বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১২

ভিন্ন মতঃ মন্ত্রিসভায় রদবদল কী আসলেই ব্যর্থতার প্রমাণ?

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ:
একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক- এক মন্ত্রী গেলেন স্বর্গ দর্শণে। এ সময় ভগবান বললেন, স্বর্গের ভেতরে সংস্কার চলছে। এখন স্বর্গে যাওয়া যাবেনা। তুমি বরং দু’দিন নরক থেকে ঘুরে আস। মন্ত্রী তখন নরকে গেলেন। গিয়ে দেখলেন,বাহ ! কী চমৎকার পরিবেশ। এখানে স্বর্গের চেয়েও বেশি শান্তি। আরাম- আয়েশ। দু’দিন পর স্বর্গের সংস্কার কার্যক্রম শেষ হয়ে গেলে মন্ত্রী এবার স্বর্গে গেলেন। কিন্তু স্বর্গে গিয়ে দেখলেন, সেটাতো নরকের চেয়েও খারাপ। কোন শান্তি নেই। নেই কোন আরাম-আয়েশ। স্বর্গের দেবতারা মানুষকে শাস্তি দিচ্ছেন। মন্ত্রী এবার বিরক্ত হয়ে গেলেন। ভগবানকে বললেন, এরচেয়েতো নরকই ভালো। স্বর্গের বুঝি এই অবস্থা। ভগবান তখন বললেন, নরকে ঐ দু’দিন ছিল তোমাদের ক্যাম্পেইন। মন্ত্রী বললেন তার মানে? তার মানে, নির্বাচনের আগে তোমরা যেমন নরককেও স্বর্গ বানাও। আর ভোটে জেতার পরে স্বর্গকেও নরক বানিয়ে ছাড়ো।
গল্পটির সারমর্ম কী দাঁড়ায়। আসলে কী তাই? আমাদের মন্ত্রিরাতো মন্ত্রীত্ব পাবার আগে আমাদের জন্য অনেক কিছু করেন। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পরে কী করতে পারেন সেটাই ভেবে দেখার বিষয়। তখন যত দোষ নন্দ ঘোষের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। তাই যদি না হবে তবে মন্ত্রীসভায় রদবদল কেন? বিবেকবান মানুষের এ প্রশ্নের জবাব কী? বিরোধী দলের কথা না হয় বাদই দিলাম। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মন্ত্রিসভার রদবদল সম্পর্কে বলেছেন, ‘মন্ত্রিসভায় রদবদলই মন্ত্রিদের দুর্নীতির প্রমাণ।’ দিন বদলের স্লোগানের সাথে সাথে মন্ত্রিসভায় রদবদল করে কী হবে? তিন বছরে যা সম্ভব হয়নি; দুই বছরে তা কীভাবে সম্ভব হবে? না কি আমরা অসম্ভব বলতে কিছু নেই স্লোগান নিয়ে নেমেছি।
আমাদের ব্যর্থতার ঝুলি এত বেশি ভারী হয়ে গেছে যে এখন আর একা বহন করতে পারছিনা। তাই অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচা। দায়িত্ব নেওয়ার আগে ভাবা উচিৎ ছিল- যথা সময়ে তা পারবো কি না। যারা দায়িত্ববণ্টন করেন তাদেরও ভাবা উচিৎ ছিল সে পারবে কি না। বিজ্ঞাপনের কমপ্ল্যানতো আর আমাদের হাতে নেই। ওটা বিজ্ঞাপণের জন্যই মানানসই। আমরা মুকুটের জন্য হা-হুতাশ করি। কিন্তু একবারও ভাবিনা, সেটা রক্ষা করতে পারবো কিনা? তারপরও কাউকে না কাউকেতো দায়িত্ব নিতেই হবে।
কিন্তু মন্ত্রীদের রদবদলে ভালো কিছু আশা করছে না নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন মহল। তারা কয়েকজন মন্ত্রিদের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছিলেন। ঈদের নামাজ শহীদ মিনারে পড়েছিলেন। তারা হতাশ হয়েছিলেন। গোপনে গোপনে সমালোচনা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও। কোন কোন এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। তারা কী ব্যর্থতাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন না কি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টাকে অভিনন্দিত করেছিলেন। যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে সরিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী করায় আমরা লাভবান হয়েছি নিশ্চয়ই। তার বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি, সড়ক ব্যবস্থার বেহাল দশা, ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু তা কি প্রমাণিত হয়েছে? দেশ-বিদেশে সৈয়দ আবুল হোসেন ও আওয়ামীলীগ সরকারের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। যারা তাকে ভোট দিয়ে সাংসদ বানিয়েছে, ব্যর্থতার কালিমা কি তাদের গায়ে লাগেনি? কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের চল্লিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে বিশ্বব্যংক আমার বিরুদ্ধে অহেতুক অসত্য অভিযোগের তীর তুড়েছে । কিন্তু দুদকের তদন্তে সকল অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করেছে, অসত্য অভিযোগ তুলেছে, তারা সবাই একদিন আমার সততা ও স্বচ্ছতার কাছে লজ্জিত হবে।
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন ফারুক খান। তাই তাকে বাণিজ্য মন্ত্রী থেকে সরিয়ে করা হয়েছে বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী। প্রশ্ন থেকে যায়, এখানে এসে আবার বিমানের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে গেলে সর্বনাশ। জিএম কাদের বিমানের ওঠা-নামা দেখতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এসে আবার বাজার দরের ওঠা-নামা দেখতে অস্বস্তি বোধ করবেন কিনা? ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব এখন সৈয়দ আবুল হোসেন ও ইয়াফেস ওসমানের কাঁধে। দেখুন নরকটাকে এবার একটু ডিজিটাল করা যায় কিনা? মাফ করবেন, শোনা গিয়েছিল - প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে আসার পর এরচেয়ে বড় চমক না কি রয়েছে সামনে। সামনে কপি নয় পুরনো ফাইলটা এবার ডিলেট করে দিয়ে নাকি নতুন ফাইল পেস্ট করা হবে। এখনো তা হয়নি। তবে সে তালিকায় যারা রয়েছেন। সময় থাকতে সাবধান। নয়তো নিজে ডুববেন, দলকে ডোবাবেন। সর্বোপরি স্বর্গের সোনার বাংলা নরকে পরিণত হবে। আশা করা যায় যে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদেরের মত মন্ত্রী থাকতে এমন আশঙ্কা করা সঙ্গত নয়। তবু কথা আছে না- চুন খেয়ে মুখ পোড়লে দধি দেখেও ভয় পায়। সুরঞ্জিত আপনি এবার কালো বিড়ালটাকে খুঁজে বের করুন। কারণ ‘শুঁটকির হাটের বিড়াল চৌকিদার’কে তাড়ানোর এখনি উপযুক্ত সময়। ওবায়দুল কাদের ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতার কাটতে চান। কিন্তু ঢেউয়ের জন্য বর্ষাকালের অপেক্ষায় থাকতে হবে। শীতকালেতো নদী শান্ত থাকে। একবার চেষ্টা করে দেখুন শান্ত নদীতেই এবার ঢেউ তুলতে পারেন কি না? আপনিতো চ্যালেঞ্জকেই বেশি ভালোবাসেন। চ্যালেঞ্জ করেও লাভ হলো না। তার এপিএসের গাড়িতে টাকার কেলেঙ্কারিতে পদত্যাগ করলেন। এখন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হয়েছেন। এতকিছুর পরও ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই বলছেন,‘মন্ত্রিসভার রদবদলে কিছু লাভ নেই। প্রধানমন্ত্রী ভুল পথে হাটছেন।’ 
শেষ করার পূর্ব মুহূর্তে আরেকটা গল্প মনে পড়ে গেল- বাবা আর ছেলে বাজারে যাচ্ছে আটা বিক্রি করতে। কিছুদূর যাওয়ার পর ছেলে আব্দার করেছে বাবার কাছে- বাবা আটার বস্তাটা আমার মাথায় দাও। বাবা বললেন, এত বড় বোঝা তুমি বইতে পারবেনা। কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা। অবশেষে বাবা বাধ্য হয়ে ছেলের মাথায় বস্তাটা চেপে ধরলেন। ছেলে বস্তাটা মাথায় নিয়ে ঠিক চলতে পারছিল না। হেলে-দুলে পড়ে যাচ্ছে। বাবা তখন বস্তার মুঠোটা নিজের হাতে ধরে রেখে ওজনের চাপটা কমিয়ে দিলেন। কিছুদূর গিয়ে ছেলে বলল, তোমার বোঝা তুমিই বহন করো। ছেলের মুখের দিকে বাবা তাকিয়ে দেখলেন ব্যর্থতার লজ্জা। বাবার মুখে তখন সন্তুষ্টির হাসি।
দেখা যাচ্ছে মন্ত্রীদের মুখেও ব্যর্থতার লজ্জা। কিন্তু আসল ব্যাপারটি দেখার পালা এখন। বাবারা কিভাবে সফল হবেন? জানিনা, তবে এবারও আমরা পূর্বের মত আশ্বাস পেয়েছি। কিন্তু আর আশ্বাসে বিশ্বাসী নই। কাজ দেখতে চাই। ভালো কথার চেয়ে ভালো কাজ দেখতে চাই। সফলতার হাসি দেখতে চাই। শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। নয়তো এ ব্যর্থতার দায়ভার সরকারকেই বহন করতে হবে। তবে একটা অনুরোধ স্বর্গটাকে আর নরক বানাবেন না। যদি পারেন তবে এই নরকটাকেই স্বর্গ বানিয়ে দিন না। আমরা স্বস্তি পাবো। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী যে পথে হাটছেন সেটাই যেন সঠিক পথ হয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ প্রথম গল্পটি গত ৬ ডিসেম্বর ২০১১ রাতে টিভি চ্যানেল জি বাংলার মিরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার-৬ এর গেস্ট পারফর্মার বাংলাদেশের মেয়ে ফারজানা সগির শশীর পরিবেশনা থেকে সংগৃহিত।
লেখকঃ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ,
সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন