সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৩

ভাব ও অভাবের তাড়নায় আমি লিখি

:: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ::
মাদারীপুরের প্রথম শ্রেণির আলোচিত ‘সাপ্তাহিক আনন্দবাংলা’য় নিয়মিত লিখতে গিয়ে অনেক প্রশংসা পেয়েছি আবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি। মাদারীপুরের যৌনকর্মীদের ওপর লেখার জন্য পত্রিকার প্রকাশক শহীদুল কবির খোকন, সম্পাদক ইয়াকুব খান শিশির ও প্রধান সম্পাদক সুবল বিশ্বাস বিশেষ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমি সম্পাদকের ছাত্র বা শিষ্য। তার দয়ায় লেখার অনুমতি পাই। তাই পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য লিখি। মূলত অন্যরা যা নিয়ে মাথা ঘামায় না আমি তা নিয়েই উঠে-পড়ে লাগি।
কেন লিখি? এমন প্রশ্ন করলে বলব, ভালো লাগে তাই। এছাড়া আমি চাঁপা স্বভাবের মানুষ। সব কথা বলতে পারিনা তাই লিখে প্রকাশ করি। ভালো লাগা থেকে শুরু হলেও এখন তা ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে। আর ভালোবাসার প্রতি একটা দায়িত্ববোধ এসে যায়। মূলতো আমি আশাবাদী ও স্বপ্নবিলাসী। তবে আমার কোন উচ্চাশা নেই। আমার আশাবাদ ও স্বপ্নবিলাসই আমাকে লেখক হতে উৎসাহ যুগিয়েছে। লেখকের মাঠে আমি কচ্ছপগতীর একজন প্রতিযোগী। অনেকের চেয়ে অনেক পেছনে। তাই বলে আমি থেমে নেই। লিখছি এবং লিখব। এটাই আমার দৃঢ় প্রত্যয়।
সেই তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন একটা গল্প লিখেছিলাম। লিখে লুকিয়ে রাখলাম। তবুও তা পরিবারের কর্তাব্যাক্তিদের হাতে পৌঁছে গেল। স্কুল থেকে ফিরে দেখি সবাই আমাকে দেখে মুচকি হাসছে। মা জানালেন আসল ঘটনা। আমি লজ্জা পেলাম। আমার লেখালেখির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার মরহুম নানাজান মাওলানা আফসার উদ্দিনের। ছোটবেলায় নানার কাছে থাকতাম। নানা রাত জেগে কী সব বই পড়তেন। আমিও পড়তে শুরু করি।
কবি-লেখকদের জীবনী আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। নিজেও লিখতে চেষ্টা করি। সে সময়ের লেখাগুলো এখন আমার কাছে নেই। থাকলে হয়তো নিজেই লজ্জা পেতাম। এখনো খুব ভালো লিখি কি না জানিনা। তবে প্রতি সপ্তাহে দু’একটা লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাঁপা হয়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন পাঠ্য বইয়ের একটা কবিতাকে নকল করে একটা কবিতা লিখেছিলাম। আমার মামা মাওলানা মেজবাহ উদ্দিন সেটা দেখে বললেন,‘অন্যেরটা নকল করে কেন? নিজে লেখার চেষ্টা করো।’ তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়। আমার নানা-মামা দু’জনেই ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলেও সাহিত্যকে সমাদর করতেন। নিজেরাও প্রচুর পড়তেন।
এক বালিকার প্রেমে পড়ে ডজনখানেক প্রেমের কবিতা লিখলাম। বন্ধুরা কবিতা ধার নিত। কাউকে আবার প্রেমপত্র লিখে দিতাম। নিজেও একটা প্রেমপত্র লিখে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলাম। ‘প্রিয় নদী, নদ যেমন নদীর কাছে ছুটে যায়। আমিও তেমন তোমার কাছে ছুটে যাই।’ এটা নিয়ে বকুনি খেতে হয়েছে। যদিও পত্রটা পাত্রীর কাছে পৌঁছানোর আগেই বড়ভাই মোসলেহ উদ্দিনের হাতে পড়ে। মূলত কবি বলেই ভেতরে একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব চলে আসে। এই ভাব থেকেই লেখক হওয়ার বাসনা আরো তীব্র হয়।
অভাব একটা মূল কারণ। দাদার মৃত্যু ও নদী ভাঙন আমাদের অভাবের মুখে ফেলে। টেনেটুনে সংসার চলছে। কোন আবদারই বাবা পূরণ করতে পারেন নি। অভাবের কারণেই নানা বাড়ি থাকতে হয়েছে আমাকে। এক কথায়, ভাব আর অভাবের সংমিশ্রণে কবিসত্ত্বা জেগে উঠেছে।
এখন ভাব আছে অভাব নেই। তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে শূন্য মনে হয়। কখনোই মানুষের জীবনে পূর্ণতা আসে না। কিছু না কিছুর অভাব থেকে যায়। বা লেখক-কবির অন্তরে অভাব থাকতে হয়। সেটা হতে পারে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম অভাব। এসএসসি পরীক্ষার আগ মুহূর্তে লেখার ভাবটা তীব্র হয়ে ওঠে। আমার মেজভাই নুরুদ্দিন আহমেদ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। রাতে ঘুমুতে গেলে তিনি বকতে থাকেন। ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল হবা। লেখা-পড়া নাই। সারাদিন কবিতা’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আমি চুপ। কথার জবাব দিলেন বড়ভাই। ‘লিখুক না। সমস্যা কী লিখলে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলতো একদিনেই বিখ্যাত হননি।’ আমি মনে মনে আন্দোলিত হই। উৎসাহ পাই। যা হোক অন্তত একজন আমার পাশে আছে। পরীক্ষার রাতেও কবিতা লিখেছি। অনেক টেনশন হলে কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়।
এইচএসসি পড়ার সময় একটা টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে যাই। সবাই ধরে নিয়েছিল- আমাকে দ্বারা লেখা-পড়া হবে না। অবস্থাটাও তেমন। ভর্তি হয়ে ক্লাসে যাইনা। ঢাকা থেকে চলে আসি গ্রামের বাড়ি। উপন্যাস লিখতে শুরু করি। দু’তিনটা লিখেও ফেলি। কিভাবে ছাঁপানো যায়? চিন্তাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। উপায় খুঁজে পাইনা। বাংলাবাজারের অনেক প্রকাশনীর সাথে যোগাযোগ করি। তাতে টাকার প্রয়োজন। ফিরে আসি। তবুও থেমে নেই। লিখে যাই প্রতিনিয়ত। আমার কবিতার খাতার কিছু পাঠক তৈরি হয়। তারা পড়ে উৎসাহ দেন। ভালো লাগে। পোশাক-আশাক, চলা-ফেরায় পরিবর্তন আসে। চটের ব্যাগ কিনি। পাঞ্জাবী-পাজামা পড়ি। সবাই ‘কবি’ বলে ডাকে। শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অপূর্ণতা থেকেই যায়। একটা লেখাও প্রকাশ হলোনা।
লেখা প্রথম প্রকাশ হয় খালাতো ভাই লুৎফর রহমানের সাহায্যে। ২০০৩ সালে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায়। ছাপার হরফে আমার কবিতা দেখে সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম। তা আজ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সম্মান শ্রেণিতে পড়তে এসে শ্রদ্ধেয় স্যার ইয়াকুব খান শিশিরের সান্নিধ্যে লেখালেখির তাড়নায় যুক্ত হয়ে যাই মফস্বল সাংবাদিকতায়। সংবাদের পাশাপাশি লেখালেখির একটা প্লাটফর্ম পেয়ে যাই। কলেজের নোটিশ বোর্ডের মাধ্যমে গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম গল্পেই বিশেষ পুরস্কার পেয়ে গেলাম। পুরস্কারের সুবাদে জেলা শহর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বিশ্লেষণ’ ও ‘সাপ্তাহিক আনন্দবাংলা’য় লেখার জন্য অনুমতি পেলাম। ২০০৮ সালে দৈনিক দেশবাংলার সাহিত্য পাতায় কবিতা ছাপা হলো। এরপর থেমে থাকতে হয়নি। জেলার গন্ডি পেরিয়ে জাতীয় দৈনিকসহ সাহিত্যের ছোটকাগজে লেখালেখি শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লেখা আহ্বান করে। খুলনা, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, নীলফামারি, জামালপুর, হাতিয়া, আগৈলঝাড়াসহ বিভিন্ন শহর থেকে আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। সর্বোপরি দেশের বাইরে ভারতের কোলকাতার ‘কারক’ সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হওয়ার আনন্দে এখনো চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। আর এ লেখাটা মূলত সম্পাদকের নির্দেশে। নির্দেশ বলবো একারণেই যে, আমার কাছে লেখা চেয়ে অনুরোধ করার মতো ক্ষুদ্র মানুষ তিনি নন। বরং আমার মতো ক্ষুদ্র লেখককে লেখার জন্য বরং নির্দেশ করা যায়।
কেন লিখি? এমন প্রশ্নের জবাবে এতক্ষণ নিজের ঢোল নিজে পেটালাম। আমার ঢোল আমি পেটালে অন্যরা পিটাবে কী? আমি শুধু বলবো- মনের তাগিদেই লিখছি। লেখাটা একটা নেশায় পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে মন থেকে যখন ভাব ও অভাব দূর হয়ে যায়; তখন কিছুই লিখতে পারিনা। চেষ্টা করেও পারি না। সে সময় অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগি। মনে হয় আমি আমার লেখক সত্ত্বাকে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে অসহায় মনে হয়। ভাবের জন্য বিরহের দরকার। অভাবের জন্য ঔদাসিন্য দরকার। তখন দু’টাকেই অর্জনের চেষ্টা করি।
‘প্রেমের পরশে প্রত্যেকেই কবি হয়ে ওঠে’ কিংবা কবিতার জন্য কবিকে প্রেমে পড়তে হয়। আমি প্রেমে পড়ি। কিন্তু আগলে রাখতে পারিনা। সঙ্গত কারণেই বিরহ অবধারিত। তখনই প্রত্যেকটি কথা হয়ে ওঠে একটি কবিতা বা গল্প। সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো যখন নাড়া দিয়ে ওঠে- হয়ে যাই বিদ্রোহী। আত্মার প্রশান্তির জন্য রচনা করি নাটক। এবং তাতে নিজেই অভিনয় করি।
লেখালেখি করি ঠিক কিন্তু সমস্যা পিছু ছাড়েনা। মফস্বল শহরে থাকি বলে লেখার জন্য কোন পারিশ্রমিক জোটেনা। ফলে বাধ্য হয়ে অন্য কাজও করতে হয়। কিন্তু কোন কাজই আমার জন্য স্থায়ী হয়না। কবিতার কারখানায় যেমন শ্রমিক- জীবিকার তাগিদেও শ্রমিক হতে হয়। এখনো পরিবারের গঞ্জনা রয়েছে। রয়েছে প্রিয়তমার তিরস্কার। ‘কিছু একটা করো’র তাগাদা। আমিতো কিছু একটা করছি। কিন্তু তাতে অর্থ নেই। আর সবাইতো অর্থই চায়। তবে আমি বিশ্বাস করি, অর্থ ও খ্যাতি একসাথে আসেনা। লেখালেখির ক্ষেত্রে অর্থ আশা করাটাও অরণ্যে রোদন মাত্র। দেশে হূমায়ুন আহমেদ আর ক’জন?
এবার মূল কথায় আসি। বাংলা সাহিত্যে প্রেম রোমান্স এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কবিতা লিখতে গিয়ে কবিকে প্রেমে পড়তে হয়। অথবা প্রেমে পড়ে তাকে কবিতা লিখতে হয়। দু’টাই চিরন্তন সত্য। কবি মনে প্রেম জাগ্রত না হলে কবিতা হয় না। সাহিত্যচর্চার জন্য প্রেম অনিবার্য। আর সে চর্চাকে অব্যাহত রাখতে হলে বেছে নিতে হয় বিরহকে। কারণ মিলনের চেয়ে বিরহ কবিকে নতুন স্বপ্ন দেখায়। নব সৃষ্টির উন্মাদনা জাগ্রত করে। কবিতার সাথে যেন প্রেমের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। লোকে বলে- কবি মানেই প্রেমিক। আর প্রেমিক মানেই কবি। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর যিনি জীবনে অন্তত এক লাইন প্রেমের কবিতা বা ছন্দ রচনা করেন নি। সবার জীবনে একবার প্রেম আসে- কথাটা যেমন সত্য; ঠিক তেমনি জীবনে অন্তত একবার কাব্য রচনা বা সাধনা করেন নি একথাও অস্বীকার করার জো নেই। কেউ যদি মনে-প্রাণে,ধ্যানে-জ্ঞানে কবি হন তবেতো কথাই নেই। বর্তমানে যারা খ্যাতনামা কবি বা যারা প্রতিষ্ঠার জন্য কাব্যচর্চা করছেন প্রত্যেকেই হয়তো প্রথম জীবনে কোন বালিকার উদ্দ্যেশ্যে প্রেমকাব্য রচনার মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন।
পড়নে পাঞ্জাবী-পায়জামা আর পায়ে চটি জুতো পড়ে কাধে একটা চটের ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে প্রথম দর্শনেই সবাই তাকে কবি বা লেখক ভাববেন। ভাবাটাই স্বাভাবিক। বেশ-ভূষায় কবি বা লেখক হলেই কী প্রকৃত লেখক হওয়া যায়? যায় না। লেখকের প্রাণশক্তি তার লেখনী। লেখনীর মাধ্যমেই সে পাঠক মহলে কবিখ্যাতি বা লেখক হিসাবে পরিচিতি লাভ করবেন। আসলে লেখক হওয়ার উপায় কী? শুধু কি কালি-কলম-মন দিয়েই লেখা যায়? নাকি আরও কিছু দরকার হয়? আপনারা যারা লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, তারা নিশ্চয় এই প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজছেন।
খালাতো ভাই মহিউদ্দিনের দেখাদেখি লেখালেখি করার সাধ জাগে। তার কন্ঠে আবৃত্তি শুনতাম। সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ বহুবার শুনেছি। তার লেখা একাধিক কবিতাও পড়েছি। তার স্টাইল আমাকে আকৃষ্ট করে। তাকে অনুসরণ করতে শুরু করি। কিন্তু আজ তিনি লেখালেখি জগতে নেই। পারিবারিক সংঘাতে বিপর্যস্ত এক দিকহারা নাবিক। জীবন-জীবিকার সন্ধানে তার কবি প্রতিভা আজ বিলুপ্ত এক ঐতিহ্য। আমি কিন্তু থেমে যাইনি। হেরে যেতে চাইনি বা হেরে যাইনি। আমি এর শেষ দেখবো। লেখালেখির প্রসঙ্গ এলে খুব বেশি মনে পড়ে নানাজান, মামা, বড়ভাই, মেজভাই, বড়দা, শিশির স্যার, ঢাকার কবি মুনশী মোহাম্মদ উবাইদুল্লাহ, জামালপুরের কবি ও রচয়িতা সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ও হারিয়ে যাওয়া কবি সেজভাইকে। আমার পিছনে তারা প্রত্যেকেই অনুপ্রেরণা। আমার মাথার ওপরে তারা বটবৃক্ষের ছায়া।
বিশেষ করে আমার বাবা আমার একনিষ্ঠ পাঠক। আমার শুভাকাঙ্খি। তিনি আমাকে ব্যাপক উৎসাহ দেন। যদিও একসময় বিরোধিতা করতেন। কারণ তাকে বোঝানো হয়েছিল- বাংলায় পড়ে ছেলেটা উচ্ছন্নে যাবে। চটের ব্যাগ নিয়ে ঘুরবে। বিশ্রী অর্থে- দাঁড়িয়ে প্রসাব করবে। ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার করবেনা। আজ ভুলে গেছি সে সব কথা। বরং সে সমস্ত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়। কারণ তাদের তিরস্কারের কারণেই আজ আমি অনেক পুরস্কার পাচ্ছি। অনেক ভালোবাসা পাচ্ছি।
লেখা-লেখিটা প্রধানত সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক ক্ষমতা। ইচ্ছে করলেই লেখক হওয়া যায় না। তার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যবসায়। ত্যাগের মানসিকতা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। সর্বোপরি লিখতে হলে পড়তে হবে। বিশিষ্ট কবি-লেখকরা অবশ্য একথার সাথে একমত যে, ‘এক লাইন লিখতে হলে দশ লাইন পড়তে হবে।’ পড়ার বা জানার কোন বিকল্প নেই। তথ্য বা শব্দ ভান্ডার হতে হবে সমৃদ্ধ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাক বা না থাক তাতে কিছু যায় আসে না। সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় শিক্ষা একান্ত আবশ্যক। এছাড়া লিখতে গেলে অগ্রজ কাউকে না কাউকে অনুসরণ করতে হয়। অনেকেই অনেক কবি-লেখক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে লেখকের কল্পনা শক্তি হতে হবে প্রখর। লেখকের ‘তৃতীয় নয়ন’ বলে একটা বিষয় আছে। যা আর দশজন সাধারণ মানুষের নেই। কবি ও অকবিদের মধ্যে মূল পার্থক্য এখানেই। সাধারণ মানুষ যে জিনিসটি সাধারণ ভাবে দেখে; একজন অসাধারাণ মানুষ সেটাকে অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে। একজন লেখকের দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের অন্যান্য মানুষের চেয়ে আলাদা হতে হয়।
জানি না আমি তেমন হতে পেরেছি কি না? হওয়ার চেষ্টা করছি। আমি যদি ভালো লেখক নাও হতে পারি তবুও আমার অনুরোধ-আপনারা এগিয়ে আসুন। প্রত্যেকটি সমাজে অন্তত একজন করে লেখক থাকা দরকার। যদি বলেন কিভাবে সম্ভব। পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। সবকিছুর মূলে চেষ্টা। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায়। নিন্দুকের নিন্দা, মানুষের কটাক্ষ, সমাজের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই এ সাধনা চালিয়ে যেতে হয়। দস্যু রতœাকর তপস্যা করে যদি বাল্মিকী হতে পারেন। আপনি কেন পারবেন না। রামায়ণ না হোক একটা নিটোল হাসির গল্পতো লিখে যান। তা পড়ে যদি অন্তত একজনের মুখে হাসি ফোটে তাতেই আপনার সার্থকতা। এবার বলি বিখ্যাত জনেরা লেখক হওয়ার ব্যাপারে কী পরামর্শ দেন।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করতেন, যদি আজকের দিনই হয় আমার জীবনের শেষ দিন, তাহলে আমার কোন কাজটি সবার আগে করা উচিত? একজন লেখকও এ রকমভাবে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেন শব্দে শব্দে কী লিখতে চান তিনি, কীভাবে লিখতে চান, কী কথাই বা বলতে চান? অমর একুশে বইমেলার বই-গন্ধ গায়ে মেখে তোমরা যারা লেখক হওয়ার পথ খুঁজছ, যারা স্বপ্ন দেখছ ভবিষ্যতের লেখক হওয়ার, তারা তো জানোই শব্দে শব্দে মিল- অমিল দিয়ে লেখক হওয়া এত সহজ কর্ম নয়। এর জন্যও লাগে দীর্ঘ প্রস্তুতি, পড়াশোনা। তোমাদের জন্য দেশের তিন খ্যাতিমান লেখক এবার জানাচ্ছেন কেন লেখক হলেন তাঁরা, কীভাবে লেখক হলেন। অভিজ্ঞতার আদ্যপান্ত।
লেখক হওয়ার উপায় সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন- লিখতে হলে পড়তে হবে। তরুণ লেখকদের প্রতি প্রথমত এটিই আমার বলার কথা। মনে রাখতে হবে, লেখকের পথ বড়ই বিপদসঙ্কুল। এটা সম্পূর্ণ একার পথ। কঠিন এক সাধনা। কোনো লেখকের পক্ষে কি বলা সম্ভব, তিনি কেন লেখক হয়েছেন? মাঝেমধ্যে আমার মনে হয়, লেখক না হয়ে উপায় ছিল না বলেই শেষ পর্যন্ত লেখক হয়েছি। খুব ছোটবেলা থেকে কেন যে কবিতা, গল্প এসব লিখতাম, আজ সেটা স্মৃতি খুঁড়ে বের করা কঠিন। বলা যায়, যে পৃথিবীতে বেঁচে আছি সেই পৃথিবীর একটা অর্থ ও ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারি লেখার মাধ্যমে। এটি হয়তো প্রত্যেক লেখকই পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে একজন লেখকের সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট একটা ধারণা থাকা জরুরি। লেখক হতে চাইলে তুমি যা কিছু করতে চাও, তার সবই তোমাকে লেখার ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত করতে হবে। ব্যক্তিভেদে একেকজন লেখকের লেখার কৌশল একেক রকম। আমি যেমন সাধারণত একটি লেখা একবারেই লিখে ফেলি। কিন্তু লেখাটি লেখার আগে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা থাকে বিস্তর। কীভাবে আগের লেখা থেকে নতুন লেখাকে আলাদা করা যায়। এই ভাবনাও থাকে। আমি মনে করি, প্রত্যেক লেখকই তাঁর নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেন একান্ত তাঁর মতো করে।
কবি মহাদেব সাহা বলেছেন, আমি কি কবি হতে পেরেছি? জানি না। মনে পড়ে, ১৯৭৬ সালে প্রেসক্লাব-সংলগ্ন ফুটপাতের ওপর বসে একটানে লিখেছিলাম ‘চিঠি দিও’ কবিতাটি। পরে সেটি প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়। শৈশবে আমার মা বিরাজমোহিনির মুখে রামায়ণ ও মহাভারত শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তখন মনে হতো, বাল্মীকি বা ব্যাসদেবের মতো যদি কবি হতে পারতাম!
তিনি আরো বলেছেন, একটি শব্দের জন্য বসে থেকেছি সারা রাত। জীবনানন্দ দাশ কিংবা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা পড়েছি উন্মাদের মতো। পড়েছি জন কিটস, রাইনার মারিয়া রিলকে, ডব্লিউ বি ইয়েটস। পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে হয়তো কবি হয়ে উঠেছি আমি। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে কবি হচ্ছে একমাত্র অবিনাশী সত্ত্বা, রাজা, সম্রাট তাঁর কাছে কিছু নয়। তাই কবি বা লেখক হতে গেলে যেমন পড়াশোনা জরুরি, তেমনি দরকার লেখকের স্বাধীন সত্ত্বা। কারও পরামর্শ নিয়ে কেউ কোনো দিন কবি হতে পারে না।
অদিতি ফাল্গুনীর বক্তব্য এরকম, যদি মেয়ে না হতাম, তাহলে আমি হয়তো কখনোই লেখক হতাম না। কথাটি খোলাসা করি, মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী সঙ্কুচিত হয়েছে। সেই শৈশব উত্তীর্ণকালে আমার বয়সী বন্ধুগোত্রীয় ছেলেরা যেভাবে পৃথিবীকে দেখেছে, আমার দেখা ছিল তাঁদের থেকে ভিন্ন। শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে আমার পৃথিবী যে ছোট হয়ে এল, এই বেদনাবোধই আমাকে লেখক করে তুলেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, প্রতিকূলতা অনেক সময় আমাদের ভেতরের আগুনকে উসকে দেয়।
আমাদের বাড়িতে বড় একটি পাঠাগার ছিল। সেখানে ছিল রুশ সাহিত্যসহ নানা ধরনের বই। এ ছাড়া কলেজের গ্রন্থাগারে পড়েছি গ্রিক নাটক। এই পাঠ আমাকে পুষ্টি দিয়েছে। একসময় পাহাড়ে ওঠার খুব শখ ছিল, পারিনি। শেষমেষ দেখি, গল্প-কবিতা লিখতে লিখতে লেখকই হয়ে উঠেছি!
লেখালেখির জন্য প্রথমত ভাষাগত প্রস্তুতি থাকা খুব দরকার বলে আমার মনে হয়। আর ভাষাগত প্রস্তুতি গড়ে ওঠে মহৎ সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষায় লিখতে হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়া যেমন আবশ্যক তেমনি অন্য ভাষার মহৎ সাহিত্যিকদের লেখাও পাঠ করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত জীবনে পাঠাভ্যাস গড়ে ওঠে আমার নানার অনুপ্রেরণায়। তিনি রাত জেগে পড়তেন। দেশি-বিদেশি সবধরণের সংগ্রহ ছিল তার। মাঝে মাঝে লিখতেন। ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন। তার সংস্পর্শে আমিও পড়া ও লেখার অভ্যাস গড়ে তুলি। নানা বলতেন, লিখতে লিখতে লেখক হওয়া যায়। গ্রামীণ প্রবাদের মতো- ‘হাটতে হাটতে নলা/ গাইতে গাইতে গলা।’ সর্বোপরি কথা হচ্ছে- নিরলস চেষ্টা, চর্চা ও সাধনাই একজনকে লেখক হিসাবে গড়ে তুলতে পারে।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কবি, কথাশিল্পী, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।

পুরনো স্মৃতি

:: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ::

সেই পুরনো ঘর, পুরনো বিছানা
ছেড়া মশারি, কাঁথা-কম্বল।
সেই পুরনো স্মৃতি-
সারাদিন একই অনুভূতি
আর একগাদা মুখস্থ মানুষ।
বদলায় না কিছুই-
মাঝে মাঝে বদলে যাই আমি,
তবু বারবার ফিরে ফিরে আসি
সেই পুরনোর কাছাকাছি।

কী যে এক মায়া, অশরীরী ছায়া
দূর থেকে কাছে, টানে বারবার।
চোখের পলকে, সুখের ঝলকে
বদলে গিয়েও আগের মতোই
তোমাকেই ভালোবাসি।

রাজপথে রক্ত-রক্ত খেলা

:: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ::

রাজপথে আজ রক্ত-রক্ত খেলা
আমরাই খেলোয়ারÑ
এখানে ভাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বি ভাই।
তোমরা নীরব দর্শক কিংবা জয় নির্দেশক।

আমার উল্লাসে ভাইয়ের পরাজয়-
আমার মুখের ফুৎকারে নিভে যায়
পিতা-মাতার যাবতীয় স্বপ্নের প্রদীপ,
মুছে যায় বোনের হাতের মেহেদী-
সন্তানের চোখে উঁকি দেয় দুঃস্বপ্নের মেঘ,
আঁধারে ডুবে যায় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

তবুও, আমাদের রক্ত ঢেলেই আজ
তোমাদের ক্ষমতার মসনদ পবিত্র করি।

কালকিনি, মাদারীপুর।

সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৩

রচয়িতা সম্পাদক কবি আরিফুল ইসলামের আঁকাবাঁকা পথচলা

:: এম এস আই সাগর ::
একবিংশ শতাব্দীর সূচনাতে যে সকল উদীয়মান তরুণ কবির আবির্ভাব ঘটেছে তাদের মধ্যে অন্যতম লিটলম্যাগ রচয়িতা সম্পাদক কবি আরিফুল ইসলাম। হৃদয়ের লুকায়িত আবেগ, অনুভূতি ও আত্মপ্রত্যয়টুকুই সাধারণত কবি-সাহিত্যিকরা বিভিন্ন বাচনভঙ্গি, কাব্যরস, গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ও নিবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন। আবার উপন্যাস, নাটক কিংবা চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও হতে পারে। মূলকথা সমাজে ঘটে যাওয়া প্রতিটি বাস্তব চিত্রের প্রতিচ্ছবি নিজের মত করে সাজিয়ে কবি-সাহিত্যকরা প্রকাশ করে থাকেন। তারই এক জ্বলন্ত প্রমাণ কবি ও ঔপন্যাসিক আরিফুল ইসলাম। বর্তমান তরুণ সমাজ যখন নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন; তখন কবি ও সম্পাদক আরিফুল ইসলাম এর জীবন সৃজনশীল নেশায় ঢুলুঢুলু।
আরিফুল ইসলাম ১৯৮৩ সালের ১৫ মে জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার কিংজাল্লা নামক এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাবিবুর রহমান ও মাতা মোছাঃ ফাতেমা বেগমের পঞ্চম সন্তান তিনি। কবির শৈশব কেটেছে আঁকাবাঁকা মেঠোপথের মত। ছেলেবেলা থেকেই ডানপিটে স্বভাবের এই তুখোড় কিশোরের কাছে লেখাপড়া ছিল অস্বস্তিকর। কিন্তু সাহিত্যের প্রতি তার ছিল অকৃত্রিম অনুরাগ। যার ফলশ্র“তিতে প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি না পেরোতেই ১৯৯৬ সালে দৈনিক পত্রিকাতে ‘রক্তের বিনিময়ে’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটির দু’টি লাইন উদ্ধৃতি না দিলেই নয়-
‘রক্তে খেয়েছে স্বাধীনতার তারছিড়াঁ বিনিময়
বাঙালি সয়েছে তারও প্রতিফলন।’
এ থেকে অনুমান করা যায়, কবি তার কবিতায় দেশপ্রেমের নিবীড় প্রেমে পাগল ছিলেন। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগি না হওয়ায় তার শিক্ষাজীবন বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। তবে তিনি যথেষ্ঠ মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমাপনিতে বৃত্তি অর্জন করেছিলেন। কৃতিতের সাথে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন ইসলামপুরের বিখ্যাত ইসলামপুর নেকজাহান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। স্থানীয় কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে কবি শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন রীতিমত বাধ্য হয়েই। কিন্তু তার সাহিত্য জীবন থেমে থাকেনি। এরই মধ্যে বেরিয়ে আসে তার কলম থেকে কালজয়ী সব কবিতার পঙক্তি। তার উল্লেখ্যযোগ্য কবিতার মধ্যে ‘যা বাস্তব’,‘আমি বিদ্রোহী’,‘রক্তে বাংলাদেশ’,‘রচয়িতার কাছে খোলা চিঠি’,‘নন্দিনীর কাছে খোলা চিঠি’,‘আমি পূজারী নই’,‘কবিতায় আমি পথকলি’,‘কবিতায় আমি পথকলি-২’,‘কবি’,‘কলমের আতœকথা’,‘বিদায় অতপর বেঁচে থাকা’,‘মুক্তিযোদ্ধা বাতেন বলছি’,‘আমন্ত্রণ’,‘অধিকার চাই’,‘আমি বাঙালি’,‘স্বরসতীর প্রেম’,‘আমি হিন্দুদের অনুসারী’ প্রভৃতি।
তার কবিতায় ঢেউ খেলেছে প্রেম, প্রেমকে দিয়েছেন হাজারো রূপ। ‘নন্দিনীর কাছে খোলা চিঠি’ তার এক অনবদ্য ও জ্বলন্ত প্রমাণ-
 “চন্দ্রাণী বলেছিলো-
     পাঁচদিন পর জেল থেকে বেরিয়ে আসছি!
তোমার অপেক্ষার অবসান ঘটাতে
অন্তরের অব্যক্ত কথনগুলোকে-
উজাড়  করে দেবো তোমার তরে
নগ্ন পায়ে হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের চূড়াঁয়-
গিয়ে ঘপটি মেরে বসে থাকবো
     রাতকে সন্ধ্যার সাথে সন্ধি করে দেবো
নদীর ভরা যৌবন দেখতে দেখতে...
দু’জনে মিলে একাকার হয়ে যাবো।
         আমি পোড়ামুখে হেসে বলেছিলাম,
          ভার্সিটি কখনো কি জেলখানা হয় ?”
তিনি ধর্মের ভেদাভেদ ভাঙতে সদা অস্থির। তাই তাকে পড়তে হয়েছে অনেক বির্তকের মধ্যে। তারপরও তার কলম তাকে ছুটি দেয়নি কখনো। তার কলমের কালি তার সাথেই সুর মিলিয়ে লিখেছে বির্তকের কবিতা “আমন্ত্রণ”-
“ভেঙে ফেল তোমার অস্পষ্ট মন্দির নামের পবিত্র উপাসনালয়
যেখানে অমানুষের রাজ্যে বসবাস করে অপদার্থ, বেহায়া আর মানুষ্যরূপী কিছু শয়তান
ভগবানের নামে মাটির স্বর্গে যারা ধোয়া উড়িয়ে উড়িয়ে পাপ করেই চলেছে দিন দিন
আমি হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী! কারণ আমি মানুষ রুপে জন্ম নিয়েছি কুকুরের বেশে নয়
জন্মের সাত জনম আগে আমি হয়ত সনাতন অথবা পুরোহিত ছিলাম
খ্রিস্টান হয়ত আমার প্রিয় ধর্ম ছিল অথবা বৌদ্ধ ছিলাম হয়ত”
তাকে ডাকা যেতে পারে টোকাইদের সহযোদ্ধা বলে। কারণ তিনি ব্যতিক্রমভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তার কবিতায় পথকলিদের। তার মন কেঁদেছে পথকলিদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে। লিপিবদ্ধ করেছেন অনেক কবিতা তাদের নিয়ে। তাই তিনি অবশ্যই আর সব কবিদের চেয়ে একটু আলাদা। একদিকে দেশ, একদিকে ধর্ম, একদিকে পথকলি। কোথায় নেই তার কলমের বিচরণ। পথকলির প্রতি তার ভালবাসা সত্যি প্রশংসনীয়। তিনি এভাবেই গেঁথে দিয়েছেন ‘কবিতায় আমি পথকলি-২’ কবিতায়-
“সমাজ বদলাতে হলে আগে আমার অধিকার দিতে হবে
দিতে হবে পথকলি ভাতা, পথকলি পেনশন, মহার্ঘ্য ভাতা-
সম্মান, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা অথবা ত্রাণের সবটুকু অধিকার
আমিও তো মুক্তিযোদ্ধা!
তোমরা দেশের জন্য একবার  যুদ্ধ করেছ; আর আমি যুদ্ধ করি প্রতিনিয়ত!।”
সমাজের অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন, মারামারি, হত্যা এগুলো দেখে তিনি চুপ ছিলেন না । লিখে গেছেন প্রতিবাদী হিসেবে অনেক বিদ্রোহী কবিতা। যেমনটি তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন “আমি বিদ্রোহী” কবিতায়-
“যুদ্ধে যাবো মা, আরেক বার যুদ্ধে যাবো
৭১’ এর যুদ্ধে যারা রাজাকার, আলবদর ছিল
তাদের ধ্বংস করার যুদ্ধে
আমি আজ বিদ্রোহী
রক্তে আমার বিস্ফোরিত হচ্ছে
জ্বালা মেটানোর ইচ্ছাগুলো
আমি উন্মাদ মাগো, বড্ড উন্মাদ।”
এভাবেই লিখেছেন তিনি অনেক কবিতা। একদিকে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ; আরেক দিকে সাহিত্যকর্ম সত্যি আশ্চর্যজনক। তা তার লিখনিতে বুঝে নেবে যে কোন পাঠক। তার কর্ম জীবনের শুরুটা আরও চমকে দেওয়ার মত। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার কর্মজীবন শুরু। তারপর থেকেই চলছে জীবনের সাথে যুদ্ধ। তারপরও থেমে থাকেনি তার সাহিত্যকর্ম। প্রথমে বাবার হাত ধরেই কর্ম শুরু করেন। মুদির দোকানে দীর্ঘদিন ব্যবসা করেন তার বাবার সাখে। তারপর তিনি পরিবারকে না জানিয়ে চলে যান চট্টগ্রাম । সেখানে জাহাজ ঘাঁটিতে কাজ করেন দুই বছর। তিনি ছিলেন জাহাজের মাল খালাসের সুপার ভাইজার। সেখানেও তিনি বেশিদিন টিকতে পারেননি। চলে আসেন ঢাকায় তার এক চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। চাচাতো ভাইয়ের সহযোগিতায় একবছর চাকুরি করেন একটি কাপড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে ফ্লোর ইনচার্জ হিসাবে। সেটাও বেশিদিন টেকেনি। তারপর সোজা চলে আসেন গ্রামের বাড়িতে। এ যেন নাড়ীর টানে ঘরে ফেরা। বাড়িতে এসে আবার চলে তার কর্মচেষ্টা। এবার চাকুরী নেন বেসরকারী ট্রেনে সুপারভাইজার পদে।  চাকরির সুবাদে তিনি ভ্রমণ করেছেন বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। আর কুড়িয়েছেন হাজারো অভিজ্ঞতা। এ থেকে প্রমাণিত হয়- কবি শুধু নিজ এলাকা নয়, সারা বাংলার সংগতি-অসংগতি সব কিছুই পাওয়া যায় তার কবিতায়। একবছর সততার সাথে চাকুরী করেন তিনি। ভালো না লাগায় আবার চলে আসেন। কর্মের স্বাদ যেন কোন ভাবেই মিটতে চায় না তার। গাজীপুর ও নরসিংদী এলাকায় তিনি অল্প কিছুদিন জুতার কারখানায় চাকুরী করেন। তারপর এলাকার কোন এক শিল্পপতির সাহায্যে চলে যান চাঁদপুর। তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। চাঁদপুরের বিশিষ্ট শিল্পপতি আলম খানের ম্যানেজার হিসাবে দীর্ঘদিন (প্রায় ৪ বছর) চাকুরী করেন। এরপর ২০১০ সালের দিকে নিজগ্রামে ফিরে আসেন মালিককে না বলে। তারপরই তার জীবনের একাকী পথ চলা শুরু। বর্তমানে তিনি ভাই ভাই গ্র“পের ডিজিটাল টেকনোলজি এর নির্বাহী পরিচালক। শুরু করেন সাহিত্যচর্চা। রচয়িতা সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তিনি উইড (অসহায় জনগোষ্ঠির জন্য একটি বিদ্যালয়) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। রাসান-২০১২ (একটি শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
দুই বাংলার বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘রচয়িতা’ সম্পাদনা করায় সত্যি তার সাহস অনুজদের আশ্চর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে ভাবলে বিন্দুমাত্র ভুল হবেনা। রচয়িতা সম্পাদনা করে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। বয়সে তরুণ এবং সম্পাদক হিসেবে নবীন হলেও তিনি ‘রচয়িতা’ প্রকাশ করে প্রমাণ করে দিয়েছেন, বয়স দিয়ে সাহিত্যিকদের মেধা মাপা যায় না বরং সাহিত্যিকের লেখাই তার জ্ঞানগড়িমা, দক্ষতা কিংবা অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ বয়স কারো যোগ্যতা কিংবা অভিজ্ঞতা মাপার মাপকাঠি নয়। দেশ-বিদেশের অনেক সুনামধণ্য কবি-লেখকরা লিখেন তার রচয়িতায়। প্রতিবছর কবির নিজের অর্থায়নে ‘রচয়িতা সাহিত্য পরিষদ’ কর্তৃক রচয়িতার বাছাইকৃত কবি লেখকদের বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন। জামালপুর জেলার জন্য অবশ্যই তা গর্বের বিষয়। তিনি একমাত্র সম্পাদক; যিনি সর্বপ্রথম ইসলামপুরে কবি-লেখকদের সম্মানিত করেছেন। করে যাচ্ছেন। তিনি ‘কাব্য কথা’ লিটলম্যাগ এর নির্বাহী সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। সদ্য প্রকাশিত ‘রচয়িতা’ (চার বাংলার ১০০ কবি ও কবিতা) সংখ্যাটি বেশ আলোচনার ঝড় তুলেছে লিটলম্যাগ মহলে। দেশ ও দেশের বাহিরের অনেক সনামধণ্য কবি-লেখকগণ লিখেছেন এ সংখ্যায়। এ যাবৎ ‘রচয়িতা’ প্রসঙ্গে দৈনিক যায়যায়দিন, দৈনিক ইত্তেফাক, বগুড়ার বিখ্যাত দৈনিক করতোয়া, জাতীয় অনলাইন প্রতিমুহূর্ত ডটকম, জাতীয় সাহিত্যবিষয়ক অনলাইন অন্যধারা ডটকম ও মাদারীপুরনিউজ ডটকম-এ আলোচনা স্থান পেয়েছে।
এছাড়াও ডজন খানেক অনলাইন পত্রিকায় এসেছে রচয়িতার আলোচনা। কবি আরিফুল ইসলামকে নিয়ে বিশেষ আলোচনা ছাপা হয়েছে জামালপুরের সনামখ্যাত ‘দৈনিক আজকের জামালপুর’ পত্রিকায়। মাদারীপুর জেলার কালকিনি প্রেস ক্লাবে রচয়িতার মোড়ক উন্মোচন করেছেন রচয়িতার সহ-সম্পাদক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। দ্বিতীয় বারের মত মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে সহ-সম্পাদক সুমন হাফিজের সভাপতিত্বে ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত শান্ত মরিয়ম এন্ড ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র ক্যাম্পাসে। এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় কবি তার নিজের গুণে কত বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছেন। 
তিনি একাধারে কবি, সম্পাদক, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক। তাকে সব্যসাচী বললেও অত্যুক্তি হবেনা। তার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘অপেক্ষার শেষ প্রহর...’ ২০১১ সালে প্রগতি প্রকাশনী, আরামবাগ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়ে সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। উপন্যাসে তিনি সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছেন যা ভাবিয়ে তুলেছে অনেক পাঠকের অন্তর। আলোচনা এসেছে প্রায় ১০-১৫ টি আঞ্চলিক পত্রিকায়। তার লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কালোমুখোশ’। প্রকাশক সৈকত আহমেদ বিল্লালের সাহয্যে প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে লেখায় তা স্থানীয় প্রশাসনের কারণে বিক্রি নিষিদ্ধ হয়। ‘কালো মুখোশ’ এর একটা কবিতা “মানুষ ঝালাই” এরকম-
“দেশটা তোর বাবার বলেই দেখাস্ যত ক্ষমতা
ভেবে দেখ্ কি  হবে তোর ক্ষেপে যদি জনতা”
তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘একাকী জীবন’। নিরেট প্রেম ধরা দিয়েছিল কবির কলমে। বাস্তববাদী প্রেম কতটা নির্মল হয় তা বোঝাতে চেয়েছেন কবি তার একাকী জীবন কাব্যগ্রন্থের “আটটি বছর পর” কবিতায়-
ভুল করেই আবার আসার অপেক্ষায়-
হাতে হাত,আর দু-বাহুর স্পর্শে চরম তৃপ্তি প্রাপ্তির প্রত্যাশায়
যৌবন যেখানে দাঁড়িয়ে হাস্যরসে
শূণ্য অযৌবনের লাঠির উপর ভর করে।”
তার সাহিত্য কর্ম আর জীবন কর্ম সত্যি ভাবিয়ে তোলার মতই।
 কবি আরিফুল ইসলাম অনেক জায়গায় সাহিত্যকর্মের জন্য পেয়েছেন অনেক সম্মান। ২০০৬ এ পেয়েছেন চাঁদপুর সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক কবিতার জন্য বিশেষ সনদ ও কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবি সেলিনা পারভিন এর স্বরণে  ঢাকা পাবলিক লাইব্ররিতে আয়োজিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে কবিতা লেখার জন্য পেয়েছেন বিশেষ সনদ ২০১৩। এ যাবৎ কবির অনেক কবিতা গল্প, উপন্যাস, বাংলাদেশসহ পশ্চিম বঙ্গের অনেক সনামধণ্য লিটলম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক: এম এস আই সাগর
কবি, শিক্ষক, সম্পাদক ও আলোচক
ইসলামপুর, জামালপুর

অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান: লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী এক রসিক মানব

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী এক রসিক মানব। তাঁর সাথে আমার পরিচয় বা যোগাযোগ বছর খানেকের। ২০১২ সালের জুলাই মাসে গাজীপুরের কোনাবাড়ি ক্যামব্রিজ কলেজে যোগদান করি। প্রথমদিন পাঠদানের পর আর ভালো লাগেনি। মন কেমন পালাই পালাই করছিল। পালাবার পথ খুঁজছিলাম। হঠাৎ করে পেয়ে গেলাম। কলেজ জীবনের এক বড় আপার সাথে ফোনে কথা হয়। তিনি জানালেন সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজে একজন খন্ডকালিন বাংলা প্রভাষক দরকার। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তিনি তাঁর সাথে কথা বলে আমাকে বললেন, কালকিনি চলে যাও। স্যারের সাথে ফোনে কথা বলো। সেই তাঁর সাথে প্রথম কথা হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রয়োজনে কথা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। খুব অল্প দিনেই আমার মনে হয়েছে তিনি লোকপ্রিয় এক মানুষ। কিন্তু আত্মপ্রচার বিমুখ। তবে স্বপ্নবিলাসী ও পুরোদস্তুর রসিক মানুষ। তাঁর নির্মল হাসি ও নিভাঁজ গল্পবলার ঢঙ দেখেই তার উদারতা ও মনের বিশালতা অনুমান করা যায়। জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও তার কর্মচাঞ্চল্য ও আশাবাদ আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি আমাদের অনুকরণিয় আদর্শ।
জন্মপরিচয়:
অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়নের সাহেবরামপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম আলহাজ্ব আব্দুর রহমান রাঢ়ি ও মাতা মরহুমা জোবেদা খাতুন। ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। কিশোর বয়সেই তিনি প্রতিবেশি আ. মাজেদ আকনের কন্যা মোসা: মনোয়ারা বেগম বুনুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর এবং বর্তমানে তিনি পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক।
অধ্যয়ন:
১৯৪৭ সালে গ্রামের জুনিয়র স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথম বিভাগে পাস করে চলে যান জেলা শহরে। ১৯৫২ সালে মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৪ সালে মাদারীপুর সরকারি নাজিমুদ্দিন কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় সম্মানসহ এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবন:
অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেন। তিনি মাদারীপুর সরকারি নাজিমুদ্দিন কলেজ, কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ, নরসিংদী সরকারি কলেজ ও টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডের একত্রীকরণ পর্যন্ত এর সচিব হিসেবে এবং কিছুকাল তিনি এ সংস্থার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশনে প্রধান প্রতিবেদক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ভ্রমণ করার সুযোগ লাভ করেন। সর্বশেষ তিনি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) পরিচালকের পদ থেকে ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর ঢাকা সেনানিবাসস্থ শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কিছুকাল কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার্থে গঠিত সাত সদস্য বিশিষ্ট সুপারিশমালা প্রনয়ন কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। তিনি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়নের সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন।
সাহিত্যচর্চা:
স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫১ সালে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় পুরান বাজারের সাহিত্য মজলিসে যাতায়াত শুরু করেন। একই বছর মাদারীপুর এমএম হাফিজ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে মাসিক সাহিত্যপত্র ‘মোহাম্মদী’তে ছোটগল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যচর্চার সূচনা। ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে ‘শুধু কাহিনী’,‘কুমার নদীর ইতিকথা’,‘দাদুর আঙ্গিনা ও আকাশ’,‘অধিকার’ ও ‘কেচ্ছার মানুষ শৈজুদ্দিনের দ্বিতীয় মরণ’ নামে কয়েকটি ছোটগল্প  প্রকাশিত হয়। অনুবাদ সাহিত্যে তার অবদান বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে ঢাকার তৎকালিন সিভিল সার্জন জেমস টেলর ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের মেডিক্যাল বোর্ডের সচিব লর্ড হাসিনসনের নির্দেশে এদেশের রোগব্যাধি সংক্রান্ত টপোগ্রাফি লিখতে গিয়ে ঢাকা তথা বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, মানুষ ও উদ্ভিদরাজির চমৎকার বিবরণ পেশ করেন এবং তা ‘টপোগ্রাফি অব ঢাকা’ নামে কলকাতা মিলিটারি অরফ্যান প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান কর্তৃক এই দু®প্রাপ্য ও মূল্যবান গ্রন্থটি ‘কোম্পানি আমলে ঢাকা’ নামে অনূদিত হয়ে বাঙলা একাডেমী থেকে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় এবং পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। তাঁর অন্য অনূদিত গ্রন্থের নাম ‘বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড)। তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘এই আঙিনা ও আকাশের উপাখ্যান’। এছাড়া ২০০৪ সালে ‘ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাঠামোঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা:
অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, শিক্ষানুরাগী, জনগণের ক্ষমতায়ন ধারার লেখক, গবেষক, আলোচক, সাহিত্যিক ও সমাজ কর্মী। তিনি ‘দৈনিক বাংলা’,‘সাপ্তাহিক রোববার’,‘দৈনিক ইনকিলাব’,‘দৈনিক সকালের খবর’ সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের নিয়মিত কলাম লেখক। তিনি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ক্যালেন্ডারে ইংরেজির সাথে বাংলা তারিখ সংযুক্ত করা, সমমান ও সমমর্যাদার ক্যাডার সার্ভিস গঠন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আন্তঃ ও বহিঃ পরীক্ষার গড় নম্বরে ফলাফল প্রকাশ ও প্যাকেট ভিত্তিক পাশ-ফেল রহিতকরণ, কৃষিভিত্তিক মিনি গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করেন। গত ২৯ জুলাই ২০১৩ তারিখে দৈনিক সকালের খবরের ‘সম্পাদকীয়’ পাতায় ‘গণতন্ত্র, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও জাতীয় সার্ভিস সিস্টেম থেকে বৈষম্যদূরীকরণ’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে তিনি বলেন,‘পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও শোষণের হাতিয়ার হিসেবে এই ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের ভিত আরো পাকাপোক্ত করা হয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে তৎকালিন সিএসপিরা অধিক ক্ষমতা ও মহিমায় শাসন চালাতে থাকে। জনগণ থাকে অপাঙক্তেয় ও অবহেলিত।’ এছাড়া চ্যানেল আই আয়োজিত টক শো’তে অতিথি হিসাবেও অংশগ্রহণ করেন।
লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী এক রসিক মানব:
তাঁর রসবোধ চমৎকার। গল্পে ঢঙে উপস্থাপনায় সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ। তৎকালিন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আলোকচিত্র দেখেছি তাঁর গ্রামের বাড়ি সাহেবরামপুরের ঘরের দেয়ালে। মেয়ের দেওয়া একটা শখের ক্যামেরায় গ্রামের প্রকৃতির ছবি তুলে তা ফ্রেমবন্দী করে রেখেছেন। মাঝে মাঝে তিনি বাড়ি আসেন। হাসি-আনন্দ-আড্ডায় মাতিয়ে রাখেন পুরো বাড়ি। নাতি-নাতনিদের নিয়ে গল্প করে, গ্রামের মেঠোপথ ঘুরে কিংবা ফসলের মাঠের কিনারে বসে কাটিয়ে দেন পড়ন্ত বিকাল কিংবা জ্যোৎøা রাতের গহীণ অবধি।
শেষ হয়েও হলো না শেষ:
তাঁর কথা কীভাবে এত স্বল্প কথনে শেষ করা যায়? আমার জানা নেই। আমার মনে হয় এ যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান মনে প্রাণে একজন কবি-স্বভাবের মানুষ। তাঁকে প্রকৃতিপ্রেমিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। গ্রামকে ভালোবাসেন মায়ের মতোই। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর আর্কষণ দুর্নিবার। এই লোকপ্রিয় মানুষটির মধ্যে একটি মহৎ ও সুন্দর মনের সন্ধান মেলে। তার সহজাত সারল্য, চিত্তের ঔদার্য, অনুভূতি ও উপলব্ধির তীব্রতা তাকে করেছে মহিমান্বিত। দীর্ঘ ও সফল অধ্যাপনা জীবনে তার সাহচর্যে ও স্নিগ্ধ মনের স্পর্শে উজ্জীবিত হয়েছে অগণিত ছাত্রছাত্রী ও অসংখ্য গুণগ্রাহী, অনুরাগী বন্ধুজন। এমন লোকপ্রিয় স্বপ্নবিলাসী রসিক মানুষ বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। তাঁর দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করছি।

তথ্যসুত্র:  কোম্পানি আমলে ঢাকা: জেমস্ টেলর- মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অনূদিত।
দৈনিক সকালের খবর, ২৯ জুলাই’ ২০১৩ইং।
একজন লোকপ্রিয় মানুষ আসাদুজ্জামান তাঁর জীবন ভাবনা ও কর্মসাধনা- অধ্যাপক সফিউল আলম
লেখক:   সাধারণ সম্পাদক, কালকিনি প্রেস ক্লাব
    কবি, কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী

আমি আমার নয়

:: এম,ডি রাসেল ::
আমি আমাকে কখনও নিজের ভাবি না
আমি সবার,সব কিছুর ভিতরে,
সকলের মাঝে আমি আমাকে খুঁজে পাই।
 কখনও বাঁশরীর বাঁশীর সুরে
আবার কবির নিরব ভাবনাতে
সেখানে আমি আমাকে খুঁজে পাই।
সকাল বেলার সূর্য,সোলালী রঙের আলো ছড়ায়
আলোকিত করে ধরণীর বুক
লাঙ্গল কাঁধে কৃষক মাঠে যায়
রাখাল ধরে যখন গান
শিল্পীর মনের মাধুরী দিয়ে
আঁকে যখন রূপসী বাংলার ছবি
সেখানে আমি আমাকে খুঁজে পাই।
প্রিয়াহারা বেদনায় কাতর
হতচকিত জীবনের মাঝে
সেখানে আমি আমাকে খুঁজে পাই।
রমণীর চোখে মায়াবী যাদু
মিনতি করে ভালোবাসা চাওয়া
ঠোঁটের বাঁকা হাসিতে মুক্তো ঝরায়
জন্ম নেয় ভালোবাসার ফন্দি
সেখানে আমি আমাকে খুঁজে পাই।
যুবক, যৌবনের দাপটে পাড়ি দেয়
অজানা পথে,ফিরিবার আশা নেই
সৃষ্টি করে নতুন কিছু
সেখানে আমি আমাকে খুঁজে পাই।
যখন কোনো যুদ্ধ বাঁধে
 নিজ মাতৃভূমির রক্ষার্থে
জীবন বাজি ধরে যুদ্ধ করে
সেখানে আমি আমাকে খুঁজে পাই।
উৎসর্গ:- জনাব কাজী কামরুজ্জামান স্যারকে।


শনিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৩

প্রসঙ্গ: মালালা- আসলে কোনটা সত্য?

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
রাত তিনটায় একটি অনলাইন পত্রিকার প্রতিবেদন দেখে চোখ আটকে গেল। কৌতুহল নিয়ে পড়ে জানলাম, মালালার ঘটনা না কি পুরোটাই সাজানো নাটক। আসলে কোনটা বিশ্বাস করবো? মালালার ঘটনা একটা সাজানো নাটক; পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র ডনের ব্লগে এমন দাবি করা হয়েছে।
অনলাইন পত্রিকাটি বলছে, নারীশিক্ষার পক্ষে কলাম ধরায় পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় গত বছর ৯ অক্টোবর মালালা ইউসুফজাইর ওপর হামলা চালায় তালেবান। গুলি লাগে মালালার মুখ আর মাথায়। সে সময় সঙ্গে থাকা আরো তিনজন আহত হন। এরপর গণমাধ্যমের 'কল্যাণে' স্কুলপড়ুয়া মালালা মুহূর্তের মধ্যে হয়ে যান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। প্রথমে পাকিস্তান এবং পরে ইংল্যান্ডে কয়েক মাসের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। এত কিছুর পরও ১৫ বছরের মালালা নারীশিক্ষার পক্ষে অনড় থাকার ঘোষণা দেন। মালালা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, হাজারো বাধা টপকাতে তিনি প্রস্তুত। জঙ্গি হামলার ভয়ে মালালা বর্তমানে ব্রিটেনেই থাকছেন। এবার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তাঁর নামটাই ছিল প্রত্যাশার শীর্ষে। যদিও শেষমেষ পুরস্কার তিনি পান নি। আর সে পুরস্কার না পাওয়ার আলোচনা শেষ হতে না হতেই 'বোমা' ফাটালেন পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র ডনের ব্লগ।
ডন পত্রিকা ও অনলাইনের জ্যেষ্ঠ কলামিস্ট নাদিম ফারুক পারাচা ব্লগে দাবি করছেন, কাহিনী আগেই লেখা ছিল, মালালা সে অনুযায়ি অভিনয় করেছে মাত্র। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও পশ্চিমা বিশ্ব না কি এ নাটক সাজিয়েছে। যা গত ১০ অক্টোবর পাকিস্তান সময় বিকাল ৪টা ৪৭ মিনিটে দ্য ডনের ব্লগে আপডেটসহ প্রকাশ করা হয়। পরে অবশ্য ১১ অক্টোবর শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ১১ মিনিটে আপডেট দিয়ে জানানো হয়, ব্লগের লেখাটি ব্যঙ্গাত্মক ও কল্পকাহিনী। কিন্তু ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা ঝড় শুরু হয়ে যায়।
ব্লগে বলা হয়েছে, মালালার ঘটনা সারাবিশ্ব যা জেনেছে তা ভুল। আসল ঘটনা একেবারে উল্টো। লেখক ফারুক বলছেন, মালালার বিষয়টি নিয়ে এ বছরের এপ্রিল মাসে ডনের একটি দক্ষ প্রতিবেদক দল সোয়াত এলাকায় গভীর অনুসন্ধান চালিয়েছে। তারা পাঁচ মাসের অনুসন্ধানে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মত তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন। মালালা মূলত সোয়াতে জন্মগ্রহণ করে নি, এমনকি সে পশতুনও নয়। সোয়াতের একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ইমতিয়াজ আলী খানজাই ডনের প্রতিবেদককে না কি জানিয়েছেন, তার কাছে মালালার ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল আছে। যা প্রমাণ করে মালালা পশতুন নয়। রিপোর্টটি দেখিয়ে তিনি জানান, তিনি মালালার ডিএনএ সংগ্রহ করেছেন। যখন তিনি মালালার ডিএনএ সংগ্রহ করেছেন; তখন মালালা শিশু ছিল। সে সময় মালালার কানের সমস্যা নিয়ে তার কাছে এসেছিল।
ডাক্তার ডিএনএ পরীক্ষায় দেখেন, মালালা আসলে ককেশীয়। ধারণা করা হচ্ছে- মালালা পোল্যান্ড থেকে এসেছে। এরপর তিনি মালালার বাবাকে ডেকে পাঠান। তখন তিনি মালালার বাবাকে বলেন, আমি মালালার আসল পরিচয় জানি। এ কথা শুনে মালালার বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই ঘাবড়ে যান। তিনি বলেন, এ কথা আমি যেন প্রকাশ না করি। আমি তাকে বলি, আপনি যদি সত্য ঘটনা খুলে বলেন তবে কাউকে বলব না। মালালার বাবা তখন ডাক্তারকে বলেন, মালালার প্রকৃত নাম হচ্ছে জেইন। ১৯৯৭ সালে সে হাঙ্গেরিতে জন্মগ্রহণ করেছে। তার প্রকৃত বাবা-মা খ্রিস্টান মিশনারিতে ছিলেন। তারা ২০০২ সালে সোয়াতে বেড়াতে এসেছিলেন এবং মালালাকে উপহার হিসেবে তার কাছে দিয়ে যান। ওই সময় তারা গোপনে খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ করেন।
এ সময় ডনের প্রতিবেদক ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন তিনি মালালার আসল পরিচয় এখন প্রকাশ করছেন। তখন ডাক্তার বলেন,‘তিনি মনে করেন মালালাকে পাকিস্তানের বিপক্ষে দাঁড় করানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে পাঠানো হয়েছিল।’ এমনকি গুলিবর্ষণকারির ডিএনএ পরীক্ষা করেও ডাক্তার আবিষ্কার করেন যে, সে ইতালি থেকে এসেছে। ডাক্তার বলেন, আমি ২০১২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে এ বিষয়গুলো জানিয়ে ই-মেইল করি। এর কয়েকদিন পর তার ক্লিনিকে পুলিশ অভিযান চালায়। তার কয়েকজন কর্মচারীকে সে সময় নির্যাতনও করা হয়েছিল। তিনি জানান, এ বছরের জুন মাসে ডাক্তার আইএসআই’র একজন তরুণ কর্মকর্তার কাছে যান। তখন ওই কর্মকর্তা ক্লিনিকে এমন অভিযানের জন্য তার কাছে ক্ষমা চান।
অফিসার ডাক্তারকে বলেন, আইএসআই মালালার আসল পরিচয়ের ব্যাপারে খুব সতর্ক অবস্থানে আছে। অনেক অনুরোধের পর ডাক্তার ওই আইএসআই অফিসারের মুঠোফোনর নাম্বার দেন। এরপর সেই ডাক্তার আইএসআই অফিসারের নম্বর দেন ডনের এ প্রতিবেদককে। ডনের প্রতিবেদকের সাথে অফিসার দেখা করেন সোয়াতের একটি পরিত্যক্ত বিদ্যালয়ে। আইএসআই’র সেই অফিসার ডনের প্রতিবেদককে জানান, মালালার ওপর হামলার ঘটনা পাতানো হয়েছিল গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। উত্তর ওয়াজিরিস্তানে আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পথ পরিষ্কার করতে পুরো ঘটনাটি পাকিস্তান ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সাজানো হয়েছিল। অফিসার জানান,‘এটা একটা নাটক। পাকিস্তান সেনাবাহিনী উত্তর ওয়াজিরিস্তান আক্রমণের একটি অজুহাত দাঁড় করানোর জন্য এটি মঞ্চস্থ করেছিল।’
তার দেওয়া তথ্য মতে, ১ অক্টোবর ১৯৯৭ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে হাঙ্গেরিয়ান বাবা-মায়ের ঘরে মালালার জন্ম । তার নাম রাখা হয় জেইন। ২০০২ সালের ৪ অক্টোবর তার বাবা-মা সিআই’র সাথে যুক্ত হন। তাদের একটি সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ২০০৩ সালের ৭ অক্টোবর তারা পাকিস্তানে প্রবেশ করেন এবং সোয়াতে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ শুরু করেন। সে সময় তারা আইএসআই’র একজন নিু শ্রেণির এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি পুরো পরিবারকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করেন। তারা জেইনকে তার কাছে রেখে যান। পরবর্তীতে ওই এজেন্ট জেইনের নাম পরিবর্তন করে রাখেন মালালা। ২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর মালালা ব্লগে লেখা শুরু করেন এবং সেখানে তিনি সোয়াতের জঙ্গিদের অস্ত্রবাজি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। ২০১১ সালের ২১ অক্টোবর জঙ্গিরা তাকে আনুরোধ করে এ ধরণের ব্লগ না লিখতে। ২০১২ সালের ১ অক্টোবর সিআইএ নিউইয়র্কে বসবাসকারী ইতালিয় বংশোদ্ভুত রবার্ট নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ করে। এবং নিয়োগের পর তাকে গুলি চালানোর ওপর স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ৭ অক্টোবর সিআইএ মালালার ওপর মিথ্যা গুলিবর্ষণের জন্য আইএসআই’র সাথে পরিকল্পনার ব্যাপারে আলোচনা করে এবং বিষয়টি মালালা ও তার পরিবারকে অবগত করা হয়। ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর রবার্ট সোয়াত এলাকায় প্রবেশ করে উজবেক বলে পরিচয় দেয়।
সবশেষে ২০১২ সালের ১২ অক্টোবর রবার্টকে গুলিহীন একটি বন্দুক সরবারহ করা হয়। বন্দুকধারী মালালার ওপর মিথ্যা গুলি চালায়। এ সময় মালালা আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার অভিনয় করে। মালালার কাছে আগে থেকে টমেটোর সস রাখা ছিলো যা সে শরীর ও মুখে মেখে নেয়। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি অ্যাম্বুলেন্সও সেখানে পৌঁছায় এবং মালালাকে নিয়ে যায়। এরপর পশ্চিমা মিডিয়াগুলো সারাবিশ্বে প্রচার করতে থাকে যে, মালালাকে তালেবান জঙ্গিরা গুলি করেছে।
এই কথাগুলো যদি সত্য ঘটনা হয়, তাহলে কত বড় ধোঁকা দেওয়া হলো সারা বিশ্বকে। তা আর ভাববার অবকাশ রাখেনা। তাই যদি হয় তাহলে এর জবাব দেবে কারা? তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। আসলে কোনটা সত্য? ডনের প্রতিবেদন না কি মালালার ওপর ঘটে যাওয়া কাহিনী। মালালাকে নিয়ে সারা বিশ্ব যখন মুখর; তখন এমন একটা সংবাদ মানুষকে ভড়কে দেবে। এটাই স্বাভাবিক। এদিকে আবার বাংলাদেশের অন্য একটি অনলাইনের বার্তা সম্পাদক আমাকে বললেন, ঘটনা ভূয়া। মালালা ঠিক আছে। পাকিস্তানের ্ওই দৈনিক একটি স্যাটায়ার লিখেছে। সেটাকে না বুঝে বাংলাদেশের অনেক পত্রিকা নিউজ করেছে। এখন আমরা পাঠক সমাজ কী করবো? কী আর করার? আছি শুধু সময়ের অপেক্ষায়। সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই। আজ অথবা কাল। সে অপেক্ষাতেই রইলাম।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।

সেই সে রাতে

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

সেদিনের সেই বৃষ্টিভেজা রাতে
হাতে হাত রেখে এক বুক সাহস নিয়ে দু’জনের নিরন্তর পথচলা
আজ শুধু স্মৃতি;
শরতের বৃষ্টিজলে অনুভবের কাঁশফুল ছুঁয়ে গেছে হৃদয়
পুলকের কোনো এক মায়াবি আবির্ভাবে
জীবনের না পাওয়া সব সত্যগুলো পেয়েছিলাম সেদিন।

ভিজেছে এই তনু-মন শরৎপ্রেমে;
প্রেমের গহীন জলাশয়ে সাঁতরিয়ে পেয়েছে সব না পাওয়াকে
আহ্ পৃথিবীর সর্বসুখ যেনো ছিলো তারই মাঝে!

কবি: নিজস্ব প্রতিবেদক, আলোকিত বাংলাদেশ।

মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

সুনীলের ৮০ তম জন্মবার্ষিকী: কথা না রাখার গোড়ার কথা

:: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ::
‘কেউ কথা রাখেনি’- কবিতাটি প্রথম শুনি খালাতো ভাই মহিউদ্দিনের কন্ঠে। ২০০৩ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশে ফুটপাতে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে ‘সুনীলের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটি বিশ টাকা দিয়ে কিনলাম। ২০০৫ সালে বাংলা সাহিত্যে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তির পর কলেজের আবৃত্তি প্রতিযোগিতার বাছাই পর্বে ‘কেউ কথা রাখেনি’ আবৃত্তি করলাম। আমার আবৃত্তি জীবনে ঐ একটা কবিতাই মুখস্থ। ২০০৬, ২০১০ ও ২০১১ সালে গল্পলেখা প্রতিযোগিতায় ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছি। পুরস্কারের সাথে কবির হাতের লেখা আশির্বাদপত্রে লেখা ‘আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে রই চিরদিন চিরকাল!- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।’ কবির আর্শিবাদ আমাকে কবির কাছে ঋণী করে দেয়।
২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া গ্রামে তার জন্মভিটায় পা রাখলেন। কবিকে দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে কবি-অকবিরা ছুটে এসেছেন। সেদিন কবিকে নিবেদিত অনুষ্ঠানে জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম। কিন্তু কবি আর আসেননি।
তখন আবৃত্তি শিল্পী মেহেদী হাসান, মাদারীপুর শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যপ্রশিক্ষক আ জ ম কামাল ও উদ্ভাস আবৃত্তি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কুমার লাভলু কবিকে একা পেয়ে ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার গোড়ার কথা জানতে চেয়েছিলেন। কবি অকপটে সব বলেছেন। মেহেদী হাসান আবৃত্তি করছেন আর কবি ব্যাখা করছেন। কবি বলেছিলেন, তাঁর বয়স যখন তেত্রিশ পেরিয়ে গেছে তখন এমন অনুভূতি তাকে তাড়িত করেছে। তাই তিনি লিখলেন ‘কেউ কথা রাখেনি।’ কবিতার কিছু অংশে কল্পনার সংমিশ্রন থাকলেও পুরো কবিতাটিই বাস্তবতার আলোকে লেখা। কবিতায় বোষ্টুমীর প্রসঙ্গ কাল্পনিক হলেও অবাস্তব নয়। কবি ১৯৩৪ সালে ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রামের নানা বাড়িতে। তখন পৈতৃক নিবাস কালকিনির মাইজপাড়ায়। সম্ভবত ১০-১১ বছর বয়সে অর্থাৎ দেশভাগের আগেই পরিবারের সাথে চলে যান কলকাতা। তবু তিনি ভুলতে পারেননি শৈশবের স্মৃতি।
কবি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ‘পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায়’ থেকেছেন। সে সময় মনে হয়েছে তার মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলী তাকে বলেছিল,‘বড় হও দাদাঠাকুর তোমাকে আমি/ তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাব’। তিন প্রহরের বিলে সাপ আর ভ্রমরের প্রসঙ্গ এলে কবি মুচকি হেসে বললেন, তখন আমি ছোট ছিলাম। মামারা যখন নৌকা নিয়ে বিলে যেত। তখন আমিও বায়না ধরতাম। কিন্তু মামারা নিতেন না। ছোট্ট সুনীলকে ভয় দেখানোর জন্য বলতেন, সে বিলে যেতে- আসতে তিন প্রহর লেগে যায়। আর সেখানে ভয়ঙ্কর সাপ রয়েছে। সেই বোধ থেকেই বিলের নাম দেই তিন প্রহরের বিল। আর সাপ আর ভ্রমরের খেলাটা বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য বলা। এসময় আ জ ম কামাল অভিযোগ করে বললেন, কবি কবিতায় আপনি মুসলমানদের ছোট করেছেন। একটি মাত্র চরিত্র তাও আবার মাঝি। কবি তখনও হাসলেন। বললেন, তখন মুসলমানরা এখনকার মতো এতো সচেতন ছিলো না। আমি তাদের ছোট করিনি বরং তাদের পশ্চাৎপদতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তখনও মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। মামাবাড়ির আশপাশের মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের বাড়ির কামলা খাটত বা নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো।
কবিরা আর্থিকভাবে অতটা স্বচ্ছল ছিলেন না। মার্বেল খেলার জন্য একটা রয়্যালগুলিও তিনি কিনতে পারেননি। তখন মাইজপাড়ার লস্কররা খুবই বিত্তবান ছিলেন। লস্কর বাড়ির ছেলেদের লাঠি লজেন্স খেতে দেখে কবি বাবার কাছে বায়না ধরতেন। বাবা বলতেন, পরে কিনে দেব। কবি অপেক্ষায় থেকেছেন। বাবা স্কুল মাস্টার। বেতন কম। তাই তার মা কবিকে বলতেন, জীবনে অন্য কিছু করবে তবু মাস্টারি করবে না। তাই কবি কখনো মাস্টারি করতে যাননি।
রাস উৎসব প্রসঙ্গে কবি বললেন, তিনি ছেলেবেলায় খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। তাদের গাঙ্গুলি বাড়িতে যখন রাস উৎসব হতো তখন ভেতর বাড়িতে মহিলারা নাচ-গান করতেন। কবি তার ব্যাঘাত ঘটাবেন বলে তাকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হতোনা। নিচেকে অসহায় কল্পনা করে কবি এমন অভিব্যক্তি করেছেন। কবি তখন ভাবতেন, একদিন আমিও সব পাব। রয়্যাল গুলি, লাঠি লজেন্স আর রাস উৎসব সবই তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তার বাবা এসব কিছুই দেখে যেতে পারেননি। আজ সুনীলের সব আছে কিন্তু তার স্কুলমাস্টার বাবা নেই। এই শূন্যতা তাকে বারবার গ্রাস করেছে।
কবিকে যখন বরুণা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলো; কবি তখন মুচকি হেসে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেলেন। তখন কবির সঙ্গে তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন। কবি শুধু এইটুকু বললেন, এটা কল্পনা। বরুণা বলে কেউ ছিলনা। তবে পরে আমরা জেনেছি, কবির এক বন্ধুর বোনের প্রতি কবির দূর্বলতা বা ভালোবাসা জন্মেছিল। কবি তার কোন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সে সময়ে একমাত্র বন্ধুর সুবাদে কেবল বন্ধুর বোনের সাথেই কথা বলার বা ভাববিনিময়ের সুযোগ ছিল। হয়ত বরুণা তার কল্পনার নারী।
কবি সবশেষে কুমার লাভলুকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন। আচ্ছা, তুই কি নাস্তিক হতে পেরেছিস? কুমার লাভলু বলল, ভয় পাই। পূর্ব পুরুষের ধর্ম ত্যাগ করি কিভাবে? কবি বললেন,‘আস্তিক হওয়া খুব সহজ; কিন্তু নাস্তিক হওয়া বড়ই কঠিন।’ কথাটায় হাস্যরসাত্মক পরিবেশটা হঠাৎ গুরুগম্ভীর হয়ে উঠলো।
৭৫ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করতে কবি এসেছিলেন তার জন্মভিটায়। এটা কবির জন্য যতটা আনন্দের; মাদারীপুরবাসীর জন্য ততটা গর্বের। তিন দিন অবস্থান করে কবি আবার চলে গেলেন তার গড়িহাটির পারিজাতে। রেখে গেলেন স্মৃতি। অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দেশভাগের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে সৌহার্দের মিলনরেখা। কিন্তু সব ছেড়েই তাকে চলে যেতে হলো ২২ অক্টোবর। পড়ে রইল পারিজাত। পড়ে রইল জন্মভিটার সুনীল আকাশ। কেউ কথা না রাখলেও আমরা আগলে রেখেছি তার সুনীল আকাশ সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র এবং সুনীল সাহিত্য পুরস্কার।
এখন মনে হচ্ছে মাদারীপুরে প্রবর্তিত সুনীল সাহিত্য পুরস্কারকে জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। তবেই হয়তো কবির কথা না রাখার দীনতা ঘুচাতে পারবো। কবি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তার কর্মে। কবি বেঁচে থাকবেন আমাদের মর্মে। আমাদের চিন্তা-চেতনায়, আমাদের উপলব্ধিতে। তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন চিরকাল।

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কালকিনি, মাদারীপুর।

রচয়িতা: অনুর্বর জমিতে কবিতার চাষ

:: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ::
সাহিত্যের ছোটকাগজ সৃষ্টির চেয়ে তাকে টিকিয়ে রাখাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়। সে অসাধ্যকেই সাধন করে চলেছেন রচয়িতা সাহিত্য পরিষদ। উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শক্ত হাতে হাল ধরে আছেন ‘রচয়িতা’র সম্পাদক কবি আরিফুল ইসলাম। দেখতে দেখতে প্রকাশিত হলো দুই বাংলার একশ’ কবির কবিতা নিয়ে ষান্মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘রচয়িতা’। ‘আমরা সৃজনশীলতার পথে’ স্লোগানকে ধারণ করে জামালপুর জেলার ইসলামপুরের একঝাঁক নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকের প্রাণের সংগঠন ‘রচয়িতা সাহিত্য পরিষদের’ উদ্যোগে নিয়মিত প্রকাশ হয়ে আসছে ‘রচয়িতা’। আরিফুল ইসলামের সম্পাদনায় জুন-২০১৩ খ্রিস্টাব্দ, আষাঢ়-১৪২০ বঙ্গাব্দ ও শাবান-১৪৩৪ হিজরী মাসে তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হলো।
ধন্যবাদ ‘রচয়িতা সাহিত্য পরিষদ’ ও সম্পাদক আরিফুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে। দুই বাংলার একশ’ কবির কবিতা গ্রন্থিত করা নিঃসন্দেহ জটিল কর্ম। এ কর্ম সম্পাদনা আরো জটিল। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। ভুল-ভ্রান্তি অবশ্যই কিছু আছে। তবে তার চেয়ে বড় কথা ‘রচয়িতা’ আবারো আলোর মুখ দেখলো- সেটাই বা কম কিসের? ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে কোন আলোচনা করার বদমতলব আমার নেই। বা সে সমালোচনা করার যোগ্যতাও আমার নেই। কর্মনিষ্ঠা ও আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। দেশের প্রথম সারির (সবাই যেটা বলে) কবিদের কবিতাসহ নবীনদের কবিতা প্রকাশের একটা প্লাটফর্ম তেরি করার জন্য সত্যিই আমি আনন্দিত। অনেকেই লেখা দিয়েছেন কিন্তু স্থানাভাবে তা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি বলে সম্পাদকও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিনীতভাবে।
প্রকাশের আগে মাঝে মাঝে কথা হয় আরিফুল ইসলামের সাথে। তার হতাশা ও দীর্ঘশ্বাসকে আমি উপলব্ধি করেছি। তবু তাকে পিছু হটতে দেখিনি। সীমাহিন স্পৃহা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। প্রকাশের পর তার তৃপ্তির প্রশ্বাস আমাকেও প্রকম্পিত করেছে। বানের জলে শস্য ভেসে যাবে বলেও যেমন কৃষক তার জমিতে চাষ বন্ধ করে দেয় না। ঠিক তেমনি অর্থনৈতিক দৈন্যদশাও রচয়িতাকে দমাতে পারেনা। অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে অনুর্বর জমিতে চাষ করে যাওয়ার মতো। অনেকে আবার ছোটকাগজ বলে লেখা দিতে কার্পণ্য করেন। সম্পাদকের ‘অভিসন্ধি’ থেকেই উদ্ধৃতি করতে হয়-‘কেউ কেউ ‘দেই-দিচ্ছি’ বলে মাস কাটিয়ে দেন। আবার অনেকেই বলে বসেন ‘ছোটকাগজে লেখা দেই না’। ফলে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। লেখকদের আত্মতুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি পাঠকের কাছে দায়বদ্ধতার কথাও স্মরণ রাখতে হয়। নবীন-প্রবীণ কবিদের সমন্বয়ে সাজানো ‘রচয়িতা’ সর্বস্তরের পাঠকের মনে দাগ কাটতে পেরেছেÑ এ আমার বিশ্বাস।
হেলাল হাফিজের কবিতা ‘ওড়না’ এখনো আমাকে প্রতিমুহূর্তে ভাবায়। আমি মনে হয় উঠতে-বসতে ‘তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ’ কথাটি নিজের অজান্তে সহস্রবার উচ্চারণ করি। একটি পঙক্তিতে এত গভীর আবেদন আর কোথাও পাই নি। ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ কথাটা আসলেই সত্যি। একটি সহজ-সরল কথাকে কত কঠিন এবং বক্র ভাবে ছুড়ে দেওয়া যায়-তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘ওড়না’ কবিতা। কবির ‘তুমি নিউট্রন বোমা বোঝ/ মানুষ বোঝ না’ কবিতার অনুরূপ। কবি বরাবরই তার পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। ‘রচয়িতা’র প্রথম কবিতা কবি আল মাহমুদের। পাতা উল্টে প্রথমেই নজরে আসে তাঁর ‘অলীক দেবদারু’ কবিতাটি। আল মাহমুদের কবিতা নিয়ে অনেকেই বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন। আমি করজোড়ে মিনতি করছি- কবিকে কখনো গোষ্ঠীবদ্ধ করবেন না। কবি সীমাবদ্ধ কোন জায়গা বা বস্তু নন। তাঁর অন্তরের বিশালতার চেয়ে তাঁর কাব্যের বিশালতাই আমাদের কাছে বড়। মহাদেব সাহার ‘যতোই বলো’, হেলাল হাফিজের ‘ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে’, হাসান হাফিজের ‘পতাকার ইতিহাস’, বেলাল চৌধুরীর ‘বাল্যকাল’ ও মলয় রায়চৌধুরীর ‘রাবনের চোখ’ এক গভীর আবেশে জড়িয়ে রাখে। এছাড়া ‘রচয়িতা’য় প্রকাশিত অন্য কোনো লেখা বা কবিতা সম্পর্কে সমালোচনা করার দুঃসাহস আমার নেই। সবার কাছেই আমি নস্যি মাত্র। শুধু নিজের সম্পর্কে এটুকুই বলব, সবার কবিতার চেয়ে আমার ‘ঈশ্বর বনাম তুমি’ কবিতাটিই কেবল দূর্বল মানের। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ‘রচয়িতা’র সহ-সম্পাদক হিসাবে অনেক ফোন বা মন্তব্য পেয়েছি। একটা দায়বদ্ধতা থেকেই সকলের পরামর্শ বা তিরস্কার হাসিমুখে মেনে নিয়েই রচয়িতার অগ্রযাত্রায় ব্রতী হয়েছি। আমার তিন কথা- ছিলাম, আছি ও থাকবো।  
এবারের সংখ্যায় আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, হেলাল হাফিজ, হাসান হাফিজ, বেলাল চৌধুরী, মলয় রায় চৌধুরী, মতিন বৈরাগী, মৃণাল বসু চৌধুরী, কাজী রোজী, প্রত্যুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সরোজ দেব. মনোজিৎ কুমার দাস, অলক বিশ্বাস, অরুণ সেন, মনির ইউসুফ, শর্মিষ্ঠা ঘোষ, ধ্র“বজ্যোতি ঘোষ মুকুল, পাবলো শাহি, রেজা রহমান, রায়হান রাইন, নজরুল জাহান, পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত, সঞ্জয় ঋষি, রহমান হেনরী, টোকন ঠাকুর, ইন্দ্রাণী সেনগুপ্ত, পরিতোষ হালদার, অমূল্য রতন পাল, কচি রেজা, ভাস্কর চৌধুরী, হাসান আল আব্দুল্লাহ, অমিতাভ দাশ, সপ্তর্ষি বিশ্বাস, জিয়াউল হক, সরসিজ আলীম, অদ্বৈত মারুত, হিজল জোবায়ের, হালিম আজাদ, অতনু তিয়াস, সৌভিক দা, আমজাদ সুজন, মধুমঙ্গল বিশ্বাস, এলিজা আজাদ, জসীম মেহবুব, ওয়াহিদ জালাল, সজল সমুদ্র, মেঘ অদিতি, সিপাহী রেজা, রমজান বিন মোজাম্মেল, রোকসানা রফিক, জিনাত জাহান খান, যাহিদ সুবহান, ইন্দ্রাণী সরকার, বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্য, গোলাম মোস্তফা ডিহিদার, সেলিম রেজা, শিমুল সুলতানা হেপি ও ভোলা দেবনাথদের মতো কবির কবিতা ‘রচয়িতা’কে আরো সমৃদ্ধ করেছে। নবীনদের এ মিছিলে প্রবীণরা যুক্ত হয়ে যাত্রার গতিবেগ ও পথচলার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এছাড়াও পীযূষ রাউত, হাসান সাব্বির, গোপাল বাইন, রুদ্রশংকর, শিকদার ওয়ালি উজ্জামান, ইমেল নাঈম, মো. ওয়াহিদুজ্জামান, দেলোয়ার হোসাইন, নরেশ মন্ডল, মুনমুন দাশগুপ্ত, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, কুসুমিকা সাহা, রুদ্র গোস্বামী, প্রশান্ত সরকার, কাজরী তিথি জামান, রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ, নুরুল আলম, ফারহানা খানম, দীপিকা রায়, সুবীর সরকার, মুহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, আলী ইদ্রিস, নাজমুল হাসান, সৈকত আহমেদ বিল্লাল, লাবণ্য কান্তা, সুমন হাফিজ, উৎপলকান্তি বড়–য়া, মৈনাক মজুমদার, আলী আফজাল খান, রেজওয়ান তানিম, রেজা নুর, সৈয়দ মাসুদ রাজা, এম এস আই সাগর, বিশ্বজিৎ লায়েক, লিখন মোরশেদ, লিখন মোরশেদ, রাজেশ শর্মা, অভিজিৎ মন্ডল, বিশ্বজিৎ মন্ডল, শুভ্রনীল, হাবিব সিদ্দিকী, অনিন্দ্য তুহিন, কল্পনা মিত্র, শৈলেন দাস, আজিজ আহমেদ, পিটু রশিদ, সীমা রানী বন্দ্য, কাঙ্খিতা কায়েম সাইকি, ছবি গুপ্তা ও আরিফুল ইসলামের কবিতা নি:সন্দেহে পাঠককে আকৃষ্ট করেছে।
কবিতা ছাড়াও নব্বই দশকের তুখোড় তারুণ্যপ্রাণ নিবেদিত লেখক, গবেষক ও কথাসাহিত্যিক মুহাম্মদ ছানোয়ার হোসেনের ‘জীবন শিকল’ বই নিয়ে আরিফুল ইসলামের আলোচনা, সৈকত আহমেদ বিল্লালের ‘আমার চোখে রচয়িতা, পাঠক এবং আমি’, সুমন হাফিজের ‘শুভেচ্ছা কথন’, সালাহ উদ্দিন মাহমুদের ‘রচয়িতা: দুই বাংলার কবিদের মিলন মেলা’, জাফরুল আহসানের লিটলম্যাগ আলোচনা ‘পুরাতন পাতা’র নতুন স্বাদ’, চিন্ময় বিবেকের ‘ময়ূখ একটা আন্দোলন ক্ষেত্র’, লেখা প্রাপ্তি স্বীকার, ছোটকাগজের প্রাপ্তি স্বীকার ‘রচয়িতা’র কলেবরকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করেছে। রচয়িতার প্রতি সংখ্যার জন্য ‘লেখক সম্মাননা পদক’ সত্যিকারের প্রশংসার দাবিদার। গত সংখ্যার জন্য সাত জনকে সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়েছে। এ থেকে একটা বিষয় উপলব্ধি করতে পারি- রচয়িতা একটা ব্যাপক আন্দেলন ক্ষেত্র। আমরা ক’জনকেই সম্মাননা জানাতে পারি। রাষ্ট্রীয়ভাবেও আমরা তা যথাযথভাবে পারি না।
আমি এই প্রথম দেখলাম, লেখা প্রকাশিত না হলে তার প্রাপ্তি স্বীকার করতে। এতে লেখকরা অন্তত একটু সান্ত্বনা পেতে পারে যে আমার লেখা যথাযথ গন্তব্যে পৌঁচেছে। বিশেষ কৃতজ্ঞতা রচয়িতা সাহিত্য পরিষদের সভাপতি কবি ও শিশু সাহিত্যিক নজরুল জাহানের প্রতি। পরম মমতায় তিনি আগলে রেখেছেন সকলকে। তবে তাঁর ‘বাণী’ পাতা বিন্যাসের পরে সম্পাদকীয়র আগে স্থাপন করলে যথাযথ সম্মান দেখানো হত। সম্পাদকের কাছে বিনীত অনুরোধ রইল-পরবর্তী সংখ্যায় যেন সেটা করা হয়।
এবারও এম আসলাম লিটনের আঁকা প্রচ্ছদ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ধন্যবাদ নিপূণ প্রচ্ছদশিল্পীকে। চমৎকার বাঁধাই ও অফসেট প্রিন্ট সব দীনতা ছাড়িয়ে সাফল্যের স্বর্ণ শিখড়ে পৌঁছানোর দীপ্ত শপথের উচ্চারণকে আরো অনুরণিত করবে। এ প্রত্যাশা সকলের।
ধন্য অনুর্বর জমির অক্লান্ত পরিশ্রমী কবিতাচাষী আরিফুল ইসলাম।
জয়তু রচয়িতা, জয়তু রচয়িতা সাহিত্য পরিষদ।
কবিতার জয় হোক। ‘রচয়িতা’ দীর্ঘজীবি হোক।

কালকিনি, মাদারীপুর।
০৯.০৯.২০১৩

কপিরাইট আইন সম্পর্কে শিল্পীদের আরো সচেতন হতে হবে - মাদারীপুরে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা

:: শাহিন ফকির ::
কপিরাইট আইন ব্যবহারে কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, সুরকার, গীতিকার সবাইকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। কারণ মেধাস্বত্ব আইনটি যথাযথ প্রয়োগ হলে রাষ্ট্রের পাশাপাশি মেধাস্বত্বাধিকারীও আর্থিকভাবে খুব লাভবান হবেন বলে মন্তব্য করেন দেশের বিশিষ্ট কবি ও মেধাস্বত্ববিদ ড. মুহম্মদ নূরুল হুদা।
বুধবার সকালে মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কপিরাইট অফিসের উদ্যোগে ‘কপিরাইট সুরক্ষা ও সুফল : বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন কালে একথা বলেন।
মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. রাহেদ হোসাইনের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রেজিষ্ট্রার অব কপিরাইট অফিস, ঢাকার মনজুর মোর্শেদ চৌধুরী, প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মো. নূর-উর-রহমান।
এসময় মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সাংবাদিক ও কবি আহসান হামিদ, শাজাহান খান, কবি দুলাল সরকার, শাহানা শৈলী প্রমুখ। সেমিনারে মাদারীপুর জেলার কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, সাংবাদিক, গীতিকার, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
ছবি ও সম্পাদনা: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সম্পাদক

রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কালকিনিতে জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী পালিত

মাইনুল ইসলাম:
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কালকিনি ফ্রেন্ডস ফোরামের উদ্যোগে গত শুক্রবার সকালে কালকিনি প্রেস ক্লাবে আলোচনা সভা, আবৃত্তি ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
কালকিনি প্রেস ক্লাবের সভাপতি শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন মাহমুদের সঞ্চালনে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক আকন মোশাররফ হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন উদীচী কালকিনি শাখার সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম ও প্রেস ক্লাব সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম মিন্টু। আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন যুগান্তর প্রতিনিধি এইচ এম মিলন, কালকিনি ডটনেট সম্পাদক বিল্লাল হোসেন, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, অর্থ সম্পাদক বি এম হানিফ, কালকিনি বন্ধুসভার সভাপতি মাইনুল ইসলাম প্রমুখ।
কবির কবিতা আবৃত্তি করেন শিশুশিল্পী বি এম পৃথেল, বি এম প্রত্যয়, আবৃত্তি শিল্পী জেবা ফারিহা, জারিন তাসনিম রাইসা ও জান্নাতুল ফেরদৌস মীম। সবশেষে নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন আকন মোশাররফ হোসেন।

মাদারীপুরের পতিতাপল্লী উচ্ছেদ: তোমার আমার পাপ উচ্ছেদ করো আগে

:: সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ::
“কে বলে তোমায় বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু এ-গায়ে,/ হয়তো তোমারে স্তন্য দিয়াছে সীতাসম সতী মায়ে।’ (-বারাঙ্গনা: কাজী নজরুল ইসলাম।) বিদ্রোহী কবির মৃত্যুদিবসে মাদারীপুরের পতিতাপল্লী উচ্ছেদকল্পে পরিচালিত অমানবিক নিষ্ঠুর অভিযানের সংবাদচিত্র দেখে নজরুলের কবিতার এ দু’টি চরণ মনে এলো। মাদারীপুরের বারাঙ্গনারা বিদেশ থেকে আসেনি, আকাশ থেকেও মাটিতে পড়েনি। উনারা আমাদেরেই মা-বোন। আমাদের বাপ-ভাইরাই উনাদের গ্রাহক। উচ্ছেদ-অভিযান সম্পন্ন করার পর কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি প্রদান না করে অভিযান পরিচালনার পূর্বেই কি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা যেতো না? সরকারের কাছে আবেদন, উনাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হোক। যারা আমাদের মা-বোনদের রক্তাত করেছে, মাদারীপুরের বারাঙ্গনাদের সহায়-সম্পদ লুট করেছে- তাদের শাস্তি দেয়া হোক। মিথ্যে তো নয়। এই সত্য যে, এ আমার পাপ এ তোমার পাপ।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এ মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম কবি নির্মলেন্দু গুণ। এমন অগণিত মন্তব্যে ভরে আছে বিভিন্ন মাধ্যম। কেউ কেউ আবার মাদারীপুরের দামাল যুবকদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেছেন। দু’শ বছরের কলঙ্ককে উচ্ছেদ করতে পেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। সবই ঠিক ছিল। তবে আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে প্রায় পাঁচ শতাধিক যৌনকর্মীকে উচ্ছেদ করাটা কোন বাহাদুরি নয়। বরং মানবতার চরম পরাজয়। নারীরা সমাজ থেকে পতিত হয়ে গেলে তারা পতিতা হয়ে যায় ঠিক; কিন্তু পতিত যুবককে বা পুরুষকে কোন অভিধায় সিক্ত করা যায়? পুরুষ শাসিত সমাজে এর কোন সদুত্তর নেই। থাকবেও না।
প্রসঙ্গত বলতে হয়, সম্ভবত প্রায় দু’শ বছর আগে মাদারীপুর বন্দরে ব্যবসায়িদের অবসর কাটাতে বিনোদনের স্বার্থে স্থানীয় প্রভাবশালী জমিদারদের উদ্যোগে পুরানবাজারে নাচ-গানের আয়োজন করা হতো। নাচ-গানের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে নামকরা বাইজিদের আনা হতো। প্রতিরাতে নতুন নতুন মুখ দিয়ে জলসার ঔজ্জ্বল্য বাড়ানো হতো। বাইজিদের কেউ কেউ ধীরে ধীরে স্থায়িভাবে থাকতে শুরু করে এখানে। প্রথম দিকে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলেও আস্তে আস্তে জমি বা বাড়ি কিনে নেয় তারা। সারারাতের নাচ-গানের আড়ালে চলতে থাকে দেহব্যবসা। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে নারী। বাড়তে থাকে পুরুষের আনাগোনা। তখন দূর-দূরান্ত থেকে আগত ব্যবসায়িদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীরাও যুক্ত হতে থাকে। জলসা ঘর রূপান্তরিত হতে থাকে যৌনপল্লিতে। বিগত দু’শ বছরে বহুবার এদের উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন হয়েছে। বিভিন্ন কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
শেষবার গত ২৭ আগস্ট সকাল ১১ টায় দু’শ বছরের সেই যৌনপল্লিতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়ে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করা হয়। এঘটনার পর জীবন বাঁচাতে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছে পাঁচ শতাধিক যৌনকর্মী। ঘটনার সময় নির্বিকার থাকলেও মঙ্গলবার রাতে পুলিশ বাদি হয়ে অজ্ঞাত ২ সহ¯্রাধিক ব্যক্তির নামে সদর থানায় মামলা করেছে। দু’দিনে ঘটনার সাথে জড়িত ১৬ জনকে গ্রেফতার করার দাবিও করেছে পুলিশ। একই রাতে আটটার সময় আন্দোলন পরিচালনাকারী সংগঠন ইসলাহে কওম পরিষদ পুরান বাজারের উত্তরণ ক্লাবে জরুরী সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যৌনপল্লিতে হামলার সাথে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ইসলাহে কওম পরিষদ, মাদারীপুর বণিক সমিতি, সাধারণ ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, গত ১৯ মাস ধরে ইসলাহে কওম পরিষদ মাদারীপুরের যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে উচ্ছেদের আন্দোলন করে আসছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, ইসলাহে কওম পরিষদ যৌনপল্লির নেত্রীদের সাথে একাধিক বৈঠকও করেছেন। এমনকি নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের সাথেও কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। কিন্তু যৌনকর্মীরা তাদের অবস্থানে অনড় থাকায় ইসলাহে কওম পরিষদের নেতৃবৃন্দ কঠোর আন্দোলন ও আল্টিমেটাম দেয়। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক মো. নূর-উর-রহমান যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য শহরের গণ্যমান্য বিশজন ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। ২৭ আগস্ট বেলা ১১টায় ওই কমিটির সদস্য মাদারীপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র নুরুল আলম বাবু চৌধুরী, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান খান, বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান মিলন ভূঁইয়া, কাউন্সিলর মো. আক্তার হাওলাদার ও মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার কণাসহ কয়েকজন যৌনকর্মীদের সাথে পুর্নবাসনের ব্যপারে পরামর্শ করতে গেলে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে যৌনকর্মীরা উত্তেজিত হয়ে হামলা চালিয়ে তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এ খবর দ্রুত পুরান বাজার এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে স্থানীয় লোকজন সঙ্গে নিয়ে যৌনপল্লিতে হামলা চালায়। হামলার সময় ইসলাহে কওম পরিষদের কোন নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিল না বলে সংবাদ সম্মেলনে তারা দাবি করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইসলাহে কওম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আলী আহমেদ চৌধুরী, ইসলাহে কওম পরিষদের নেতা আলহাজ্ব বোরহান উদ্দিন খান, বণিক সমিতির সহ-সভাপতি সায়ীদ খান, সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান মিলন ভূইয়া, পৌর কাউন্সিলর মো. আক্তার হাওলাদার, আওয়ামীলীগ নেতা ইরশাদ হোসন উজ্জ্বল, যুবলীগ নেতা জাহিদুল ইসলামসহ শতাধিক ব্যবসায়ী।
তবে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে অজ্ঞাত ২ সহ¯্রাধিক ব্যক্তিকে আসামী করে একটি মামলা করেছে। গত দু’দিনে নূরে আলম, শহিদুল ইসলাম, সীমান্ত, সুজন, মিরাজ, ফারুক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, আজিজুল হক ও শাহাদাৎ কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেছেন, গ্রেফতারকৃতদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া পরবর্তীতে কোন ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্যে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
যৌনপল্লির নেত্রীবৃন্দ দাবি করেছেন, তারা দু’শ বছর ধরে মাদারীপুর যৌনপল্লিতে বসবাস করে আসছে। এখানকার অধিকাংশ সম্পত্তি তাদের। আর এ সম্পত্তি জবরদখলের জন্যই একটি স্বার্থান্বেষী মহল পায়তারা করে আসছে। গত ১৯ মাস ধরে স্থানীয় ইসলাহে কওম পরিষদ নামের একটি সংগঠন তাদের উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন শুরু করে। এবং যে কোন সময় তাদের উপর হামলা হতে পারে এ আশঙ্কায় পাঁচ শতাধিক যৌনকর্মীর জান-মালের নিরাপত্তা চেয়ে উচ্চতর আদালতে একটি রীট পিটিশন করে। আদালত গত ২২ জুলাই থেকে একবছরের জন্য তাদের নির্বিঘেœ জীবন যাপনের জন্য একটি রুল নিশি জারি করেন। যার অনুলিপি সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইজিপি, মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও মাদারীপুর সদর থানার ওসিকে দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও আকস্মিকভাবে গত ২৭ আগস্ট হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও মারপিট করে যৌনকর্মীদের বের করে দেওয়া হয়েছে। আইনত যা মারাত্মক অপরাধ। আদালতের নির্দেশকে অবমাননা করা হয়েছে। যৌনকর্মী হলেও তারা মানুষ। এবং এ দেশের নাগরিক। এদেশে তাদেরও অধিকার রয়েছে।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার খোন্দকার ফরিদুল ইসলাম বলেছেন, হাইকোর্টের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে তাই হবে। যৌনপল্লিতে হামলা, লুটপাট, উচ্ছেদ ও ভাঙচুরের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু কথা হচ্ছে- যৌনকর্মীরাতো তাদের পল্লিতে নেই। জীবন বাঁচাতে তারা পল্লি ছেড়ে চলে গেছে। উচ্চতর আদালতের নির্দেশ মতে তারা আর একবছরও থাকতে পারলো না। তার আগেই তাদের জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হলো। আন্দোলনকারীরা যৌনকর্মীদের চুলের মুঠি ধরে টেনে হেচড়ে বাইরে নিয়ে আসে। এরপর রাস্তায় ফেলে মারধর করে টাকা-পয়সা, অলঙ্কার ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ইজিবাইকে তুলে দেয়। অনেকেই আবার সবকিছু ফেলে জীবন বাঁচাতে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।
আজ আমরা আমাদের পাপ ঢাকতে উচ্ছেদ করেছি তাদের। অন্ধকারের অতল গহ্বরে ছুড়ে দিয়েছি তাদের। এখন তারা সমাজের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। সমাজ আরো বেশি কলুষিত হবে। যুব সমাজ তথা পুরুষ আরো বেশি বিপথগামী হবে। পক্ষান্তরে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের লালসা চরিতার্থ হবে। মূলত যৌনপল্লির জমি দখলের রাস্তা উন্মোচিত হলো আজ। আমি ব্যক্তিগতভাবে পতিতাবৃত্তি বন্ধের পক্ষে। তবে সেটা হতে পারতো সহমর্মিতা, ভালোবাসা ও মানবিক উপায়ে। জোর করে একটি মেয়েকে পতিতা বানানো যায়। কিন্তু জোর করে তাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা যায় না। যে পুরুষ রাতের অন্ধকারে পতিতার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়। দিনের আলোতে সে তার স্বীকৃতি দিতে চায় না বা পারে না। যারা তাদের উচ্ছেদ করেছে তারা তাদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করলো না কেন?
কবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আমিও বলতে চাই- সরকারের উচিৎ যৌনকর্মীদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ধর্মকে পুঁজি করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে ব্যবহার করে যারা যৌনকর্মীদের রক্তাক্ত করেছে, বারাঙ্গনাদের সহায়-সম্পদ লুট করেছে- তাদের শাস্তি দেয়া হোক। কারণ, ‘এ আমার পাপ এ তোমার পাপ।’

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
০১৭২৫৪৩০৭৬৩
২৮.০৮.২০১৩

সোমবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৩

সাম্যবাদী চেতনার কবি নজরুল

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
বাঙলা সাহিত্যে ধুমকেতুর ন্যায় আগমন যার। বিদ্রোহ-প্রেম-সাম্যবাদের মশাল হাতে যিনি আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নানাবিধ সমস্য-সংকটে যখন সারা বিশ্ব আলোড়িত। কাজী নজরুল ইসলামের(১৮৯৯-১৯৭৬) তখন আবির্ভাব। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে যখন মানবতা ধুলায় লুন্ঠিত তখন তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সাম্যবাদের গান। একই কন্ঠে হামদ- নাত এবং শ্যামা সংগীতের সুরের মূর্ছনায় মানব জাতিকে উপহার দিয়েছেন সাম্যবাদের মূলমন্ত্র। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসায় কবি হয়ে উঠেছেন মানবতাবাদী।

নজরুলের সাম্যবাদের প্রধান ক্ষেত্র মানুষ। কে কুলি-মজুর আর কে সাহেব? সবাই তার দৃষ্টিতে সমান। আশরাফ আর আতরাফের কোন ভেদাভেদ নেই এখানে। সবাই সৃষ্টির সেরা। সবাইকেই তিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। নজরুলের সাম্যবাদ তাঁর অন্তরের প্রেরণালব্ধ বস্তু। কবি কল্পনার রঙে রঙিন। মানবতাবোধই তার সাম্যবাদের ভিত্তি।  তিনি সকল ধর্মের উর্ধে মানবধর্মকেই উচ্চাসনে বসিয়েছেন। মানবের মাঝে তিনি স্রষ্টাকে আবিস্কার করেছেন। তাঁর সাম্যবাদ স্রষ্টাকে অস্বীকার কওে নয়। কাল মার্কসের মত তাঁর সাম্যবাদ নাস্তিক্য সাম্যবাদ নয়। তাঁর সাম্যবাদ আস্তিক্য সাম্যবাদ। অসাম্প্রদায়িক হলেও তিনি পুরোপুরি আস্তিক ছিলেন।

নজরুলের সাম্যবাদ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে। ১৯৫২ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থে মোট ১১টি কবিতা স্থান পেয়েছে। যেমন- ‘সাম্যবাদী’, ‘নারী’, ‘মানুষ’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘রাজা-প্রজা’, ‘ঈশ্বর’, ‘পাপ’, কুলি-মজুর’, ‘চোর-ডাকাত’, ‘সাম্য’ ও ‘কান্ডারী হুশিয়ার’। মূলত  ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের কবিতাগুলোতে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব রয়েছে।
তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের ‘নারী’ কবিতাটি বহুল প্রশংসিত। ‘নারী’ কবিতায় কবি নারী-পুরুষে সাম্যের বাণী উচ্চারণ করেছেন। কবি নারী-পুরুষের ভেদাভেদ অস্বীকার করেছেন। কবির ভাষায়-
“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
আর ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটি অধিক সমালোচিত। কবিতায় কবি বলেছেনÑ
“কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও-গায়ে?
হয়ত তোমায় স্তন্য দিয়াছে সীতা-সম সতী মায়ে।”
তিনি মন্দির-কাবার চেয়ে মানুষের হৃদয়কে বড় জ্ঞান করেছেন। কবি বলেছেনÑ
“এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।”

‘সাম্য’ কবিতায় কবি বলেছেন-
“হেথা স্রষ্টার ভজন আলয় এই দেহ এই মন,
হেথা মানুষের বেদনায় তার দুঃখের সিংহাসন।
সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে নামে যে কেহ ডাকে,
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যে নামে ডাকে সে মাকে।”

নজরুল মানুষের কবি। সাম্যের কবি। নজরুলের বড় পরিচয় তিনি সাম্যবাদী কবি। নজরুলের সাম্যবাদ সকল মানবের মহামিলন।
‘‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’’
কবি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। মানুষকে কখনো তিনি ঘৃণার চোখে দেখেন নি। কবি বলেছেনÑ
“বন্ধু, তোমার বুক ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হয়েছে কুলি।”

মানুষকে তিনি সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। হিন্দু- মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কারো আসল পরিচয় হতে পারে না। আসল পরিচয় হলো- আমরা সবাই মানুষ। ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায় বলেছেন-
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
এছাড়াও তার কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
‘জাতের চাইতে মানুষ সত্য
অধিক সত্য প্রাণের টান
প্রাণ ঘরে সব এক সমান।’

‘ঈশ্বর’ কবিতায় নজরুল ইসলাম ঈশ্বর অন্বেষণের ব্যাপারে বলেছেন, বনে- জঙ্গলে, পর্বত চূড়ায় ঈশ্বর অন্বেষণের কোন প্রয়োজন নেই। ঈশ্বর মানব মনেই অধিষ্ঠিত। আর শাস্ত্র অন্বেষণে না গিয়ে সত্যের সন্ধানে অগ্রসর হতে বলেছেন। ঈশ্বর মানুষের মধ্যেই বিরাজিত, তাকে বাইরে না খুঁজে নিজের মধ্যে ডুব দিতে হবে। কবি বলেছেন- “স্রষ্টারে খোঁজো - আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।”

সর্বোপরি কবি ‘সাম্য’ কবিতায় স্বপ্নের দেশ- আদর্শ দেশের করেছেন। এমন দেশ যেখানে রাজা প্রজা নেই, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। ‘সাম্যবাদী’ এ স্থানে বর্ণবৈষম্য নেই, এখানে সাদা ও কালোদের জন্য আলাদা গোরস্থান বা গির্জা নেই। এখানে কোন ধর্মের বা শাস্ত্রের ভেদ নেই, নেই কোলাহল। সেখানে পাদ্রী পুরুত মোল্লা এক পাত্রে জল খেলেও জাত যাবে না, স্রষ্টা বাতিল হবে না।
‘সাম্য’ কবিতায় কবিতায় স্রষ্টাকে মহিমাময় এবং মানুষের দেহ মনকেই তার ভজনালয় রূপে বিবেচনা করেছেনÑ
“সাড়া দেন তিনি এখানে তাঁহারে যে নামে কেহ ডাকে
যেমন ডাকিয়া সাড়া পায় শিশু যেই নামে ডাকে সে মা’কে।”

সাম্যবাদ বাঙলা সাহিত্যে নতুন কোন বিষয় নয়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম যে মমতায় মানবতা মিশ্রিত সাম্যের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন তা একান্তই অভিনব। এখানেই নজরুলের সাম্যবাদী চেতনার নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।    

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
কালকিনি, মাদারীপুর
২৩.০৮.২০১৩

রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৩

তেঁতুল রাজ্য

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

সম্মানিত সভাসদ!
নারী জাগরণ সভায় আপনাদের অভিনন্দন!
আজ আমি একক বক্তা এখানে।
অনেক মুখরোচক আলোচনা হবে।
হবে তেঁতুল বিষয়ক লালা ঝরানো ভাষণ।
ধৈর্য ধরে বসুন এবং উপলব্ধি করুন।
সভায় আসার সময় স্ত্রীকে ঘরের ভেতর রেখে
দরোজার তালা সতর্কভাবে লাগিয়েছেন কিনা?
দেশটাকে আজ আমরা তেঁতুল রাজ্যে পরিণত করেছি-
সর্বত্রই লালা ঝরানো পিচ্ছিল পথ।
বাড়ি ফেরার পথে সাবধানে পা ফেলবেন।
নয়তো হোচট খাবেন কিংবা ভাঙবে কোমড়।
তেঁতুল গাছে ধরবে তেতুল। ঝরবে শুধু লালা।
ঝরতে ঝরতে একদিন দেখবেন লালা শূন্য হবে পুরুষ।
আমার বক্তব্য সেইদিন শেষ হবে-
ততদিন এসভায় আপনাদের উদার আমন্ত্রণ!

বন্ধন

(ছোট কাকার ফোন পেয়ে পারিবারিক জটিলতা নিয়ে)
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

বন্ধন কী এতোই তুচ্ছ- এতোই শিথিল?
ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেওয়া যায়?
জীবনের খুঁটি-নাটি দুঃখবোধ হাসি-কান্না
ফেলনা কোন ময়লা নয়Ñ
ইচ্ছে করলেই ভাসিয়ে দেওয়া যায়।

বন্ধন কী রান্না শেষে চুলার ছাঁই?
ভাও বাতাসে উড়িয়ে দিলাম কুয়োর জলে।
চাওয়া-পাওয়া কিংবা হতাশা-ব্যর্থতার
হিসেব কষে বলে দেওয়া যায় লাভ
কিংবা ক্ষতির পরিমাণ।

বন্ধনে বন্ধনে অটুট করে জীবনের গতিপথ
আমাদের চলতে হবে বহুদূর।
ভালোবাসা- শ্রদ্ধা- ত্যাগের মহিমায়
টুকরো টুকরো স্মৃতির লুক্কায়িত বোধের
অন্তরালে অঙ্কুরিত হোক যাবতীয় লেনদেন।

বন্ধন কোন তুচ্ছ- শিথিল বস্তু নয়.. ..
ইচ্ছে করলেই তাকে ছুঁড়ে ফেলবে ভাঁগাড়ে।

হ্যালো, রবীন্দ্র্রনাথ!

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। অন্ধকার হাতরে খাটের কোণায় পানির বোতলের অস্তিত্ব টের পেলাম। ঢক-ঢক করে গলা ভিজিয়ে নিলাম। চোখ বন্ধ করলাম আবার।
তবু স্বপ্নটা আমার পিছু ছাড়ছে না। ফোন করলাম রবীন্দ্রনাথকে।
- হ্যালো, রবীন্দ্রনাথ!
- হ্যা বৎস! বলো।
- তুমি গুরু মরিয়া প্রমাণ করিলে তুমি মর নাই। কাদম্বিনী রোজ সকালে আমার ঘুম ভেঙে দেয়।
- ও তাই। আর...
- গোরা প্রতিনিয়ত ভর্ৎসনা করে। আমাদের নোংরা রাজনীতির জন্য তার সেকি খিস্তিখেউর।
- তুমি কি বলো?
- আমি আর কী বলবো। আহাম্মকের মতো সব শুনি। মুখ বুজে থাকি। কোন উত্তর নেই।
- তুমি আসলে কী করো?
- বছরখানেক হলো, একটা ডিগ্রী কলেজে বাংলা পড়াই।
- ভালোতো।
- কিসের ভালো? সমস্যাতো ওখানেই।
- কী সমস্যা?
- ‘হৈমন্তির এত কষ্ট কেন?’ ‘অপু কেন বাবার আচরণের প্রতিবাদ করে না?’ নানাবিধ প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের।
- তুমি কী বলো?
- তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার দোষ দেই। তা শুনে ছাত্রীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। বলে, আমরা তখন থাকলে দেখিয়ে দিতাম।
- তুমি কী বিবাহিত?
- নারে বাবা। তোমাদের মত অল্প বয়সে বিয়ে করার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। এন্ট্রান্স পড়লেই বাবা বিয়ে দেবেন। এমন ভাগ্য আমাদের নেই। সতের বছরের হৈমন্তি বয়সে দাদি-নানিকে হার মানালেও বাংরাদেশ সরকার আঠারো বছরের আগে মেয়েদের বিবাহ নিষিদ্ধ করেছে।
- সে যাই হোক। যখন যে নিয়ম। আমাদের সময় আট বছরে বিয়ের নামে ‘গৌড়ি দান’ করা হতো। বিয়ে না করতে পারো। প্রেমতো নিশ্চয়ই করো। ওটাতে তো আর বয়সের বালাই নেই।
- হা- হা- হা। তা বলতে পারো। ডজন খানেক তো হবে। জলের মতো আসে আর যায়। তবে এ ক্ষেত্রে তোমার গানগুলি বেশ সহায়ক।
- যেমন?
- কাউকে দেখলেই গেয়ে উঠি-‘আমারও পরাণও যাহা চায়’ কিংবা ‘ভালোবাসি- ভালোবাসি...’
- তাতে কাজ হয়?
- হবে না মানে। রবীন্দ্রনাথকে কে না জানে। তার গান কে না শোনে। তবে মাইন্ড করলে বলি, তোমাকে কিছু বলিনি। রবীন্দ্র সংগীত গাইছি।
- হা- হা- হা। ভালো তো। দারুণ বুদ্ধি তোমার।
- তোমার চেয়ে কমই।
- অনেক দিন পরে হাসলাম। তুমি আমাকে হাসালে।
- কেন?
- ফটিকের জন্য মন খারাপ হয়। আমার ফটিকরা কেমন আছে?
- আগের মতোই দুষ্টু। খালি ছুটির জন্য অস্থির হয়ে ওঠে।
- তা না হয় মানলাম। তুমি লেখালেখি কর নাকি?
- চেষ্টা করি। হয় কি না জানি না। তবে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে দু-চার লাইন। হাতে হাতে দিতে পারি না। ফলে পত্রিকায় পাঠাই। সম্পাদক মহাশয় সদয় হলে প্রকাশ হয়। পত্রিকার কপিটা নিয়ে ভালোবাসার মানুষটির হাতে দেই। হাতে পেয়ে বলে, ‘বাহ! চমৎকার কবিতা তো।’ কিন্তু মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। যার জন্য লিখলাম- সে বোঝল না। আর প্রেমে পড়লো কি না অন্যজন। বল, এটা মহামুশকিল না?
- চালিয়ে যাও। একদিন বুঝিবে বাছাধন। আমার ‘শেষের কবিতা’ পড় নাই?
- আরে মহাশয়! সেতো কয়েকবার পড়েছি। কিন্তু আমার বাবারও সাধ্য নাই বোঝার। না বুঝলেও শেষের কবিতাটা কয়েকবার আবৃত্তি করেছি। শ্রোতারা বড্ড হাততালি দেয়।
- তাই নাকি? তুমি আবৃত্তি করো? আমি না ভালো আবৃত্তি করতে পারতাম না। মিনমিনে কন্ঠ ছিল তো।
- হ্যা, তা ঠিক বলেছো। তোমার কন্ঠে ‘সোনার তরী’ শুনে আমি অনেক হেসেছি। কেমন কাতর-কাতর কন্ঠ। মেয়েলি-মেয়েলি ভাব।
- তুমি আমাকে অপমান করছো?
- দুঃখিত, সে স্পর্ধা আমার নেই। ক্ষমা করবেন জাহাপনা! তবে আপনার ‘হঠাৎ দেখা’, ‘বাঁশি’, ‘দেবতার গ্রাস’, ‘দুই বিঘা জমি’, ‘সোনার তরী’, ‘অপমানিত’, ও ‘রক্ত করবী’র অংশবিশেষ বহুবার আবৃত্তি করেছি। পুরস্কারও পেয়েছি।
- বাহ- বাহ! তোমরাইতো আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে। তা নাহলে কবেই পঁচে যেতাম। মিশে যেতাম মাটির সঙ্গে।
- কী বলেন? আপনি আছেন বলেইতো আমরা আছি। আজো বাংলা সাহিত্য আছে। বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে। ‘নোবেল’ পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছি আমরা।
- ও কথা আর বলো না। পেলাম একটা নোবেল। তা নিয়ে কত সমালোচনা। শেষমেষ আবার নোবেলটা চুরিও হয়ে গেল।
- দুঃখিত! অনাকাক্সিক্ষত এ ভুলের জন্য।
- না থাক, ঠিক অছে। তবে আমার একটা অনুরোধ। সাহিত্যটাকে কলুষিত হতে দিও না। বিখ্যাত হওয়ার বাসনা নিয়ে লিখতে বসো না। বরং লিখে বিখ্যাত হও। সহজ-সরল পাঠককে ঠকিও না। তোমারা লিখে যাও। তাতেই আমি বেঁচে থাকবো। বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকবে। মানুষ বেঁচে থাকবে। সর্বোপরি মানুষের জন্য কিছু করো।
‘আজি ঝরোঝরো মুখোড়ও বাদল দিনে’ গানের সুরে হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো।
ঘুম ভেঙে গেল। সাথে স্বপ্নটাও। মোবাইল স্ক্রীনে ‘অনিন্দিতা কলিং’ দেখে রাগটা সামলে নিয়ে ফোন রিসিভ করলাম। ---
- হ্যালো, রবীন্দ্রনাথ!
অনিন্দিতা বললো- পাগল নাকি? রবীন্দ্রনাথ এলো কোত্থেকে?
- ও তাইতো, তুমি অনিন্দিতা। আসলে এতক্ষণ রবীন্দ্রনাথের সাথে কথা বলছিলাম তো।
অনিন্দিতা হাসলো।
- তোমার মাথা একেবারে গ্যাছে। আমার মনে হয় কি জানো? বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবার্ষিকী। তুমি হয়তো ভাবছিলে কিছু লিখবে। কিন্তু কি লিখবে খুঁজে পাচ্ছিলে না। তাই ভাবতে- ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছো। আর অমনি ঘুমের ঘোরে রবীন্দ্রনাথকে ফোন করেছো। হা- হা- হা।
ফোন কানে ধরে আছি। অনিন্দিতার হাসির লহরী বেজে যাচ্ছে অবিরাম। আসলে রবীন্দ্রনাথ আমাকে স্বপ্ন দেখায়। রবীন্দ্রনাথ আমাকে বাঁচতে শেখায়।
তুমি কেন চলে গেলে রবীন্দ্রনাথ? আর কিছুদিন থাকতে পারলে না? কিংবা আবার কেন ফিরে আসো না!

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কালকিনি, মাদারীপুর।
০১৭২৫৪৩০৭৬৩

বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

কালকিনিতে সাহিত্য পত্রিকা ‘রচয়িতা’র মোড়ক উন্মোচন

জান্নাতুল ফেরদাউস মীম:
জেজেডি ফ্রেন্ডস ফোরাম কালকিনির উদ্যোগে গত শুক্রবার সকালে স্থানীয় প্রেসক্লাবে সাহিত্য পত্রিকা ‘রচয়িতা’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ফ্রেন্ডস ফোরামের আহ্বায়ক আকন মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে ‘রচয়িতা’র সহ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন মাহমুদের সঞ্চালনে মোড়ক উন্মোচন করেন সাংবাদিক এইচ এম মিলন। বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক বি এম হানিফ, শিক্ষিকা শামীম আরা ডলি, সহ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ও কবি-কথাসাহিত্যিক আকন মোশাররফ হোসেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন রচয়িতার কবি আলী ইদ্রিস, সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম, বিল্লাল হোসেন, নাফিজ সিদ্দিকী তপু, মেহেদী হাসান শান্ত, আবৃত্তি শিল্পী জান্নাতুল ফেরদাউস মীম, জেবা ফারিহা, নাট্যকর্মী আহসান হাবীব, দবির হোসেন, সাব্বির, উথান, রকিব ও জাবির প্রমুখ। সবশেষে উপস্থিত সকলের মাঝে ‘রচয়িতা’ বিতরণ করা হয়।
জামালপুর জেলার ইসলামপুরের রচয়িতা সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে কবি আরিফুল ইসলাম সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা ‘রচয়িতা’ গত তিন বছর যাবৎ ষান্মাসিক হিসাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় মাদারীপুরের কালকিনি বসে এর সহ-সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছেন সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। দুই বাংলার একশ’ কবির কবিতা নিয়ে জুন মাসে তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এপার বাংলা- ওপার বাংলার উল্লেখযোগ্য বইয়ের দোকানে ‘রচয়িতা’ পাওয়া যাচ্ছে।

বুধবার, ৩ জুলাই, ২০১৩

হয়নি আজো বলা


সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

বলি বলি করে একটি কথা
হয়নি আজো বলা,
চলি চলি করে একই পথে
হয়নি আজো চলা।

রোজ সকালে ডাকবাক্সে
হাতড়ে ফিরি কি একটা,
প্রাপক হয়ে আমার নামে
নেইতো সেই চিঠিটা।

যখন তোমার সামনে দাঁড়াই
ভাবছি এবার বলি,
তোমার ছাঁয়া সামনে এলেই
বলার আগেই ভুলি।

বলি বলি করে সেই কথাটা
ভুলে যাচ্ছি রোজ,
চলার পথে যে যার মতো
নেয়না কোন খোঁজ।

মাদারীপুরে ই-তথ্যসেবা কেন্দ্রের সেরা উদ্যোক্তা উম্মে কুলসুম

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
‘জনগণের দোরগোড়ায় সেবা’-স্লোগানকে সামনে রেখে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালিত একসেস টু ইনফরমেশনের(এ টু আই) আওতাধীন ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের পুরস্কৃত করা হয়। সম্প্রতি মাদারীপুরের জেলা প্রশাসন আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলার সমাপনী দিনে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এবছর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সাহেবরামপুর ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্রের উম্মে কুলসুম সেরা উদ্যোক্তা (মহিলা) হিসাবে পুরস্কার, ক্রেস্ট ও সনদপত্র লাভ করেন।
মাদারীপুর জেলার চারটি উপজেলার অন্তর্গত ৬১টি ইউনিয়ন পরিষদে তথ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তথ্যসেবা প্রদানে বিশেষ অবদান রাখায় উম্মে কুলসুম সেরা ইউ আই এস সি উদ্যোক্তা(মহিলা) হিসাবে এ পুরস্কার লাভ করেন। কুলসুম দিনমজুর বাবা মতিউর রহমান ও গৃহিনী মা কমলা বেগমের তৃতীয় সন্তান। প্রায় একবছর আগে সাহেবরামপুর ইউনিয়ন পরিষদে উদ্যোক্তা হিসাবে কাজ শুরু করেন। তিনি কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের বিএ শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। লেখাপড়ার পাশাপাশি এ কাজ করে তিনি সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন এবং জনগণের মাঝে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি জন্মনিবন্ধন, স্কাইপির মাধ্যমে যোগাযোগ, ই-মেইল ব্যবহার, অনলাইনে ভর্তি ও ইউনিয়ন ওয়েব পোর্টালসহ ইন্টারনেট সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করে থাকেন। তার এ সেবায় উপকৃত হচ্ছে এলাকার জনগণ।
উম্মে কুলসুম জানান, এখানে কাজ করে মাসে ৬-৭ হাজার টাকা আয় হয়। মাসিক খরচ বাদে ৩ হাজার টাকার মতো লাভ হয়। পড়াশুনার পাশাপাশি কাজটি করতে পেরে আমিও লাভবান হচ্ছি। স্বপ্ন আছে ভালো কিছু করার। ইন্টারনেট নিয়ে অনেক বড় কাজও করার ইচ্ছা আছে।
সাহেবরামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল আহসান সেলিম জানান, কুলসুম পরিশ্রমি মেয়ে। আমি ওকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছি। ভালো কিছু করতে চাইলে আরো সহযোগিতা করবো।

শুক্রবার, ২১ জুন, ২০১৩

তোমাকে ভালোবাসা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

তোমাকে ভালোবাসা অনেকটা খাবার টেবিলে
পাশাপাশি বসার প্রথম অনুভূতির মতো,
প্রবল বৃষ্টির মাঝে এক ছাতার তলে
পাশাপাশি হেটে যাওয়ার মতো।

শেষ বিকেলের বিলে আমি নৌকার মাঝি
তুমি তার সওয়ারি হওয়ার অভিজ্ঞতার মতো,
গাঢ় অন্ধকারে হাত ধরে হেটে যাওয়া
দু’জন দু’জনার অবলম্বনের মতো।

তোমাকে ভালোবাসা অনেকটা না বলা কথার
মাঝেও অনেক কিছু বলে ফেলার মতো,
পার্বণে-উৎসবে কাছে পাবার ব্যাকুল আগ্রহ
অথবা না পাবার মন খারাপের মতো।

তোমাকে ভালোবাসা অনেকটা ভালোবাসি
তবু বলতে না পারার কষ্টের মতো,
তবু ভালোবেসে যাওয়া কাছাকাছি এলে
দূরে গেলে মন কাঁদে তোমাকে না পেলে।

মঙ্গলবার, ১৮ জুন, ২০১৩

কালকিনিতে নজরুলের জন্মজয়ন্তী উদযাপন

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের ১১৪ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা শিল্পকলা একাডেমী। গত ১৮ জুন সন্ধ্যা ৭টায় অফিসার্স ক্লাবে এ উপলক্ষে আলোচনা সভা, কবিতা আবৃত্তি ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও শিল্পকলা একাডেমীর সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে আজিমের সভাপতিত্বে সহকারি মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লিটু চ্যাটার্জির সঞ্চালনে বক্তব্য রাখেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপিকা তাহমিনা সিদ্দিকী। নজরুলের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন শিল্পকলা একাডেমীর সদস্য ও কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক দেদারুল আলম মুরাদ। আবৃত্তি করেন শিল্পকলা একাডেমীর সদস্য ও সাহেবরামপুর কবি নজরুল ইসলাম ডিগ্রী কলেজের বাংলা প্রভাষক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। সংগীত পরিবেশন করেন ডি কে আইডিয়াল সৈয়দ আতাহার আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ জসিম উদ্দিন, শিল্পকলার সংগীত প্রশিক্ষক উমা দাস, মিলন বড়াল, শিশুশিল্পী রাফিয়া  ও সামিউন।

মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০১৩

একগুচ্ছ প্রেমের ছড়া

ইয়াকুব খান শিশির
১.
তুলতুলে গাল
ঠোট টুকটুকে লাল
পাখিঠোটা নাক তার
চন্দ্র কপাল
ঢেউ তোলা কালো কেশ
ডাগর আঁখি
মন বলে তার পানে
চেয়েই থাকি।

২.
প্রেয়সীর হাসি দেখে
কেউ যদি চমকায়
দু’চার কথা শুনে
বার বার দম খায়
কভু কি সে বুঝবে
প্রেম কি তা ছলনা
তার মত ভীতু যেন
প্রেম কভু করে না।

প্রেম যেন করে যার
ভয়হীন চিত্ত
হৃদয়ের নির্যাস
ভালবাসা বিত্ত
ত্যাগ আছে আছে যার
ধৈর্য ও বীর্য
প্রেম তারে খোঁজে তার
পেতে সাহচার্য।

৩.
ওটাকে চোখ বলা দায়
দৃষ্টি চোখের হানলে বুকের
পাজর ভেঙে যায়।

সাগরের গভীরতা কথার কথা
আছে তলদেশ
ও চোখের নাই কিনারা
মাপতে সারা
জীবন হবে শেষ

আকাশের নীল আর কত
সোভা কত কতই বা বিস্তৃত
কতইবা তার উদারতা
ওই চোখেরই মত

ও চোখে জাদু আছে মায়া আছে
আছে ভালবাসা
ও চোখে স্বপ্ন আছে আরো আছে
দুর্বাধ্য এক ভাষা।

সোমবার, ১০ জুন, ২০১৩

বাবার কাছে খোলা চিঠি

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
পরম শ্রদ্ধাভাজন পিতা,   
পৃথিবীর সবটুকু অনুভূতি দিয়ে আজ উপলব্ধি করছি তোমায়। তোমার মাঝেই আমার অস্তিত্ব। আর আমার মাঝে সুপ্ত তোমার আগামী দিনের স্বপ্ন। তুমি আমার স্বপ্নদ্রষ্টা। আর আমি তোমার স্বপ্নবিলাসী রাত। এখনো কী রাত জেগে জেগে ঝাপসা চোখে আগামীর স্বপ্ন দেখো? হাজার রঙের ছবি আঁকো মনে মনে। এখনো হয়তো বসে বসে ভাবো, ফেলে আসা অতীত। বার্ধক্যের মাঝে আজ খুঁজে ফেরো শৈশব ও যৌবনের সার্থকতা।
বাবা, আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে তুমিই ছিলে প্রধান। তুমি পরিবারের বড় সন্তান। সকলের মিয়া ভাই। তোমাকে নিয়ে হয়তো তোমার বাবারও অনেক স্বপ্ন ছিলো। আজ তুমি পেশাগত জীবনে একজন শিক্ষক। সমাজে আলো ছড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলে। অথচ তেলের অভাবে তোমার প্রদীপই ছিল নিভূ নিভূ। যৌবনে তুমি তোমার বাবাকে (আমার দাদা) হারিয়েছ। ছয় বোনকে পাত্রস্থ করাসহ তিনভাইকে মানুষ করার গুরুভার ছিলো তোমার ঘাড়ে। তুমি সফল হয়েছো। নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েও তুমি তোমার আস্থায় অবিচল ছিলে। আদর্শ আর নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হওনি কখনো।
বাবা, আমার মনে আছে- কাকারা বিবাহ করার পরপর আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে যায়। সেদিন তুমি অঝোরে কেঁদেছিলে। আমি তখন থেকে বুঝতে শিখেছি- বিচ্ছেদ মানুষকে কতটা কষ্ট দেয়। আলাদা হবার মত বা নতুন সংসার গড়ার মত তেমন কোন উপাদান তোমার হাতে ছিলো না। তবুও আলাদা সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থার মধ্য দিয়ে অনেক কষ্টে আমাদের মানুষ করেছো। আসলে মানুষের মত মানুষ হতে পেরেছি কিনা সে মাপকাঠি তোমার হাতে। ছয় ভাই-এক বোনের বিশাল সংসারের দায়িত্ব তোমার মত ছাপোষা শিক্ষকের ঘাড়ে।
বাবা, ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি- মায়ের অনেক আব্দার তুমি রক্ষা করতে পারোনি। তখন অনেক তিক্ত কথাও শুনতে হয়েছে তোমাকে। তিক্ততা রিক্ততা টানাপড়েন আর হতাশার গ্লানি নিয়েই কেটে গেছে তোমাদের সুদীর্ঘ দাম্পত্য জীবন। অনেক কষ্টে টেনে-টুনে আজো হাল ধরে আছো সংসারের। সন্তানের চাওয়াগুলো তুমি হাসিমুখে মেনে নিয়েছ। সাধ্যমত চেষ্টা করেছো সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে। তোমার মধ্যে আমি হতাশা দেখেছি তবে তোমাকে অধৈর্য হতে দেখেনি।
বাবা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করতে পারিনি। প্রকাশের কোন সুযোগ বা উপলক্ষও পাইনি। বাবা এখন তুমি আমাদের আনন্দে আনন্দিত হও। আমাদের ব্যথায় ব্যথিত হও। আমাদের আনন্দ-বেদনার সমান অংশীদার তুমি। তুমি বলতে,‘তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ আমি জানিনা, কখনো কিছু করতে পারবো কিনা। তবে যেদিন এমএ শ্রেণির ফলাফল পেয়ে তোমাকে ফোন করেছিলাম, সেদিন তুমি মহাখুশি হয়েছিলে। তোমার ছেলে ফার্স্ট ক্লাশ পেয়েছে- তুমি তা মহল্লার সবাইকে গর্বের সাথে জানিয়েছিলে। এ যেন তোমার বিশাল পাওয়া। বাবা তুমি উপজেলা শহর থেকে চার কেজি মিষ্টি কিনে বাড়ি ফিরেছিলে। আনন্দে সেদিন তোমার চোখের কোণে চিকচিক করছিল আনন্দ অশ্রু।
বাবা, বিশ্বাস করো, আমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে তোমার সব ক্লান্তি মুছে দিতে চাই। তুমি শুধু সে অবধি বেঁচে থাক। সৃষ্টিকর্তার কাছে তা-ই প্রার্থনা করি। সৃষ্টিকর্তা যেন আমাকে একটু সুযোগ দেন। আমার জীবনে জন্মদাতা তুমি, আভিভাবক তুমি, এমনকি বন্ধুও তুমি। ঘৃণা যত করেছো তার চেয়ে বেশি ভালোবেসেছো আমায়। যখন কিছু না পারার ব্যর্থতার কারণে আমাকে বকতে; তখন বড্ড রাগ হতো তোমার ওপর। কিন্তু আজ বুঝতে পারি, সন্তানের সফলতায় প্রত্যেক বাবাই গর্বিত হয়। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও।
বাবা, তুমি দীর্ঘজীবী হও। তোমার সুস্থ্যতা সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনায়Ñ
ইতি, তোমার আশির্বাদ প্রত্যাশী।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
কালকিনি, মাদারীপুর।
০৯.০৬.২০১৩

রবিবার, ২৬ মে, ২০১৩

ক্যাম্পাসের প্রিয় মুখ: শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকেই লালন করতে চান আজীবন

খায়রুল আলম:
সারাদিন কাজ নিয়ে পড়ে থাকেন। নাওয়া-খাওয়া ভুলে যান। কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। পড়াশুনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা, সাহিত্য চর্চা, নাটক ও আবৃত্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সারাক্ষণ। লিখতে বসলে ভোর হয়ে যায়। ঘুমঘুম চোখে দিনের সব কাজ সারেন। কাজ পাগল এই মানুষটির নাম সালাহ উদ্দিন মাহমুদ। অনেকের কাছে এস. মাহমুদ নামে পরিচিত। কেউ কেউ ডাকেন সালু বলে।
সংবাদ সংগ্রহ, নাটক লেখা, অভিনয় করা কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি থেকে শুরু করে সবখানেই তার বিচরণ। বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা, উপ-সম্পাদকীয় ও ছোটগল্প লিখেও বেশ পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার সবার পরিচিত জন। পড়ালেখা করছেন বাংলা সাহিত্যে। কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজ থেকে এবছর মাস্টার্সে(বাংলা) প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাই কলেজের বাংলা বিভাগ তাকে কৃতি শিক্ষার্থী হিসাবে সংবর্ধনা দিয়েছে।
সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই। বাবা জেড এম এ মাজেদ মাদ্রাসা শিক্ষক ও মা হাসনে আরা গৃহিনী বলে সঙ্গত কারণেই পড়তে হয় মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করে নিজ উদ্যোগে ভর্তি হন বাংলা সাহিত্যে অনার্স করার জন্য। কলেজে এসে যুক্ত হন প্রথম আলো বন্ধুসভার সাথে। দৈনিক দেশবাংলার মাধ্যমে শুরু করেন সাংবাদিকতা। জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অভিনয় ও আবৃত্তিতে অংশ নিয়ে বরাবরই প্রথম হতে থাকেন। ছোটগল্প প্রতিযোগিতায় ২০০৬, ২০১০ ও ২০১১ সালে ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। সম্পাদনা করেন সাহিত্য পত্রিকা ‘আলোর পথে’ ও ‘দহন’। ২০০৭ সালে ‘প্রথমা রঙ্গমঞ্চ’ নামে একটা নাটকের গ্র“প প্রতিষ্ঠা করেন। এ পর্যন্ত এক ডজনের বেশি নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ করেছেন। ২০১১ সালে বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের ‘পথনাটক নির্মাণ কর্মশালা’য় অংশগ্রহণ করেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় নাট্যোৎসবে ‘একটাই চাওয়া’ নাটকে এবং ২০১৩ সালের মে মাসে ‘স্বপ্ন ও দ্রোহের জাতীয় নাট্যোৎসবে’ কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের পরিবেশনায় নিজের লেখা ‘বৈচাপাগল’ নাটকে অভিনয় করেন। বর্তমানে অক্ষর আবৃত্তি একাডেমীর প্রশিক্ষক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কালকিনি শাখা সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও কালকিনি শিল্পকলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের অনুপ্রেরণা আর উৎসাহে এগিয়ে চলছেন তিনি। ধ্যানে-জ্ঞানে, চিন্তা-চেতনায় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকেই লালন করতে চান আজীবন।

সোমবার, ২০ মে, ২০১৩

কালকিনিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উদযাপন

জান্নাতুল ফেরদৌস মীম:
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫২ তম জন্মবার্ষিকী ও নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তীর শততম বছর উদযাপন করে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা প্রশাসন। গত সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় অফিসার্স ক্লাবে এ উপলক্ষে আলোচনা সভা, কবিতা আবৃত্তি ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফজলে আজিমের সভাপতিত্বে লিটু চ্যাটার্জি ও মাজহারুল আলমের সঞ্চালনে বক্তব্য রাখেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপিকা তাহমিনা সিদ্দিকী। বরীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন কবি দুলাল সরকার ও অধ্যাপক দেদারুল আলম মুরাদ। আবৃত্তি করেন জারিন তাসনিম রাইসা, জান্নাতুল ফেরদৌস মীম, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, লিয়াকত হোসেন লিটন ও দুলাল সরকার। সংগীত পরিবেশন করেন অধ্যক্ষ মোঃ জসিম উদ্দিন, উমা দাস, সন্ধ্যা রানী বল, বন্ধন, একা, পৃথা, মানসী, অনিন্দিতা ও নন্দিতা।