সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
(সুনীল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ছোটগল্প)
সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি চৈতী। ফজরের আজানের পর সারারাতের ক্লান্তিতে অবশ শরীরে একটু চোখ বন্ধ করেছিল। তাও আবার মায়ের চেঁচামেচিতে ভেঙ্গে গেল। ঘরের দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং শব্দে জানান দিলো- সকাল নয় টা।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসল চৈতী। সারারাতের দু:শ্চিন্তাগুলো মাথার মধ্যে পোকার মতো কিলবিল করছে। প্রচন্ড মাথাব্যথা। কিছুই আর ভাবতে পারছেনা। দু’হাত দিয়ে মাথাটা চেঁপে ধরলো। জানালা খুলে ভোরের আলো দেখতে ইচ্ছে করছেনা। জীবনের আলো যার ফুরিয়ে এসেছে। জগতের আলোতে তার কী হবে? আলোকিত অতীত আর অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্তমান তাকে দোদুল্যমান করে তুলেছে।
‘এ্যাই চৈতী, এ্যাতো ব্যালা পর্যন্ত ঘুমাস, কলেজে যাওয়া লাগবো না।’-মায়ের চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পায় সে।
কলেজ! হ্যা, সেতো কলেজেই পড়ে। একাদশ শ্রেণীতে। কলেজের প্রিয় মুখগুলো ভেসে ওঠে মনের ক্যানভাসে। ভেসে ওঠে জমজ বোন চাঁদনীর মুখ। হঠাৎ আঁৎক ওঠে। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। না, যেভাবে হোক চাঁদনীকে তার রক্ষা করতেই হবে।
স্মৃতির পথ ধরে চৈতী চলে যায় চিরচেনা এক জগতে। তখন সে বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। জমজ বলে চৈতী ও চাঁদনী একই ক্লাসে পড়ে। তখনকার আনন্দের মুহূর্তগুলো এখন কেবল বেদনা বাড়ায়। চৈতীকে চাঁদনী, চাঁদনীকে চৈতী বলে অনেকেই ভুল করতেন। এমন কি শিক্ষকরাও।
মধুময় স্মৃতির প্রসবণ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে আসে কণ্টকাকীর্ণ মোহনায়। আসতে বাধ্য হয়। একরকম সুখেই কাটছিল ওদের দিনগুলো। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে রোজ একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কোন কথা নেই। শুধু অপলকে তাকিয়ে থাকা।
একদিন একটা গোলাপ ফুল হাতে চৈতী-চাঁদনীর পথ আগলে দাঁড়ায় ছেলেটা। চৈতীরা ভীত-সন্ত্রস্ত। এদিক-সেদিক তাকায়। নির্জন রাস্তা। দৌঁড়ে পালাবার সাহসও হয়না। চিৎকার করার মনোবৃত্তি জাগেনা মান-সম্মানের ভয়ে। নিথর হয়ে নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে দু’জন। ছেলেটার মুখে স্মীত হাসি।
‘আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। চৈতীর জন্য আমার এ ক্ষুদ্র উপহার।’-বলেই ফুলটা চাঁদনীর হাতে জোর করে গুঁজে দিয়ে কম্পমান পায়ে দাঁড়ায়। চাঁদনী হেসে ওঠে।
‘ফুলটা কার? চৈতী না চাঁদনীর ?’-ছেলেটা হতবাক।
থতমত খেয়ে বলে-‘চৈতীর জন্য।’
আবার হাসে চাঁদনী। ‘আমি চাঁদনী, এটা নিশ্চয়ই আমার নয়?’
ছেলেটা এবার ভীষণ লজ্জিত হয়Ñ‘সরি, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। যারটা তাকেই দিয়ে দাও।’-বলে দ্রুত চলে যায়। একবারও পিছন ফিরে তাকায়নি।
চৈতী ও চাঁদনী খুব মজা পায়। হাসতে হাসতে পা বাড়ায় স্কুলের দিকে।
সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে , না পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। বিষয়টি নিয়ে স্যার খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছেন। কিন্তু কোন কথাই চৈতীর মাথায় ডোকে না। কারণ চৈতীর পৃথিবীই এখন বিরামহীন ঘুরছে।
চৈতীকে লক্ষ্য করে স্যার বললেন,‘ চাঁদনী তোমার কী হয়েছে?’
চৈতী এবার হেসে উঠলোÑ‘ স্যার আমি চাঁদনী নই-চৈতী।’
‘এই হলো আর কী, কি হয়েছে তোমার?’-স্যার জানতে চাইলেন।
‘না স্যার কিছু হয়নি তো।’-বাধ্যগত ছাত্রের মতো কথাটা বলল চৈতী।
‘ ঠিক আছে পড়ায় মনোযোগ দাও।’ -বলেই স্যার পুনরায় আলোচনা শুরু করলেন।
একটা উদাসীনতা ক্রমেই গ্রাস করতে থাকে চৈতীকে। ঘুরে-ফিরে একটা লাল গোলাপ আর গোবেচারা ধরণের একটা চেহারা ভেসে ওঠে মনের ক্যানভাসে। ছেলেটার প্রতি কেন যেন একটা মায়া জন্ম হয় তার। ভালো লাগতে শুরু করে।
এই ভালোলাগাই ভালোবাসার মহিরূহ আকার ধারণ করে। মধুময় হয়ে ওঠে জীবন ও যৌবন। বাবা-মার অগোচরে ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে ভাবতে কতই না ভালো লাগে।
আর ভাবতে পারেনা। শরীরটা গুলিয়ে ওঠে। বমি বমি ভাব হয়। নিজের শরীরের দিকে তাকায়। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিজেকে নিজের কাছে কেমন অচেনা লাগে। শরীরটাকে আর নিজের বলে মনে হয় না। রাতের কথা মনে পড়ে। খাবারের টেবিলে কী বিশ্রীভাবে বকলেন বাবা। বাবাতো বকবেনই। নিজের চোখে কে তার মেয়ের অধ:পতন সহ্য করবে? কিন্তু কূল-মানের আশা ছেড়ে চৈতী যার জন্য আজ পথের ভিখিরি। সেই বা কোথায়? এ পথের শেষই বা কোথায়? কেনই বা এমন হলো?
সাগরের পরিবার মেনে নেয়নি ওদের ভালোবাসা। তাই জোর করে সাগরকে বিয়ে করালো অন্য জায়গায়। চৈতীর মাথায় বাজ পড়লো। বিয়ের দেড় বছর পর ঘর আলো করে এল সন্তান। ঘর আলো করলেও সাগরের মন আলোকিত করতে পারেনি। পুরনো ভালোবাসা নাকি শরীরী টানে কাঙালের মতো ছুটে এসেছে চৈতীর কাছে।
এ কেমন খেলা? কোন আশায় বাঁধবে তারা খেলাঘর? এ কেমন পরীক্ষা? কী করবে এখন চৈতী? একটা দোদুল্যমানতা আঁকড়ে ধরে তাকে। কিন্তু মন যে মানে না। সেও কাছে পেতে চায় সাগরকে। ফিরে পেতে চায় হারানো ধন। একটি ঘর ভাঙ্গার আয়োজন চলে প্রতিনিয়ত। ভালোবাসার উন্মাদনায় মেতে ওঠে দু’টি প্রাণ। মনের টানে শরীরে শরীর ঘষে পেতে চায় মধুর উত্তাপ। দগ্ধ হতে চায় দু’জন। সে উত্তাপের আগুনেই তিলে তিলে দগ্ধ হয় চৈতী। পরকীয়ার অপবাদ নিয়ে গৃহবন্দীর মতো সময় কাটে। তিলে তিলে বিপর্যস্ত নাবিকের মতো ছেড়া পালে ভাঙ্গা নায়ে হাল ধরে বসে থাকে।
কথাটা বাবার কান অব্দি পৌঁছে যায়। তাই যাচ্ছে-তাই বলে বকলেন রাতে। দরজাটা খুলতে আর প্রবৃত্তি হয় না। এ মুখ সে কাকে দেখাবে, কীভাবে দেখাবে?
চাঁদনী কলেজে চলে গেছে। চৈতীর ওপর ঝড়ের বিধ্বস্ততা দেখে কলেজে যাওয়ার সময় ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। বাবা রীতিমতো ফার্মেসীতে। মা গৃহস্থালির টুকিটাকি নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষণে ক্ষণে চেঁচিয়ে যায়-‘চৈতী ওঠ, বের হ।’
ঝড়ের পূর্বাভাস সবাই টের পায়। আকাশে মেঘ দেখে সবাই বলে দেয় কীরকম ঝড় হতে পারে। ক্ষুব্ধ নদীতে মাঝি শক্ত হাতে হাল ধরে। উত্তাল সমুদ্রে নাবিক খোঁজে কূল। অকূল পাথারে পড়ে চৈতীও সাঁতরায়। খড়-কুটা ধরে বাঁচতে চায়।
টলতে টলতে গিয়ে বসে পড়ার টেবিলে। বইয়ের সাথে সাজানো ডায়রিটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টায়। কলমদানী থেকে একটা কলম নিয়ে পরাজীত জীবনের কিছু কথা লিখে রেখে যায় কালো অক্ষরে। ভুল আর মিথ্যা সম্পর্কের জাল ছিন্ন করতে না পারার ব্যর্থতা তাকে আর কতদূর নিয়ে যেতে পারে?
বাইরের কাজ শেষে ঘরে এসে দরজা বন্ধ দেখে থমকে দাঁড়ায় চৈতীর মা। মেয়েটার হলো কী? বেলা বয়ে যায় তবু ওঠার নাম নেই। বাবা না হয় একটু বকেছে। ভুল করলে বাবাতো বকবেই। এখনতো ভুলেরই বয়স। বাবা-মাতো শাসন করবেই। তাই বলে এতো অভিমান? এতই যদি ঘৃণা হয়- তবে কেন একটা বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম। কেন অন্যের সাজানো সংসার তছনছ করার অভিপ্রায়। একবার হারানোর পরও কেন মিথ্যে প্রণয়ে আবদ্ধ হওয়া।
দরজায় কড়া নাড়ে বারকয়েক। কোন সাড়া শব্দ নেই। এমন অঘোরে কেউ ঘুমায়? হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা হোচট খায়। দু:শ্চিন্তার রেখা অঙ্কিত হয় মুখে। জোরে জোরে ডাকে বারকয়েক। প্রতিবেশিরা কী ভাববে? মহল্লায় এমনিতেই কানাকানি। ঘরের কথা পরের মুখে বাতাসের আগে দৌঁড়ায়। তিলকে তাল বানানোর ভয়। কণ্ঠ কিছুটা ক্ষীণ হয়ে আসে। এবার সে হতাশ হয়ে পড়ে।
দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে যায় চৈতীর মা। নির্বাক চোখে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ে দু’গন্ড বেয়ে। সম্মুখে ঝুলন্ত চৈতীর শরীর। নিথর সে দেহ। চৈতীর চোখে মুখে ক্ষোভের বিচ্ছুরণ। জিহ্বাটা বের হয়ে দু’মাড়ির দাতের সাথে আটকে আছে। এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় একটি টিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন চৈতীর মা। চিৎকার আর পতনের শব্দে ছুটে আসেন পাশের বাড়ির একজন। ক্রমান্বয়ে বাড়ি ভর্তি লোকজন। আত্মীয়-স্বজন, শত্র“-মিত্র, থানা-পুলিশ, সাংবাদিক, হিতাকাক্সিক্ষ-পরশ্রীকাতর সহ সর্বস্তরের মানুষ।
চৈতী এখন একটা লাশ। সবাই ভুলে যাচ্ছে তার নাম। সবার মুখে মুখে চৈতী শব্দের পরিবর্তে লাশ শব্দটাই ব্যবহার হচ্ছে। সুরতহাল প্রতিবেদন, আলামত সংগ্রহ ও ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠানোর আয়োজন চলছে। পুলিশের হাতে একটি রোজনামচা। আলামত সংগ্রহ করতে গিয়ে যেটা পাওয়া গেছে চৈতীর টেবিলে। সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তার উপর।
পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক জায়গায় এসে সবার চোখ আটকে যায়। কোন সম্বোধন ছাড়াই শুরু হয়েছে লেখাটি
‘ লম্পট সাগর আমাকে বাঁচতে দিল না। ভালোবাসার অভিনয় করে মিথ্যা আশ্বাসে আমাকে নষ্ট করেছে। এখন আমার ছোট বোনকেও নষ্ট করবে বলে হুমকি দিচ্ছে। একথাগুলো কাউকেই বলতে পারলামনা। আমার বাবা খুব রাগী। তাকে খুব সম্মান করি। তাই তার কাছেও বলার সাহস হয়নি।
একটা মেয়ে কখন তার জীবনের মায়া ত্যাগ করে? কিন্তু আমি যে বাঁচবো, তার কোন কূল-কিনারা বা পথ খুঁজে পাই না। বাধ্য হয়ে আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম।
আব্বু-আম্মু, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও। দাদু,কাকা,চাঁদনী,আন্না,মুন্না ও স্বর্ণা তোমরা কেউ আমার জন্য কেঁদ না।
যারা আমার চিঠি পড়বেন, তাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ- আমার মতো আর কারো জীবন যেন নষ্ট না হয়। এই সব লম্পট বখাটে ছেলের শিকার যেন আর কাউকে না হতে হয়।
ইতি, চৈতী।’
(সুনীল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ছোটগল্প)
সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি চৈতী। ফজরের আজানের পর সারারাতের ক্লান্তিতে অবশ শরীরে একটু চোখ বন্ধ করেছিল। তাও আবার মায়ের চেঁচামেচিতে ভেঙ্গে গেল। ঘরের দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং শব্দে জানান দিলো- সকাল নয় টা।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসল চৈতী। সারারাতের দু:শ্চিন্তাগুলো মাথার মধ্যে পোকার মতো কিলবিল করছে। প্রচন্ড মাথাব্যথা। কিছুই আর ভাবতে পারছেনা। দু’হাত দিয়ে মাথাটা চেঁপে ধরলো। জানালা খুলে ভোরের আলো দেখতে ইচ্ছে করছেনা। জীবনের আলো যার ফুরিয়ে এসেছে। জগতের আলোতে তার কী হবে? আলোকিত অতীত আর অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্তমান তাকে দোদুল্যমান করে তুলেছে।
‘এ্যাই চৈতী, এ্যাতো ব্যালা পর্যন্ত ঘুমাস, কলেজে যাওয়া লাগবো না।’-মায়ের চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পায় সে।
কলেজ! হ্যা, সেতো কলেজেই পড়ে। একাদশ শ্রেণীতে। কলেজের প্রিয় মুখগুলো ভেসে ওঠে মনের ক্যানভাসে। ভেসে ওঠে জমজ বোন চাঁদনীর মুখ। হঠাৎ আঁৎক ওঠে। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। না, যেভাবে হোক চাঁদনীকে তার রক্ষা করতেই হবে।
স্মৃতির পথ ধরে চৈতী চলে যায় চিরচেনা এক জগতে। তখন সে বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। জমজ বলে চৈতী ও চাঁদনী একই ক্লাসে পড়ে। তখনকার আনন্দের মুহূর্তগুলো এখন কেবল বেদনা বাড়ায়। চৈতীকে চাঁদনী, চাঁদনীকে চৈতী বলে অনেকেই ভুল করতেন। এমন কি শিক্ষকরাও।
মধুময় স্মৃতির প্রসবণ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে আসে কণ্টকাকীর্ণ মোহনায়। আসতে বাধ্য হয়। একরকম সুখেই কাটছিল ওদের দিনগুলো। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে রোজ একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কোন কথা নেই। শুধু অপলকে তাকিয়ে থাকা।
একদিন একটা গোলাপ ফুল হাতে চৈতী-চাঁদনীর পথ আগলে দাঁড়ায় ছেলেটা। চৈতীরা ভীত-সন্ত্রস্ত। এদিক-সেদিক তাকায়। নির্জন রাস্তা। দৌঁড়ে পালাবার সাহসও হয়না। চিৎকার করার মনোবৃত্তি জাগেনা মান-সম্মানের ভয়ে। নিথর হয়ে নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে দু’জন। ছেলেটার মুখে স্মীত হাসি।
‘আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। চৈতীর জন্য আমার এ ক্ষুদ্র উপহার।’-বলেই ফুলটা চাঁদনীর হাতে জোর করে গুঁজে দিয়ে কম্পমান পায়ে দাঁড়ায়। চাঁদনী হেসে ওঠে।
‘ফুলটা কার? চৈতী না চাঁদনীর ?’-ছেলেটা হতবাক।
থতমত খেয়ে বলে-‘চৈতীর জন্য।’
আবার হাসে চাঁদনী। ‘আমি চাঁদনী, এটা নিশ্চয়ই আমার নয়?’
ছেলেটা এবার ভীষণ লজ্জিত হয়Ñ‘সরি, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। যারটা তাকেই দিয়ে দাও।’-বলে দ্রুত চলে যায়। একবারও পিছন ফিরে তাকায়নি।
চৈতী ও চাঁদনী খুব মজা পায়। হাসতে হাসতে পা বাড়ায় স্কুলের দিকে।
সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে , না পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। বিষয়টি নিয়ে স্যার খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছেন। কিন্তু কোন কথাই চৈতীর মাথায় ডোকে না। কারণ চৈতীর পৃথিবীই এখন বিরামহীন ঘুরছে।
চৈতীকে লক্ষ্য করে স্যার বললেন,‘ চাঁদনী তোমার কী হয়েছে?’
চৈতী এবার হেসে উঠলোÑ‘ স্যার আমি চাঁদনী নই-চৈতী।’
‘এই হলো আর কী, কি হয়েছে তোমার?’-স্যার জানতে চাইলেন।
‘না স্যার কিছু হয়নি তো।’-বাধ্যগত ছাত্রের মতো কথাটা বলল চৈতী।
‘ ঠিক আছে পড়ায় মনোযোগ দাও।’ -বলেই স্যার পুনরায় আলোচনা শুরু করলেন।
একটা উদাসীনতা ক্রমেই গ্রাস করতে থাকে চৈতীকে। ঘুরে-ফিরে একটা লাল গোলাপ আর গোবেচারা ধরণের একটা চেহারা ভেসে ওঠে মনের ক্যানভাসে। ছেলেটার প্রতি কেন যেন একটা মায়া জন্ম হয় তার। ভালো লাগতে শুরু করে।
এই ভালোলাগাই ভালোবাসার মহিরূহ আকার ধারণ করে। মধুময় হয়ে ওঠে জীবন ও যৌবন। বাবা-মার অগোচরে ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে ভাবতে কতই না ভালো লাগে।
আর ভাবতে পারেনা। শরীরটা গুলিয়ে ওঠে। বমি বমি ভাব হয়। নিজের শরীরের দিকে তাকায়। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিজেকে নিজের কাছে কেমন অচেনা লাগে। শরীরটাকে আর নিজের বলে মনে হয় না। রাতের কথা মনে পড়ে। খাবারের টেবিলে কী বিশ্রীভাবে বকলেন বাবা। বাবাতো বকবেনই। নিজের চোখে কে তার মেয়ের অধ:পতন সহ্য করবে? কিন্তু কূল-মানের আশা ছেড়ে চৈতী যার জন্য আজ পথের ভিখিরি। সেই বা কোথায়? এ পথের শেষই বা কোথায়? কেনই বা এমন হলো?
সাগরের পরিবার মেনে নেয়নি ওদের ভালোবাসা। তাই জোর করে সাগরকে বিয়ে করালো অন্য জায়গায়। চৈতীর মাথায় বাজ পড়লো। বিয়ের দেড় বছর পর ঘর আলো করে এল সন্তান। ঘর আলো করলেও সাগরের মন আলোকিত করতে পারেনি। পুরনো ভালোবাসা নাকি শরীরী টানে কাঙালের মতো ছুটে এসেছে চৈতীর কাছে।
এ কেমন খেলা? কোন আশায় বাঁধবে তারা খেলাঘর? এ কেমন পরীক্ষা? কী করবে এখন চৈতী? একটা দোদুল্যমানতা আঁকড়ে ধরে তাকে। কিন্তু মন যে মানে না। সেও কাছে পেতে চায় সাগরকে। ফিরে পেতে চায় হারানো ধন। একটি ঘর ভাঙ্গার আয়োজন চলে প্রতিনিয়ত। ভালোবাসার উন্মাদনায় মেতে ওঠে দু’টি প্রাণ। মনের টানে শরীরে শরীর ঘষে পেতে চায় মধুর উত্তাপ। দগ্ধ হতে চায় দু’জন। সে উত্তাপের আগুনেই তিলে তিলে দগ্ধ হয় চৈতী। পরকীয়ার অপবাদ নিয়ে গৃহবন্দীর মতো সময় কাটে। তিলে তিলে বিপর্যস্ত নাবিকের মতো ছেড়া পালে ভাঙ্গা নায়ে হাল ধরে বসে থাকে।
কথাটা বাবার কান অব্দি পৌঁছে যায়। তাই যাচ্ছে-তাই বলে বকলেন রাতে। দরজাটা খুলতে আর প্রবৃত্তি হয় না। এ মুখ সে কাকে দেখাবে, কীভাবে দেখাবে?
চাঁদনী কলেজে চলে গেছে। চৈতীর ওপর ঝড়ের বিধ্বস্ততা দেখে কলেজে যাওয়ার সময় ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। বাবা রীতিমতো ফার্মেসীতে। মা গৃহস্থালির টুকিটাকি নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষণে ক্ষণে চেঁচিয়ে যায়-‘চৈতী ওঠ, বের হ।’
ঝড়ের পূর্বাভাস সবাই টের পায়। আকাশে মেঘ দেখে সবাই বলে দেয় কীরকম ঝড় হতে পারে। ক্ষুব্ধ নদীতে মাঝি শক্ত হাতে হাল ধরে। উত্তাল সমুদ্রে নাবিক খোঁজে কূল। অকূল পাথারে পড়ে চৈতীও সাঁতরায়। খড়-কুটা ধরে বাঁচতে চায়।
টলতে টলতে গিয়ে বসে পড়ার টেবিলে। বইয়ের সাথে সাজানো ডায়রিটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টায়। কলমদানী থেকে একটা কলম নিয়ে পরাজীত জীবনের কিছু কথা লিখে রেখে যায় কালো অক্ষরে। ভুল আর মিথ্যা সম্পর্কের জাল ছিন্ন করতে না পারার ব্যর্থতা তাকে আর কতদূর নিয়ে যেতে পারে?
বাইরের কাজ শেষে ঘরে এসে দরজা বন্ধ দেখে থমকে দাঁড়ায় চৈতীর মা। মেয়েটার হলো কী? বেলা বয়ে যায় তবু ওঠার নাম নেই। বাবা না হয় একটু বকেছে। ভুল করলে বাবাতো বকবেই। এখনতো ভুলেরই বয়স। বাবা-মাতো শাসন করবেই। তাই বলে এতো অভিমান? এতই যদি ঘৃণা হয়- তবে কেন একটা বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম। কেন অন্যের সাজানো সংসার তছনছ করার অভিপ্রায়। একবার হারানোর পরও কেন মিথ্যে প্রণয়ে আবদ্ধ হওয়া।
দরজায় কড়া নাড়ে বারকয়েক। কোন সাড়া শব্দ নেই। এমন অঘোরে কেউ ঘুমায়? হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা হোচট খায়। দু:শ্চিন্তার রেখা অঙ্কিত হয় মুখে। জোরে জোরে ডাকে বারকয়েক। প্রতিবেশিরা কী ভাববে? মহল্লায় এমনিতেই কানাকানি। ঘরের কথা পরের মুখে বাতাসের আগে দৌঁড়ায়। তিলকে তাল বানানোর ভয়। কণ্ঠ কিছুটা ক্ষীণ হয়ে আসে। এবার সে হতাশ হয়ে পড়ে।
দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে যায় চৈতীর মা। নির্বাক চোখে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ে দু’গন্ড বেয়ে। সম্মুখে ঝুলন্ত চৈতীর শরীর। নিথর সে দেহ। চৈতীর চোখে মুখে ক্ষোভের বিচ্ছুরণ। জিহ্বাটা বের হয়ে দু’মাড়ির দাতের সাথে আটকে আছে। এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় একটি টিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন চৈতীর মা। চিৎকার আর পতনের শব্দে ছুটে আসেন পাশের বাড়ির একজন। ক্রমান্বয়ে বাড়ি ভর্তি লোকজন। আত্মীয়-স্বজন, শত্র“-মিত্র, থানা-পুলিশ, সাংবাদিক, হিতাকাক্সিক্ষ-পরশ্রীকাতর সহ সর্বস্তরের মানুষ।
চৈতী এখন একটা লাশ। সবাই ভুলে যাচ্ছে তার নাম। সবার মুখে মুখে চৈতী শব্দের পরিবর্তে লাশ শব্দটাই ব্যবহার হচ্ছে। সুরতহাল প্রতিবেদন, আলামত সংগ্রহ ও ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠানোর আয়োজন চলছে। পুলিশের হাতে একটি রোজনামচা। আলামত সংগ্রহ করতে গিয়ে যেটা পাওয়া গেছে চৈতীর টেবিলে। সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তার উপর।
পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক জায়গায় এসে সবার চোখ আটকে যায়। কোন সম্বোধন ছাড়াই শুরু হয়েছে লেখাটি
‘ লম্পট সাগর আমাকে বাঁচতে দিল না। ভালোবাসার অভিনয় করে মিথ্যা আশ্বাসে আমাকে নষ্ট করেছে। এখন আমার ছোট বোনকেও নষ্ট করবে বলে হুমকি দিচ্ছে। একথাগুলো কাউকেই বলতে পারলামনা। আমার বাবা খুব রাগী। তাকে খুব সম্মান করি। তাই তার কাছেও বলার সাহস হয়নি।
একটা মেয়ে কখন তার জীবনের মায়া ত্যাগ করে? কিন্তু আমি যে বাঁচবো, তার কোন কূল-কিনারা বা পথ খুঁজে পাই না। বাধ্য হয়ে আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম।
আব্বু-আম্মু, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও। দাদু,কাকা,চাঁদনী,আন্না,মুন্না ও স্বর্ণা তোমরা কেউ আমার জন্য কেঁদ না।
যারা আমার চিঠি পড়বেন, তাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ- আমার মতো আর কারো জীবন যেন নষ্ট না হয়। এই সব লম্পট বখাটে ছেলের শিকার যেন আর কাউকে না হতে হয়।
ইতি, চৈতী।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন