সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
রাত জেগে মাছ
ধরার কারণে সবাই মোতালেবকে ‘মাউছ্যা ভূত’ বলে ডাকে।তাতে তার কিছু যায় আসে না। সারাদিন রাজ্যের খাটাখাটুনির পরও রাতে মাছ ধরাই
তার শখ।
প্রতিরাতে খেয়ে-দেয়ে
খ্যাপ জাল আর একটা পাতিল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মোতালেব। গ্রামে রাত বলতে আটটাই অনেক রাত।
উড়ার চর গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ আসেনি। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া
সেরে তেলের বাতি বা হারিকেন নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। শুধু শুধু তেল পুড়বে কেন? দু’চারটা
ঘরে যারা পড়াশুনা করে তারা বড়জোর রাত ১০টা পর্যন্ত সজাগ থাকে। এছাড়া সবকিছু নিশ্চুপ
নিঝুম। যেন এক ভুতুড়ে গ্রাম।
রাতে বের হলে
গা-টা একটু ছমছম করে। ঘর থেকে আড়িয়াল খাঁ নদ বেশি দুরে নয়। তবে একটা চর পার হতে হয়।
একসময় আড়িয়াল খাঁর ভাঙনে উড়ার চরের প্রায় অর্ধেকটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তারপর নাকি
বাহাদুরপুরের পীর সাহেবেদের তাবিজ পড়ায় নদী ভাঙন রোধ হয়। কিছুদিন পরে এ চর জাগে।
চরে এখন কয়েকটা
বাড়ি-ঘর হয়েছে। বান্দা গ্রাম যাদের জায়গা-জমি কম, তারা চরে গিয়ে বাড়ি করেছে।তাদের বেশির
ভাগই মৎস্যজীবী। নদীকেন্দ্রীক তাদের জীবন। মোতালেব বান্দা গ্রামে থেকেও মাছের নেশায়
বুদ হয়ে থাকে। মাছ ধরতে তার কোনো সঙ্গী লাগে না। একাই যায়, একাই মাছ ধরে, একাই বাড়ি
ফেরে। কাউকে সাথে নিলে আবার ভাগ দিতে হবে। কেনো দিন পাতিল ভর্তি মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরে।
যেদিন মাছ কম পায় সেদিন ভোর হয়ে যায়। বাড়ি ফেরার নামগন্ধ থাকে না। বাড়ি এলে বাবা-মার
বকুনি শুনতে হয়। বাবা বলে, ‘অ্যাতো ডাঙ্গর অইছে তাও বোধ-বুদ্ধি নাই।’ মোতালেবের তাতে
কী আসে যায়? মাছ রেখে পুকুরে যায় গোসল করতে। গোসল করে এসে যা পায়- তাই খেয়ে নেয়।
সকালে ওয়াজেদ
বেপারীর দোকানের সামনে মাছগুলো নিয়ে বসে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। কী
আনন্দ মোতালেবের। পকেট ভর্তি টাকা। অর্ধেক বাবাকে দিয়ে বাকিটা নিজের ব্যাংকে জমা রাখে।
ব্যাংক বলতে বছর দুয়েক আগে বড় ফাইলের একটি বাঁশ কেটে একটা ব্যাংক বানিয়েছে। বাঁশের
এক গিট থেকে অন্য গিট পর্যন্ত রেখে উপরে একটা ফুটা করে নিয়েছে। কত টাকা জমা হয়েছে আজও
জানে না সে। কেবল রেখেই যাচ্ছে।
মাছ ধরা টাকা
নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার। এখনো বিয়ে করেনি। বিয়ে করতে হলে টাকা জমাতে হবে। তাই জমায়। কয়েকটা
মেয়ে ইতিমধ্যে দেখেছে। কিন্তু মনমতো হচ্ছে না। দেখুক না আরো। পছন্দসই হলে বিয়েটা করে
ফেলবে।
হাঁটতে হাঁটতে
ভাবতে ভাবতে হিজল গাছটার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় মোতালেব। হঠাৎ একটা দমকা বাতাস লাগে
গায়। শরীরের পশমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। শরীরের মধ্যে শিরশির করে ওঠে। এদিক-ওদিক তাকায়। না,
কিছুই না। তবে গা ছমছম করছে কেন? লুঙ্গির গাটে বাঁধা প্যাকেট থেকে একটা চাঁন বিড়ি বের
করে ধরায়। আগুন দেখলে ভুত-পেত্নী কাছে আসার সাহস পায় না। হিজল গাছের ঝোপের মধ্যে খছখছ
শব্দ হয়। কিছু একটা উড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়। মনে মনে ভাবে, ধুত্তরি, কোন পাখি-টাখি
অইবো হয়তো।খালি খালি ভয় পাইতাছি ক্যান?
সামনের দিকে এগিয়ে
যায় মোতালেব। কিছুদূর যেতেই মনে হয় পেছনে পেছনে কেউ হেঁটে আসছে। পেছনে তাকালে কিছুই
দেখা যায় না। ভাবে, পায়ের আওয়াজ আসে কোত্থেকে? কোনো উৎস খুঁজে পায় না। তবুও ভয়ে গা
শিউরে ওঠে। গা ছমছম করে। মনে মনে একটু সাহসও পায়। সাথে লোহা থাকলে ভুত-পেত্নী আসে না।
লোহাতো আছেই। কাধে ঝোলানো জালটাকে জোরে ঝাকি দেয়। জালের সঙ্গে থাকা লোহার কাঠিগুলো
ঝনঝন শব্দে বেজে ওঠে। একবুক সাহস নিয়ে এগিয়ে যায় নদীর দিকে।
নদীর পাড়ে গিয়ে
এদিক-সেদিক তাকিয়ে জালটা ঠিক করে নদীর জলে খ্যাও মারে। দুহাতে টেনে তোলে। হঠাৎ পিছনে
শো শো বাতাস। পাট-মেস্তা গাছগুলো বাতাসে হেলে পড়ে। পেছনে তাকাতেই সব স্বাভাবিক। আবারও
একটু ভয় দানা বাঁধে মনে। জাল ততক্ষণে উপরে উঠে আসে।
আকাশে উজ্জ্বল
চাঁদ। তারা জ্বলে মিটিমিটি। আলো-আঁধারির খেলা। হালকা আলোয় সাদা সাদা ছোট-বড় মাছগুলো
চিকচিক করছে। মাছ পাওয়ায় আনন্দে মোতালেবের চোখও চিকচিক করে ওঠে। জাল থেকে মাছগুলো ছাড়িয়ে
পাতিলে রাখে। মাছ পাওয়ার আনন্দে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মন থেকে ভয় নামক দানবটি সরে যায়।
এগিয়ে যায় নদীর বাঁকে। যে বাঁকটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে সূর্যমনির দিকে। রাত বলেই ট্রলার
চলাচল বন্ধ। একটু দূরে ছোট ছোট নৌকায় মিটমিট করে জ্বলছে আলো। যার নৌকা আছে- সে নৌকায়
বসে মাছ ধরে।
নদীর বাঁকে গিয়ে
পাতিলটা মাটিতে রেখে আরেকটা খ্যাও মারে। একটু দম ধরে। জালটা পানির নিচে মাটি অবধি পৌঁছে
থিতু হওয়ার সুযোগ দেয়। লুঙ্গির কোচর থেকে একটা চাঁন বিড়ি বের করে ধরিয়ে ঠোঁট দিয়ে চেপে
ধরে টানতে থাকে। শুরু হয় জাল ওপরে তোলার পালা। জালটা মনে হলো হালকা। খুব সহজেই উঠে
আসে। দুএকটা পুটি ও ট্যাংরা লেপ্টে আছে। একটা পুটি মাছ খুলে পাতিলে রাখতে গিয়ে চোখ
ছানাবড়া। একি? পাতিল শূন্য। মাছ গেলো কোথায়? ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে। হাত-পা কাঁপতে থাকে।ভূতেরা
মাছ খায়। পুরুষ হলে তাকে ‘মাউছ্যা ভূত’ আর স্ত্রী হলে ‘মাউছ্যা পেত্নী’ বলে। মোতালেব
নিশ্চিত। এ তবে ভূতের কারবার। আজ তাহলে রক্ষা নাই।
ভয় আর উৎকণ্ঠায়
দম খিঁচে বিড়ি টানতে থাকে মোতালেব। অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক তাকায়। কোনো জনমানবের সাড়াশব্দ
নাই। হঠাৎ মনে পড়ে মোতালেবের দাদা ইব্রাহীম বেপারি ভূতের গল্প বলতেন। তখন সেগুলোকে
গল্প মনে হলেও এখন বাস্তব ভূতের খপ্পড়ে পড়েছে সে। বাড়ির পিছনে থেকেই তার পিছু নিয়েছে
ভূত। বুঝতে বাকি নেই। বাড়ির পিছনে শিমুল গাছের সাথে আব্দুর রহিম শিকদার ভূত বেঁধে রেখেছিলেন।
একথা তাহলে সত্যি। রহিম শিকদার বেঁচে নেই। তাই হয়তো ভূতগুলো মুক্তি পেয়েছে।
ওয়াজেদ বেপারির
দোকানের সামনে বসে একদিন শুনেছিলো- একবার নাকি মাছ ধরতে গিয়ে ভূতের সাথে ধস্তাধস্তি
হয়েছে বশার রাঢ়ির। সেকি মারামারি। সারারাত কুস্তি। বশার রাঢ়িও কম না। পিছু না হটে ভূতের
সাথে মারামারি জুড়ে দিলেন।প্রথমে নাকি বিশাল ষাড়ের মতো ছুটে আসলো। বশার রাঢ়ি শক্ত হয়ে
দাঁড়িয়ে শিং দুটো ধরে হ্যাচকা টানে কাৎ করে ফেললেন ষাড়টাকে। গৎ করে একটা শব্দ হলো-তারপর
উধাও।
হঠাৎ পেছনে ম্যাও
ম্যাও শব্দে ডেকে উঠলো একটা কালো বিড়াল। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। তেড়ে আসছে কামড়াতে।
বশার রাঢ়ির পায়ে প্লাস্টিকের জুতো। সজোরে লাথি মারলেন। বিড়ালটা ছিটকে পড়লো দূরে। বিড়ালের
আর অস্তিত্ব নেই। যেই বাড়ির পথে পা বাড়াবেন অমনি সামনে ফোঁস করে উঠলো একটা সাপ। দৌড়ে
পালাচ্ছেন, সাপও পেছন পেছন ছুটছে। দৌড়াতে দৌড়াতে পেয়ে যান কাফলা গাছের ডাল। ভেঙে দাঁড়ান।
সাপ কাছে চলে আসে। বশারের নিশানা ভুল হয় না। এক আঘাতে কাৎ। তবু ফণা তুলে আসতে চায়।
সপাৎ সপাৎ কয়েক ঘা মরে অর্ধেকটা নরম মাটির মধ্যে পুতে ফেলেন। তবে মজার বিষয় হলো- সকাল
বেলা খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেলো সেখানে মরা সাপের কোনো চিহ্ন নেই। পড়ে আছে একটা মরা
কাক। মোতালেব জানে, ভূতেরা মরে গেলে কাক হয়ে যায়।
মোতালেব মনে মনে
সাহস সঞ্চারের চেষ্টা করে। জালটা শক্ত করে হাতের মুঠোয় ধরে। এটুকু সাহস তার আছে। লোহার
কাঠি সমেত জাল যতক্ষণ তার হাতে থাকবে ততক্ষণ ভূত-পেত্নী কাছে ঘেঁষতে পারবে না। দূর
থেকে শুধু ভয় দেখাবে। শত সাহসের মধ্যেও বুকটা কেমন ধুকধুক করে। পেছনে কিছু একটা ভাঙার
শব্দ হয়। তাকিয়ে দেখে পিছনের পাটখেত ভেঙে তছনছ করছে কালো রঙের একটা ষাঁড়।
মোতালেবের বুঝতে
বাকি নেই- গল্পই এবার সত্যি হলো। এই রাতে একা নদীর ঘাটে। চিৎকার করারও প্রবৃত্তি হয়
না। কেইবা শুনবে তার চিৎকার। ভূত আজ সহজেই তার পিছু ছাড়বে না। গলায় বাঁধা তাবিজটা একবার
দেখে নেয়। সঙ্গেই আছে। তাবিজে একটা চুমু খায়। তাবিজটা খাদেম আলী শিকদার তাকে দিয়েছিলো।
রাত বিরাতে চলাচলের জন্য। তাবিজেও আজ কাজ হচ্ছে না দেখে বিস্মিত মোতালেব। তাবিজের কার্যক্ষমতা
কি শেষ হয়ে গেলো? নাকি ‘ছুইৎ’ লেগেছে? বাড়ি গিয়ে সোনা-রূপার পানি দিয়ে ধুয়ে নিবে। কিন্তু
সেটা তো পরে। এখনতো রক্ষা পেতে হবে।
ভাঙচুরের শব্দ
শেষ। ষাঁড়ও উধাও। পাটখেত আগের মতোই গোছালো। কোনো আলামত নেই। কাউকে বললেও বিশ্বাস করবে
না। এমন সময় নারী কণ্ঠের কান্নার আওয়াজ আসে। ডান দিকে তাকিয়ে অবাক। নদীর পাড়ে পা ছড়িয়ে
বসে এক তরুণী কাঁদছে। চাঁদের আলোয় তার ঔজ্জ্বল্য মোতালেবকে হতবাক করে দেয়। মুহূর্তেই
অন্য রকম ভালো লাগা অনুভূত হয়। মেয়েটি কাঁদছে কেন? এতরাতেই বা কোত্থেকে এলো? মেয়েটির
জন্য মায়া হয়। এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে।
মোতালেব যতটুকু
আগায় মেয়েটি ততটুকু দূরে সরে যায়। এভাবে ১০ মিনিট আগানোর পর মেয়েটি দাঁড়ায়। মোতালেব
মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিকট হাসিতে মাঠ কাপিয়ে তোলে মেয়েটি। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে
আসে আগুনের ফুলকি। মোতালেব মুহূর্তেই চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখে মেয়েটি
নেই। মোতালেব আস্তে আস্তে ঢলে পড়ে মাটিতে।
তখন ভোরের আলো
ফুটেছে। নদীর পাড়ে যারা নৌকা ভিড়িয়েছে তাদের ভিড় এখন মোতালেবকে ঘিরে। মোতালেব চোখ তুলে
তাকায়। তাকে ঘিরে আছে গ্রামের মানুষ। কিছুটা অবাক হয়। কিছুই মনে পড়ে না তার। কোথায়
জাল আর পাতিল ফেলে এসেছে বলতে পারে না। কেউ একজন নদীর কিনারা থেকে কুড়িয়ে আনে। মোতালেবের
বাড়ির লোকজন এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। সোনা-রূপার পানি দিয়ে গোসল করায়। ফকির-কবিরাজ ডেকে
আনে। ফকির বাবা বলেছে, ‘তাক্কুর তুক্কুর, তাকে বলে দিও। সে বাঁচবে কি বাঁচবে না। শক্ত
সামর্থ ছোকড়া, তাকে রূপবতীর হাতে পানি পান করাও।’ যার সারমর্ম- ছেলেকে বাঁচাতে হলে
শিগগিরই বিয়ে দাও।
এবার জোরেশোরে
চলছে মেয়ে খোঁজা। পাশের ভবানী শংকর গ্রামে এক মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেলো। মোতালেবকে সাথে
নিয়ে চলল তার বাপ-চাচারা। নাস্তা-পানি খাওয়ার পর মেয়েকে আনা হলো সামনে। শান্ত-শিষ্ট
স্বভাবের মেয়েটির মুখখানা একনজর দেখানোর জন্য ভাবি জাতীয় কেউ মুখের ঘোমটাখানা সরালো।
মোতালেব একনজর তাকিয়েই চিৎকার করে উঠলো। চোখ বড় বড় করে বলল, ‘না, এইডাতো সেই মাইয়া।
রাইতে যারে দেখছিলাম।’ বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে পাগলের মতো ছুটতে থাকে। মোতালেবকে ধরার
জন্য পেছন পেছন ছোটে কয়েকজন। মোতালেবকে ছোঁয়ামাত্রই অজ্ঞান হয়ে যায়।
সালাহ উদ্দিন
মাহমুদ
বিজয় নগর, ঢাকা।
০১৭২৫৪৩০৭৬৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন