বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

আর কত প্রাণ গেলে সড়ক নিরাপদ হবে

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই একটি শিরোনাম চোখে পড়ে- ‘সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত.....ও আহত.....’। এ খবরটি আমাদের জন্য নিয়মিত হয়ে গেছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ নামে একটি আলাদা বিভাগ চালু করতে হবে। তাই জনমনে শুধু একটাই প্রশ্নÑ আর কত মায়ের বুক খালি হলে সড়ক নিরাপদ হবে? আর কত স্বজনের আর্তনাদে আকাশ ভারি হলে সড়ক নিরাপদ হবে? কেবলই জিজ্ঞাসা? উত্তর নেই। বিবেকের দরজায় কড়া নেড়েও কী এর সদুত্তর পাওয়া যাবে না?
আমাদের দেশে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে দৈনিক যে পরিমাণ প্রাণহানী ঘটে তার চেয়ে বেশি প্রাণহানী ঘটে সড়ক দূর্ঘটনায়। গতবছর মিরসরাই ট্র্যাজিডিতে বড় ধরনের একটা ধকল গেল। উজ্জ্বল আগামীর কর্ণধার কোমলমোতি শিশুরা প্রাণ হারালো। এতগুলো প্রাণ যার অবহেলায় অকালে ঝরে গেল। তার শাস্তি কী অপরাধের তুলনায় যথেষ্ট ছিল? সবাই সমস্বরে বলবেন, ছিল না। তা সামলে উঠতে না উঠতেই আবার সড়ক দুর্ঘটনায় হারাতে হল দেশের প্রথিতযশা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনিরকে। তাদের অকাল মৃত্যুতে নড়েচড়ে উঠেছিল সারাদেশ। চালকের শাস্তির দাবিতে কত আন্দোলন - সংগ্রাম হলো। কিন্তু সরকার পক্ষ নির্বিকার। অথচ সরকার পক্ষের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্তব্যক্তি চলে গেলেন চালকদের পক্ষে। মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠল। এক সময় ঝড় থেমে গেলে আবার সব স্বাভাবিকভাবেই চলছে। কোন পরিবর্তন নেই। সেই পুরণো নিয়মে প্রতিনিয়তই ঘটতে থাকলো দুর্ঘটনা।
গত ১৭ ফেব্র“য়ারি শুক্রবার সকালে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পান্তাপাড়ায় ঘটেছে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। এতে ১৮ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়। নিহতের বাড়ি ও স্বজনদের মধ্যে এখনো বিরাজ করছে শোকের ছায়া। ঐ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ি করা হয় ত্র“টিপূর্ণ বিকল্প সড়ককে। পত্রিকায় একাধিক প্রতিবেদন ছাঁপা হলো। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা ঠিকাদার। মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেও ঠিকাদারের টনক নড়াতে পারে নি জনগণ। শুধু বৃথাই স্লোগান দেওয়া-‘জনগণ সকল ক্ষতার উৎস’। মূলত বর্তমান গণতন্ত্রে সরকারি দলই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই যদি না হবে- তবে যেখানে ব্রীজ ভেঙ্গে বক্স কালভার্ট করার কথা থাকলেও দীর্ঘ দুই বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এখনো কাজ শেষ হয়নি। যার ফলে ডাইভারশন বা বিকল্প সড়কের কারণে ঝরে গেছে ১৮টি তাজা প্রাণ।
সম্প্রতি আমাদের দেশের নৌ পরিবহন মন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খান নিজেই মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট নামক স্থানে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। ভাগ্য অতি প্রসন্ন যে, শাকুরা পরিবহনের ধাক্কায় তাঁর গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নিজে রক্ষা পেয়েছেন। নৌমন্ত্রী শাজাহান খান যে চালকদের পক্ষে সাফাই গাইতেন; তাঁর দুর্ঘটনার পর সেই গাড়ির চালককে কেন আটক করা হলো। জনমনে প্রশ্ন- তিনি দুর্ঘটনায় না পড়লে কী চালককে আটক করা হতো?
গত ৫ মে শনিবার দিবাগত রাত ১টায় চাঁদপুর সদর উপজেলার বহরিয়ার ছালামত খাঁ মোড় এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের চার জন নিহত হয়েছেন। গো-খাদ্যবাহী একটি ট্রাক উল্টে রাস্তার পাশের বসত ঘরের ওপর পড়ে। এতে ঘরে থাকা পাঁচ জনের মধ্যে চার জনই মারা যায়। নিহত সেলিম শেখ,  তার স্ত্রী ফজিন্নেছা বেগম, ছেলে রাসেল শেখ ও মেয়ে শিল্পী আক্তারকে নিয়ে চার জনের এ সুখের সংসারটি মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে- রাস্তার পাশে ঘর-বাড়িও নিরাপদ নয়। ঘরে থাকলেও মৃত্যু, রাস্তায় গেলেও মৃত্যু। তাহলে আমরা যাব কোথায়? আর কত মৃত্যু...? মৃত্যুর মিছিল আর কত দীর্ঘ হবে?
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। এ আন্দোলন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। অথচ ‘আল্লার মাল আল্লায় নিয়া গেছে’- বলে স্বান্তনা দেওয়া হয়। বা ‘সড়ক দূর্ঘটনার জন্য চালক দায়ী নয়’- এমন কথাও বলা হয়। কিন্তু পিতার কাধে সন্তানের লাশ কতটা যন্ত্রণার তা কেবল ভূক্তভোগীরাই জানে। স্বান্তনাই নয় প্রত্যেককে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। সর্বস্তরে সচেতনতা প্রয়োজন। চালক হওয়ার আগে প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ । সাক্ষরজ্ঞানহীন চালক হলেও বোধশক্তি থাকা দরকার। ‘গরু-ছাগল চিনলেই তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যাবে’- বলে নির্বোধের হাতে চালিকা শক্তি দেওয়া সমীচিন নয়।
আমাদের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম সড়ক পথ। তাই দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে গাড়ীর সংখ্যা। অনুমোদন ছাড়াই ফিটনেস বিহীন গাড়ি সংখা বেড়ে যাচ্ছে। গাড়ীর সংখ্যা বাড়লেও দক্ষ চালকের সংখ্যা বাড়ে না। নছিমন, ভটভটিসহ অদ্ভুত অনেক গাড়ি প্রমাসনের নাকের ডগা দিয়ে চলাচল করে। প্রশাসন চোখ থাকতেও অন্ধ। কারণ মাস শেষে তারা অনুমোদনহীন গাড়ির মালিকদের কাছ থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। তাই এত দুর্ঘটনা।
এ পর্যন্ত আমরা হারিয়েছি অনেক তাজা প্রাণ। তার সঠিক পরিসংখ্যান করতে পারবো কি না জানি না। আর পরিসংখ্যান করেই কী হবে? আমরা কী আর ফিরে পাবো, যা হারিয়েছি এতদিন। পাবো না। শুধু বলতে পারি-অকালে ধূলিস্মাৎ হয়ে যাচ্ছে আমাদের স্বপ্ন। আকাশে-বাতাসে আজ শুধুই আর্তনাদ। রাস্তায়-রাস্তায় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের মিছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন