের কাম নাই, হাতে সময় কম, অয় ওটলে অরে কইবা, তোর বাজানে যুদ্ধে গ্যাছে। আমি অহোন যাই (আমীরন পিছু পিছু কাদতে কাদতে যায়, পিছন থেকে মেয়ে সাজু ডাকে)
সাজুঃ মা তুমি কান্দ কেন? বাজান কই?
আমীরনঃ তোর বাজানে গ্যাছে গা।
সাজুঃ মা বাজানে কই গ্যাছে?
আমীরণঃ তোর বাজানে যুদ্ধে গ্যাছে।
সাজুঃ মা-রফিকের মা চাচি কইলো। রফিক ভাই নাকি যুদ্ধে যাইবে, চাচি পাগোলের মত কানতাছে।
আমীরনঃ কছকি? তুই তইলে ঘরের কাম কর। আমি একটু ঐ বাড়ি যাই।
সাজুঃ আইচ্ছা যাও। তাড়াতাড়ি আই ও। (আমীরনের প্রস্থান। রফিকের প্রবেশ)
রফিকঃ চাচী, চাচী ও চাচী বাড়িতে আছেন?
সাজুঃ ক্যাডা?  (বের হয়ে) ও আপনে? মায় তো এই মাত্র আপনা গো বাড়ী গেল। বাজানে যুদ্ধ গ্যাছে। আপনিও নাকি            যাইবেন।
রফিকঃ হ, যাইতাছি। তয যাওয়ার আগে তোমারে একটা কতা বলার আছিল।
সাজুঃ কি কতা কইবেন। আমনে আমার দিকে ওমনে চাইয়া রইছেন ক্যান।
রফিকঃ চাইয়া রইছি ক্যান তুমি বুঝ না।
সাজুঃ  না বুঝি না। বুঝলে কি জিগাইতাম।
রফিকঃ আমি তোমারে খুব পছন্দ করি। কইতে পার ভালোও বাসি।
সাজুঃ আপনার কি সরমলজ্জা নাই। আসারে এইসব কইতাছেন।
রফিকঃ তোমার কাছে আমার শরম কীসের। জানিনা সাজু জান লইয়া ফিরতে পারুম কিনা যদি ফিরি তাইলে তোমারে আমার জীবন(সঙ্গী/সাথী) করুম।
সাজুঃ ঠিক আছে আগে দ্যাশটারে রক্ষা করেন। দেশের এই বড় বিপদে আমাগো সকলেরই উচিৎ দ্যাশের কথা চিন্তা করা। যদি ঠিকমতো দ্যাশ স্বাধীন হয় আর আমরা সবাই বাইচ্চা থাকি তয় অবশ্যই আমি আমনের হমু।
রফিকঃ সাজু তোমার উৎসাহ আমার শক্তি আরও বাড়াইয়া দিছে। তুমি দোয়া কইরো আমি যেন তোমার লাইগা স্বাধীন দ্যাশের পতাকা লইয়া ফিরতে পারি। (আবেগ জরিত কন্ঠে রফিকের বিদায়) আমি তাইলে এইবার া আসি সাজু।

৪র্থ দৃশ্য:
(চারদিকে গোলাগুলির শব্দ। চিৎকার ধ্বনি।)

মানিকঃ (ফিস ফিস গলায়) বাদল ভাই, আমরা যারা ট্রেনিং নিয়া আইছি। তারা এহন কী করুম। একটা কিছু ভাবা দরকার।
বাদলঃ হ, তা-ই ভাবতাছি। দুইডা ব্রীজ ধংসের পরে আমাগো হাতে এহন তেমন কোন অস্ত্র নাই। তাই প্রথমে কৌশলে পোষ্ট অফিস পাটের গুদাম, তফসিল অফিস, টেলিফোনের লাইন এগুলা ধ্বংস করতে হবে। অস্ত্র হাতে পাওয়ার পর যামু অন্য কোন অপারেশনে।
বয়াতীঃ হ-তয় খুব সাবধান। জুটমিল, কুলপদ্দি বাজারসহ কয়েকটা জায়গায় আর্মিরা ক্যাম্প বসাইছে। আর তগো সাহায্য করতাছে আমাগো দ্যাশের কিছু বেঈমান কুত্তারা।
মানিকঃ জানেন বাদল ভাই আমার পিচ্চি ভাইর ব্যাটা বাচ্চু আছেনা? ও আমাগো লগে লগে থাকতে চায়। হেদিন আমারে কয় চাচা আমারে একটা অস্ত্র দ্যাও। আমি দ্যাশের শত্রুগুলা শ্যাষ কইরা দেই।
বয়াতীঃ শোন মানিক, বয়াতী ঠিকই কইছে। আরে কবি-কাগজে-কাগজে স্লোগান লেইখ্যা পোষ্টার বানাইয়া গোপনে সবখানে লাগাইয়া দিতে।
রফিকের প্রবেশ।
বয়াতীঃ আচ্ছা বাদল ভাই সমাদ্দারে ব্রীজটা উড়াইয়া দিলে ক্যামন হয়। নুরুল ইসলামরা নাকি কালকিনির গোপালপুর ব্রীজ উরাইয়া দিছে। তয় নুরুল ইসলাম হানাদারগো গাত থেইক্কা বাঁচতে পারে নাই। ব্রীজ উরাইয়া যাওয়ার সময় আর্মিগো গুলিতে শহীদ হইছে।
বাদলঃ হ- নুরুর লেইগ্যা খুব খারাপ লাগতাছে। তয় জীবনের ঝুকি নিয়া হইলেও সমাদ্দারের ব্রীজ উড়াইতে হইবো। তাইলে আর্মি আর মাদারীপুর এর ভিতরে ঢুকতে পারবোনা।
রফিক ঃ হ-হেইডাই ভালো হয়। চোকদার ব্রীজ, আমগ্রাম ব্রীজতো ধ্বংস করা হইছেই। তয় সমাদ্দারের ব্রীজটাই হইলো আসল।
বাদল ঃ শোন, আজকে আমাগো দুই দলে ভাগ হইয়া যাইতে অইব। একদল চরমুগরীয়ার জেডিসি পাটের গুদাম ধ্বংস করব। আর একদল এ আর হাওলাদার জুট মিল ধ্বংস করবো। শোন, আইজ ১৪ই আগষ্ট। পাকিস্তান দিবস। আমাগো প্রান থাকতে বাংলার মাটিতে পাকিস্তান দিবস পালন করতে দিমু না।
বয়াতীঃ তয় সাবধান। আমাগো খলিল বাহীনির সবার চোখ কান খোলা রাখতে হইবো। শুনলাম কুলপদ্দিতে দুই জন মুক্তিযোদ্ধারে কারা য্যান ধারাইয়া দিছে।
মানিকঃ রাজৈর, শিবচর, কালকিনির খবরাখবর ও একটু লইও কোখায় সকি অবস্থা। বাদল ভাই এহন তইলে আমরা উডি। মূল অপারেশনের দিকে যাই। আর বাচ্চুরে পাঠাইয়া দেই কুলপদ্দিতে আটক দুইজনের নাম জাইন্না আসতে।
বয়াতীঃ চলো সবাই। জয় বাংলা। (সকলের প্রস্থানঃ গোলাগুলির শব্দ)

৫ম দৃশ্য:
*সোলেমান বয়াতীর দাওয়ায় বসে আমীরন তার মেয়ে সাজুর মাথায় বিলি কাটছে। এমন সময় রফিকের মার প্রবেশ।)
রফিকের মাঃ মায়ে ঝিয়ে ক্যামন আছো?
আমীরনঃ হ-গো-বু আমাগো আর থাকা। দ্যাশের যা অবস্থা প্রত্যেকটা রাইত কাটে দুঃচিন্তায়, আর রাজাকারগো ভয়ে।
রফিকের মাঃ তুমি ঠিকই কইছো। মা সাজু ঘরে কি পান টান কিছু আছে? (সাজু ঘরে যায়)
রফিকের মাঃ বইনরে বুকটার মইধ্যে খালি ধক্্ ধক্্ করে। আমার রফিক ক্যামন আছে, খোদা মাবুদই জানে। সাজুর বাপের কোন খোজ খবর পাওনি বোইন।
আমীরনঃ নারে বু-কোন খোজ খবর পাই নাই। দোয়া করেন বু দোয়া করেন। আমাগো আপনজন যাতে দেশ স্বাধীন কইরা আমাগো বুকে ফিইরা আহে। মাইয়াডা আমার মনমরা অইয়া গ্যাছে।
রফিকের মাঃ বু- সাবধনে থাকিস। ওয়াজেদ আলী আর কেতর আলী পাকবাহীনিরে সাহায্যে করতাছে। বাড়ি বাড়ি ঘুইরা মুক্তিযোদ্ধাগো আর জুয়ান মাইয়া মানুষ ধইরা নিয়া মেলেটারীগো হাতে তুইল্লা দেয়।
আমীরনঃ আমি ও হুনছি। হের লেইগ্যাইতো ডর। ঘরে আমার ডাঙ্গর মাইয়া। (পান হাতে সাজুর প্রবেশ)
সাজুঃ নেন চাচী আমনের পান। পানও ক্যামন শুকাইয়া গ্যাছে। হাড়ে-ঘাড়ে কেন্ডা যাই কন? তিন বেলার খাওন এক বেলায় খাই।
রফিকের মাঃ হরে- মা। তোর মুখখান ক্যামন শুকাইয়া গ্যাছে। কী সুন্দর বউ আমার ক্যামন হইয়া গ্যাছে। (সাজু লজ্জা পায়) থাউক, আর কয়ডা দিন মা, পোলা আমার দ্যাশ স¦াধীন কইরা ফিরলেই তোরে লাল শাড়ী ফিন্দাইয়া আমার ঘরে নিমু।
আমীরনঃ দোয়া করো বু। দোয়া করো সব উপর আলার মর্জি।
রফিকের মাঃ আইজ যাইরে বইন। একটু সাবধানে থাকিস।
আমীরনঃ চলেন আপনেরে একটু আগায় দিয়া আহি। চল মা সাজু। (সকলের প্রস্থান)
ষষ্ঠ দৃশ্য:
স্থানঃ আর্মি ক্যাম্প
সময়ঃ বিকাল
*( পাক বাহীনির ক্যাম্পে মেজরের সাথে রাজাকার ওয়াজেদ আলী ও কেতর আলীর কথোপকথোন)
ওয়াজেদ আলীঃ মেজর সাব, মুক্তি বাহীনিরা যা শুরু করছে তাতে তো বেশি সুবিধার মনে হইতাছে না।
মেজরঃ (ভয় পেয়ে) তুম কিয়া বাত বোলা, মুক্তি কোনছে............ মুক্তি মিলেগা।
ওয়াজেদঃ না হুজুর এ ধারমে নেহী মিলেগা। তবে যেভাবে ক্ষ্যাপছে তাতে এ ধারমে আইতে কতক্ষন।
মেজরঃ (অট্রহাসি) মুক্তি এ ধারমে নেহি আয়েগা কাভি নেহি। তুম ঝুট বলতাহু। হামছে ডরমে লাগা থা। যা শালা মেজাজ মে বিগড়ে দিলে তো।
ওয়াজেদঃ হুজুর, খোশ আমদেদ হো এওগা ভি খুশির বাত বোলতাহু। মেজাজ ভি ঠান্ডা হোতা হায়।
কেতরঃ কিচু মনে না করলে একটা কথা কই। সুন্দরী জোয়ান মাইয়া আছে। আপনার মেজাজ এক্কেবারে ঠান্ডা হইয়া যাইবো।
মেজরঃ মাইয়া? মাইয়া কিয়া হ্যায় ?
কেতরঃ মাইয়া মানে হইলো মানে ....................... (আটকে যায়)
ওয়াজেদঃ মাইয়া মানে বহুত খুব সুরত লাড়কী।
মেজরঃ ও ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়। যাও ওকে লিয়ে  আসতা হ্যায়।
ওয়াজেদঃ হুজুর, জেলার সাহেবকা কিয়া বাদ হে।
মেজরঃ জেলার সাবকা লাড়কীকা বাদ মে সব খতম করতা হায়।
ওয়াজেদঃ হুজুর, জেলারের মেয়ে বাদে সব খতম?
কেতরঃ মানে ঐ সুন্দরী সুফিয়া?
মেজরঃ হা- হা- হা- হা ওকে হাম ধীরে ধীরে খতম করতাহু। ও হামার ক্যাম্পে ভি রাখতাহু।
ওয়াজেদঃ আমরা তাইলে এখন আসি হুজুর।
মেজরঃ ঙশ তুম যাও  মেজরের প্রস্থান)
ওয়াজেদঃ শোন কেতর আলী। বয়াতীর বাড়ীর দিকে নজর রহিস শুনলাম ও নাকি যুদ্ধে গ্যাছে। সালার কত্তবড় সাহস সালায় ভাত পায় না চা খায়।
কেতরঃ হুজুর দোতারা লইয়া যুদ্ধে যায়। হুজুর ঘরে কিন্তু সুন্দরী বউ আর মাইয়া আছে।
ওয়াজেদঃ কেতর আলী চল গায়েনের বাড়ীর দিকে যাই ওর যুদ্ধে যাওনের সাধ মিটাইয়া দিমু চল।
কেতরঃ চলেন তাইলে। (উভয়ের প্রস্থান)
সপ্তম দৃশ্য:
(স্থানঃ মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা)
বাদলঃ কিরে মানিক চারিদিকের খবর কী?
মানিকঃ ভাই আমগ্রাম আর পাথুরিয়াপাড় ব্রীজ ধ্বংস কইরা দিছি। মিলিটারিরা এহন আর সহজে ঢুকতে পারবো না। তয় সমাদ্দারের ব্রীজ ভাঙ্গতে পারলেই আমরা সফল।
বয়াতীঃ শোন গোপনে একটা খবর পাইলাম।
সবাইঃ কী খবর?
বয়াতীঃ রফিক, কাশেম আর সাইদুলরা মিল্লা ঘটকচর স্কুলে কয়েকজন রাজাকারগো আটক করছে। আমাগো এহন সে দিকে যাওয়া দরকার।
মানিকঃ তাইলে চল, আমরা এহনই যাই। শালাগো জনমের তরে বেঈমানীর সাধ মিটাইয়া দেই।
বয়াতীঃ সাবধানে যাইস, তোরা আইলে আমরা এ আর হাওলাদার জুট মিলে হামলা করুম। হুনলাম, কালকিনির ফাসিয়াতলা হাটে পাকবাহীনিরা আইজ গণহত্যা চালাইছে। ঘরে ঘরে আগুন ধরাইয়া দিছে। শত শত মানুষরে মিথ্যা কতা কইয়া বাজারে আইন্না গুলি কইরা মারছে। আমাগো গোপন সংবাদ দাতা নুরে আলম পান্নারে ধইরা লইয়া গ্যাছে।
মানিকঃ হ- গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ ধইরা আনছে জুট মিলে। তাগোরে মুক্ত করতে না পারলে হারামীর বাচ্চারা তাগো মাইরা জুট মিলের মধ্যেই গণকবর দিব। বেশি দেরি করন ঠিক অইবোনা।
বয়াতীঃ বাদল, মানিক আমার মনডা জানি ক্যামন করতাছে বউ মাইয়াডারে খুব দ্যাখতে মন চায়। না জানি ওরা ক্যামন আছে।
বাদলঃ বয়াতী তুমি এই অবস্থার মইধ্যে বাড়ীর কথা ভাবো?
বয়াতীঃ হ-ভাবি, তোমরা কি বুঝবা। তোমাগোতো আমার মতোন সংসার নাই, বউ নাই, শিয়ানা মাইয়া নাই। জানি না ওরা কোন বিপদে আছে।
মানিকঃ সব ঠিক অইয়া যাইব। দেইখেন আমাগোরই জয় অইবো। আপনে কোন চিন্তা কইরেন না। ওরা ভালোই আছে।
বাদলঃ না বয়াতী, তোমার বাড়ি যাওনের কাম নাই। আমার এখন উডি( সকলের প্রস্থান)

অষ্টম দৃশ্য:
(ঝি ঝি পোকার শব্দ)
* (সলেমান বয়াতীর বাড়ি। খন্দকার ও কেতর আলী আসে)
ওয়াজেদঃ বয়াতী ও সলেমান বয়াতী, বাড়ী আছ নাকি?
আমীরনঃ ক্যাডা, ক্যাডা জিগায়?
ওয়াজেদঃ আমি ঐ পাড়ার খন্দকার ওয়াজেদ আলী
আমীরনঃ তারে  কি দরকার? হে তো বাড়িতে নাই।
ওয়াজেদঃ না মানে,ওতো আমাগো গৌরব। মুক্তিযোদ্ধা- জয় বাংলার সৈনিক। মনে বড় আশা ছিল যুদ্ধে যামু। এই দ্যাহো আমি ট্রেনিং কইরাও যাইতে পারলাম না।
কেতরঃ হে- হে- হে। হুজুর আপনার আর কী আশা ছিল।
আমীরনঃ আমনেরা এহোন যান। হে আইলে আমি আমনের কতা কমু হানে।
ওয়াজেদঃ আহা........ । লক্ষী পায়ে ঠ্যালতে নাই। তারে দিয়া আমি কি করুম। দরকারতো তোমারে। ঘরে মেজবান আইলে একটু খাতির যতœ করতে হয় না?
আমীরনঃ সুন্নতী লেবাস পইরা  এইসব কি কতা কন? শয়তান বদমাইশ, এই দিকে আর একটু ও আগাই বিনা কইতাছি।।
ওয়াজেদঃ (অট্রহাসি দিয়ে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে) কেতর আলী শালিরে আমি নিতাছি তুই মাইয়াডারে নিয়া চল মেজর সাব পাইলে খুশি হইবো।
আমিরনঃ ছাড় কুত্তার বাচ্চা। তগো মা বোন নাই। তগো উপর আল্লার গজব পরবো। তোরা শান্তিতে থাকতে পারবি না।
মেয়েঃ ছাড় শয়তান ছাড়, তোরা আমাগো ছাড় কইতাছি।
*একদিক দিয়া ওয়াজেদ আলী, গায়েনের বউ ও মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, অপর দিক দিয়ে আবার ওয়াজেদ কেতর আমীরন ও মেয়েকে নিয়ে ঢুকবে মেজর সাবে ক্যাম্পে।
ওয়াজেদঃ হুজুর, এই যে, আপনার সুন্দরী লাড়কী
মেজরঃ আও লারকী আও। হাম তুমকো সাদি করতাম। হাম তুমকো বিবি বানাইতাম। আও মেরা দিলের রানী। তুম বহুত সুরাত হে।
আমীরনঃ না- না- না। আমার গায় হাত দিবি না কইলাম, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বরের দোহাই দিয়া কইতাছি আমারে ছাইড়া দে।
মেয়েঃ বেঈমান, রাজাকার, আমাগো ছাইড়া দে। অবলা  মাইয়া মানুষ লইয়া টানাটানি করছ ক্যান। পারলে মুক্তিযোদ্ধার সামনে গিয়া খাড়া। আমার বাজানে হুনলে তোগো কাইট্টা কুত্তা দিয়া খাওয়াইব।
মেজরঃ গায়েনের বউকে অত্যাচার করতে উদ্যত হয় তখন সাজু কেতরের হাত থেকে ছুটে গিয়ে মেজরের উপর ঝাপিয়ে পড়ে বলে আমার মায়রে ছাইড়া দে কইতাছি। মেজর তখন রাগ হয়ে গলায় ফাস দিয়ে সাজু কে মেরে ফেলে।
(আমীরনকে টেনে নিয়ে ভিতরে নিয়ে যায় এবং সকলের প্রস্থান)
নবম দৃশ্য:
বাদলঃ হুনছনি তোমরা কালকিনি, রাজৈর ও শিবচর হানাদারমুক্ত অইয়া গ্যাছে। চিন্তুা কইরো না আমরাও শীঘ্রই মুক্ত অইয়া যাইমু। আমাগো দ্যাশ ও স্বাধীন অইয়া যাইব।
মানিকঃ ভাই, রফিকের তো কোন খোজ পাইলাম না।
বাদলঃ রফিকের ঐ দুঃসম্পর্কের বোন কি জানি অর নাম বেনু না কি জানি? অয়তো গোপনে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাগো অনেক সাহায্যে তরছে। অর খবর কী?
মানিকঃ হ- ভাই বোইনডা আমার দ্যাশের লাইগ্যা নিজের ইজ্জত পর্যন্ত হারাইছে। তয় হুনছি হানাদারগো খতম না কইরা বেনু  ও থামবো না।
বাদলঃ হ-বেনু পারবো। অর বুকের মধ্যে জেদ ধইরা গ্যাছে। ও এহোন জীবনের পরোয়া করে না। কি নিয়াই ও বাচবো মাইয়াডা।
মানিকঃ বয়াতী ভাই কি হইছে- তুমি এত অস্থির ক্যান?
বয়াতীঃ সাইদুলের কাছে হুনলাম ওয়াজেদ আলী নাকি আমার বউ আর মাইয়ারে ধইরা নিয়া গ্যাছে। বাদলরে আমার সব শ্যাষ হইয়া গ্যালো রে ভাই সব শ্যাষ হইয়া গ্যালো।
বাদলঃ আইজ এতগুলা দুঃসংবাদ আমারে দিলা। বয়াতী কান্দ ক্যান। কাইন্দা কোন লাভ নাই, এই ধরো অস্ত্র, এইডারে চাইপ্পা ধরো। মনটারে শক্ত করো, বাঁচতে অইলে লড়তে অইবো। সব কিছুর বিনিময়ে অইলেও দ্যাশ স্বাধীন কইরা ছাড়–ম। চলো তোমরা, আইজই সমাদ্দারের দিকে, ঐখানে আর্মিগো গাড়ি আইসা জড়ো হইছে। অগো খতম করতেই হইবো।
বয়াতীঃ বাদলরে না আমি আর কান্দুম না, আমি এইবার পাকিস্থানি ক্ত্তুার বাচ্চাগো কইলজা টাইন্না বাইর কইরা কুত্তা দিয়া খাওয়ামু।
মানিকঃ চল সবাই (একদিকে দিয়ে বের হয়ে অন্য দিক দিয়ে ঢুকবে এবয় আর্মিদের সাথে যুদ্ধ করবে।
এক জন : আমাদের গোপন সংবাদ দাতা জানিয়েছে মাদারীপুর থেকে আর্মিরা সব কিছু নিয়ে যে কোন সময় পালিয়ে যাবে।
বাদল : ঘটকচর থেকে প্রতিরোধ শুরু করতে হবে। এই যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতে হবে।
যুদ্ধের সময়
বাদলঃ বাচ্চু তুই গ্রেনেড সাবধানে মার। ওরা কিন্তু রাস্তার ওপারে বন্দুক তাক করে আছে।
মানিকঃ তুই যা বাচ্চু আমি তোরে কাভার দিতাছি।
 আর্মিঃ মুক্তির উপর গুলি ছোর দে। (বাচ্চুর মারা যাওয়ার শব্দ)
মানিকঃ বাদল ভাই বাচ্চু মনে হয়,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
বাদল : মেজর খটক, তুমি আতœসমর্পন কর। মুক্তি যোদ্ধারা তোমাদের চারিদিক ঘিরে ফেলেছে।
 *যুদ্ধের ময়দানে মানুষ মরে পড়ে থাকবে ঐ দিকে বাদলের কাছে মেজর সাব সাদা রুমাল দেখিয়ে আত্মসমর্পন করবে।
(থমথমে পরিবেশ থাকবে)
শেষ দৃশ্য:
(যুদ্ধ শেষ। জয় বাংলার মিছিলে। বয়াতী ছুটে আসে তার বাড়ী অন্যদিকে জয়বাংলার মিছিলের  শব্দ শুনে রফিকের মাও ছুটে আসে বয়াতীর বাড়ী)
বয়াতীঃ আমীরন, সাজু তোমরা কই? এই দ্যাগো আমি আইছি। দ্যাশ স্বাধীন করে আইছি।
(বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে)
রফিকের মাঃ সোলেমান ভাই তুমি আইছ? তয় বড় দেরি কইরা হালাইছো। তোমার মাইয়াডা আর ফিরতে পারে নাই, বউডা সব হারাইয়া পাগল হইয়া গ্যাছে। হয়তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাছে........। (হাঠাৎ রফিকের কথা মনে হয়ে ব্যাকুল হয়ে গায়েনকে প্রশ্ন করবে)
রফিকের মাঃ গায়েন ভাই তুমি একলা আইছ ক্যান? আমার রফিক আহে নাই। আমার রফিক কই। গায়েন ভাই তুমি কথা কওনা ক্যান?(গায়েন শোকে বিহ্বল হয়ে কান্নাজরিত কন্ঠে বলে)
বয়াতীঃ ভাবীসাব তোমার রফিকের কোন খোজ পাই নাই(রফিকের মার চিৎকার কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে আসবে) না........... আমার রফিক..............................
রফিকের মাঃ আমার বাজান, আয় বাব, তুই ফিরা আয় যুদ্ধ তো শ্যাষ তুই এহোনো কি করছ? সবাইতো ঘরে ফিইরা আইছে, তুই কবে আবি বাজান কবে? আয়.............বাবা আয়( বলে কানতে কানতে বেরিয়ে যাবে, গায়েন রফিকের মার পিছন পিছন গিয়ে আবার ফিরতে যাবে এমন সময় আমীরন পাগল বেশে প্রবেশ করবে এবং গায়েন দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে। বউকে ধরতে যায় সে ছিটকে দুরে সরে যায়)
আমীরনঃ না আমারে ছুইবিনা ছুবিনা কইতাছি, পর পুরুষ আমার সব কাইরা নিছে। তুই আবার কোন পুরুষ? তুই আবার কি চাষ(কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে)
বয়াতীঃ আমীর আমার আমীরন। আমি তোমার গায়েন আমীর। আমার সাজু মইরা গিয়া বাইচ্চা গ্যাছে। দ্যাশের জন্য শহীদ হইছে। এই দৃশ্য দেখার আগে আমি ক্যান শহীদ হইলাম না? আমু...... আমুরে কতা কও আমীর কতা কও। (বলে জোরে ঝাকুনী দেয়)
আমীরনঃ (স্মৃতি ফিরে পেয়ে) আমি মরি নাই? আমি বাইচ্চা আছি ক্যান? গায়েন কতা কও ক্যান আমি বাইচ্চা আছি? কি আছে আমার? তুমিতো দ্যাশ স্বাধীন করছো। কত মানুষের মুখে হাসি ফুটাইছো। হ্যারা কি পারবো আমাগো ইজ্জত ফিরাইয়া দিতে। জানো ওরা আমার আর সাজুর ইজ্জত একলগে নিছে। (আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে গায়েনের বুকে।)
বয়াতীঃ চুপ করো, আমীরন চুপ করো, আর কইওয়ানা তুমি চুপ করো। (গায়েনের কোলে আমীর মারা যায়) আমির কতা কও, কতা কওনা ক্যান? চোখ খোল আমীরন চোখ খোল।( কান্নারত অবস্থায় আমীর কতা কও বলে জোরে চিৎকার করে)
বয়াতীঃ আমার আমীরন কতা কয়না। তোমরা কতা কওনা ক্যান? তোমরা চুপ কইরা রইছো ক্যান? দ্যাহো তোমরা, দ্যাশের লাইগ্যা আমি আমার সব হারাইলাম। তোমরা আমারে ফিরাইয়া দিতে পারবা? পারবানা। তোমাগো কাছে কিছু চাই না আমি, খালি আমার নিষ্পাপ মাইয়া আর বউরে যারা নষ্ট কইরা মারছে,যারা আমাগো মাছুম বাচ্চুরে মারছে, যারা এই দ্যাশের লগে বেঈমানী করছে যাগো হিং¯্র থাবায় দ্যাশ আর দ্যাশের মানুষ ধ্বংস হইয়া গ্যাছে, আমি হেইসব ওয়াজেদ আলী আর কেতরগো বিচার চাই। পারবানা তাগো বিচার করতে? আমি মরার আগে আমার “একটাই চাওয়া” একটা জিনিস দেইখ্যা যাইতে চাই আর কিছু চাই না (বলতে বলতে কান্নারত অবস্থায় পতাকা দিয়ে  বউকে ঢেকে কোলে নিয়ে এগিয়ে যায়)
* নেপথ্যে গান বাজবে-একসাগর রক্তের বিনিময় বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা)
:সবাই ফ্রীজ: